খালেদা জিয়া, কর্তৃত্ববাদী সরকার এবং বোধহীন সুশীল সমাজ
বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য বিএনপি ও খালেদা জিয়া উভয়েরই বেঁচে থাকা জরুরি।
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা বেশ খারাপ। চিকিৎসক ও নিকটজনদের দেয়া তথ্য মতে, তিনি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। সম্প্রতি তার চিকিৎসকেরা সংবাদ সম্মেলনে বেশ পরিষ্কার করেই এই রাজ নৈতিক নেত্রীর সংকটাপন্ন অবস্থার বিবরণ দিয়েছেন। জানিয়েছেন, এ ধরনের রোগে দেশে চিকিৎসার সুব্যবস্থা নেই; সুচিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেয়া প্রয়োজন। কিন্তু এদিকে খালেদা জিয়ার বিদেশ যাওয়ার অনুমতি নিয়ে টালবাহানা করে চলেছে আওয়ামী লীগ সরকার।
খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসা বিষয়ে সরকারের নীতি-নির্ধারকদের দেয়া বক্তব্য গতানুগতিক রাজনৈতিক বিরোধিতার উর্ধ্বে উঠতে পারছে না। মানবিক আচরণ তো দূরের কথা, মৃত্যুর প্রায় কাছাকাছি চলে যাওয়া এই রাজনৈতিক নেত্রীরকে স্বাভাবিক চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ দেয়া উচিত কিনা তা নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে। এই আলোচনার একটা বড় অংশ জুড়েই রয়েছে বিচারিক প্রক্রিয়ার আলাপ। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ যেন বড়ই সুষ্ঠু বিচারের দেশ! ভাবে মনে হচ্ছে, এদেশে রাজনৈতিক বিবেচনায় কোনো বিচারের রায় দেয়া হয় না, খুনের আসামি রাষ্ট্রপতির নির্দেশে ছাড়া পায় না কিংবা শুধু প্রভাবশালী বাহিনীর আত্মীয় হবার কারণে এদেশে কেউ বিশেষ সুবিধা পায় না! অথচ এর সবকিছুই চলে এদেশে।
শুধু যখন দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রধান নেত্রীর জীবন-মরনের প্রশ্ন, তখনই কেমন করে জানি সরকার ভয়ানক আইনের শাসক হয়ে যায়! যখন প্রধান প্রতিপক্ষ শারীরিকভাবে প্রায় অক্ষম, সত্তরোর্ধ, রোগাক্রান্ত, প্রায় মৃত্যুর কাছাকাছি, তখন আওয়ামী লীগের এই প্রচণ্ড আইনপ্রীতি অমানবিকতার আরেকটি উদাহরণ হিসেবেই ধরা দেয়।
অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশে আইন আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সুবিধা নিশ্চিত করতে আর বিরোধীদের দমনে হাতিয়ার হয়ে কাজ করছে। শুধু যারা আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে তারাই না, দেশে সুশীল সমাজ ও বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত অনেকেই খালেদা জিয়ার এই সংকটপূর্ণ সময়ে আইনের মারপ্যাঁচ সামনে এনে বরাবরের মতোই আওয়ামী স্বার্থরক্ষায় কাজ করে চলেছেন।
খালেদা জিয়ার নানা সমালোচনা থাকতে পারে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির মতো বিতর্কিত নির্বাচন তার আমলেই হয়েছে। তিনি হয়ত কোনো “পার্ফেক্ট নেতা” নন। আবার বাঙালির আবেগী মনের কথা আর বয়ানের মোহ যে তিনি তৈরি করতে পারেননি, সেটাও সত্য। তাই বিতর্কিত নির্বাচন করে তার ফায়দাও তিনি নিতে পারেননি।
খালেদার সমালোচকদের অনেকেই বলেন, তিনি খুবই “এলিটিস্ট”। তার প্রধান প্রতিপক্ষের মতো তিনি রান্না করা, মাছ ধরা, রিকশায় ঘুরে বেড়ানোর ছবি দিয়ে মানুষের মন জয় করেন না, করার চেষ্টাও তার মধ্যে লক্ষ্য করা যায় না। তিনি সাধারণ জনগণের নেত্রী নন, এই অভিযোগ করা হয়।
এতসব সমালোচনা সত্ত্বেও তিনি যে বাংলাদেশিদের কাছে তুমুল জনপ্রিয়, তার বিভিন্ন নজির কিন্তু থেকেই যায়। খালেদা জিয়া সাধারণত প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনে পাঁচটি করে আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন। কোনো আসনে নির্বাচনে কখনো পরাজিত হওয়ার কোন রেকর্ড নেই তার। সমালোচকদের ভাষ্যমতে তিনি যদি সাধারণের নেত্রীই না হবেন, তাহলে সাধারণ মানুষের মধ্যে, গ্রামে-গঞ্জে, খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে তিনি কীভাবে এতো জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন, সেটি একটি ধাঁধা। নাকি আমরা নগরের মধ্যবিত্ত আর বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণি জনপ্রিয়তার যে মাপকাঠি তৈরি করেছি, নেতা-নেত্রীর যে গুণাবলী আমাদের কাম্য, তা খুবই সংকীর্ণ? নাকি ঢাকা-ভিত্তিক নাগরিক ভ্যালু ঢাকার বাইরে কাদামাটি-ঘনিষ্ট মানুষদের চেয়ে আলাদা? তাই প্রশ্ন জাগে, যে খালেদা জিয়াকে আমি-আপনি আর্ম-চেয়ার বুদ্ধিজীবীতা দিয়ে মাপছি, তিনি কি তার চেয়ে বেশি কিছু ডিজার্ভ করেন ?
খালেদা জিয়ার নগরভিত্তিক সমালোচকেরা তার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে বক্রক্তি করে থাকে। অথচ একটু খুঁটিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, এই সমালোচনা আসলে খালেদা জিয়ার অযোগ্যতার চেয়ে যোগ্যতাকেই তুলে ধরে। তথাকথিত শিক্ষিত শ্রেণি যতোই এই রাজনৈতিক নেত্রীকে ছোট করুক না কেনো, তাদের মানতেই হবে বিএনপিকে পূর্ণাঙ্গ একটি দলে পরিণত করেছে এই খালেদা জিয়ার নেতৃত্বই।
মৃত্যুর আগে জিয়াউর রহমানের চট্টগ্রাম সফরের একটা বড় উদ্দেশ্য ছিল, সে অঞ্চলে দলীয় কোন্দল নিয়ন্ত্রণে আনা। বেঁচে থাকতে জিয়াউর রহমান তার দলের তৃণমূল পর্যায়ের সংকট কাটিয়ে উঠার সুযোগ আর পাননি। জিয়ার জীবদ্দশায় বিএনপি কেবলই একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে উঠেছিল; তৃণমূল পর্যায়ে বিএনপির সংগঠনগুলো তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু তা শক্তিশালী ও বিস্তৃত হয়েছে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বেই। খালেদা জিয়া সেই “গৃহবধূ” যিনি সামরিক শাসকের হাতে তৈরি একটি রাজনৈতিক দলকে দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের প্রধান দলে পরিণত করেছেন; এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রধান নেত্রী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। ১৯৮৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে যখন শেখ হাসিনা এরশাদের অধীনে নির্বাচন করলেন, তখন এই “অশিক্ষিত” নেত্রী আপোস করলেন না। বাংলাদেশের ইতিহাসে গণতন্ত্রের যতোটুকু ছিটেফোঁটা এখনো আছে, তার জন্য কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত এই “অশিক্ষিত” গৃহবধূর কাছেই। তাই খালেদা জিয়াকে ইতিহাসের সাধারণ সমীকরণ দিয়ে মাপা ভুল।
বাংলাদেশে নারীর অধিকার রক্ষায় সোচ্চার অংশটিও সমালোচনা করতে গিয়ে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ভূমিকার চাইতে নারী হিসেবে তার বাহ্যিক সৌন্দর্য নিয়েই কথা বলতে পছন্দ করে। খালেদা জিয়ার মেকআপ, আঁকা ভ্রু, শিফন শাড়ি নিয়ে উপহাস করে। এ অংশটিও খালেদাকে কেবল নারী হিসেবে দেখতে চায়, মানুষ হিসেবে না। তাই খালেদার যে মানসিক সৌন্দর্য, তা তাদের আলোচনায় আসে না। একটা উদাহরণ দেই। ১৯৮৯ সালের ২৫ মে খালেদা জিয়া ফারাক্কা বিরোধী লং মার্চে অংশ নিতে দেশের উত্তরাঞ্চল শিবগঞ্জে যান। শিবগঞ্জ ডাকবাংলো থেকে কানসাট প্রায় ১০ কিলোমিটার দূর। মনে করা হয়েছিল, খালেদা জিয়া গাড়িতে করে সেখানে যাবেন, আর মিছিল যাবে হেঁটে। কিন্তু ডাকবাংলো থেকে বের হয়ে খালেদা বললেন, তিনি মিছিলের সঙ্গে হেঁটে যাবেন। এই পুরোটা পথ হাজারো মানুষের সঙ্গে হেঁটে যান খালেদা। লংমার্চ শেষে বাংলাদেশের ন্যায্য পানির হিস্যা দাবি করেন। খালেদা জিয়া যে মানসিক শক্তির জোরে ১০ কিলোমিটার হাঁটেন, গণতন্ত্র রক্ষায় রাজপথে থাকেন, সেই সৌন্দর্যের কথা আমরা ভুলে যাই। ভুলে যাই যে খালেদা জিয়াই নারীদের জন্য উপবৃত্তি চালু করে লাখো নারীর ক্ষমতায়নের পথ তৈরি করে দিয়েছিলেন।
এসব আমরা ভুলে যাই, কারণ ইতিহাসের শুধু একটি ধারাকেই বর্তমান সরকার ও তার অনুগতরা সামনে আসতে দেয়। তাদের এই সত্য আড়াল করার প্রয়াসে বাকি সবাই হয়ে যায় ব্রাত্য। দেশে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দলের যে কৃতিত্ব থাকতে পারে, একটি পরিবার ছাড়া আরও কারো যে অবদান থাকতে পারে, তা আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় ভুলে থাকতে হয়। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় খালেদা জিয়া বা বিএনপির পক্ষে যায় এমন কোনো কথা বলা, সেটা যতই সত্য হোক, যেন অপরাধ! তাই আমাদের চতুর বুদ্ধিজীবীরা সবসময় ব্যালান্স করে চলে। তারা প্রয়োজন না থাকলেও বিএনপির সমালোচনা করে তারপর নিজেদের বক্তব্য উপস্থাপন করতে ভালোবাসে। সরকার নিয়ন্ত্রিত যাবতীয় প্রচার যন্ত্র ও অনুগত প্রচার বাহিনীও যেন যথেষ্ট নয়। বিরোধী দল ও দুর্বল প্রতিপক্ষ হিসেবে বিএনপির সমালোচনা করা বেশ সহজ। আর এই সহজ কাজটি করতেই পারদর্শী আমাদের বুদ্ধিজীবী শ্রেণী।
এদিকে খালেদা জিয়া যখন জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন, তখন বিএনপির ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত অনেকেই। খালেদা জিয়ার মৃত্যুর পর কীভাবে বিএনপি দল হিসেবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, তা নিয়ে প্রচার মাধ্যমগুলোতে চলেছে জল্পনাকল্পনা। গত কয়েক বছর ধরেই বিএনপি যে ক্ষয়িষ্ণু একটি দল, তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু এই আলোচনায় কিছু প্রশ্নের উত্তর অবশ্য পাওয়া যায় না। প্রশ্ন থেকে যায়, কেনো হাজারো মামলা, হামলা ও গুমের পরেও তৃণমূল পর্যায়ে বিএনপি এখনো টিকে আছে? প্রশাসনের অনিচ্ছুক শিথিলতা অথবা আওয়ামী কোন্দলকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে এখনো স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা জিতে আসছে? কেনো এখনো আওয়ামী লীগ সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে ভয় পাচ্ছে? তাহলে কি বিএনপির ক্ষয়, বিএনপির বিনাশ, বিএনপির অন্ধকার ভবিষ্যত — এসব চিন্তার পিছনে যতটা না সত্যতা, তার চেয়ে বেশি কর্তৃত্ববাদী সরকারের বেঁধে দেয়া ন্যারেটিভই দায়ী?
অথচ এখন বিএনপির ভবিষ্যত কী, এই চিন্তার চেয়ে বেশি জরুরি ছিল বাংলাদেশের ভবিষ্যত চিন্তা করা। বিএনপির মতো মধ্যপন্থী একটি দলের উপস্থিতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য যে খুবই জরুরি, সেই উপলব্ধিটা গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপির অনুপস্থিতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে শূন্যস্থান তৈরি করবে, তা বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য বিপদ ডেকে আনবে। দুর্বল বিএনপি বা বিএনপি শূন্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক জগৎ কর্তৃত্ববাদী একক নেতৃত্বকে আরও শক্তিশালী করবে, উগ্রপন্থার উত্থান ত্বরান্বিত করবে।
বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য বিএনপি ও খালেদা জিয়া উভয়েরই বেঁচে থাকা জরুরি। বর্তমান কর্তৃত্ববাদী সরকার বিদেশে পাঠিয়ে খালেদা জিয়ার সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে, এমন আলামত এখনো দেখা যাচ্ছে না। সরকারের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক। অন্তত: একজন মৃত্যু পথযাত্রীকে বাঁচানোর যে তাড়না আমাদের মানুষ করে তোলে, তার কিছুটা হলেও এই সরকারের আছে, আপাতত এটুকু দেখার আশাবাদ রাখছি।●
সাইমুম পারভেজ, গবেষক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক।