ফেসবুককে নিজেদের সেন্সরশিপ যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে বাংলাদেশ সরকার
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কী প্রকাশ করা যাবে বা কোন ধরনের পোস্ট করা যাবে, তার উপর কঠোর সীমাবদ্ধতা আরোপ করে নতুন একটি খসড়া নীতিমালা এনেছে বাংলাদেশ সরকার।
গত ২ মার্চ, বুধবার, জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ প্রসঙ্গটি উঠলে ৩৫টি দেশ এর পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকে। অর্থাৎ এই প্রসঙ্গে তারা কোনও অবস্থান নিতে চায় না বা মন্তব্য করতে চায় না। এই ৩৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। যদিও অনেকেই হয়তো আশা করতে পারেন যে, বাংলাদেশ নিজে যেহেতু একটি স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে গেছে, অতএব নিজের সেই অভিজ্ঞতা থেকেই ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব রক্ষার পক্ষে অবস্থান নেবে দেশটির সরকার। কিন্তু রাশিয়াকে নিজের পক্ষে রাখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে আওয়ামী লীগের, আর সেই কারণেই দৃশ্যত রাশিয়ার আক্রমণের বিপক্ষে যায়নি বাংলাদেশ।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে রাশিয়া সম্পৃক্ততা এবং ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জ্বালানি প্রকল্পে রাশিয়ার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি তো আছেই। পাশাপাশি, কর্তৃত্ববাদী রাশিয়ার যে একটি অগণতান্ত্রিক বাংলাদেশকে মেনে নিতে কোনো অসুবিধা নেই, সেই বিষয়টিও মাথায় রেখেছেন হাসিনা। বিশেষত, আসন্ন (পাতানো) দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রেক্ষিতে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে রাশিয়ার এই সমর্থন। আর এই কারণেই অন্যান্য কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র, যারা আওয়ামী লীগের ক্রমবর্ধমান স্বৈরাচারকে সমর্থন দেয়, তাদের প্রতি আওয়ামী লীগ সরকারের পাল্টা সমর্থনে অবাক হওয়ার তেমন কোনও কারণ নেই। ঠিক যেমন চীনে উইঘুর গণহত্যার অভিযোগ নিয়ে টুঁ শব্দটিও উচ্চারণ করেনি আওয়ামী লীগ সরকার।
আমাদের এই লেখা কিন্তু ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে নয়। বরং উপরের দুই অনুচ্ছেদে বিষয়টি নিয়ে আমরা এতক্ষণ যা বললাম এই ধরনের সমালোচনামূলক পোস্ট বা মন্তব্য যদি বাংলাদেশে বসবাসকারী কেউ ফেসবুকে প্রকাশ করতে চায় সেক্ষেত্রে কী ঘটবে — তা নিয়ে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করা খুব জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন? কারণ সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার একটি নতুন নীতিমালার প্রস্তাবনা আলোচনার জন্য প্রকাশ করেছে, যার শিরোনাম “বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন রেগুলেশন ফর ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া এ্যান্ড ওটিটি প্ল্যাটফর্মস”। তো কী আছে প্রস্তাবিত এই নীতিমালায়? এই নীতিমালার অধীনে ফেসবুক তাদের যেকোনও বাংলাদেশি ব্যবহারকারীকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানাবে যে “বন্ধুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব হুমকির মুখে পড়ে” বা “বিদেশি কোনও রাষ্ট্রের প্রতি অবমাননা প্রকাশ পায়” এমন কোনও কিছু বাংলাদেশের একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী “ডিসপ্লে” (প্রদর্শন), “আপলোড” (অনলাইনে উত্তোলন), “প্রকাশ” বা “শেয়ার” করবেন না। খসড়া নীতিমালার ভাষা যদিও বেশ অগোছালো, তবে যতটুকু বোঝা যাচ্ছে তাতে মনে হয় যে এই নীতিমালা অনুযায়ী এধরনের যেকোনও কন্টেন্ট সরিয়ে দিতে বাধ্য থাকবে ফেসবুক।
এখন আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে এই নিবন্ধের প্রথম অংশে আমরা যা যা আলোচনা করেছি, সেসব হয়তো এই নীতিমালায় নিষিদ্ধকৃত বিষয়ের অধীনে পড়বে না। কিন্তু ব্যাপারটা একেবারেই তা নয়। আপনাদের হয়তো মনে আছে, ২০২১ সালের মার্চ মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে আসেন এবং ওই সময় মোদির সমালোচনা করে ফেসবুকে লেখার জন্য সরকার কয়েকজনকে গ্রেফতারও করে। তাদের গ্রেফতারের কারণ হিসেবে বাংলাদেশ সরকার জানায় যে তাদের প্রকাশিত মন্তব্যের ফলে “আইন শৃঙ্খলার অবনতি” ঘটতে পারে। আর নরেন্দ্র মোদির সফরের সমালোচনা যদি “আইন শৃঙ্খলার” জন্য হুমকি হয়ে থাকে, তাহলে ইউক্রেন প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান এবং বর্তমান সরকারের প্রতি রাশিয়ার সমর্থনের সমালোচনাও নির্দ্বিধায় রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের “বন্ধুত্ব হুমকির মুখে ফেলা” বা “বিদেশি কোনও রাষ্ট্রের প্রতি অবমাননা” হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
এখানেই শেষ নয়। নতুন এই নীতিমালার একটি বিধির দিকে তাকালেই এর প্রকৃত স্বরূপটি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এই বিধির অধীনে ফেসবুক তাদের ব্যবহারকারীদের এমন কোনও কিছু পোস্ট বা শেয়ার করা নিষিদ্ধ করবে যা “অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা তৈরি করে বা আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় বা অবনতি ঘটানোর কাজ অগ্রসর করে।” এই একই কারণ দেখিয়ে মোদির সমালোচকদেরও গ্রেফতার করা হয়েছিল ২০২১ সালে।
কিন্তু খসড়া নীতিমালা এখানেই থামেনি। এই তিনটি কারণের বাইরেও নীতিমালায় নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়বস্তুর আরো বিস্তারিত একটি তালিকা রয়েছে। অর্থাৎ ফেসবুক ব্যবহারকারীরা আর কী কী প্রকাশ বা পোস্ট করতে পারবেন না, সেসমস্ত বিষয়বস্তু নিয়েই এই তালিকা। কী কী আছে সেই তালিকায়? এমন যেকোনও কন্টেন্ট যা:
— মানহানিকর
— অশ্লীল বা পর্নোগ্রাফিক
— অন্যের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করে (শারীরিক গোপনীয়তা অন্তর্ভুক্ত)
— লিঙ্গের ভিত্তিতে অপমানজনক বা হয়রানিমূলক
— কোনও জাত বা গোত্রের জন্য আপত্তিকর
— শিশুদের জন্য ক্ষতিকর
— শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে
— কোনও অপরাধের তদন্ত বিঘ্নিত করে
— বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে
— জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত, বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে
— কোনও ব্যক্তির জন্য আপত্তিকর, হুমকি এবং অপমান বা অবমাননামূলক
— ধর্মীয় মূল্যবোধ বা আবেগকে আহত করে
— সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা, বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে
— সরকারের গোপনীয়তা লঙ্ঘন করে।
এখন প্রশ্ন হলো, সরকার এই তালিকার কোনও একটির অধীনে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে না, এমন কোনও কিছু কি আদৌ লেখা সম্ভব?
ধরা যাক, সরকার গোপন করতে চায় এমন অপ্রকাশিত বা গোপনীয় কোনও নথি বা তথ্য নিয়ে লেখা হলো। তবে কি তা “সরকারের গোপনীয়তা লঙ্ঘন” এর আওতায় পড়বে না?
কিংবা কোনও ব্যক্তির সমালোচনা করা হলো, বিশেষত কোনও রাজনীতিবিদের। সেক্ষেত্রে সেই সমালোচনামূলক পোস্ট বা মন্তব্য “কোনও ব্যক্তির জন্য আপত্তিকর, হুমকি এবং অপমান বা অবমাননামূলক”-এর অধীনে পড়েছে — এমনটা কি সরকার বলবে না? এই প্রশ্ন তোলার কারণ হলো, এর আগে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন (২০০৬) এবং পরবর্তিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (২০১৮)-এর অধীনে অসংখ্য ব্যক্তিকে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সমালোচনা করার জন্য গ্রেফতার করা হয়েছে।
এরপর ধরা যাক, সরকারের গৃহীত কোনও নীতির সমালোচনা করে কোনও লেখা প্রকাশ করা হলো ফেসবুকে। তখন সরকার খুব সহজেই এই ধরনের পোস্টদাতার বিরুদ্ধে “শৃঙ্খলা বিঘ্নিত” করার অভিযোগ তুলতে পারবে, তাই নয় কি?
একটা ব্যাপার কিন্তু মনে রাখা জরুরি: সামনেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। আর নতুন এই নীতিমালা যদি অনুমোদন পায় তবে খুব সহজেই কল্পনা করা যায় যে, আসন্ন এই নির্বাচন নিয়ে কোন কোন বিষয় নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বে এবং ফেসবুককে তা প্রকাশে বাধা দিতে হবে।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, কোনও পোস্ট এই বিশাল তালিকার অধীনে প্রকাশযোগ্য না কি অপ্রকাশযোগ্য, সেটা ফেসবুক নির্ণয় করবে কিভাবে?
আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, এই সম্পর্কে নীতিমালায় কোনও স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। আসলে এই নীতিমালা দিয়ে বাংলাদেশ সরকার চাচ্ছে ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সরকারের পক্ষে সেন্সরশিপ আরোপের যন্ত্র হিসেবে কাজ করুক। কেননা নিষেধাজ্ঞা আরোপের সুবিশাল এই তালিকা সম্পর্কে সরকার কোনও ব্যাখ্যা দেয়নি। এমনকি ফেসবুক এই তালিকার বিষয়বস্তু কিভাবে যাচাই বা প্রয়োগ করবে, সে বিষয়েও এতে কোনও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া নেই।
তবে আশার কথা হলো, পৃথিবীর কোনও স্বাধীন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সরকারের এই আবদার মেনে নেবে, তেমন সম্ভাবনা নেই। বাকস্বাধীনতা রক্ষায় বর্তমান সরকারের কোনও সুনাম না থাকলেও, এই নীতিমালার বিধিগুলোর কোনও ব্যাখ্যা বা ন্যায্যতা সমর্থন করে কোনও যুক্তি পেশ না করাটা আওয়ামী লীগ সরকারের নিজেদের তুলনাতেও বিশেষ বেপরোয়া।
ফেসবুকে কোন ধরনের কন্টেন্ট প্রকাশ করা যাবে বা যাবে না, তার যুক্তিযুক্ত ও ন্যায্য সীমারেখা অবশ্যই রয়েছে, এবং আইনের মাধ্যমে তা আরোপ করতে কোনো অসুবিধা নেই। সরকারের দায়িত্ব হলো, সেসব বিষয়ে পরিষ্কারভাবে চিন্তা করা এবং এধরনের সীমারেখা আরোপের ক্ষেত্রে মত প্রকাশে যতটুকু-না-হলেই-নয় কেবল ঠিক ততটুকু পরিমান সীমাবদ্ধতার বাইরে যেন যেতে না হয় তা নিশ্চিত করা। তা না করে, বাংলাদেশ সরকার চাইছে ফেসবুক একটি দানবীয় সেন্সর যন্ত্র হয়ে উঠুক, যা দিয়ে যেকোনও কিছুর প্রকাশ আটকে দেওয়া যায়।●
ডেভিড বার্গম্যান, (@TheDavidBergman), ব্রিটেন-ভিত্তিক সাংবাদিক — নেত্র নিউজের ইংরেজি বিভাগের সম্পাদক।
* প্রথম প্রকাশিত হয়েছে ইংরেজিতে, মার্চ ৭, ২০২২