বাংলাদেশের অনারারি কনসাল পদে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা-প্রাপ্ত দুই ব্যবসায়ী
বেলারুশ এবং রাশিয়ার সেইন্ট পিটার্সবার্গে বাংলাদেশের দুই অনারারি কনসালের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ রয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ একাধিক পশ্চিমা রাষ্ট্রের।
নিজ দেশে গণতন্ত্রে “বিঘ্ন” ঘটানো বা “বিশ্বব্যাপী ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডে যুক্ত” থাকার অভিযোগে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার অধীনে থাকা ইউরোপের দুই ব্যবসায়ী বর্তমানে নিয়োজিত আছেন বাংলাদেশের অনারারি কনসাল পদে। নেত্র নিউজের এক অনুসন্ধানে এই তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
এদের মধ্যে একজন বেলারুশে বাংলাদেশের অনারারি কনসাল আলেকজান্ডার ভাসিলিয়েভিচ শাকুতিন, যার ওপর ২০২০ সালে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাজ্য। ওই বছর বেলারুশের নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি আলেকজান্ডার লুকাশেংকোকে সমর্থন দিয়ে নির্বাচন কারচুপিতে ভূমিকা রাখার অভিযোগে তার ওপর এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
অন্যজন হলেন রাশিয়ার সেইন্ট পিটার্সবার্গে বাংলাদেশের অনারারি কনসাল সের্গেই আলেসান্দ্রোভিচ ফারসেনকো। ২০১৮ সালে তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা। ২০১৪ সালে রাশিয়া যখন ক্রিমিয়া দখল করে, তখনই তাতে যুক্ত থাকার অভিযোগে ফারসেনকোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
তবে পশ্চিমা বিশ্বের নিষাধাজ্ঞা আরোপের আগে নাকি পরে এই দু’জনকে বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
সাধারণত কোনও রাষ্ট্র তার স্বার্থে কাজ করার উদ্দেশ্যে বিদেশি নাগরিকদের অনারারি কনসাল বা অবৈতনিক দূত হিসেবে নিয়োগ দিয়ে থাকে। তারা নিজ নিজ দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা ধরনের সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার পাশাপাশি নিয়োগদাতা রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করেন। তবে কূটনীতিকরা যেসব বিশেষ সুবিধা ভোগ করেন — যেমন দায়হীনতা, বেতন-ভাতা — এর কোনওটিই তারা ভোগ করেন না।
অনারারি কনসালদের মূল দায়িত্ব দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক — বিশেষ করে বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করা। এই কারণে সাধারণত উচ্চ পর্যায়ে রাজনৈতিক যোগাযোগ আছে এমন ব্যবসায়ীদের অনারারি কনসাল পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।
এই দুই কনসালের নিষেধাজ্ঞা প্রাপ্তির কোনও প্রভাব বাংলাদেশের ওপর পড়বে কি না, তা এই মুহূর্তে ঠিক স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না।
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে নেত্র নিউজ। তাদেরকে প্রশ্ন করা হয় যে, এই নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি নিয়ে তারা অবগত কিনা এবং আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার অধীন কাউকে বিশেষ দূত হিসেবে বহাল রাখা সমীচীন কিনা। কিন্তু এই প্রতিবেদন প্রকাশ অবধি তারা কোনো জবাব দেননি।
বেলারুশের কনসাল
২০২০ এর ডিসেম্বরে শাকুতিনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ)। তাকে বেলারুশের “নাগরিক সমাজ ও বিরোধী মত দমনে নেতিবাচক ভূমিকা রাখার” দায়ে অভিযুক্ত করে ইইউ। ইইউ অভিযোগ করে যে, ২০২০ সালে বেলারুশের বিপুল বিতর্কিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় “দেশটির বিরোধী দলের প্রতিবাদ-বিক্ষোভের নিন্দা জানিয়ে প্রকাশ্যে বিবৃতি প্রকাশ করেন”। ধারণা করা হয় যে, বেলারুশের ওই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি সংঘটিত হয়েছিল।
একই মাসে যুক্তরাজ্যও (ইউকে) শাকুতিনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
নিষেধাজ্ঞার অধীনে থাকা অবস্থাতেও শাকুতিনের একটি দেশের অনারারি কনসাল পদে থাকা নিয়ে ইইউর মতামত জানতে চাইলে একজন ইইউ কর্মকর্তা নেত্র নিউজকে বলেন, “যদিও ইইউ-এর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা স্বাভাবিক কারণেই ইইউ বহির্ভুত দেশেও প্রভাব ফেলে, তবুও যেহেতু এটি (নিষেধাজ্ঞা) পররাষ্ট্রনীতির একটি অংশ, তাই এটি শুধুমাত্র ইইউর সীমানার ভেতর প্রযোজ্য হবে।”
আর এ কারণেই তিনি এই বিষয়ে বক্তব্য দেবার জন্য সঠিক ব্যক্তি নন বলে জানান ইইউর এই কর্মকর্তা।
এদিকে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা এই প্রতিবেদনের বিষয়ে কোনও ধরনের মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। নেত্র নিউজ ধারণা করছে যে, যুক্তরাজ্য কনসাল নিয়োগের বিষয়টিকে বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্তের বিষয় বলে মনে করছে, যেখানে তাদের (যুক্তরাজ্যের) কোন ভূমিকা নেই।
সেইন্ট পিটার্সবার্গের কনসাল
২০১৮ সালে রাশিয়ার সেইন্ট পিটার্সবার্গে বাংলাদেশের অনারারি কনসাল ফারসেনকোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। ওই সময় “বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে নানা ধরনের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা, যার মধ্যে ক্রিমিয়া দখল করে রাখা, পূর্ব ইউক্রেনে হানাহানি উস্কে দেওয়া, নিজ দেশের জনগনের উপর বোমা হামলাকারী সিরিয়ার আসাদ সরকারকে সরঞ্জাম ও মারণাস্ত্র সরবরাহ করা, পশ্চিমা দেশের গণতন্ত্র নস্যাতের চেষ্টা চালানো ও ক্ষতিকর সাইবার কর্মকাণ্ড চালানোর” অভিযোগে রাশিয়া সরকারকে দায়ী করে যুক্তরাষ্ট্র। আর এসমস্ত কর্মকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার ওপর যেসমস্ত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হন বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল ফারসেনকো।
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার এক বছর পর কানাডা সরকারও তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। “ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও সীমানার মারাত্মক লঙ্ঘন এবং গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের” প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়ার ওপর এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে কানাডা।
দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গ্লোবাল এ্যাফেয়ার্স কানাডার এক মুখপাত্র নেত্র নিউজকে বলেন, “ইউক্রেনের ওপর প্রেসিডেন্ট পুতিনের অন্যায্য ও উস্কানিবিহীন আক্রমনের কঠোর নিন্দা করে কানাডা… এবং ইউক্রেন ও এর জনগনের সমর্থনে আন্তর্জাতিক মিত্র ও সহযোগীদের সঙ্গে আমাদের কাজ অব্যাহত থাকবে। আর বাংলাদেশের বিদেশি দূত বিষয়ক প্রশ্ন বাংলাদেশের সরকারকেই জিজ্ঞেস করা সমীচীন হবে।“
নেত্র নিউজ এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করলেও, এই প্রতিবেদন প্রকাশের আগ পর্যন্ত কোনো জবাব মেলেনি।
ক্ষমতার কেন্দ্র
শাকুতিন এবং ফারসেনকো — দু’জনই স্ব স্ব দেশে ক্ষমতাসীনদের বেশ ঘনিষ্ঠ।
শাকুতিন একজন শিল্পপতি। তা ছাড়াও, ২০০৮ থেকে ২০১২ পর্যন্ত বেলারুশ আইনসভার উচ্চকক্ষের (আপার হাউজ) সদস্য ছিলেন শাকুতিন। বেলারুশের স্বৈরাচারি শাসক আলেকজান্ডার লুকাশেংকোর সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।
ইইউর তথ্যমতে, “লুকাশেংকোর শাসনামলে বেসরকারিকরণ থেকে সবচেয়ে লাভবান” হয়েছেন যেসব ব্যবসায়ী, তাদের মধ্যে শাকুতিন একজন। তিনি “লুকাশেংকোপন্থী গনসংগঠন ‘বেলিয়া রাস’-এর একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং কাউন্সিল ফর দ্য ডেভলপমেন্ট অফ অন্টারপ্রেনিয়রশিপ ইন দ্য রিপাবলিক অফ বেলারুশের একজন সদস্য।”
ইইউর দাবি, এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শাকুতিন “লুকাশেংকোর শাসনকে সমর্থন করছিলেন এবং তা থেকে লাভবান হচ্ছিলেন।”
যুক্তরাজ্যের মতে বাংলাদেশের এই বেলারুশি অনারারি কনসাল “আলেকজান্ডার লুকাশেংকোর দীর্ঘকালীন সহযোগী” যিনি “নির্বাচনে কারচুপি-ভিত্তিক ফলাফলের পরও লুকাশেংকোর শাসনকে সমর্থন দিয়ে গেছেন”।
দেশটি আরও দাবি করে, “এই শাসনের প্রতি শাকুতিনের সমর্থন দেশটিতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটাতে ভূমিকা রাখছে”। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ইইউ ও যুক্তরাজ্যে শাকুতিনের সমস্ত সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। এছাড়াও, তিনি ইইউ বা ইউকের কোনও নাগরিকের সঙ্গে বানিজ্য করতে পারবেন না।
সেইন্ট পিটার্সবার্গের কনসাল সের্গেই ফারসেনকোর সঙ্গে তার দেশের ক্ষমতাসীনদের সম্পর্ক আরও নিবিড়।
তিনি ও তার ভাই আন্দ্রেই ফারসেনকো “ওজিরো” নামের একটি কুখ্যাত গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। রাশিয়ার সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা এবং সেইন্ট পিটার্সবার্গের অভিজাত ব্যাক্তিবিশেষকে নিয়ে গঠিত এই ওজিরো গ্রুপ রাশিয়ায় প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের উত্থানে বড় ভূমিকা পালন করেছে। ২০১২ সালে পুতিনের প্রেসিডেন্ট হবার পর থেকেই বিপুলভাবে লাভবান হয়েছে এই গোষ্ঠীটি।
এর পাশাপাশি সের্গেই ফারসেনকো ছিলেন গ্যাযপ্রম নেফটের একজন বোর্ড সদস্য। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় জ্বালানি কোম্পানি গ্যাযপ্রমের ৪২ বিলিয়ন (চার হাজার দুইশ কোটি) ডলারের সাবসিডিয়ারি (অধীনস্ত কোম্পানি) প্রতিষ্ঠান হলো গ্যাযপ্রম নেফট। ২০১৮ সালে রাশিয়ান ধন্যাঢ্য অভিজাতশ্রেণির (অলিগার্ক) ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। তখনই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসেন ফারসেনকো।
“রাশিয়ার অলিগার্ক ও অভিজাত শ্রেণী দেশটির দুর্নীতিগ্রস্ত শাসনব্যবস্থা থেকে লাভবান হয়ে আসছে। আর তাই নিজ দেশে দেশটির সরকার স্থিতিশীলতা ধ্বংসকারী যেসমস্ত কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে, সেসবের পরিণতি থেকে এই অভিজাত শ্রেণী আর নিরাপদ দূরত্বে থাকতে পারবে না,” ফারসেনকো ও অন্যান্যদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারির সময়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব কথা বলে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অফ ট্রেজারি।
গ্যাযপ্রম নেফটের পূর্ব নাম সিবনেফট। এক সময় এই সিবনেফটের মালিক ছিলেন কুখ্যাত রাশিয়ান অলিগার্ক রোমান আবরামোভিচ, যিনি যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত চেলসি ফুটবল ক্লাবের মালিক। তার বিরুদ্ধেও অতিসম্প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাজ্য। বিবিসির একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, আবরামোভিচের বহু-বিলিয়ন ডলারের বিশাল সম্পদের উল্লেখযোগ্য অংশ এসেছে দুর্নীতির মাধ্যমে সিবনেফট কেনা এবং পরে তা রাশিয়া সরকারের কাছে বিক্রি করা বাবদ লাভ থেকে।
বাংলাদেশের কনসাল সের্গেই ফারসেনকোর ভাই আন্দ্রেই ছিলেন রাশিয়ার মন্ত্রীসভার পূর্ণ মন্ত্রী। পুতিনের একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাকে। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়াকে রাশিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করার পর যাদের বিরুদ্ধে প্রথম নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র, তাদের অন্যতম ছিলেন এই আন্দ্রেই।
বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক
সেইন্ট পিটার্সবার্গে বাংলাদেশের অনারারি কনসাল হিসেবে সের্গেই আলেসান্দ্রোভিচ ফারসেনকোর নাম বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের ওয়েব সাইটে তালিকাভুক্ত আছে।
অনারারি কনসালদের এই তালিকায় অবশ্য শাকুতিনের নাম নেই। কিন্তু বাংলাদেশের রাশিয়া দূতাবাসের ওয়েবসাইটে তার নাম উল্লেখ আছে মিনস্কে বাংলাদেশের কনসাল হিসেবে। সেখানে তার যোগাযোগের বিস্তারিত তথ্যও দেওয়া রয়েছে।
শাকুতিনের অফিসে যোগাযোগ করা হলে তারাও নেত্র নিউজকে নিশ্চিত করেন যে তিনি এখনও বাংলাদেশের অনারারি কনসাল পদে বহাল আছেন এবং “অন্তত কয়েক বছর ধরে” এই পদে আছেন তিনি।
তার কার্যালয়ের এক সহকারী জানান, “হ্যা, তিনি অনারারি কনসাল, তবে শুধুমাত্র বাংলাদেশ ও বেলারুশের মাঝে অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়িক সহযোগিতার ক্ষেত্রে তিনি কাজ করেন।”
তবে শাকুতিন কখন বা কীভাবে বাংলাদেশের অনারারি কনসাল হয়েছেন, তা তার জানা নেই।
আলেকজান্ডার ভাসিলিয়েভিচ শাকুতিন বেলারুশের অন্যতম প্রধান একজন ব্যবসায়ী। নির্মাণ শিল্প, যন্ত্র নির্মাণ, কৃষি এবং অন্যান্য নানা ক্ষেত্রে তার ব্যবসা আছে। মিনস্কের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি আমকদরের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান তিনি। আমকদর নামের এই কোম্পানি বাংলাদেশে পরিবহন ও যন্ত্রাদি সরবরাহ করে। ২০২০ সালের এর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, “বাংলাদেশে ১১৭ মিলিয়ন ডলার (১১ কোটি ৭০ লাখ ডলার — প্রায় ১,০১৪ কোটি টাকা) মূল্যের পরিবহন সামগ্রী ও যন্ত্রাদি বিক্রি করার লক্ষ্য আছে কোম্পানিটির।”
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, “আমকদরের সঙ্গে কিছু নতুন চুক্তি করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের একাধিক সংস্থা, যার অধীনে ১৭ মিলিয়ন ডলার ও ১০০ মিলিয়ন ডলার দামের যানবাহন বাংলাদেশে সরবরাহ করবে কোম্পানিটি।”
এর আগে ২০১৬ সালে আমকদর বাংলাদেশে ১,৪০০ ইউনিট স্ব-চালিত যন্ত্রাদি (সেলফ প্রোপেল্ড মেশিন) এবং যন্ত্রপাতি (মাউন্টেড টুলস) বাংলাদেশে পাঠিয়েছে, যার মূল্য ৫০ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ৮৩৩ কোটি টাকা)।
একই বছর শাকুতিনের বেলারুশিয়ান কোম্পানি আমকদর পলাশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন লিমিটেড নামে একটি বাংলাদেশি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে। বাংলাদেশি ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ কুমার রায় এবং তার স্ত্রী শাশ্বতী রায়ের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে এই কোম্পানি গঠন করা হয়।
এই অনিরুদ্ধ কুমার রায় আবার বাংলাদেশে বেলারুশের অনারারি কনসাল। রেজিস্ট্রার অফ জয়েন্ট স্টক কোম্পানির নথি অনুসারে তিনি বাংলাদেশ-বেলারুশ যৌথ কোম্পানিটির চেয়ারম্যান। ২০১৭ সালে এই কোম্পানি একটি বিপনন ও বিক্রয়োত্তর সেবাকেন্দ্র চালু করে।
পরের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে বাংলাদেশের বিচারবিভাগ সম্পর্কিত একটি কেলেংকারিতে জড়িয়ে পড়েন অনিরুদ্ধ কুমার রায়।
অনিরুদ্ধ ছিলেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বন্ধু। বিচারপতি সিনহার ভাষ্যমতে, ২০১৭ সালের আগস্টে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অনিরুদ্ধ রায়কে অপহরণ করে। বিচারপতি সিনহার বন্ধু অনিরুদ্ধকে আটক করে সিনহাকে প্রধান বিচারপতির পদ থেকে ইস্তফা দিতে বলা হয়। বিনিময়ে অনুরুদ্ধকে মুক্ত করার কথা দেওয়া হয়।
সিনহা জানান ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর গভীর রাতে যখন তিনি অস্ট্রেলিয়া থেকে কানাডার উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন, তখন একজন বাংলাদেশি গোয়েন্দা কর্মকর্তা তার কাছে আসেন ও তাকে বলেন যে ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ রায়কে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
“তারপর তিনি আমাকে বলেন যে তাকে (অনিরুদ্ধ) একটি গোপন স্থানে রাখা হয়েছে এবং আমি পদত্যাগ করলে অনিরুদ্ধ ছাড়া পাবে,” সিনহার দাবি। তিনি সেই কর্মকর্তাকে বলেন যে, তিনি অনিরুদ্ধের স্ত্রীর সঙ্গে কথা না বলে এবং অনিরুদ্ধকে তার বাসায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে নিশ্চিত না হয়ে পদত্যাগ করবেন না।
কয়েক মিনিট পর তারা অনিরুদ্ধের স্ত্রীর হাতে ফোন তুলে দেয়। সিনহা বলেন, “ও চিৎকার করছিল এবং আমার কাছে অনুনয় করছিল যেন আমি পদত্যাগ করি এবং তার স্বামীর জীবন রক্ষা করি” এবং তারপর অনিরুদ্ধকে ফোন দেওয়া হয় ও অনিরুদ্ধ বলে: “স্যার, আমি আমার বাসার সিঁড়িতে।”
এরপরই পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করেন বিচারপতি সিনহা। সাবেক এই প্রধান বিচারপতি নিজেও ২০১৬ সালে বেলারুশে গিয়েছিলেন বলে জানা যায়।
তবে মুক্ত হবার পর অনিরুদ্ধ সাংবাদিকদের বলেন যে, তাকে ব্যবসায়িক শত্রুতার কারণে অপহরণ করে আটকে রাখা হয়েছিল।
অনিরুদ্ধ রায়ের ব্যবসায়িক যোগাযোগ শুধু বেলারুশেই সীমাবদ্ধ ছিল না।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলা ও বাপেক্সের সঙ্গে চুক্তি করে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রম। তখন এক সফরে গ্যাজপ্রমের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহ সরকারের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। পরবর্তীতে, “চড়া মূল্যে” ভোলায় গ্যাস অনুসন্ধানে গ্যাজপ্রমের অংশগ্রহণের সম্ভাবনাও অনেকদূর অগ্রসর হয়। আর এসব ক্ষেত্রে গ্যাজপ্রমের বাংলাদেশ প্রতিনিধির ভূমিকা পালন করেন অনিরুদ্ধ রায়।●
* প্রথম প্রকাশিত হয়েছে ইংরেজিতে, এপ্রিল ১৪, ২০২২।