সমালোচনা বন্ধের আওয়ামী লীগ স্টাইল: পরিবার জিম্মি
বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা ভগ্ন ও অকেজো হয়ে আছে দীর্ঘকাল। দুর্নীতি, অসততা, রাজনৈতিক প্রভাবে আচ্ছন্ন এই বিচার ব্যবস্থা দোষীর চেয়ে বেশি নির্দোষ ব্যক্তিদেরই যে কারাগারে নিক্ষেপ করে, তা প্রায় নিশ্চিত।
এসবের সঙ্গে সরকার এখন বিচার ব্যবস্থাকে ব্যবহার করছে “মুক্তিপণ আদায়” স্টাইলে মানুষ জিম্মি করার কাজেও — সম্প্রতি কনক সারোয়ারের বোনকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় সেটাই দেখা গেল। আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচক যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত সাংবাদিক কনক সারোয়ারের বোনকে “ষড়যন্ত্রমূলক অপপ্রচার কার্যক্রমের” অভিযোগে সম্প্রতি গ্রেপ্তার করা হয়।
সারোয়ার সেই ২০১৫ থেকেই সরকারের চক্ষুশূল। ওই বছর তিনি ইটিভিতে কর্মরত অবস্থায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন। লন্ডন থেকে বিএনপি নেতা তারেক রহমানের বক্তৃতা ইটিভিতে প্রচারের পর ইটিভির মালিক ও সারোয়ারকে গ্রেপ্তার করা হয়। বেশ কয়েক মাস তিনি আটক ছিলেন। জামিনে মুক্তির পর তিনি দেশ ত্যাগ করেন এবং তারপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বাস করছেন।
কনক সারোয়ার ২০১৮ সালে একটি ইউটিউব চ্যানেল শুরু করেন (বর্তমানে যার নাম কনক সারোয়ার নিউজ)। সেখানে তিনি বিভিন্ন বিরোধী দলের রাজনীতিবিদ ও আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচকদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেন। দেশের ভিতরে হালকা সমালোচনার বাইরে কিছু সহ্য করে না সরকার। নির্ধারিত সীমার বাইরে সমালোচনা করলেই জেল-জুলুমের ভয়। এ অবস্থায় দেশের বাইরে থেকে ফেইসবুক ও ইউটিউবে সরকারের সমালোচনামূলক ভিডিওগুলো ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এরই অংশ হিসেবে তুমুল জনপ্রিয়তা পান সারোয়ার। কনক সারোয়ার ২০২০ এর জুনে সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলের সাক্ষাৎকার প্রচার করেন। তাতে সেই সেনা কর্মকর্তা তৎকালীন সেনাপ্রধানের তীব্র সমালোচনা করেন। এর ফলে সেই জেনারেলকে পরে আত্মগোপনও করতে হয়।
সরকার সারোয়ারকে থামানোর চেষ্টা করেছে এর আগেও। ২০২০ এর শুরুর দিকে সারোয়ারের ইউটিউব চ্যানেলের বিরুদ্ধে মিথ্যা কপিরাইট অভিযোগ দিয়ে তা বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। সরকারের পক্ষ থেকেই এ চেষ্টা করা হয়েছে বলে মনে করা হয়। সম্প্রতি হাইকোর্ট সরকারকে সারোয়ারের ফেইসবুক ও ইউটিউব চ্যানেল বন্ধ করে দিতে নির্দেশ দেয়। হাইকোর্টের এই নির্দেশও খুব সম্ভবত সরকারের ইন্ধনেই করা হয়েছে। কিন্তু সরকারের কোন কৌশলই কাজে দেয়নি। যেহেতু কনক সারোয়ারের চ্যানেলগুলো বন্ধ করতে হলে সম্পুর্ণ ইউটিউব এবং ফেইসবুকই বন্ধ করে দিতে হবে, তাই সরকারের পক্ষে আর তার চ্যানেল বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।
প্রবাসী সারোয়ারকে ধরতে এবং তার চ্যানেল বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়ে সরকার তাকে থামাতে আরেক কৌশল গ্রহণ করেছে। তা হলো, বোনকে গ্রেপ্তার করে, চাপ সৃষ্টি করে সারোয়ারের ভিডিও প্রকাশ বন্ধ করা। যেমনটা কাউকে আটকে মুক্তিপণ আদায় করা হয়।
সরকারের এই প্রচেষ্টার ভেতর কোন লুকোচুরিও নেই।
নুসরাত শাহরিন রাকা ঢাকায় থাকেন। তার ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী তিন ছেলে রয়েছে। তার স্বামী কুয়েতে কর্মরত। সারোয়ারের ভাষ্যমতে তার বোন একজন গৃহিণী। সেই সঙ্গে তিনি অনলাইনে গয়নার ব্যবসা করেন।
“রাজনীতি নিয়ে ওর কোন আগ্রহ নেই,” বলেন সরোয়ার।
গত মাসের শেষের দিকে রাকা জানতে পারেন, তার নামে ২৮ সেপ্টেম্বর একটি ফেইসবুক প্রোফাইল খোলা হয়েছে। সেখানে তার নাম, ছবি, তার ব্যবসায়িক ফেইসবুক পেইজ থেকে নেওয়া গয়নার ছবি এবং তার যোগাযোগের আরও কিছু তথ্য দেওয়া রয়েছে। বিশেষ উদ্বেগের বিষয় যেটা ছিল, তা হলো সেই প্রফাইলে বিরোধী দলের পক্ষে কিছু পোস্ট করা হয়েছে আর কিছু পোস্ট করা হয়েছে তারেক রহমানকে সমর্থন জানিয়ে (এই প্রোফাইলটি এখন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে)।
রাকা তার বড় ভাই কনক সারোয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করে কী করা যায়, সে পরামর্শ চান। এই প্রোফাইল তার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা ঠেকাতে সারোয়ার বোনকে দ্রুত জিডি করতে বলেন। সারোয়ারের আশংকা ছিল যে সরকার সমর্থকেরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে মামলা করে তার বোনকে হয়ত গ্রেপ্তার করিয়ে ফেলবে। সারোয়ারের পরামর্শে রাকা দ্রুত স্থানীয় থানায় জিডি করেন। সেখানে তিনি জানান, তার নামে একটি ভুয়া ফেইসবুক পেইজ খোলা হয়েছে এবং এর সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই।
কিন্তু যা প্রতিকারের উদ্দেশ্যে রাকা জিডি করলেন, ঠিক তাই ঘটল পাঁচদিন পর। র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র্যাব) তাকে ঠিকই এই ভুয়া প্রোফাইলের জন্যই গ্রেপ্তার করে। র্যাবের অভিযোগ, রাকা “রাষ্ট্রবিরোধী অপপ্রচারকারী ও ষড়যন্ত্রকারী চক্রের একজন সক্রিয় সদস্য”। সেই সঙ্গে তাকে মাদক মামলাতেও জড়িন হয়। পুলিশ খুব সম্ভব নিজেই মাদক রেখে রাকাকে এই মাদক মামলায় ফাঁসায়। কারণ প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে নিজেরাই মাদক রেখে অভিযুক্ত করার কাজটি বাংলাদেশে পুলিশ প্রায়ই করে থাকে।
এটি একটি অবৈধ গ্রেপ্তার। এটাকে অপহরণ কিংবা জিম্মি করাও বলা চলে। সরকার চায়, কনক সারোয়ার ভিডিও তৈরি করা বন্ধ করুক। তার জন্য তার বোনকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে জিম্মি রাখতে হলে তাই করা হবে। রাকাকে গ্রেপ্তারের উদ্দেশ্যে যে সরকারের পক্ষ থেকেই সেই জাল প্রোফাইল তৈরি করা হয়েছিল তাতে এখন প্রায় কোন সন্দেহ নেই।
এই জিম্মি রাখার ষড়যন্ত্রে সেই ম্যাজিস্ট্রেটও যুক্ত যিনি রাকাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন।
এধরনের জিম্মি রাখার ঘটনা যে এই প্রথম ঘটেছে, তা না। তবে এটা সম্ভবত প্রথম ঘটনা যেখানে একজন সাংবাদিকে চুপ করাতে তার স্বজনকে বন্দি করা হয়েছে।
ঠিক যখন ফিলিপিনসের মারিয়া রিসা এবং রাশিয়ার দিমিত্রি মুরাতভ সাংবাদিকতার জন্য নোবেল শান্তি পুরষ্কার পেলেন, তখনই বাংলাদেশে ঘটল এমন ঘটনা। কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সাংবাদিকদের নিরাপত্তার জন্য কমিটি) তাদের প্রকাশিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলে, বিচার ব্যবস্থার এই অবৈধ ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশ সরকারের লজ্জিত হওয়া উচিত। কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টের এশিয়া প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর স্টিভেন বাটলার বলেন, “নির্বাসিত সাংবাদিক কনক সারোয়ারকে শাস্তি দিতে তার বোন নুসরাত শাহরিন রাকাকে গ্রেপ্তার করা খুব অসভ্য এবং বর্বোরোচিত প্রতিশোধ স্পৃহার প্রকাশ। বাংলাদেশ সরকারের জন্য এটা লজ্জাজনক”।●
ডেভিড বার্গম্যান, (@TheDavidBergman), ব্রিটেন-ভিত্তিক সাংবাদিক — নেত্র নিউজের ইংরেজি বিভাগের সম্পাদক।