যে উপায়ে গুম বন্ধ হতে পারে
উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও নিরাপত্তা সংস্থার হর্তাকর্তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞাই পারে বাংলাদেশে গুম বন্ধ করতে।
বাংলাদেশে গুমের কারণে সরকারের ভাবমূর্তি যে ক্ষতির শিকার হচ্ছে, এ ক্ষতিটা সরকার কেন হজম করছে? এর কারণ নিশ্চয়ই এই যে সরকার মনে করে, গুমের মাধ্যমে যে অর্জন হচ্ছে, তার বিনিময়ে ভাবমূর্তির এ ক্ষতি মেনে নেয়াই যায়! গুমের বিরুদ্ধে সারাদেশে ক্ষোভ বিরাজ করলেও তা মূলত দমিত অবস্থায় আছে। তবে দেশে এ ক্ষোভ দমিত অবস্থায় থাকলেও গুমের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কণ্ঠস্বর সুউচ্চ এবং প্রকাশ্য। তারপরও গুম বন্ধে এ সমালোচনা বা চাপ যে যথেষ্ট নয়, সেটাও স্পষ্ট। বাংলাদেশে গুমের কাজটা করে আইনশৃঙ্খলা-রক্ষাকারী বাহিনী। ফলে এদের দিয়ে গুম বন্ধ করা সম্ভব না। এ চর্চা বন্ধের ক্ষমতা আছে শুধুমাত্র বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ের রাজনীতিবিদদের হাতেই।
সাক্ষ্যপ্রমাণ বলে, বড় ধরনের গুমের ঘটনাগুলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশেই হয়ে থাকে — যেমন হুম্মাম কাদের চৌধুরীর গুম। তাকে ডিজিএফআই (ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স) তুলে নিয়ে গিয়েছিল।
এ ধরনের বড় গুম বাদে অন্যান্য গুমের নির্দেশ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনীগুলোর নেতৃত্বাধীন ব্যক্তি ও কমান্ডার অর্থাৎ ডিজিএফআই, র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ান এবং পুলিশের (বিশেষত পুলিশের ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ বা ডিবি) কাছ থেকে আসার কথা। কিন্তু এসব গুমেরও বেশিরভাগই রাজনৈতিকভাবে হুকুম প্রাপ্ত। যেমন ধরা যাক ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময়কার কথা। এ সময় দুই সপ্তাহের মধ্যে ২১ জন বিরোধী দলীয় কর্মীকে ঢাকা এবং সংলগ্ন এলাকা থেকে তুলে নিয়ে যায় বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী — মূলত র্যাব এবং ডিবি। এরপর সাত বছর পেরিয়ে গেলেও সেই ২১ জনের মধ্যে ১৮ জন এখনো নিখোঁজ। কোন সুস্পষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক অনুমোদন ছাড়া এই গুমগুলো কিভাবে ঘটতে পারে, তা কল্পনা করা মুশকিল।
তবে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ এবং বাহিনীগুলোর নিজস্ব উদ্যোগেও গুমের ঘটনা ঘটছে। যেমন, শহিদ উদ্দিন খানের ঘটনা। ইউকেতে বসবাসরত ব্যবসায়ী এবং অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা শহিদ উদ্দিন খান যখন প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং তার প্রাক্তন ব্যবসায়িক অংশীদার মেজর জেনারেল (অব:) তারিক সিদ্দিকের প্রতিহিংসার মুখে পড়েন, তখন ফল হিসেবে গুমের শিকার হন শহিদ উদ্দিন খানের কর্মচারী ও পরিবারের সদস্যরা। এই গুমগুলোর পেছনে কোন রাষ্ট্রীয়/সরকারি প্রয়োজনীয়তা ছিল না, বরং অতি ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক ব্যক্তির নিজস্ব স্বার্থ জড়িত ছিল।
গুমের ঘটনায় রাষ্ট্র জড়িত থাকার অনস্বীকার্য সব প্রমাণের জবাবে সরকার কেবল অভিযোগগুলো অস্বীকার করে গিয়েছে। সেই সঙ্গে উদ্ভট ও অতি সহজে খণ্ডনযোগ্য নানা দাবি করেছে। সরকারের এসব যুক্তি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে প্রকাশ পেয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, দ্য ডিপলোম্যাটে শেখ হাসিনার ছেলে ও উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের প্রকাশিত একটি লেখা। আরও সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের টম ল্যানটস হিউম্যান রাইটস্ কমিশনের কাছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত (যুক্তরাষ্ট্র) শহিদুল ইসলামের লিখিত একটি চিঠিতেও সরকারের সেসব যুক্তি ও দাবি প্রকাশ পায়। এই চিঠিতে দাবি করা হয়:
— “দেশে ঘটিত যেকোন মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয় খতিয়ে দেখতে বদ্ধপরিকর” বাংলাদেশ সরকার।
— “আমরা [গুমের] বিষয়টি যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দেখেছি।”
— “অনেক ক্ষেত্রেই ‘ধারনাকৃত’ [গুমের] ভুক্তভোগী ব্যক্তিকে পরবর্তীতে পাওয়া গিয়েছে। [ফলে] প্রমাণিত হয় যে তথাকথিত ‘গুমের’ অভিযোগ মিথ্যা ছিল।”
— “দেখা গিয়েছে যে ‘গুম’ হওয়া অনেকেই আসলে বিভিন্ন নৃশংস অপরাধের বিচার থেকে বাঁচতে আত্মগোপনে ছিল।”
— “দুষ্কৃতিকারীরা বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, যেমন র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) নাম ব্যবহার করে ও ছদ্মবেশ ধারণ করে এসব ‘অপহরণ’ করে থাকে”। সরকার এসব ঘটনার জন্য দায়ী নয়।
— এছাড়াও সরকার “বিচারবহিৰ্ভূত হত্যার অভিযোগ ছিল” এমন বিভিন্ন ঘটনা “খতিয়ে দেখেছে” এবং “প্রায় কোন অভিযোগেরই সত্যতা পায়নি।”
— এছাড়া পুলিশও “বিচারবহিৰ্ভূত হত্যা ও গুমের বিভিন্ন অভিযোগ তদন্ত করে দেখেছে। তারা সরকারের জড়িত থাকার কোন প্রমাণ পায়নি।”
— “যদিও বাংলাদেশ নিখোঁজের প্রতিটি অভিযোগই গুরুত্বের সঙ্গে নেয় এবং তদন্ত করে, তথাপি ব্যবস্থাপনা ও আইনি দিক বিবেচনা করলে [হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচের প্রতিবেদনে] বেনামি অভিযোগ [সরকার] বিশ্বাস করতে পারে না।”
অথচ বাস্তবতা হচ্ছে:
প্রথমত, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ কখনোই গুম নিয়ে কোন যথাযথ তদন্ত করে না। অবশ্য এতে খুব অবাক হবারও কিছু নেই। যেহেতু তারাই গুম করে এবং তদন্ত করলে তাদের নিজেদের বিরুদ্ধেই তদন্ত করতে হবে, তাই তদন্ত না করাটাই স্বাভাবিক। খুব বিরল কোন ক্ষেত্রে যদি কোন তদন্ত হয়ও, তবে তা শুধু মাত্র লোক দেখান; আসল ঘটনার সুরাহা করতে হয় না। কোন তদন্তই যখন হয় না, তখন তদন্ত করে “সরকারের জড়িত থাকার কোন প্রমাণ পায়নি” এই দাবি করাটা উপহাস মাত্র।
দ্বিতীয়ত, যারা গুম হয়েছে তাদের বেশির ভাগের বিরুদ্ধেই কোন ফৌজদারি অভিযোগ/মামলা নেই। তাহলে কেন তারা আত্মগোপন করবে?
তৃতীয়ত, এত মানুষকে যদি আসলেই অপরাধীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেজে ধরে নিয়ে থাকে, তবে সত্যিকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সংগঠিত ও যৌথ ভাবে এসব গুমের তদন্ত করে না কেন? এবং কেন এসব ছদ্মবেশী অপরাধীদের ধরেনা, যারা সরকারি বাহিনী সেজে অপহরণ করে বেড়াচ্ছে?
চতুর্থত, একথা সত্য যে অনেকেই নিখোঁজ হবার পর আবার ফিরে আসে। কিন্তু এর কারণ এই না যে তাদের কখনো ধরে নেয়া হয়নি। বরং তাদের নিয়ে যাবার পর কয়েক সপ্তাহ বা মাস আটকে রেখে তারপর গোপন বন্দিখানা থেকে ছেড়ে দেয়া হয়। ছেড়ে দেয়া ব্যক্তিকে সাধারণত সঙ্গে সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাদের যখন ছেড়ে দেয়া হয়, তারা ভয়ে প্রকাশ্যে তাদের অভিজ্ঞতা নিয়ে আর কিছু বলে না। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে কথা বললে তাদের অভিজ্ঞতা জানা যায়।
কী ঘটলে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো গুম করা বন্ধ করবে — বা যাদের এখনো আটকে রেখেছে তাদের ছেড়ে দেবে? হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচের গবেষণা অনুসারে, গুমের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে এখনো ৮৬ জন নিখোঁজ।
দেশের অভ্যন্তরের কোন চাপে গুম বন্ধ বা গুমের শিকার ব্যক্তিদের ছেড়ে দেয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। এছাড়া অনানুষ্ঠানিক ভাবে কোন কূটনৈতিক চাপ দেয়া হলেও সেটাও যে কোন কাজে লাগেনি, তা স্পষ্ট।
তবে আরেকটি পদ্ধতি প্রয়োগ করা হলে সরকার গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য হতে পারে। সেটা হলো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও জড়িত সরকারি কর্মকর্তাদের উপর ভ্রমণ ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বা স্যাংশন।
যুক্তরাজ্যের এখন একটি নতুন আইন রয়েছে যার মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িতদের বিরুদ্ধে এ ধরনের ভ্রমণ ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করা সম্ভব। যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক আইনজীবীদের একটি দল সম্প্রতি দেশটির ফরেন, কমনওয়েলথ এ্যান্ড ডেভলপমেন্ট অফিস বরাবর একটি আবেদন করেছে, যেখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক ব্যক্তি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা চাওয়া হয়েছে। এর মাঝে শেখ হাসিনার নাম রয়েছে বলে ধারনা করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রেও অনেক আগে থেকেই অনুরূপ আইন রয়েছে। নেত্র নিউজ জানতে পরেছে যে একই রকম একটি আবেদন যুক্তরাষ্ট্রেও করা হয়েছে, তবে তার বিস্তারিত তথ্য গোপন রাখা হয়েছে। এছাড়াও, অক্টোবর ২০২০ এ কংগ্রেসের একটি দ্বিদলীয় কমিটি র্যাব কমান্ডারদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছে।
সম্প্রতি সংবাদপত্রে আরও একটি নতুন গুমের খবর প্রকাশিত হয়েছে। আগস্টের শুরুর দিকে মিশরের আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বাংলাদেশী ছাত্র রিজওয়ান হাসান রাকিন দেশে ফিরলে ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তাকে তুলে নেয়া হয়। একমাস যাবত তিনি নিখোঁজ রয়েছেন।
গোপন স্থানে আটকে রাখা ব্যক্তিদের মুক্তি দিতে এবং গুম বন্ধ করতে বাংলাদেশ সরকারকে বাধ্য করতে সম্ভবত আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞাই এখন একমাত্র উপায়। সংশ্লিষ্ট রাজনীতিবিদ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্মকর্তাদের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেই হয়ত শেষ পর্যন্ত সরকার বাধ্য হবে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে।●
ডেভিড বার্গম্যান, (@TheDavidBergman), ব্রিটেন-ভিত্তিক সাংবাদিক — নেত্র নিউজের ইংরেজি বিভাগের সম্পাদক।