আওয়ামী লীগের ধাঁধা: জনপ্রিয়, কিন্তু নির্বাচন চাই না!
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু দলটি ক্রমাগত স্বৈরাচারী হয়ে ওঠা সত্ত্বেও ২০১৪ সাল থেকে বিভিন্ন জরিপে দেখা গিয়েছে, দেশে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বজায় আছে।
তবে জনপ্রিয়তা নির্ধারণের এই মাপকাঠি নিয়ে আপত্তি রয়েছে সরকারের সমালোচকদের। দেশে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনপ্রিয়তা থাকার ধারনাকে তারা প্রত্যাখ্যান করবেন। দেশে চলমান ভয়াবহ রাজনৈতিক দমন-নিপীড়ন, বিরোধী মত পোষণকারীদের স্তব্ধ করে দেয়া এবং দুর্নীতি কথা উল্লেখ করতে চাইবেন তারা। এই প্রতিটি দাবিই সত্য এবং অনস্বীকার্য। সরকার সমালোচকেরা বলবেন, এসব করে আওয়ামী লীগ তার জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা — সরকার সমালোচকরা বলবেন — স্বাভাবিক, ন্যায্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন বন্ধ করতে আওয়ামী লীগের আপ্রাণ চেষ্টাই প্রমাণ করে যে দেশে তাদের কোনো জনপ্রিয়তা নেই।
কিন্তু বিভিন্ন জরিপে বার বার আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনপ্রিয়তার সপক্ষে তথ্য এসেছে। সম্প্রতি এমন আরও একটি জরিপ প্রকাশিত হয়েছে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট ফর গভর্নেন্স এ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (বিআইজিডি) পরিচালিত এই জরিপে আবারো আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনপ্রিয়তা দেখা গিয়েছে।
“স্টেইট অফ গভার্নেন্স ইন বাংলাদেশ ২০২০-২০২১: গাভার্নিং কোভিড-১৯ ইন বাংলাদেশ — রিয়ালিটিস এ্যান্ড রিফলেকশন্স টু বিল্ড ফরওয়ার্ড বেটার” (২০২০-২০২১ সালে বাংলাদেশে শাসনকার্যের পরিস্থিতি: বাংলাদেশে কোভিড-১৯ ব্যবস্থাপনা — উন্নত ভবিষ্যৎ নির্মাণের নিরিখে বাস্তবতা ও চিন্তা) নামক এই জরিপেও আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তার প্রমাণ মিলেছে। দেখা গিয়েছে, জরিপে অংশগ্রহণকারীর ৩ হাজার ৮৫৬ জনের মাঝে ৭০% মনে করছে বাংলাদেশ সামাজিক ক্ষেত্রে সঠিক পথে চলছে। ৬৪% মনে করে অর্থনৈতিক এবং ৫৪% মনে করে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সঠিক পথে রয়েছে।
করোনা মহামারি বিষয়ে জরিপে দেখা গিয়েছে ৯০% মনে করে, সরকারের পদক্ষেপ কার্যকরী (৩৬%) বা কিছুটা কার্যকরী ছিল (৫৪%)।
৮২% অংশগ্রহণকারী আরও মনে করে যে করোনা মোকাবেলায় সরকারের ভূমিকা “অন্য অনেক দেশের তুলনায় বেশি কার্যকরী ছিল।”
বিশেষত লকডাউনের সময় সরকারি ত্রাণ বিতরণ উদ্যোগ “মোটামুটি ঠিক ছিল” বলে মনে করে ৬৫% অংশগ্রহণকারী।
যদিও জরিপের কিছু ফলাফল সেভাবে সরকারের পক্ষে যায়নি — যেমন, ৪০% মনে করে, করোনা আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা সরকারি হিসাবের তুলনায় বেশি বা অনেক বেশি। আর ৫৪% মনে করে “সরকার তথ্য গোপন করে” — তারপরও প্রাপ্ত সংখ্যাগুলো সরকারের জন্য তেমন একটা খারাপ না।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, “ফলাফলগুলো নির্দেশ করছে যে বাংলাদেশ সরকার মহামারি চলাকালীন জনসাধারণের ব্যাপক ও উল্লেখযোগ্য আস্থা অর্জন করতে পেয়েছে। মহামারি মোকাবেলায় সরকারের ভূমিকাতেও মানুষের আস্থা ছিল।”
তবে যারা আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি মানুষের সমর্থন নেই বলে মনে করেন, তারা এরকম জরিপের যথার্থতা নিয়েও সন্দিহান। তাদের যুক্তি, সত্যি বলতে ভয় পায়, এতে সে বিপদ হতে পারে মনে করে। এই জরিপ থেকেই বলা যায় যে ২৭% অংশগ্রহণকারী দেশের রাজনৈতিক গতিপথ কোনদিকে সে প্রশ্নের উত্তরে “জানি না” বলেছে। অতীতের জরিপেও অনেক প্রশ্নে “জানি না” উত্তর অনেক বেশি ছিল। এতেই বুঝা যায়, জরিপে অংশগ্রহণকারীরা সত্যতার সঙ্গে উত্তর দিতে ইতস্তত বোধ করছে।
এর ফলে জরিপ বিষয়ে প্রশ্ন বা সন্দেহ তৈরি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু জরিপে অংশগ্রহণকারীরা যখন বেনামে উত্তর দিচ্ছেন তখন এই সন্দেহকে অমূলক বলা যায়। যদি আসলেই সত্য উত্তর দিতে ভীতি থাকত, তবে ৫৪% উত্তরদাতা কীভাবে বলতে পারল যে সরকার “তথ্য গোপন করে”? যদি এত অধিক সংখ্যক মানুষ (অর্ধেকের বেশি) এই উত্তর দিতে পারেন, তবে অন্যান্য প্রশ্নের ক্ষেত্রেও তাদের সরকারের সমালোচনা করতে বাধা কোথায়?
কিন্তু দেশের রাজনৈতিক অর্থনীতির যে বিশ্লেষণ বিআইজিডি দিয়েছে জরিপের প্রতিবেদনে, তা বিবেচনায় নিলে সরকার সমালোচকদের হয়তো আওয়ামী লীগের জনসমর্থন দেখে বিস্মিত হওয়া উচিত না। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেহেতু আওয়ামী লীগকে কেউই বৈধভাবে নির্বাচিত সরকার বলে মনে করে না, তাই আওয়ামী লীগ চেষ্টা করছে অন্য উপায়ে বৈধতা অর্জন করতে। সেই বৈধতা অর্জনের মূল উপায় হিসেবে তারা বেছে নিয়েছে উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, এই লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যমে “সরকার এমন পর্যায়ের জনসমর্থন অর্জনে সমর্থ হয়েছে যা এর গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা খর্ব করার ইতিহাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।”
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই নীতির ফলেই সরকার দেশে দরিদ্র মানুষদের জন্য যথাযথভাবে অর্থায়িত ত্রাণের ব্যবস্থা না করেই লকডাউন প্রত্যাহার করেছে। যদিও এসময় করোনার প্রকোপ বাড়ছিল। প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, “সরকার চাচ্ছিল, প্রবৃদ্ধির যেন দীর্ঘ সময়ের জন্য ব্যাহত না হয়। সরকারের রাজনৈতিক বৈধতার বিশেষ ও স্বতন্ত্র উৎসটি রক্ষার জন্য এই পদক্ষেপ ছিল অপরিহার্য। এই রাজনৈতিক বৈধতা নির্ভর করছে দেশে জোরালো প্রবৃদ্ধির নায়ক হিসেবে সরকারের সুনাম রক্ষার উপর। তাদের প্রয়োজন ছিল প্রবৃদ্ধির পতন রোধ করা যেন শাসকের রাজনৈতিক বৈধতার মূল উৎসটা অন্তত টিকে থাকে।”
প্রতিবেদনে অনুযায়ী করোনা ব্যবস্থাপনায় সরকারের ভূমিকা নিয়ে জনগণের পেতে লকডাউন আগেভাগে তুলে নেওয়াটা সরকারের জন্য জরুরি ছিল।
আওয়ামী লীগের পক্ষে বিস্ময়কর জনসমর্থনের পিছনে আরও কারণ নিশ্চয়ই থাকতে পারে, বিশেষত এর স্বৈরাচারী শাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন কারণ। এর মধ্যে রয়েছে গণমাধ্যমের উপর আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ, বিরোধী দলকে নির্যাতন ও দমনের মাধ্যমে সম্পূর্ণ পঙ্গু করে দেয়া। এছাড়া দেশে রাজনৈতিক হানাহানির অনুপস্থিতি — যাকে স্বৈরশাসনের একটি ভালো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বলে ধরা হয় — সাধারণ মানুষের জীবনে কিছুটা স্থিতিশীলতা এনে দিয়েছে।
জরিপে আওয়ামী লীগের প্রতি সাধারণ সমর্থন দেখা গেলেও প্রতিবেদনের লেখকরা করোনা মোকাবেলায় সরকারের বেশকিছু মারাত্মক ব্যর্থতা চিহ্নিত করেছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “কোভিড-১৯ উদ্ভূত দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকারের দুর্বল নেতৃত্ব ও সমন্বয়হীনতা প্রকট ছিল। একই সঙ্গে স্বজনপ্রীতি ও আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতার অপব্যবহারও ছিল লক্ষণীয়”। প্রতিবেদন লেখকরা এই পরিস্থিতিকে “অকার্যকর” একটি ব্যবস্থা বলে উল্লেখ করেছেন।
জনমত ও বিশেষজ্ঞ বিশ্লেষণের মাঝে কতখানি ব্যবধান থাকতে পারে তারই একটি দৃষ্টান্ত এই প্রতিবেদন।
এই নিবন্ধের শিরনামে যে স্ববিরোধী পরিস্থিতি বা ধাঁধার কথা বলা হয়েছে, তার উত্তর কী? যে কারণে জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও — অন্তত এসব জরিপ অনুযায়ী — আওয়ামী লীগ এ পর্যন্ত সুষ্ঠু নির্বাচন হতে দেয়নি এবং সম্ভবত ভবিষ্যতেও কখনো সুষ্ঠু নির্বাচন দেবে না, তা হলো, দলটি মানুষকে স্বাধীনভাবে ভোটের সুযোগ দিয়ে হারার ঝুঁকি নিতে চায় না। গণমাধ্যম এবং বিরোধী দল মুক্তভাবে কাজ করতে পারলে দলটির পক্ষে কতখানি এ জনসমর্থন ধরে রাখা সম্ভব হতো তা নিয়ে আওয়ামী লীগ উদ্বিগ্ন। কাজেই ইউকে সরকারের কাছে সুষ্ঠু ও ন্যায্য নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের সাম্প্রতিক প্রতিশ্রুতিকে খুব বেশি ভরসা করা ঠিক হবে না। যদি জোর করেই নির্বাচনে জেতা যায়, তবে হারার ঝুঁকি নিয়ে লাভ কী?●
ডেভিড বার্গম্যান, (@TheDavidBergman), ব্রিটেন-ভিত্তিক সাংবাদিক — নেত্র নিউজের ইংরেজি বিভাগের সম্পাদক।