বইমেলায় “বঙ্গবন্ধু” বন্দনা

শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে শত শত বই, অথচ তার রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তকে যারা সমালোচনা করেন, তাদের বই কেউ প্রকাশ করে না।

বইমেলায় “বঙ্গবন্ধু” বন্দনা

ফেব্রুয়ারি মানেই বইমেলা। জানুয়ারি থেকেই শুরু হয় তার প্রস্তুতি। কিন্তু চলতি বছর মেলা হবে নাকি হবে না, তা নিয়ে ছিল বিস্তর শঙ্কা। অবশেষে ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা, চলবে ১৭ মার্চ পর্যন্ত। আর এ বইমেলা মানেই শেখ মুজিবুর রহমানের নামে অজস্র স্টল, শত শত বই। এবারের মেলার প্রতিপাদ্য “জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্ত”। ফলে মেলার ২৫ দিনে শেখ মুজিবুর রহমান বিষয়ক বই এসেছে প্রায় চারশো।

বঙ্গবন্ধুর বইয়ে সয়লাব মেলা

ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন হিমেল। ফি বছর বইমেলায় ঘোরাটা নেশার মতো তার। কিন্তু এবার তিনি প্রথম বইমেলায় এসেছেন ১১ তম দিনে। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গন ঘুরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একটি প্যাভিলিয়নের সামনে গেলে দেখা হয় তার সঙ্গে। কথা হয় বইমেলার নানা বিষয় নিয়ে। বাংলা একাডেমিকে আওয়ামী লীগের কীর্তনমেলা বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তার ভাষ্য, “বাংলা একাডেমির বইমেলাকে আমার মনেই হয়নি এটা কোন বইমেলা, এ যেন আওয়ামী লীগের কীর্তনমেলা। যুবলীগ বা স্বেচ্ছাসেবকলীগের এমন কোন কাজ নেই যার জন্য মেলায় তাদের স্টল নিতে হবে! অথচ বাংলা একাডেমির মেলা মানেই মূল মেলা ছিল এক সময়। মানুষকে বঙ্গবন্ধু নিয়ে জানাতে গিয়ে যদি বিরক্ত করে ফেলে তাহলে আসলে হিতে বিপরীত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুকে আমরা ভালোবাসি, সম্মান করি মানেই বিরক্ত হতে হবে তা কিন্তু নয়।”

হিমেলের মতো আরেকজন পাঠকের সঙ্গেও কথা হয় নেত্র নিউজের। তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জাতিসত্ত্বার অংশ, স্বাধীনতার স্থপতি সব ঠিক আছে কিন্তু তাকে নিয়ে যে বইগুলো প্রকাশ হচ্ছে তা মূলত দালালরা করছে। এই বইগুলোর মধ্যে গবেষণা ও শ্রদ্ধা নেই।”

তিনি বলছেন, “বাঙালী মুসলমানের সবচেয়ে বড় সমস্যা ইতিহাস চর্চা না করা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অদক্ষ ও প্রায় অশিক্ষিত শিক্ষক দিয়ে চলছে, কলোনিয়াল প্যারাডাইম ও সাম্প্রদায়িক প্যারাডাইমকে কপি পেস্ট করে পিএইচডি করে যাচ্ছে। এদের কাছ থেকে যা আসে তা চর্বিত চর্বণ, গবেষণাধর্মী কোন ইতিহাসের বই আমরা পাচ্ছি না। ফলে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ভুল ইতিহাস জেনে বেড়ে উঠছে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এসব লেখালেখি করে সরকারি সুবিধা আদায় করতে না পারলে তারা লিখত না।”

২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ৩১ মার্চ সময়কে মুজিববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করে বাংলাদেশ সরকার। গত বছর তাই মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রকাশনা সংস্থাগুলোর আয়োজনে অন্যতম প্রধান বিষয়বস্তু হিসেবে পর্যবসিত হয় “বঙ্গবন্ধু”। চলতি বছরের প্রতিপাদ্যও শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ। এমনিতেই বিগত কয়েক বছরে বইমেলায় হরেদরে প্রকাশ পেয়েছে শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কিত বই। বিশেষ করে বাংলা একাডেমি ও তাম্রলিপির “বঙ্গবন্ধু” নিয়ে আয়োজন চোখে পড়ার মতো। তবে ঐতিহ্য, আগামী, ইত্যাদি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যাও কম নয়।

মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রকাশিত বইগুলোকে “ভুয়া” বলে মন্তব্য করেন এক লেখক। তিনি বলেন, এসব বইয়ে গবেষণা না করে লেখকদের মধ্যে অন্যের তথ্য চুরি করার প্রবণতাই বেশি। অনেকের তথ্যই একে অন্যের সাথে হুবহু মিলে যায়।

“তথ্যঋণ স্বীকার করছে না লেখক”

শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা সব বই ভুয়া এমন দাবি মানতে নারাজ প্রকাশকরা। নিজ নিজ প্রকাশনার বইয়ের তথ্য যাচাই বাছাই করেই প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন বলে জানান তারা। তবে অন্য প্রকাশনার বইয়ের ব্যাপারে মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে তাদের।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন প্রকাশক জানান, গবেষণা একটি শ্রমসাধ্য ব্যাপার। দীর্ঘদিন গবেষণার ফলেই একটি ঐতিহাসিক ঘটনা বা ব্যক্তি সম্পর্কিত বই প্রকাশ সম্ভব। ‌এটি তৎক্ষণাৎ নিয়ে ফেলার মতো কোন সিদ্ধান্ত নয়। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে প্রকাশিত বই ভুলে ভরা। পাঠক যারা শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে আগ্রহী তারা তালিকার ওপর নির্ভর করেই বই কেনেন। বই অন্তসারশূন্য হলে বিভ্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

লেখকদের মধ্যে তথ্যসূত্র উল্লেখ না করার প্রবণতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। এক্ষেত্রে তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে পাঠকদের মধ্যে প্রশ্ন তৈরি হয় বলেই তার ধারণা।

ভিন্নমতের লেখকদের বই নেই

শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে শত শত বই, অথচ তার রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তকে যারা সমালোচনা করেন, তাদের বই কেউ প্রকাশ করে না। এছাড়াও বইমেলা প্রাঙ্গনে লেখক হত্যা, স্টল বন্ধ, নিজ অফিসে প্রকাশক খুন, বিভিন্ন স্থান থেকে লেখকদের আটক ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছে বলেও মনে করেন অনেকে। এছাড়াও বইমেলায় সরকার দলীয় নানা সংগঠন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বইয়ের বিষয়বস্তু পরীক্ষা করা নিয়েও ক্ষোভ রয়েছে মেলায় দর্শনার্থীদের।●