ফয়েজের ভিডিও সরাতে ছয় দিন লেগেছিল ফেসবুকের
সম্প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলার সূত্রপাত যেই ভিডিওকে কেন্দ্র করে, সেটি সরিয়ে নিতে ছয় দিন সময় নেয় ফেসবুক। নেত্র নিউজের এক অনুসন্ধানে এই ফেসবুকের এই শ্লথ প্রতিক্রিয়ার চিত্র উঠে আসে।
১৩ অক্টোবর ভোর ছয়টায় ফেসবুকে প্রকাশিত একটি ভিডিওতে দেখা যায়, কুমিল্লার নানুয়া দিঘীর পাড় এলাকার একটি পূজা মণ্ডপে একটি কোরআন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। ভিডিওটি ধারণ করছিলেন মোহাম্মদ ফয়েজ নামে একজন ব্যক্তি, যিনি বর্তমানে কারাগারে আছেন। ভিডিওর ধারাবর্ণনায় ফয়েজকে বলতে শোনা যায়, এই পুলিশ কর্মকর্তা “মূর্তির পায়ের নিচ” থেকে কোরআন উদ্ধার করেছেন। ওরা “আমাদের কোরআনকে পায়ের নিচে রেখে অপমান করেছে।” পাশাপাশি, মুসলিমদের “জেগে উঠতে”ও আহবান জানান ফয়েজ।
ভিডিওটি ফেসবুকে আপলোড হওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যেই ঘটনাস্থলে জড়ো হয় অনেক মানুষ। সেখান থেকেই ওই পূজামণ্ডপে হামলা চালিয়ে মূর্তি ভাংচুর করা হয়। এই সহিংসতা পরবর্তী কয়েকদিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। এতে অনেক হিন্দু প্রার্থনালয় ও পূজামণ্ডপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। লণ্ডভণ্ড হয় বহু হিন্দু বাসাবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। এছাড়া কিছু হিন্দু বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে।
সহিংসতা চলাকালে দুই জন হিন্দু ব্যক্তি নিহত হন। এছাড়া পুলিশের গুলিতে নিহত হন চার জন মুসলমান। পরবর্তীতে পুলিশকে উদ্ধৃত করে বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, স্থানীয় একজন মুসলমান ব্যক্তি ওই হিন্দু মণ্ডপে কোরআনটি রেখেছিলেন। তারপর থেকেই প্রশ্ন উঠে যে, সহিংসতা ছড়ানোর পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই ফয়েজ ওই ভিডিও প্রকাশ করেছিলেন কিনা।
নেত্র নিউজের পর্যালোচনায় দেখা গেছে যে, প্রকাশিত হওয়ার ছয় দিন পরও ফয়েজের ওই ভিডিও ফেসবুকে ছিল। ততক্ষনে এটি অন্তত ৫৬ হাজার বার শেয়ার করা হয়েছে। প্রতিক্রিয়া পেয়েছে প্রায় ৯,৬০০টি। পাশাপাশি, ১,৮০০ জন মানুষ এতে মন্তব্য করেছেন।
পরদিন ভিডিওটি আর ফয়েজের অ্যাকাউন্টে দেখা যায়নি। যা থেকে ইঙ্গিত মিলে যে, ফেসবুক ভিডিওটি মুছে দিয়েছে। ফেসবুকে ফয়েজের বন্ধুসংখ্যা মাত্র ৮৮। দৃশ্যতই, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সামান্য পরিচিতি থাকা অ্যাকাউন্ট থেকেও সহিংসতার ইন্ধন যোগানো কোন পোস্ট খুব দ্রুত ভাইরাল হয়ে যেতে পারে।
মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাউথ এশিয়া ক্যাম্পেইনার সাদ হামাদি নেত্র নিউজকে বলেন, “অনিষ্টকর ও বিভক্তি সৃষ্টিকারী বক্তব্য আরও দৃশ্যমান করা ও ছড়িয়ে দেয়ার যে ক্ষমতা ফেসবুক অ্যালগরিদমের রয়েছে, তার বিভীষিকাময় ফল ভোগ করেছে বৈশ্বিক দক্ষিণাঞ্চল (গ্লোবাল সাউথ)।” তিনি আরও বলেন, “যে অ্যালগোরিদম পদ্ধতিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো নিয়ন্ত্রিত হয় তাতে আরও বেশি স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। এবং সেখানে নিরপেক্ষ যাচাইয়ের পথ উন্মুক্ত করতে হবে যেন ক্ষতিকর ও বিদ্বেষ সৃষ্টিকারী বিষয়বস্তুর প্রচার কমিয়ে আনা যায়।”
ফয়েজের ভিডিও কেন আরো আগে সরিয়ে নেয়া হয়নি তার কোন সরাসরি জবাব দেননি ফেসবুকের একজন মুখপাত্র। তবে তিনি বলেন যে ফেসবুকের “একটি নিবেদিত কর্মীদল সংঘাত শুরু হবার পর থেকেই বাংলাদেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিল। তারা বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে তাৎক্ষনিক পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশে [ফেসবুকের] ফ্যাক্টচেকাররা কন্টেন্ট মূল্যায়ন করছেন।”
ওই মুখপাত্র আরও বলেন, একই সাথে তারা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ছড়ানো অপতথ্য চিহ্নিত করছেন। একই সাথে যেসব কনটেন্টের মাধ্যমে সহিংসতার ইন্ধন যোগানোর ঝুঁকি রয়েছে, সেসব সরিয়ে ফেলার বিষয়েও কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে ফেসবুক।
ফেসবুকের ভেতরকার আরেকটি সূত্র বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিষয়ে স্বীকার করেছেন যে ভিডিওটি সরিয়ে ফেলতে দেরি হয়েছে, কিন্তু তিনি দাবি করেছেন যে এ বিষয়ে ফেসবুকের পদক্ষেপ গ্রহণের গতি ও কার্যকারিতা শুধুমাত্র “একটি ভিডিও”র ভিত্তিতে বিচার করা “সঠিক বা প্রাসঙ্গিক” হবে না।
তিনি বলেন কোন চলমান ও দ্রুত গতিতে পরিবর্তনশীল ঘটনার ক্ষেত্রে — বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সহিংসতার ঘটনা যেমন ছিল — ফেসবুকের পক্ষে ঘটনার ভেতরে কোনটা কখন হচ্ছে তা সঠিকভাবে ও তাৎক্ষনিকভাবে নির্ণয় করা কঠিন। কিন্তু ফেসবুক চেষ্টা করে “মারাত্মক ক্ষতিকর যেকোনো কন্টেন্ট যতদ্রুত সম্ভব সরিয়ে ফেলতে।”
তিনি আরও দাবি করেন যে, “আলোচিত ভিডিওটি সরিয়ে ফেলার আগে” ফেসবুক এই “সহিংসতার সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য ভিডিও, পোস্ট ও ছবির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়েছিল।”
সম্প্রতি ফেসবুকের অভ্যন্তরীণ বেশ কিছু নথি ফাঁস হবার পর থেকে আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে রয়েছে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কোম্পানিটি। ফেসবুকের প্রাক্তন কর্মচারী ফ্রান্সিস হাউগেন কোম্পানির বিভিন্ন নথি প্রকাশ করে দেন। এসব নথি প্রকাশ হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন দেশে সহিংসতা ঠেকাতে ফেসবুকের ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের একটি কমিটির কাছে হাউগেন বলেছেন, ফেসবুক যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে তাদের বিভিন্ন সার্ভিস পর্যাপ্তভাবে পর্যবেক্ষণ করেনি। যার ফলে ফেসবুক মায়ানমার ও ইথিওপিয়ার মতো কিছু দেশে “আক্ষরিক অর্থেই সাম্প্রদায়িক সহিংসতা উস্কে দিচ্ছিল” । দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসও সম্প্রতি ভারতে “মুসলমান বিদ্বেষ” এবং “অপতথ্য” ছড়ানোতে ফেসবুকের ভূমিকা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি এ বিষয়ে নেত্র নিউজকে বলেন, “[ফেসবুকের] প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে বিদ্বেষ ছড়ানো ও সহিংসতার ইন্ধন যোগানো বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে আসছিল ফেসবুক। এখন এই [ঘটনাও] সেসব প্রশ্নের সাথে যুক্ত হবে।”
এদিকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে ফেসবুক ও সরকারের মাঝে বিরোধ চলছে। মূলত, সরকারবিরোধী পোস্ট সরকারের দাবি মোতাবেক ফেসবুক সরিয়ে না দেওয়ায় এই বিরোধের উৎপত্তি। এছাড়াও, ফেসবুক বাংলাদেশ সরকারের সাথে সম্পৃক্ত থাকা কিছু চক্রকে সনাক্ত করেছে, যারা স্বাধীন সংবাদ মাধ্যম সেজে ফেসবুকে পেইজ তৈরি করেছিল এবং ভিন্নমতালম্বীদের অ্যাকাউন্ট বন্ধের চেষ্টা করছিল।
মোহাম্মদ ফয়েজ যেদিন ভিডিওটি প্রকাশ করেন সেদিনই তিনি গ্রেফতার হন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে তাকে গ্রেফতার করা হয়। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় দীর্ঘদিন ধরেই আক্রমণের শিকার হয়ে আসছে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর মোট ৩,৬৭০ টি আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে।●