জাতীয় নির্বাচন ও মার্কিন নিষেধাজ্ঞা
সম্প্রতি ওয়াশিংটনে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি সরিয়ে নেয়, যেখানে দাবি করা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির প্রভাবশালী চেয়ারম্যান গ্রেগরি মিকস র্যাবের উপর আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে নেতিবাচকভাবে কথা বলেছেন। এ বিষয়ে নেত্র নিউজে একটি সংবাদও প্রকাশিত হয়।
একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সেটি ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে ফেলাটা নিঃসন্দেহেই বাংলাদেশ দূতাবাসের জন্য বিব্রতকর। অবশ্য একই সংবাদ বিজ্ঞপ্তি এখনও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ঝুলছে। কিন্তু পুরো বিষয়টি কেবল বিব্রত হওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি।
একদিন পরই কংগ্রেস্ম্যান গ্রেগরি মিকস নিজেই আনুষ্ঠানিক বিবৃতি প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ সরকার তাকে যেভাবে উদ্ধৃত করেছিল ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে, নিজের বিবৃতিতে ঠিক বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করেন মিকস। শুধু তাই নয়, র্যাবের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে যে আগামী নির্বাচনেরও সম্পর্ক রয়েছে, তার একটি আভাসও পাওয়া যায় ওই বিবৃতি থেকে।
আওয়ামী লীগ সরকার গত কয়েক বছরে ক্রমশই কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠলেও কূটনৈতিকভাবে সেরকম কোনো মূল্য সরকারকে এখন পর্যন্ত দিতে হয়নি। সুষ্ঠু নির্বাচনের চর্চা বিলুপ্ত করে, বিরোধী দলগুলোকে দমিয়ে রেখে ক্ষমতায় টিকে থাকা এই সরকারের শাসনামলকে অনেকেই একদলীয় হিসেবে আখ্যা দেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও, পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলো তেমন জোর ভূমিকা নেয়নি। এমনকি ব্যাপকভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের মতো ঘটনা ঘটলেও পশ্চিমা দেশগুলো তেমন সোচ্চার হয়নি।
পশ্চিমা দুনিয়ার এই রাজনৈতিক অবস্থানের পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ ছিল। ভৌগলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ একটি মুসলিম-প্রধান রাষ্ট্র। এই দেশকে রাজনৈতিক ইসলামের প্রভাবমুক্ত রাখার ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগের বিশেষ প্রচেষ্টা ছিল। এসব বিষয় পশ্চিমা দেশগুলো মাথায় রেখেছে। পাশাপাশি, বাংলাদেশের চলমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও একটি কারণ। বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে দারিদ্র্য কমে এসেছে, সামাজিক বিভিন্ন সূচকে উন্নয়ন ঘটেছে। এছাড়াও ২০১৭ সালে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। ফলে এই সরকার যেন অসন্তুষ্ট না হয়, সেই বিষয়ে পশ্চিমা সরকারগুলো সতর্ক ছিল।
আওয়ামী লীগ সরকারও পশ্চিমা সরকারগুলোর এই অবস্থান সম্পর্কে সচেতন। এ কারণেই আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, একেবারে যা তা করেও সরকার পার পেয়ে যাবে। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ধরেই নেয় যে আগামী নির্বাচনেও আগের মতো জালিয়াতি বা জোরজবরদস্তির মাধ্যমে যেনতেনভাবে জিতে ক্ষমতায় গেলেও উন্নত দেশগুলো না দেখার ভান করে থাকবে; বড় জোর একটি বিবৃতি দেবে।
তবে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে র্যাবকে নিশানা বানিয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তা থেকে ইঙ্গিত মিলে যে, পশ্চিমা সরকারগুলো আগের মতো চুপ থাকবে না। বাংলাদেশ দূতাবাসের দেয়া বিভ্রান্তিকর ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তির বিপরীতে গ্রেগরি মিকস যেই বিবৃতি দিলেন, তা থেকেও এই ধরণের ধারণা পোক্ত হয়েছে।
প্রথমত, চেয়ারম্যান মিকস দ্বার্থ্যহীনভাবে নিষেধাজ্ঞার প্রতি তার সমর্থন প্রকাশ করেছেন। তিনি আরও বলেছেন যে, তিনি বাংলাদেশের মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের পথে প্রতিবন্ধকতাসমূহ নিরসনের লক্ষ্যে কাজ করতে চান। যার মধ্যে দেশটির পরবর্তী নির্বাচন যেন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়, তা নিশ্চিত করাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
এই বিবৃতির পর প্রতিনিধি পরিষদের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির একজন কর্মকর্তা নেত্র নিউজকে বলেন, এ বিষয়ে চেয়ারম্যানের অবস্থান হলো, “বাংলাদেশ সরকারকে আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে, আগের নির্বাচনের মতো নয়। আমি মনে করি যে, [মিকসের] ভাবনা হলো, তেমনটা যদি না ঘটে, তাহলে আরও অনেক বেশি পরিণতি ভোগ করতে হবে, যা ট্রাম্প প্রশাসনের সময় যা হয়নি।”
এই মন্তব্যের ভিত্তিতে অনেক কিছু ধরে না নেওয়াই নিরাপদ। এছাড়া নিষেধাজ্ঞার কথা মিকসও উল্লেখ করেননি। তবে এমনটা ধরে নেয়া অযৌক্তিক নয় যে, যেসব পরিণতির বিষয়ে মিকসের কমিটির ওই কর্মকর্তা হুশিয়ারি দিয়েছেন, তার মধ্যে নিষেধাজ্ঞা থাকতেও পারে।
কোনো দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে সেই দেশের রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের নজির যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে। ২০২১ সালের নভেম্বরে নিকারাগুয়ায় কারচুপিপূর্ণ নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্র দেশটির একটি মন্ত্রণালয় ও নয় জন কর্মকর্তার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এ নির্বাচনের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র যে বিবৃতি দিয়েছে, তার বর্ণনা বাংলাদেশের ২০১৮ সালের নির্বাচনের প্রেক্ষিতে দেওয়া দেশটির বক্তব্যের সাথে মিলে যায়।
নিকারাগুয়ার ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নও দেশটির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। নিষেধাজ্ঞার পর নিকারাগুয়ার রাষ্ট্রপতি ওরতেগা শপথ নিলে, যুক্তরাষ্ট্র ফের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এই নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্যবস্তুতে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রী অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
এখন প্রশ্ন হলো, র্যাবের বিরুদ্ধে আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা কি আওয়ামী লীগ সরকারের উপর আগামী নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে আয়োজন করার বিষয়ে যথেষ্ট চাপ ফেলবে কিনা। ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে যে, মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর দেশে কোনো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে; কোনো গুমের খবরও পাওয়া যায়নি। এতে প্রমাণিত হয় যে, এই ধরণের ঘটনা বন্ধ করার ক্ষমতা সরকারের হাতে ছিল।
দৃশ্যমান এই উন্নতি সত্ত্বেও, আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য বিরোধী দলের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে এখনও সরকার প্রস্তুত বলে মনে হচ্ছে না। বিরোধী দলগুলো বলছে, আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু হবে যদি তত্বাবধায়ক সরকারের অনুরূপ কোনো ব্যবস্থা বিরাজ করে। কিন্তু নতুন নির্বাচন কমিশন বাছাই করার প্রক্রিয়া থেকে ইঙ্গিত মিলছে, এটি সরকারের নিত্যনৈমিত্তিক কান্ডকারবারের অংশ, যা থেকে কেবল নিরপেক্ষতার তকমা দেওয়া হয়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, একজন সরকারপন্থী বিচারক এই বাছাই কমিটির প্রধান ছিলেন।
তারপরও অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন যে, এই নিষেধাজ্ঞা যদি শাসক দলের নেতৃত্বের মধ্যে কোনো পরিবর্তন আনতে সক্ষম নাও হয়, তারপরও নির্বাচনের পাইকারি কারচুপি সম্পন্ন করতে পুলিশ, বেসামরিক প্রশাসন ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যেই প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থক গোষ্ঠী আওয়ামী লীগ সৃষ্টি করেছে, সেই গোষ্ঠী অন্তত এই নিষেধাজ্ঞার কারণে দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। তাদের বক্তব্য হলো, এসব প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থক গোষ্ঠীর উপর আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচন কারচুপি করতে আর নির্ভর করতে পারবে না। তবে এই বক্তব্য নিষেধাজ্ঞার প্রকৃত প্রভাবের বিষয়ে অতিমাত্রায় আশাজাগানিয়া দৃষ্টিভঙ্গি। বিশেষ করে পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে যদি গত নির্বাচনের মতো এবারও বিভিন্ন উপহারে ভরিয়ে দেয়, তাহলে তো কথাই নেই।
তবে পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে যদি অন্যান্য পশ্চিমা দেশও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলিত হয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয় যে আগামী নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ না হলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ হতে পারে।
বর্তমানে অবশ্য শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ পরিষ্কার। একদিকে কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা যাওয়ার নিশ্চিত হাতছানি। অপরদিকে ভবিষ্যতে যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ হবে, তা স্রেফ একটি শঙ্কা, যা ঘটতেও পারে, নাও ঘটতে পারে। এই সমীকরণ যদি পাল্টে না যায়, শেখ হাসিনা চোখ বন্ধ করে ক্ষমতাকে বেছে নেবেন।●
ডেভিড বার্গম্যান, (@TheDavidBergman), ব্রিটেন-ভিত্তিক সাংবাদিক — নেত্র নিউজের ইংরেজি বিভাগের সম্পাদক।