সরকারি নেতাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপে যুক্তরাজ্যের কাছে আবেদন
আন্তর্জাতিক আইনজীবীদের একটি দল বাংলাদেশ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য যুক্তরাজ্য (ইউকে) সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি আবেদন দাখিল করেছেন। যুক্তরাজ্যের ফরেন, কমনওয়েলথ এ্যান্ড ডেভলপমেন্ট অফিস (এফসিডিও) বরাবর এই আবেদন পাঠানো হয়েছে। এতে বাংলাদেশ সরকারের ছয় জন উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবিশেষ এবং ৱ্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাবের নয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সুপারিশ করা হয়।
গ্লোবাল হিউম্যান রাইটস্ স্যাংশন রেগুলেশনের (২০২০) অধীনে এ আবেদন করা হয়। এ আইনের মাধ্যমে যুক্তরাজ্য সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের সন্দেহে/অভিযোগে বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে। এসব নিষেধাজ্ঞার মধ্যে রয়েছে সম্পদ বাজেয়াপ্ত কিংবা ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার মতো বিষয়। সুনির্দিষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত বিশ্বের যে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের উপর ইউকে সরকার এ নিষেধাজ্ঞা আরোপের এখতিয়ার রাখে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের এ তালিকায় আছে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা।
যুক্তরাজ্যে অবস্থিত লিগাল চেম্বার গারনিকা-৩৭ এই আবেদন করেছে। গারনিকা-৩৭ মূলত আন্তর্জাতিক অপরাধ ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে থাকে। বাংলাদেশের কারও বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে যুক্তরাজ্য সরকারের কাছে এটাই তাদের প্রথম আনুষ্ঠানিক আবেদন।
তবে গারনিকা-৩৭ তাদের আবেদনের অনুলিপি বা কাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা চাওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে এখনো বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেনি। কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছে যে আবেদনপত্রে গোপনীয় তথ্য রয়েছে। এসব তথ্যের উৎসের গোপনীয়তা রক্ষায় গারনিকা-৩৭ বিস্তারিত প্রকাশে অপারগ। ধারনা করা হচ্ছে, এই আইনজীবী দলের সুপারিশ করা নামের তালিকায় আওয়ামী লীগ সরকারের জ্যেষ্ঠ সদস্যরা আছেন।
গারনিকা-৩৭ চেম্বারের যৌথ প্রধান টোবি ক্যাডম্যান নেত্র নিউজকে জানান, তাদের আবেদন “কোন রাজনৈতিক দলের সাহায্য বা সমর্থন নিয়ে করা হয়নি। এটি সম্পূর্ণ প্রো-বোনো (অব্যবসায়িক) মনোভাব থেকে করা হয়েছে।’’ ক্যাডম্যান বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতে ইসলামীর আইনি প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশে পরিচিত। সিরিয়া সরকারের মানবতা বিরোধী অপরাধের জবাবদিহিতার দাবি তুলে আন্তর্জাতিক বিশ্বে পরিচিত হয়ে উঠেছেন ক্যাডম্যান।
গারনিকা-৩৭ এর পক্ষ থেকে প্রকাশিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ২০১৫ থেকে ৱ্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন “৪৪০টির বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যা করেছে’’ । সেই সঙ্গে সংস্থাটি “মারাত্মক ধরণের মানবাধিকার লঙ্ঘনের কাজে জড়িত, যা নিয়মিতভাবে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী এবং অন্যান্য বিরোধী মত পোষণকারীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়েছে।’’
বিজ্ঞপ্তিতে আরও উল্লেখ করা হয়, “যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তারা সবাই গত পাঁচ বছর ৱ্যাবের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনে মারাত্মকভাবে জড়িত বিভিন্ন ইউনিটের নেতৃত্ব দিয়েছেন বা ৱ্যাব ব্যাটেলিয়ন পরিচালনার ক্ষমতাধারী পদে ছিলেন। […] তারা এই মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধে বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে কোন বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত বা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন সে নজিরও নেই।’’
বাংলাদেশ সরকারের যে ছয় জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সুপারিশ করা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ভিত্তি কী, তা নিয়েও সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি। তবে ২০২০ সালের গ্লোবাল হিউম্যান রাইটস্ স্যাংশন রেগুলেশন আইনটির অধীনে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা সম্ভব। এ আইনে বলা আছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের “ব্যবস্থাকারী, প্ররোচনা প্রদানকারী, উৎসাহদাতা ও সহযোগিতাকারী” ব্যক্তি বা এমন ব্যক্তিরা “যারা এ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্ত বা বিচারকার্যের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন কিন্তু উদ্দেশ্যমূলক ভাবে বা অবহেলা করে সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন”, তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যেতে পারে।
গারনিকা-৩৭ আরও উল্লেখ করে, গত কয়েক বছরে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। অথচ র্যাবের নেতৃস্থানীয় কর্মকর্তারা “শাস্তির বদলে পদন্নোতি পেয়েছেন”। এক্ষেত্রে র্যাবের প্রাক্তন মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদকে ২০২০ সালে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হিসেবে পদোন্নতি দেওয়ার কথা উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
যুক্তরাজ্য এ আইন প্রয়োগ করে এ পর্যন্ত চীন, মায়ানমার, সৌদি আরব ও রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের ৭২ ব্যক্তির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। যুক্তরাজ্যের মতো যুক্তরাষ্ট্রেরও একই রকম একটি আইন আছে। এই আইনের নাম গ্লোবাল ম্যাগনিটস্কি হিউম্যান রাইটস্ এ্যাকাউন্টিবিলিটি এ্যাক্ট।
এই লেখা প্রকাশের আগে যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাদিয়া মুনা তাসনিমের কাছে এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়। তবে তার কাছ থেকে কোন জবাব পাওয়া যায়নি।
গারনিকা-৩৭ এর আবেদন মূল্যায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে এফসিডিওর কাছে জানতে চাওয়া হলেও কোন উত্তর পাওয়া যায়নি।●