বিএনপি-জামায়াত লবিং: আসলে যা ঘটেছে
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম গত ১৮ জানুয়ারির সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) যুক্তরাষ্ট্রে লবিং করতে ৩.৭ মিলিয়ন ডলার (৩৭ লাখ ডলার) ব্যয় করেছে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও (জামায়াত) যুক্তরাষ্ট্রে লবিং করেছে। সূত্র হিসেবে তিনি চারটি নথির কথা উল্লেখ করেন, কিন্তু কোন টাকার অঙ্ক বলেননি।
সম্প্রতি নেত্র নিউজের একটি প্রতিবেদনে বলা হয় আওয়ামী লীগ সরকার যুক্তরাষ্ট্রে লবিং-এর পেছনে ২০১৪ সাল থেকে ২.৩ মিলিয়ন (২৩ লাখ) ডলার ব্যয় করেছে। এই খবর প্রকাশের পরই এই সংবাদ সম্মেলন ডাকেন শাহরিয়ার আলম।
এর এক সপ্তাহ পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল মোমেন সংসদে তার বক্তৃতায় বিএনপির বিরুদ্ধে অভিযোগের মাত্রা আরও বাড়িয়ে বলেন, “বিএনপি…২০১৫ থেকে এপ্রিল ২০১৭ পর্যন্ত ২৭ লক্ষ ডলার খরচ করেছে। প্রতিমাসে রিটেইনার ফি হিসেবে ১ লক্ষ ২০ হাজার [ডলার ব্যয় করেছে]। …এই তথ্যগুলো আমেরিকার ওয়েবসাইটেই দেয়া আছে।”
শাহরিয়ার আলম সংবাদ সম্মেলনে বিরোধী দলের লবিং নিয়ে অভিযোগ করেননি। তার মূল প্রশ্ন ছিল অর্থের উৎস নিয়ে। বিশেষত দেশের বাইরে অর্থ প্রেরণে প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও বিএনপি কিভাবে আইনত দেশ থেকে টাকা নিতে পারলো তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। একই সাথে নির্বাচন কমিশনের কাছে দেয়া আর্থিক হিসাবে এই খরচ সঠিকভাবে দেখানো হয়েছে কিনা তা নিয়ে তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেন।
“এগ্রিমেন্টে বিএনপির ঠিকানা ব্যবহার করে করা হয়েছে, কাজেই আমরা ধারনা করতে পারি যে বিএনপি সরাসরি ৩.৭৫ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে,” পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন। “এই অর্থ বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের যথাযথ অনুমতি নিয়ে ট্রান্সফার হয়েছে কিনা। যদি না হয় তাহলে বাংলাদেশে আইন আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নিশ্চয় সঠিক ব্যবস্থা নিবে।”
শাহরিয়ার আলম আরও মনে করেন, বিএনপি ও জামায়াত হয়তো নির্বাচন কমিশনের নিয়মও ভঙ্গ করেছে, “আপনারা জানেন যে রাজনৈতিক দল নিবন্ধন নিয়মের ৯(খ) বা ৯(গ) অধীনে এটা পরিষ্কার বলা আছে যে রাজনৈতিক দলগুলো প্রতি বছরের শেষে তাদের আয়-ব্যায়ের হিসাব প্রকাশ করবে।”
সংবাদ সম্মেলনের পরের দিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে চিঠি পাঠায়। পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগে বিএনপির অর্থ প্রেরণের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে আবেদন জানায়। সেই সাথে মন্ত্রণালয় নির্বাচন কমিশনকেও চিঠি লেখে এবং লবিং বাবদ খরচ বিএনপির বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে কিনা তা জানতে চায়।
২৫ জানুয়ারি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংবাদ সম্মেলন করেন ও যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগের কথা অস্বীকার করেন, “যা কিছু করি দেশকে রক্ষার জন্য করি। তার মানে এই না যে লবিস্ট নিয়োগ করেছি দেশকে রক্ষার জন্য এটা কিন্তু নয়। ক্লিয়ার করে বলে দিচ্ছি আপনাদেরকে।”
তাহলে কে সত্য বলছে?
যুক্তরাষ্ট্রের লবিং সংস্থাগুলো বিদেশি যেকোনো সরকার বা রাজনৈতিক দলের পক্ষে যেকোনো ধরনের লবিংয়ের কাজ করলে তার আর্থিক ও অন্যান্য বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করতে আইনত বাধ্য। একারণে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্য কতখানি সঠিক তা যাচাই করা সম্ভব।
বিরোধী দলের লবিং
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল: লবিং সংক্রান্ত যে পাবলিক ডাটাবেস রয়েছে সেখানকার তথ্যের ভিত্তিতে নেত্র নিউজ পাঁচটি লবিং ফার্ম বা সংস্থাকে চিহ্নিত করতে পেরেছে যাদেরকে বিএনপি বা বিএনপির পক্ষে নিযুক্ত করা হয়েছে। নথিতে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে এই নিযুক্তির সময়কাল শুরু ২০০৭ সালে।
২০১৮ এর আগস্টে যুক্তরাজ্য নিবাসী বিএনপি নেতা আব্দুল সাত্তার ব্লু স্টার স্ট্র্যাটেজিস এলএলসি কে নিযুক্ত করেন “বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে অগ্রসর” করার জন্য। সেই সাথে নিযুক্ত সংস্থাটি একটি কর্মপরিকল্পনা প্রস্তুত করে যা “বিএনপি সম্পর্কে এবং স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে বিএনপি কিভাবে উপকৃত হবে সেই বিষয়ে কর্মকর্তা, নীতি নির্ধারনী পর্যায়ে প্রভাব ফেলতে সক্ষম এমন ব্যক্তিবিশেষ এবং গণমাধ্যমকে অবহিত করবে।” এছাড়া তারা “বিএনপির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটি ন্যারেটিভে”র খসড়া তৈরি করেছিল। চুক্তিতে সাক্ষর করেছিলেন সাত্তার ব্যক্তিগতভাবে। কিন্তু নথিপত্র থেকে স্পষ্ট হয় যে তিনি মূলত বিএনপির পক্ষে কাজ করছিলেন। ফর্মের “ফরেন প্রিন্সিপাল” (বিদেশি চুক্তিকারি) অংশে আব্দুল সাত্তারের নাম রয়েছে এবং তাকে “বিদেশি রাজনৈতিক দল” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বিদেশি চুক্তিকারি কি বিদেশি রাজনৈতিক দল কিনা তা জানাবার জন্য স্থান রয়েছে দাখিলকৃত ফর্মের এক অংশে। সেখানে ব্লু স্টার স্ট্র্যাটেজিস এলএলসি লিখেছে: “বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি, ২৮, ভিআইপি রোড, ঢাকা – ১২০৫, বাংলাদেশ।”
নথি থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়, এই লবিং প্রতিষ্ঠানকে কাজের জন্য অর্থও প্রদান করা হয়েছে বিএনপির পক্ষ থেকে। নথি অনুসারে দুই বছর ধরে মোট ২ লাখ ৭৮ হাজার ৫৮২ ডলার দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ যে অর্থ প্রেরণ করা হয়েছে, তা সিঙ্গাপুরে অবস্থিত ওভারসিস-চাইনিজ ব্যাংকিং কর্পোরেশন লিমিটেডের একটি এ্যাকাউন্ট থেকে পাঠানো হয়েছে। তবে ব্লু স্টার স্ট্র্যাটেজিস আবার বিএনপির লবিং-এ সহায়তার জন্য রাস্কি পার্টনার্স নামে আরেকটি লবিং ফার্মকে সাব-কন্ট্রাক্টর হিসেবে চুক্তিবদ্ধ করে। চুক্তির অংশ হিসেবে রাস্কি পার্টনার্সকে ৮৬ হাজার ৬২৭ ডলার প্রদান করে ব্লু স্টার স্ট্রেটজিস।
২০২১ এর মার্চে ব্লু স্টার স্ট্র্যাটেজিস জানায় যে বিএনপির পক্ষে প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ এর সেপ্টেম্বর থেকে আর কাজ করছে না। এর কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করে যে “বিদেশি চুক্তিকারি পক্ষ [বিএনপি] পাওনা অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে।”
২০১৮ সালে রাস্কি পার্টনার্স ইমেইলে পাঠায় একজন সাংবাদিকের কাছে, যিনি বর্তমানে নেত্র নিউজে কর্মরত। ইমেইল থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে রাস্কি পার্টনার্স বিএনপির পক্ষে কাজ করছে বলেই জানত। রাস্কি’র ওই কর্মকর্তা ইমেইলে লেখেন, “আমি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের পক্ষে কাজ করি”, এবং আরও লেখেন, “হুমায়ুন কবির — বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য, ইন্টারন্যাশনাল এ্যাফেয়ার্স সেক্রেটারি ও এ্যাক্টিং চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা — ওয়াশিংটন ডিসিতে সফরে আসবেন এই সপ্তাহে। আমি তার সাথে আপনার যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারি।”
২০১৫ সালের জানুয়ারিতে আকিন গাম্প স্ট্রাউস এ্যান্ড ফেল্ড এলএলপি নামের একটি প্রতিষ্ঠান আইনজীবী টোবি ক্যাডম্যানের কাছে একটি প্রস্তাব পাঠায়। প্রস্তাবে বলা হয়, “আকিন গাম্প বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টিকে (‘বিএনপি’) ওয়াশিংটন ডিসিতে সহায়তা দেবার প্রস্তাব করছে। নিম্ন বর্ণিত আইনি সেবা (যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে নীতি পর্যালোচনা) প্রদানের মাধ্যমে এই সহায়তা দেয়া হবে।” তারা আরও বলে যে তাদের সেবায় অন্তর্ভুক্ত থাকবে “বিএনপি ও ওয়াশিংটনের রাজনীতিবিদদের মাঝে আলোচনার ব্যবস্থা করা (আলোচনার মধ্যে আসন্ন নির্বাচনের বিষয়টিও থাকবে)। এছাড়া বাংলাদেশের চলমান যুদ্ধাপরাধ বিচার, বাণিজ্য নীতি ও বাণিজ্য সম্পর্ক, বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন, এবং বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সার্বিক সম্পর্ক বিষয়ে লবিংয়ের কাজও এর অংশ হিসেবে করা হবে।”
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই প্রতিষ্ঠান একটি নথি দাখিলের মাধ্যমে নিশ্চিত করে যে তারা বিএনপির পক্ষে একটি “আনুষ্ঠানিক লিখিত চুক্তির” ভিত্তিতে কাজ করছে। টোবি ক্যাডম্যানের কাছে পাঠানো প্রস্তাবটি দুই পক্ষের মধ্যে সম্মতিসূচক চুক্তির দলিল হিসেবে তারা সংযুক্ত করে।
দাখিলকৃত নথিতে দেখা যায়, এই লবিং প্রতিষ্ঠান ছয় মাসের কাজ নিয়েছিল। তাদের পাঠানো প্রস্তাবনায় বলা হয়, প্রতি মাসে বিএনপির পক্ষ থেকে ৪০ হাজার ডলার দেয়াড় কথা থাকলেও, প্রতিষ্ঠানটির দাখিল করা নথিতে বলা হয়েছে কোন অর্থই প্রদান করা হয়নি। তাদের জমা দেয়া নথিপত্রের সংযুক্তিতে বিদেশি গ্রাহকের কাছ থেকে গৃহীত সব অর্থ তালিকা করা হয়েছে, সেখানে লেখা হয়েছে: “বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি: শূন্য।“ ক্যাডম্যান নেত্র নিউজকে জানিয়েছেন এই চুক্তি “কার্যকর হয়নি”, অর্থাৎ বিএনপি চুক্তিতে উল্লেখিত অর্থ দেয়নি।
২০০৭ সালে, জরুরি অবস্থা জারি থাকাকালীন যখন বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয় দলই ক্ষমতার বাইরে ছিল, সেসময় বিএনপি পিলসবরি উইনথ্রপ শ পিটম্যান এলএলপিকে নিযুক্ত করে “বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সরকার ফিরিয়ে আনার কাজে সাহায্য ও নির্বাচন অনুষ্ঠান তরান্বিত করার” উদ্দেশ্যে।
যিনি নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সাথে (পিলসবরি) কাজ করেন তার নাম ও উপাধির স্থানে ফর্মে খালেদা জিয়ার নাম উল্লেখ করেছে পিলসবরি।
পিলসবরিকে মোট ১ লক্ষ ৬০ হাজার ডলার প্রদান করে বিএনপি।
উল্লেখ্য, ২০০৫ থেকে ২০০৭ সাল সময়কালে আওয়ামী লীগ মোট ৯ লাখ ডলার যুক্তরাষ্ট্রে লবিং করতে ব্যয় করে। ৩ লক্ষ ৬০ হাজার ডলার ২০০৫ সালে, ৩ লক্ষ ৬০ হাজার ডলার ২০০৬ সালে, এবং ১ লক্ষ ৮০ হাজার ডলার ২০০৭ সালে।
একই বছর, ২০০৭ সালে, করভিস কমিউনিকেশনস বিএনপির পক্ষে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে, কিন্তু এর জন্য তারা বিএনপির কাছ থেকে কোন পারিশ্রমিক পায়নি।
কাজেই বিএনপি “কোন লবিস্ট নিয়োগ করেনি” বলে মির্জা ফখরুল যে দাবি করেছেন সঠিক নয়। শুধুমাত্র নিয়োগই নয়, বিএনপি মোট ৪ লক্ষ ৪৮ হাজার ৫৮২ ডলার পরিশোধ করেছে। এর পরিমাণ আরও বেশি হতো, যদি তারা লবিং প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে তাদের সব পাওনা পরিশোধ করতো।
বিএনপির লবিং-এর বিস্তারিত তথ্য পরীক্ষা করলে দেখা যাচ্ছে যে সরকারের পক্ষ থেকে যতখানি দাবি করা হয়েছে সে তুলনায় বিএনপির লবিং এ ব্যয় করা অর্থের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কম। সরকার দাবি করেছে বিএনপি মোট ৩.৭৫ মিলিয়ন (৩০ লাখ ৭৫ হাজার) ডলার লবিং বাবদ খরচ করেছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বিরোধীদল থাকাকালীন সময়ে লবিং-এর পেছনে বিএনপি মোট খরচ করেছে ৪ লক্ষ ৪৮ হাজার ৫৮২ ডলার, যা পরিমাণে সরকারের দাবির আট গুন কম। আওয়ামী লীগ নিজেই ২০০৫-০৭ সালে বিরোধী দলে থাকাকালীন এর দ্বিগুণ অর্থ — ৯ লাখ ডলার — ব্যয় করেছে লবিং এ।
জামায়াতে ইসলামী: বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সরাসরি কোন লবিং প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ করেনি। নিউ ইয়র্কে অবস্থিত ও নিবন্ধিত সংগঠন অর্গানাইজেশন ফর পিস এ্যান্ড জাস্টিস (ওপিজে) দু’টি লবিং প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দিয়েছিল। লবিং প্রতিষ্ঠানগুলোর দাখিলকৃত নথি থেকে জানা যায় যে ওপিজে জামায়াতে ইসলামীর একটি সংগঠন। “জামায়াতে ইসলামী দলের সহমর্মি ব্যক্তিরা অর্গানাইজেশন ফর পিস এ্যান্ড জাস্টিস, ইঙ্ক-এর ডিরেক্টর হিসেবে আছেন। এর লক্ষ্য হলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গঠিত ও সরকারের প্রভাবে পরিচালিত একটি ট্রাইব্যুনালে বিচারের হাত থেকে দলের সদস্যদের রক্ষা করা,” দাখিলকৃত একটি নথিতে বলা হয়েছে।
২০১৮ সালে ওপিজে হাশ ব্ল্যাকওয়েল এলএলসিকে নিয়োগ করে। নিয়োগের উদ্দেশ্য ছিল “যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় নীতি, যা বর্তমানে বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্র, উন্নয়ন, এবং মানবাধিকারের উপস্থিতি চায়, তা যেন কোনভাবেই এমনভাবে পরিবর্তিত না হয় যা জামায়াতে ইসলামীর স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়, বা রাষ্ট্রীয় নীতি এমনভাবে পরিবর্তিত না হয় যার ফলে জামায়াতে ইসলামীকে বাংলাদেশে বা আন্তর্জাতিকভাবে নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে দেখার মতো পরিবেশ তৈরি হতে পারে।” যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে জমা দেয়া নথি থেকে দেখা যায় যে তারা জামায়াতের পক্ষে কাজ করছিল, যেহেতু তারা নিজেদের “বিদেশি রাজনৈতিক দল” হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
ওপিজে পাঁচ মাসের কাজের জন্য হাশ ব্ল্যাকওয়েল এলএলসিকে ৫৫ হাজার ডলার দেয়।
২০১৪-১৭ ওপিজে ক্যাসিডি এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েটসকে নিয়োগ করে, যারা তাদের লবিং কাজের অংশ হিসেবে “বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে বিভিন্ন শিক্ষামূলক বৈঠক সম্পাদন করেছে এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গঠিত ও সরকারের প্রভাবে পরিচালিত একটি ট্রাইব্যুনালে বিচার হওয়া ও মৃত্যুদণ্ড থেকে জামায়াতে ইসলামীর সদস্যদের রক্ষা পেতে সহায়ক হয় এমন কৌশলী পরামর্শ দিয়েছ।” ওপিজে এই কাজের জন্য ক্যাসিডি এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েটসকে মোট ২ লাখ ৮৫ হাজার ৯৫২ ডলার প্রদান করে (২০১৪ সালের এপ্রিল থেকে জুন সময়ে ৫০ হাজার ডলার, ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই তারা ৭৫ হাজার ৯১৫ ডলার, ২০১৫ সালের আগস্ট থেকে ২০১৬ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ৫০ হাজার ৩৭ ডলার, এবং ২০১৬ সালের বাকি কাজের জন্য তারা ১ লক্ষ ১০ হাজার ডলার খরচ করে)। ক্যাসিডি এই কাজে সাহায্যের জন্য ক্লোকরুম এ্যাডভাইজার নামক আরেকটি প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি করে।
২০১১ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে এই একই আইনি প্রতিষ্ঠান ক্যাসিডি এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েটসকে মীর মাসুম আলী মোট ৩ লক্ষ ৭০ হাজার ডলার প্রদান করেন। উদ্দেশ্য ছিল, “বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও বিরোধী দল সংক্রান্ত বিষয়ে” লবি করা। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মীর মাসুম আলী আবার মুসলিম উম্মাহ অফ নর্থ আমেরিকা নামক একটি সংগঠনের মিডিয়া ও পাবলিকেশন্স বিষয়ক প্রকল্প পরিচালক। এই সংগঠনে জামায়াতে ইসলামীর যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সমর্থকদের দেখা যায়। মীর মাসুম আলী একই সাথে জামায়াতে ইসলামী নেতা মীর কাসেম আলীর আপন ভাই। মীর কাসেম আলী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত ও দণ্ডিত হন। মাসুম ২০১১ সালে ২ লক্ষ ১০ হাজার ডলার, ২০১২ সালে ১ লক্ষ ৪০ হাজার ডলার, এবং ২০১৩ সালে ২০ হাজার ডলার ক্যাসিডি এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েটসকে প্রদান করেন।
২০১১ সালে ইন্সটিটিউট ফর ইউএস-বাংলাদেশ রিলেশনস ক্যাসিডি এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েটসকে নিয়োগ করে ও ২ লাখ ১০ হাজার ডলার প্রদান করে। তবে এই সংগঠনের জামায়াতের সাথে কোন ধরনের সম্পর্ক রয়েছে বলে আমরা পাইনি।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে দাখিলকৃত তথ্যের ভিত্তিতে দেখা যাচ্ছে যে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক জামায়াত সমর্থক সংগঠনগুলো লবিং করতে মোট ৭ লক্ষ ১০ হাজার ৯৫২ ডলার খরচ করেছে। উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকার অসত্য অভিযোগ করেছিল যে জামায়াত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বিরুদ্ধে লবিং করতে ২৫ মিলিয়ন (আড়াই কোটি) ডলার খরচ করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধিনিষধ
তবে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর এ বক্তব্য সঠিক যে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া লবিং এর জন্য বাংলাদেশ থেকে অর্থ প্রদান করে থাকলে তা হবে আইন লঙ্ঘনের শামিল। কারণ, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অর্থ স্থানান্তরের ক্ষেত্রে আইনি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বিএনপির পক্ষে লবিং বাবদ যা খরচ হয়েছে সেই অর্থের উৎস অজানা।
তবে এখানে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে ব্লু স্টারকে ২০১৮-১৯ সালে দেয়া অর্থ (২ লাখ ৭৮ হাজার ৫৮২ ডলার) দিয়েছিলেন যুক্তরাজ্য নিবাসী ব্যক্তি আব্দুল সাত্তার। যদিও তিনি এই চুক্তি করা ও অর্থ প্রদানের কাজ বিএনপির পক্ষে করেছিলেন বলেই ধারনা করা যায়, কিন্তু এর থেকে মনে হয় যে অর্থ প্রদান করা হয়েছিল বাংলাদেশের বাইরে থেকে। নথি থেকে দেখা যায় যে দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ দেয়া হয়েছিল সিঙ্গাপুরের ওভারসিস-চাইনিজ ব্যাংকিং কর্পোরেশন লিমিটেডের একটি এ্যাকাউন্ট থেকে।
যদি লবিং এর অর্থ বিদেশ থেকে দেয়া হয়ে থাকে এবং বাংলাদেশ থেকে কোন অর্থ অবৈধভাবে স্থানান্তরিত না হয়ে থাকে তবে লবিং এর খরচ প্রদানে কোন আইন লঙ্ঘন হয়নি।
২০০৭ সালের ১ লাখ ৬০ হাজার ডলারের যে খরচ দেয়া হয়েছে তার চুক্তিতে সরাসরি বিএনপির বাংলাদেশের ঠিকানা উল্লেখ করা ছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অর্থ কোন দেশ থেকে দেয়া হয়েছে তার তথ্য নেই। যদি বাংলাদেশ থেকে পাঠানো হয়ে থাকে তবে তা বিএনপির জন্য আইনি সমস্যার কারণ হবে।
জামায়াতের ক্ষেত্রে যেসব ব্যক্তি বা সংগঠন লবিং প্রতিষ্ঠান নিয়োগে জড়িত ছিল তারা সাবই বাংলাদেশের বাইরে অবস্থিত বলেই বোঝা যায়। এখান থেকে ধারনা করা স্বাভাবিক যে, সব অর্থও সম্ভবত বাংলাদেশের বাইরে থেকেই প্রদান করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউট সরকারের পক্ষে লবিং-এর জন্য যে ৩৫ হাজার ডলার খরচ করেছে, সে ক্ষেত্রেও একই বিধিনিষেধ প্রযোজ্য। ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠানটি কোনওয়্যাগো কনসাল্টিং এলএলসিকে এই অর্থ দেয়, যা কিছুদিন আগে নেত্র নিউজ প্রকাশ করেছে।
আর্থিক লেনদেন নিরীক্ষণ
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর এ বক্তব্যও সঠিক যে বিদ্যমান আইনের অধীনে রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচন কমিশনের কাছে তাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব দিতে হয়।
তবে এই আইন বলবত হয়েছে ২০০৮ সালে এবং পূর্ববর্তী বছরের জন্য এই আইন প্রযোজ্য নয়। এর আগে লেনদেনের হিসাব জমা দেবার এধরনের কোন আইনি বাধ্যবাধকতাও ছিল না। অর্থাৎ বিএনপি ২০০৭ সালে পিলসবরি উইনথ্রপ শ পিটম্যান এলএলপিকে যে অর্থ দিয়েছে সেক্ষেত্রে ৯(খ) ধারা প্রযোজ্য হবে না। তবে আগস্ট ২০১৮ তে ব্লু স্টার স্ট্র্যাটেজিস/রাস্কিকে প্রদেয় অর্থের ক্ষেত্রে এই আইন প্রযোজ্য হবার সম্ভাবনা আছে।
জামায়াতের পক্ষের সব লবিং যেহেতু ২০০৮ সালের পর ঘটেছে, সেহেতু ৯(খ) ধারার বিধান তাদের সব লবিং সংক্রান্ত খরচের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রেও তাদের ক্ষেত্রে এই আইন প্রয়োগযোগ্য থাকবে না ২০১৩ সালের সাল থেকে, যেহেতু সেবছর হাইকোর্ট রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে।
২০০৮ সালের ওই আইনে লেনদেনের হিসাবের বিষয়ে কোন হিসাব দিতে হবে এবং কি ধরনের হিসাব অন্তর্ভুক্ত হবে না তার বিস্তারিত বলা নেই।তবে দেশের বাইরে কোনো ব্যাক্তি বা সংগঠনের ব্যয় করা অর্থের হিসাব এই বিধানের আওতায় না পড়াই স্বাভাবিক।
সেক্ষেত্রে বিএনপি বা জামায়াত কাউকেই লবিং-এর খরচ দেখাবার বাধ্যবাধকতা নেই। তবে যদি প্রমাণ করা যায় যে দেশ থেকে সরাসরি অর্থ পাঠানো হয়েছে সেক্ষেত্রে আইন লঙ্ঘনের প্রশ্ন আসতে পারে।
নেত্র নিউজ বিএনপির কাছে লবিং নিয়ে এসব তথ্যের বিষয়ে, এবং কিভাবে এই অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে সে বিষয়ে তাদের মন্তব্য জানতে চাইলে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “আমরা বিএনপির পক্ষ থেকে লবিস্ট নিয়োগ দেব এমন কোন সিদ্ধান্ত নেইনি।”
আমরা জানতে চাই বিএনপির পক্ষে লবিস্ট নিয়োগ সেক্ষেত্রে কিভাবে হয়েছে। খসরু এর উত্তরে বলেন: “প্রত্যেক দেশপ্রেমী এবং স্বাধীনতা প্রিয় বাংলাদেশি নাগরিক নিজেদের মুক্তির পক্ষে একজন লবিস্ট এবং নিজেদের মতো করে যা তারা পারে করছে। তবে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং বাংলাদেশের নিরাপত্তায় বিশ্বাসী যেকোনো দেশ ও আন্তর্জাতিক সংগঠনের সাথে কাজ করার মাধ্যমে বিএনপি দেশের জনগণের প্রতি তাদের যে নৈতিক দায়িত্ব আছে তা পালন করে যাবে।”●
* প্রথম প্রকাশিত হয়েছে ইংরেজিতে, ২৮ জানুয়ারী ২০২২