মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি যুক্তরাষ্ট্রের
বাংলাদেশে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়নের (র্যাব) বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয়। প্রতিষ্ঠান হিসেবে র্যাব ও ব্যক্তি হিসেবে র্যাবের বর্তমান ও প্রাক্তন ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেওয়া হয়।
পৃথক আরেক বিজ্ঞপ্তিতে ২০১৮ সালে টেকনাফে কাউন্সিলর একরামুল হকের হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে তৎকালীন র্যাব মহাপরিচালক (বর্তমানে আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও তৎকালীন ৱ্যাব-৭ অধিনায়ক মিফতাহ উদ্দিন আহমেদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকারের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নেয়া সবচেয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত এটি। তালিকায় সবচেয়ে চমকপ্রদ নাম পুলিশ প্রধান বেনজির আহমেদ। তিনি প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও ক্ষমতাধর নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের একজন। তার সরাসরি নেতৃত্বে তথাকথিত মাদক-বিরোধী যুদ্ধে কয়েক শ’ মানুষ র্যাব ও অন্যান্য আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহত হয়। এক্ষেত্রে টেকনাফে একরামুল হত্যার ঘটনা মার্কিন দুই মন্ত্রণালয় বিশেষভাবে উল্লেখ করেছে। বেনজির প্রকাশ্যে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার ফলে তার পরিবারের সদস্যবৃন্দও যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে পারবেন না। পাশাপাশি, তার ব্যবসা-বাণিজ্য বা আর্থিক লেনদেনে জটিলতা সৃষ্টি হবে।
দীর্ঘদিন ধরেই র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবি জানিয়ে আসছে রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটস ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো প্রখ্যাত মানবাধিকার সংস্থাগুলো। তাদের অব্যাহত দাবির মুখেই যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এই পদক্ষেপ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতেও তাদের কথা উঠে এসেছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার বরাত দিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়ে, র্যাব এবং অন্যান্য বাংলাদেশী আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের জন্য দায়ী। এসবের শিকার যারা হয়েছেন, তাদের মধ্যে বিরোধী দলের সদস্য, সাংবাদিক এবং মানবাধিকার কর্মীরাও রয়েছেন বলে কিছু প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়া পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি নেত্র নিউজকে বলেছেন, “যুক্তরাষ্ট্র সরকার র্যাব ও প্রতিষ্ঠানটির জ্যেষ্ঠ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। র্যাবের বিরুদ্ধে নির্যাতন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সহ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। কাজেই এটি এসব মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী ও তাদের শিকার ব্যক্তিদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা যে এসব জঘন্য অপরাধের জন্য জবাবদিহিতা আছে। বাংলাদেশের উচিত অনতিবিলম্বে এসব অভিযোগ তদন্ত করা, দায়ীদের বিচারের মুখোমুখি করা, গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারকে তাদের প্রিয় মানুষজন কোথায় আছেন তা জানানো, সব ধরণের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গ্রেপ্তার বন্ধ করা এবং র্যাবকে বিলুপ্ত করতে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেয়া।”
মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয় যাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে:
১. চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, মহাপরিচালক, র্যাব
২. বেনজীর আহমেদ, প্রাক্তন মহাপরিচালক, র্যাব
৩. খান মোহাম্মদ আজাদ, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস), র্যাব
৪. তোফায়েল মুস্তাফা সরওয়ার, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স), র্যাব
৫. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস), র্যাব
৬. মোহাম্মদ আনোয়ার লতিফ খান, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস), র্যাব
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যাদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে:
১. বেনজীর আহমেদ, প্রাক্তন মহাপরিচালক, র্যাব
২. মিফতাহ উদ্দিন আহমেদ, সাবেক অধিনায়ক, র্যাব-৭
এই বিষয়ে র্যাবের বক্তব্য জানতে বাহিনীটির একজন মুখপাত্রের সাথে যোগাযোগ করেছে নেত্র নিউজ।
যুক্তরাষ্ট্র আয়োজিত গণতন্ত্র সম্মেলনের অংশ হিসেবে মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে দেশটির সরকার এই পদক্ষেপ নিল। গণতন্ত্র সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানায়নি। বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তারা প্রথম দিকে এ বিষয়টি তেমন গুরুতর কিছু নয় বলে অবহিত করেন। যুক্তরাষ্ট্র এ ধরণের সম্মেলন আয়োজন করতে পারে কিনা তা নিয়েও পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন প্রশ্ন তোলেন।
ঢাকায় কসমস ফাউন্ডেশন আয়োজিত একটি সাম্প্রতিক আলোচনা সভায়, ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল মিলার বাংলাদেশে “অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের” প্রতি তার দেশের সমর্থনের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি আরও বলেন, “গণতন্ত্র তখনই কার্যকর হতে পারে যখন সব মানুষকে সম্পূর্নরূপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তাদের অধিকার সুরক্ষিত রাখা হয়, তাদের কথা শোনা হয় এবং তাদের ভোট গোনা হয়।”
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সরকার অন্যান্য দেশে গণতন্ত্রের প্রতি সমর্থন ব্যাক্ত করে চলেছে। গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে অভিযুক্ত ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে তারই প্রতিফলন ঘটেছে। পাশাপাশি, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পদস্খলনের প্রতি ওয়াশিংটনের অব্যাহত হতাশার বহিঃপ্রকাশও এই নিষেধাজ্ঞা।●
* প্রতিবেদনটি আপডেট করা হয়েছে।