আরেকটি ভোট চুরির নির্বাচন কি আসন্ন?

আবার শুরু হয়েছে বিরোধী দলের নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার। শংকা দেখা দিয়েছে, এই তৎপরতা আগামী বছর আবারো এক ভুয়া নির্বাচন অনুষ্ঠানের ইঙ্গিত বহন করছে কিনা।

আরেকটি ভোট চুরির নির্বাচন কি আসন্ন?
২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় ঢাকায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপসের পোস্টার। ফটো: মেহেদি হাসান/জুমা ওয়ার/আলামি লাইভ নিউজ

বাংলাদেশ আরেকটা নির্বাচনী বছরে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। পর্যবেক্ষকেরা খুব শিগগিরই যে প্রশ্নটি নিয়ে বিশ্লেষণ শুরু করবেন তা হলো, নির্বাচন সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ হবে কিনা।

আওয়ামী লীগ ২০০৯ এর যে নির্বাচনে জিতেছিল তা মোটামুটি সুষ্ঠ নির্বাচন হিসেবেই স্বীকৃত। কিন্তু ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি সংবিধান থেকে উঠিয়ে দেয়। এর প্রতিবাদে নির্বাচন বর্জন করে সব বিরোধী দল। আর ২০১৮ সালের নির্বাচনে সব বিরোধী দল অংশ গ্রহণ করলেও তাতে আওয়ামী লীগ পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে সম্পূর্ণ কারচুপির মাধ্যমে জিতেছে বলে প্রায় সর্বত্র স্বীকৃত।

আওয়ামী লীগ দাবি করেছিল, দলীয় সরকারের অধীনেও যে সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন হতে পারে, তারই প্রমাণ দেওয়া হবে ২০১৮-এর নির্বাচনে। কিন্তু সে পরীক্ষায় শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয় আওয়ামী লীগ। এরপর তিন বছর অতিক্রান্ত হলেও এমন কিছুই বদলায়নি যাতে ভাবা যেতে পারে যে আওয়ামী লীগ এখন সুষ্ঠ নির্বাচন দিতে ইচ্ছুক। বরং উল্টোটা ঘটেছে। এই সরকার এখন আরও বেশি স্বৈরাচারী। দেশে মানুষের বাকস্বাধীনতা আরও অনেক বেশি সংকীর্ণ হয়ে এসেছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহ ও বিচার বিভাগের উপর সরকারের দলীয় নিয়ন্ত্রণ অতীতের যেকোন সময়ের তুলনায় সবচেয়ে বেশি এখন। যদিও আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারের ফলে দলটি যতখানি জনপ্রিয়তা হারাবে বলে ধারনা করা হয়েছিল, ততখানি হয়ত তারা হারায়নি। তবুও একটা কারচুপি বিহীন নির্বাচন দিয়ে হেরে যাবার সাহস দলটির নেই।

সুষ্ঠু ও স্বাধীন নির্বাচনের প্রথম শর্তই হলো, বিরোধী দলকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেবে ক্ষমতাসীন দল। হয়রানি ও গ্রেপ্তারের ভয় ছাড়াই বিরোধী দল তাদের দৈনন্দিন সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড — মিছিল, মিটিং, গণসংযোগ ইত্যাদি — পরিচালনা করতে পারবে। এখন কথা হচ্ছে, নির্বাচন এখনো বেশ দূরে। অথচ সাম্প্রতিক ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, সরকার দেশের প্রধান বিরোধী দল, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে (বিএনপি) তাদের স্বাভাবিক রাজনৈতিক কাজ করতে ক্রমাগত বাঁধা দিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, বিএনপির জন্য পরিস্থিতি যে ততোই কঠিন হবে, তা প্রায় নিশ্চিত।

বিএনপি গত অক্টোবরের শেষ দিকে ঢাকায় একটি মিছিল ও সমাবেশ করার চেষ্টা করে। পুলিশ সেখানে লাঠিপেটা করে ও ৪৪ জন বিএনপি নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করে। পুলিশ কখনোই বিএনপিকে শান্তিপূর্ণভাবে মিছিলও করতে দেয় না। সবসময়ই তারা গ্রেপ্তারের কোনো না কোনো ছুতো খুঁজে বের করে বা সংঘর্ষ ঘটাবার ক্ষেত্র তৈরি করে এবং মিছিল বানচাল করে।

এই সমাবেশের অল্প কিছুদিন পরেই, ৩১ অক্টোবর আরও একটি ঘটনা ঘটে। পুলিশ সেদিন অভিযান চালায় সাজেদুল ইসলাম সুমনের বাসায়। এই সাজেদুল ইসলাম সুমনকে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে র‍্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ান উঠিয়ে নিয়ে যায়। একই দিনে আরও পাঁচজন গুম হন এবং তারা কেউই আর ফিরে আসেননি। সুমন ছিলেন ঢাকার একজন বিএনপি নেতা। এই গুমের পর তার পরিবার “মায়ের ডাক” নামক সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করে। দেশে গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যারা এই সংগঠনের যোগ দিতে থাকে।

সুমনের বাসায় সেদিন, ৩১ অক্টোবর, এসেছিলেন বিএনপি নেতা আমানউল্লাহ আমান এবং বিএনপির বিভিন্ন নেতা-কর্মী। তারা এসেছিলেন গুম হওয়া সুমনের মা এবং “মায়ের ডাক”-এর একজন প্রধান সংগঠক হাজেরা খাতুনকে দেখতে। হাজেরা খাতুন অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি থাকার পর সেদিনই মাত্র বাসায় ফিরেছিলেন। সেদিন “মায়ের ডাক” সংগঠনের অনেক সদস্যও ওই বাসায় ছিলেন। সেখানে সেদিন সবাই মিলে দোয়ার অনুষ্ঠানে অংশ নিতে এসেছিলেন। গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতেই প্রায় ৩০ জন পুলিশের একটি দল ওই বাসায় প্রবেশ করে। তারা উপস্থিত অনেককেই শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত এবং প্রহার করে। তারপর তারা ১৬ জন বিএনপি কর্মীকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়।  

পুলিশের দাবি, সেখানে “গোপন বৈঠক” হচ্ছে বলে তাদের কাছে খবর ছিল। দিনদুপুরে ও জনসমক্ষে বিএনপি নেতা দলীয় কর্মীদের নিয়ে গোপন বৈঠক করতে এসেছেন! এসব হলো বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারে পুলিশের অজুহাত।

তাহলে কি এখন বিএনপি নেতা-কর্মীদেরকে তাদের প্রতিদিনের কাজ সম্পর্কে বিস্তারিত পুলিশকে আগে থেকেই জানিয়ে রাখতে হবে? স্পষ্টত বিষয়টা তাই দাঁড়াচ্ছে; যেহেতু এর অন্যথা হলেই যে কোনো কাজই পুলিশের কাছে হয়ে যেতে পারে “গোপন বৈঠক”।

এরকম “গোপন বৈঠকের” অভিযোগ পুলিশের জন্য অত্যন্ত সুবিধাজনক। কেননা এর মাধ্যমে তারা যেকোন ঘরে যেকোন সময় প্রবেশ করে যেকোনো বিরোধী দলীয় কর্মীকে ইচ্ছামাফিক গ্রেপ্তার করতে পারে।

বাংলাদেশ পুলিশি রাষ্ট্র নয়। কিন্তু এদেশের বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীদের জন্য এটা এখন অনেকটাই পুলিশি রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগের শাসনামলে হাজার হাজার বিএনপি নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন, অসংখ্য কর্মী কারাগারে এবং যারা বাইরে আছে, তারাও সারাক্ষণ গ্রেপ্তার বা গুম হয়ে যাওয়ার আতঙ্কে থাকেন।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই পুলিশের বিরুদ্ধে “বিধি বহির্ভূত” গ্রেপ্তারের অভিযোগ পাওয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের যথেচ্চ গ্রেপ্তার এখন আর “বিধি বহির্ভূত” কোনো বিষয় না। এটা এখন যেন রাষ্ট্রীয় কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে।

নির্বাচন যতই এগিয়ে আসবে, ততই আওয়ামী লীগকে বলতে শোনা যাবে যে নির্বাচন স্বাধীন ও সুষ্ঠু হবে। কিন্তু তাদের এসব কথা, পদক্ষেপ স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে সরকার ইতিমধ্যেই কারচুপির নির্বাচন করার পথ তৈরি করছে।●

ডেভিড বার্গম্যান, (@TheDavidBergman), ব্রিটেন-ভিত্তিক সাংবাদিক — নেত্র নিউজের ইংরেজি বিভাগের সম্পাদক।

প্রথম প্রকাশিত হয়েছে ইংরেজিতে, ৪ নভেম্বরে ২০২১