জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর: মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ শান্তিরক্ষা মিশনে প্রভাব ফেলবে
বাংলাদেশের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ সংস্থাটির সাবেক ও বর্তমান সদস্যদের জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কর্মসূচিতে অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের কার্যালয় নেত্র নিউজকে এ কথা বলেছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরের উপ-মুখপাত্র রাভিনা শ্যামদাসানি বলেছেন, “জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বিষয়ে মানবাধিকার সংক্রান্ত উদ্বেগসমূহ যেন তাদের মোতায়েনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় প্রতিফলিত হয় — তা পর্যাপ্তভাবে নিশ্চিতে এই প্রক্রিয়া নিয়মিতভাবে হালনাগাদ করার কথা জাতিসংঘের। র্যাবের মানবাধিকার লঙ্ঘন সংক্রান্ত অভিযোগ সম্পর্কে যেহেতু জাতিসংঘের বিভিন্ন মানবাধিকার সংক্রান্ত কাঠামো থেকে উদ্বেগ উঠেছে, তাই এসব উদ্বেগ প্রাসঙ্গিকভাবে বিবেচ্য একটি বিষয়।”
নেত্র নিউজের পাঠানো প্রশ্নের প্রেক্ষিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের দপ্তর থেকে নির্দিষ্টভাবে ২০১৯ সালে প্রণীত জাতিসংঘের নির্যাতন বিরোধী কমিটির একটি প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করা হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নে কাজ করেছেন এমন সৈন্য বা পুলিশ সদস্যদের প্রতিনিয়তই জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে মোতায়েন করা হয়েছে বলে যেসব তথ্য বা প্রতিবেদন রয়েছে, তা নিয়ে [কমিটি] উদ্বিগ্ন।”
শ্যামদাসানি আরও উল্লেখ করেন, বলপূর্বক বা অনৈচ্ছিক অন্তর্ধান (গুম) বিষয়ক জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সরকারের কাছে চিঠি লিখে নিজেদের উদ্বেগের বিষয়টি প্রকাশ করেছে। এতে লেখা হয়, “মানবাধিকার লঙ্ঘন সংঘটনে র্যাব সদস্যদের জড়িত থাকার অভিযোগ সম্পর্কে কোনো তদন্ত কিংবা পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাইবাছাই ছাড়াই র্যাবের সদস্যরা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে পারছে” বলে ওয়ার্কিং গ্রুপ উদ্বিগ্ন।
নেত্র নিউজ জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরের কাছে জানতে চেয়েছিল গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত থাকার দায়ে র্যাব ও সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কারণে কী কী প্রভাব পড়তে পারে। তারই জবাবে রাভিনা শ্যামদাসানি তার বক্তব্য দেন। তার প্রতিক্রিয়া থেকে ইঙ্গিত মিলছে যে, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা শান্তিরক্ষী কর্মসূচিতে সরাসরি প্রভাব না ফেললেও, জাতিসংঘের এ সংক্রান্ত নিজস্ব প্রতিবেদন নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
শ্যামদাসানি আরও বলেন, জাতিসংঘে কাজ করার ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তিকে তার দেশের সরকার মনোনয়ন দিলে, তাকে যাচাই-বাছাইয়ের মূল দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের। তবে তিনি যোগ করেন, “সরাসরি অংশ নেয়া বা (জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বা কমান্ডার হিসেবে) নিবৃত্ত করতে ব্যার্থ হওয়ার মাধ্যমে কোনো ব্যাক্তি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বা মানবতা সংক্রান্ত আইন লঙ্গণে জড়িত রয়েছেন বলে বিশ্বাস করার মতো যৌক্তিক কারণ প্রতিষ্ঠা করে এই ধরণের তথ্য বা অভিযোগ কেস-বাই-কেস ভিত্তিতে বিবেচনায় নিতে জাতিসংঘ বিভিন্ন প্রক্রিয়া ঠিক করেছে। এর ফলে ওই ব্যক্তি যোগ্যতা, কার্যকারিতা ও ন্যায়নিষ্ঠতার সর্বোচ্চ মানদণ্ড পূরণ করবেন না; তার অর্থ হলো, ওই ব্যক্তিকে শান্তিরক্ষার সেবায় নির্বাচন বা মোতায়েন করা সঠিক হবে না।”
তিনি যোগ করেন, “জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরের ভূমিকা হলো, আমরা জাতিসংঘ সচিবালয়ের অনুরোধ অনুযায়ী নির্বাচন, নিয়োগ, মনোনয়ন, মোতায়েন বা চুক্তি সম্পাদন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন প্রণালীতে তথ্য দিয়ে থাকি। ব্যক্তিবিশেষ বা সম্ভাব্য সদস্য দলের মানবাধিকার সংক্রান্ত কর্মকান্ড বিষয়ক তথ্য এসব ধাপে আমলে নেয়া হবে বলে প্রত্যাশা করা হয়।”
তার প্রতিক্রিয়ায় শ্যামদাসানি জাতিসংঘের নির্যাতন-বিরোধী কমিটি ও গুম বিষয়ক ওয়ার্কিং কমিটির প্রতিবেদনসমূহকে বিশদভাবে উদ্ধৃত করেন, যেখানে র্যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিস্তর অভিযোগ বর্ণনা করা হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্তকে সমালোচনা করা হয়েছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রী একে আবদুল মোমেন দাবি করেছেন, “যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত যথাযথ তথ্যের বদলে নেতৃত্বের দায় সংক্রান্ত অযাচাইকৃত বা অপ্রমাণসিদ্ধ অভিযোগের ভিত্তিতে নেয়া হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।” তবে জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরের বক্তব্য থেকে দেখা যাচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রাপ্ত তথ্যের সঙ্গে জাতিসংঘের শীর্ষ মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অনুসিদ্ধান্তের মিল রয়েছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরের এসব বক্তব্য সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানতে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে নেত্র নিউজ যোগাযোগ করেছে।●