আওয়ামী লীগের স্বার্থে এক বুদ্ধিজীবীর অবস্থান বদল
বাংলাদেশি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. রওনক জাহান যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক দশক শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছেন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই গবেষকের বেশ কিছু গবেষণামূলক নিবন্ধ ও গ্রন্থের মূল বিষয় ছিল বাংলাদেশের রাজনীতি ও সুশাসন, যার অন্যতম শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল। তিনি তার Bangladesh Politics: Problems and Issues বইতে বাংলাদেশের বিভিন্ন নেতা ও দলীয় সরকারের শাসনকাল সম্পর্কে বেশ নির্মোহ বিশ্লেষণ করেছেন।
কর্মজীবন জুড়ে ড. জাহানের নিরপেক্ষতা নিয়ে কখনো কোন প্রশ্ন তোলার অবকাশ ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি তিনি ও তার স্বামী প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. রেহমান সোবহান, শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্যদের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগপন্থী প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন পরিচালিত একটি সাময়িকীতে একটি নিবন্ধ লিখেন। আর এই নিবন্ধে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতি বিশ্লেষণে তার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ করে দিয়েছেন।
সিআরআই পরিচালিত White Board সাময়িকীর প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত তার Mujib’s economic policies and their relevance today (শেখ মুজিবের অর্থনৈতিক নীতি ও আজকের দিনে তার প্রাসঙ্গিকতা) নিবন্ধে শেখ মুজিবুর রহমানের সাড়ে তিন বছরের শাসনকালের বিভিন্ন অর্থনীতি বিষয়ক সিদ্ধান্ত ও সেগুলোর প্রভাব কতটা ইতিবাচক ছিল, তা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই নিবন্ধে উপস্থাপিত ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ শেখ মুজিবের শাসনকাল নিয়ে ড. রওনক জাহানের বইয়ের (Bangladesh Politics: Problems and Issues) বিশ্লেষণের সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক।
অর্থনীতি পুনরুজ্জীবনের আষাঢ়ে গল্প
শেখ মুজিবের অর্থনৈতিক নীতির ওপর আলোকপাত করে রওনক জাহান তার নিবন্ধে লিখেছেন, “অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সরকার শিল্প-কারখানাগুলো জাতীয়করণ করে। পরে সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন এসব শিল্প-কারখানার অধিকাংশ প্রধান নির্বাহী অনেক কম বেতনে কাজ করে দেশের শিল্পখাতকে স্বাধীনতা পূর্ব সময়ের কার্যক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে লাভজনক করে তুলতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন।’’
অথচ এই রওনক জাহান তার Bangladesh Politics: Problems and Issue বইটির বর্ধিত সংস্করণের ১৬৭ পৃষ্ঠায় সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ভাষ্য তুলে ধরেছিলেন। তিনি লিখেছেন, “[মুজিবের] শাসনকালে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির অবস্থা ছিল হতাশাজনক।’’ তিনি যোগ করেন, “এই সরকার তার অর্থনৈতিক উৎপাদন ১৯৬৯-৭০ সাল বা স্বাধীনতা পূর্বের মাত্রায় ফিরিয়ে আনতে যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল, তা থেকে ক্রমেই পিছিয়ে পড়েছিল। উৎপাদন ও বাণিজ্য, দুটোর পরিমাণই ১৯৬৯-৭০ অর্থবছরের তুলনায় ছিল অনেক কম।”
বইয়ের ১২০ পৃষ্ঠায় তিনি এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত তুলে ধরেন। “১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে চাল উৎপাদন, ১৯৬৯-৭০ এর তুলনায় ১৫% কম ছিল। শিল্পখাতে ১৯৬৯-৭০ সময়কালের সাধারণ উৎপাদনের তুলনায় ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে উৎপাদন ছিল ৩০% কম। পাটশিল্পের উৎপাদন ১৯৬০-৭০ অর্থবছরের তুলনায় ২৮% কম ছিল। এছাড়া ধারণা করা হয়, ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে রপ্তানির পরিমাণ ১৯৬৯-৭০ এর তুলনায় ৩০% কম ছিল।’’
এর সঙ্গে আরও কিছু তথ্য বিবেচনা করলেই প্রমাণ হয়, রওনক জাহানের “শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির পুরুজ্জীবনের” দাবি কতটা ভিত্তিহীন। কেউ যদি মুজিবের শাসনামলে বাংলাদেশের পাটশিল্পের ক্ষতির পরিমাণের দিকে দৃষ্টি দেন, তাহলে সহজেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। বাংলাদেশের এক সময়ের লাভজনক পাটশিল্প শেখ মুজিবের শাসনামলে, যথাক্রমে ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে ৩০ দশমিক ৫১ কোটি, ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে ১৪ দশমিক ৪৪ কোটি এবং ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে ৩০ দশমিক ৫১ কোটি টাকা ক্ষতির শিকার হয়।
গবেষক ড. রওনক নিজেই তার বইতে মন্তব্য করেছেন, “সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন এই সব শিল্প-কারখানায় উৎপাদনের এই দুরাবস্থার জন্য দুর্নীতিবাজ এবং অদক্ষ প্রশাসন দায়ী।’’
দক্ষ প্রশাসক নাকি রাজনৈতিক অনুগতদের ক্ষমতায়ন?
এরপর আসা যাক, উৎপাদনখাতে প্রশাসক নিয়োগ বিষয়ে ড. রওনক জাহানের বিশ্লেষণে। শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দীক সম্পাদিত White Board সাময়িকীতে প্রকাশিত নিবন্ধে ড. রওনক জাহানের দাবি প্রসঙ্গে। তিনি দাবি করেন, শেখ মুজিবের সময়ের পরিকল্পনা কমিশন, জাতীয়করণের পরপর মুজিবকে দেশের শিল্প-কারখানাগুলোতে দক্ষ প্রশাসক নিয়োগ ও পেশাজীবীদের সেগুলোর দায়িত্ব দিতে পরামর্শ দিয়েছিল এবং শেখ মুজিব তাই করেছিলেন। এখানে উল্লেখ্য, তৎকালীন পরিকল্পনা কমিশনের অন্যতম সদস্য ছিলেন ড. রেহমান সোবহান।
নিবন্ধে ড. জাহান লিখেছেন, “শেখ মুজিব তাদের [পরিকল্পনা কমিশনের] এই পরামর্শ সানন্দে গ্রহণ করেছিলেন এবং বেশ কয়েকজন শীর্ষ পেশাজীবীকে দেশের বিভিন্ন শিল্প-কারখানা, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও পরিবহন খাতের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও পরিচালক পদে নিয়োগ দেন।’’
কিন্তু তার Bangladesh Politics: Problems and Issues বইয়ের ১৬৭ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, “দলীয় নেতা-কর্মীদেরকে আনুগত্যের পুরষ্কার হিসেবে বাংলাদেশের জাতীয়করণ হওয়া খাতগুলোর প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এসব নেতা-কর্মীর মাঝে বিতরণ করা হয়েছিল দেশে নতুন শিল্প-কারখানা তৈরির লাইসেন্স।’’
একই বইয়ের ১৪৯ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, “বীজ, সার, পানির পাম্প ইত্যাদি সব সম্পদের উপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল [আওয়ামী লীগ] সরকারের। সংসদ সদস্যরা তাদের দলীয় ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে প্রতিটি জেলায় সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা সম্পদ কুক্ষিগত করে। তারা নিজ নিজ জেলায় সম্পদ ও লাইসেন্স বন্টনের দায়িত্ব নিয়ে নেয়।’’
শব্দবহুল যত সুপারিশ
সাম্প্রতিক নিবন্ধে শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকালের বিভিন্ন অর্থনৈতিক নীতির কথিত “প্রাসঙ্গিকতা” তুলে ধরে ড. রওনক জাহান এবং তার সহ-লেখক ড. রেহমান সোবহান বেশ কিছু সুপারিশ করেছেন। যদিও ড. জাহান নিজেই তার বইতে এসব নীতির সমালোচনা করেছেন।
তাদের প্রধান সুপারিশগুলোর একটি হচ্ছে সমবায়-ভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এই মুজিবীয় উদ্যোগটিকে ড. জাহান বর্তমান সময়ের জন্য বেশ প্রাসঙ্গিক বলে মনে করছেন। অথচ বইয়ে তিনি লিখেছেন, এই উদ্যোগটি অতীতে ব্যর্থ হয়েছিল। কারণ “গ্রামের মধ্যম আয়ের কৃষকেরা এই সমবায়ের ধারণা একদমই নিতে পারেনি। তারা এরকম সমবায়ে অংশ নেয়া থেকে বিরত থেকেছে।’’ প্রায় পঞ্চাশ বছর পর, বিতর্কিত নির্বাচনে ক্ষমতা ধরে রাখা শেখ হাসিনার মতো একজন নেতার নির্দেশে কৃষকেরা দলে দলে সমবায়ী হয়ে উঠবে, এই ধারণা ড. রওনক ও তার সহলেখক কেন পোষণ করেন, তা ব্যাখ্যা করা দুরূহ।
হাস্যকর হলেও সত্য, ড. সোবহান এবং ড. রওনক শেখ মুজিবের অর্থনৈতিক নীতিকে “সাম্যবাদী” আখ্যা দিয়েছেন। সেই অর্থনৈতিক নীতি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশে “সুশাসন ও আইনের শাসন ফিরে আসবে এবং সবার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে বলে স্বপ্ন দেখছেন। বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তাদের এই আশাবাদ এক ধরনের কষ্ট কল্পনা ছাড়া আর কিছুই না।
সত্য হচ্ছে, শেখ মুজিবের অর্থনৈতিক নীতিগুলো চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছিল। রওনক জাহানের নিজের ভাষাতেই যদি বলি, “[মুজিবের] শাসনকালের অর্থনৈতিক পদক্ষেপগুলো প্রতিটি স্তরে একাধিক মধ্যস্বত্ত্বভোগীর জন্ম দেয় এবং বিভিন্ন পণ্যের পরিবেশকের লাইসেন্স একাধিকবার বিক্রি হয়। ফলে দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বী হয়ে যায়।’’
এই সুপারিশগুলো বাদে নিবন্ধের বাকি সুপারিশগুলো অধিকাংশই বুলি সর্বস্ব এবং প্রায় অবাস্তব। ড. রওনক জাহানের উচিৎ নিজের পুরনো বিশ্লেষণগুলো আবার পড়া এবং স্বীকার করে নেয়া যে শেখ মুজিবের কোন অর্থনৈতিক নীতিই বাংলাদেশে এখন আর প্রাসঙ্গিক না।●
একেএম ওয়াহিদুজ্জামান, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক।