শুধু গুণ্ডারাই এরকম কাজ করে!
এখন আমি যেখানে আছি, ঠিক সেখান থেকেই আমাকে তুলে নেয়া হয়েছিল। এটা ছিল ২০১৮ সালের ৫ আগস্ট। তখন ছিল গভীর রাত। আমাকে হাতকড়া পড়িয়ে, চোখ বেঁধে, টেনে-হিঁচড়ে বের করে নেয়া হয়। কোথায় নিচ্ছে, কেন নিচ্ছে এ বিষয়ে আমাকে কিছুই জানানো হয়নি। আমার বাসার সব সিসি টিভি ক্যামেরায় কাগজ লাগিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। ভিডিও সংরক্ষিত হয় যে হার্ড-ডিস্কে, তা নিয়ে নেয় তারা। আমার নিজের আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলার কোন সুযোগ ছিল না। ধরে নিয়ে যাবার সময় ধস্তাধস্তি আর আমার চিৎকারের শব্দ না শুনলে আমার পরিবার ও আশেপাশের পরিচিতরা টেরও পেত না যে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
আমি যে দৃশ্যের বর্ণনা দিলাম, তা কি কোন রাষ্ট্রের কাজে নিয়োজিত সংস্থা দ্বারা সংঘটন সম্ভব? এই আচরণের সঙ্গে গুণ্ডা বা ডাকাতের আচরণের পার্থক্য কী?
আমাকে তুলে নেয়ার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকলেও এর কোন দায় গ্রহণ বা এ সম্পর্কে জানাশোনা থাকার কথা অস্বীকার করেছে পুলিশ। পুলিশ পরে অভিযোগ বা জিডি গ্রহণেও অস্বীকৃতি জানায়। অথচ আইন অনুযায়ী তারা এটা কোনভাবেই করতে পারে না। এমনকি আমাকে কোথায় নেয়া হয়েছে, তাও আমার পরিবারকে জানান হয়নি।
আমাকে কোথায় রাখা হয়েছে, সেটা আমার পরিবারের লোকজন অন্যভাবে জানতে পারে এবং সেখানে গিয়ে সারারাত তারা সেই স্থান ঘিরে অবস্থান করে। সেই রাতে তাদের উপস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক চাপের ফলেই হয়ত আমি জীবিত ফিরে এসেছি। আমাকে যখন আদালতে নেয়া হয়, তখন বিচারক আমার পরিবারের উদ্দেশ্যে বলেন, “আপনাদের ভাগ্য ভালো যে ওনাকে গুম করে ফেলা হয়নি”।
বাংলাদেশে এখন যেসব মানুষ হারিয়ে যায় বা গুম হয়ে যায় — হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচের মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, তারা সাধারণত ভিন্নমত পোষণকারী, বিরোধী দলের কর্মী বা স্বাধীনভাবে নিজের মত প্রকাশকারী ব্যক্তি। অথচ এগুলো সবই বাংলাদেশে একজন মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু এই অধিকারের চর্চার ফল হচ্ছে এখন ক্রস ফায়ারের শিকার হওয়া বা গুম হয়ে যাওয়া।
গত ৩০ আগস্ট ছিল গুম বিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস (ইন্টারন্যাশনাল ডে অফ দ্যা ভিকটিমস অফ এনফোর্সড ডিসএ্যাপিয়ারেন্সেস)। এদিন ‘মায়ের ডাক’ সংগঠনের আহ্বানে জাতীয় প্রেসক্লাবে সমাগত হয় গুমের শিকার বিভিন্ন পরিবার। আমিও সেখানে ছিলাম।
সরকারের মূল দায়বদ্ধতা দেশের জনগণের কাছে। সরকার টম ল্যানটস্ হিউম্যান রাইটস্ কমিশনের একটি ভারচুয়াল ব্রিফিংয়ের উত্তরে একটি চিঠি দিয়েছে। কিন্তু এই পরিবারগুলোর প্রশ্নের কোন জবাব কেন সরকার দিচ্ছে না? এই সমাবেশের কথা সবাই জানত। উপস্থিত বিভিন্ন গুম হওয়া ব্যক্তির মা, বোন এবং সন্তানেরা নিজেদের প্রিয়জনকে হারাবার কষ্টে অঝোরে কেঁদেছে। দেশের সাধারণ মানুষ এরা। ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হয়ে এসব মানুষ নিজেদের সরকারের কাছে সাহায্য চাইছে। সরকার কেন তাদের কথা শুনবে না? সমাজের সব স্তরের মানুষ ছিল সেই সমাবেশে। যদি গুমের সঙ্গে সরকারের কোন সম্পর্ক না-ই থেকে থাকে, তবে তাদের জন্য কি স্বাভাবিক হতো না, এই নাগরিকদের প্রয়োজনে সাড়া দেয়া, তাদের পাশে দাঁড়ানো?
কেন একটি গুমের ঘটনাও তদন্ত হলো না? সরকারের চিঠিতে [গুমকারীদের] আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পরিচয় ব্যবহার করা হচ্ছে বলে বলা হয়েছে। সেই সমাবেশে অনেকে তাদের বক্তব্যে বলেছে, তারা স্বচক্ষে র্যাবের পোশাকে এবং র্যাবের গাড়িতে করে তাদের আপনজনদের তুলে নিয়ে যাওয়া দেখেছে। যদি সরকারি বাহিনীর পরিচয়ে এত ব্যাপকভাবে এসব ঘটনা ঘটতে পারে, তবে সরকারের অবস্থান বা বিশ্বাসযোগ্যতা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? সশস্ত্র এবং আনুষ্ঠানিক সিল লাগানো গাড়ি বহরে করে ইউনিফর্ম পরা ব্যক্তিরা আসে এবং মানুষকে উঠিয়ে নিয়ে যায়! যে সরকারের অধীনে এমন ঘটনা ঘটে, তার উপর কিভাবে আস্থা রাখা সম্ভব?
ফেসবুকে লেখার জন্য দুর্গম কোন গ্রামের এক কিশোরকে যে পুলিশ গ্রেপ্তার করে ফেলতে পারে, তারা মানুষকে গুম করে বেড়ানো সশস্ত্র গাড়িবহর বিষয়ে কিছুই জানে না! এটা কী আসলে কারো বিশ্বাস করার কথা? যদি একথা সত্য হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে সেই নিরাপত্তা বাহিনীর পরিচয়ধারীদের খোঁজে সারাদেশে অভিযান হবার কথা। কিন্তু এর বদলে আমরা দেখছি, বিষয়টা সম্পূর্ণ অস্বীকার করার প্রক্রিয়া। ল্যানটস্ কমিশনের কাছে বাংলাদেশ সরকারের চিঠি আরও একবার দায় অস্বীকারের ঘটনা। যদি কোন মিথ্যা বারবার বলা যায়, তাহলে মানুষ সেটা বিশ্বাস করতে শুরু করবে; সরকারের আচরণের পেছনের চিন্তাটা যেন এমনই। কিন্তু যেসব পরিবার এই নির্মমতার শিকার ও সাক্ষী, তারা তো এই মিথ্যা বিশ্বাস করবে না। কারণ তারা জানে কী ঘটেছে। সমগ্র জাতি এর সাক্ষী হয়ে থাকবে। যদি সরকার নিজেদের যেমন দাবি করে তেমনটা হতো, তবে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন দেবার সৎসাহস তাদের থাকত। তারা জনগণের মুখোমুখি হতো। তারা মানুষের সত্যিকারের আহাজারির জবাব দিত।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে বিভিন্ন অর্থহীন প্রতিশ্রুতি দিয়ে, নিজের দেশের জনগণকে অবজ্ঞা করা কোন বৈধ সরকারের আচরণ হতে পারে না। তবে আমাদের সরকার আদৌ বৈধ কিনা সেটাই হলো প্রশ্ন।●
শহিদুল আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত আলোকচিত্রশিল্পী, লেখক এবং এ্যাকটিভিস্ট।
লগত ৩১ আগস্ট টম লন্টাস হিউম্যান রাইটস্ কমিশনের সঙ্গে কথা বলেন শহিদুল আলম। লেখাটি সেই বক্তব্যের সামান্য সম্পাদিত রূপ। সেই সেশনের ভিডিও দেখা যাবে এখানে।