অপপ্রচারের জেরে আন্তর্জাতিক ফেলোশিপ থেকে বাধ্যতামূলক নাম প্রত্যাহার আওয়ামী লীগ কর্মীর
নেত্র নিউজ নিয়ে অপপ্রচারের জেরে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া এড়াতে ফেলোশিপ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন আওয়ামী লীগের নিজস্ব থিঙ্কট্যাংকের কর্মকর্তা তন্ময় আহমেদ।
বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের মদতে কেউ যদি আপনার প্রতি কোনো অপরাধ বা অন্যায় করে, তাহলে আপনার পক্ষে বাংলাদেশে কোনো ধরণের বিচার বা জবাবদিহিতা আদায় করা বাস্তবে অসম্ভব। অন্তত, যতদিন বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। এই কথা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’র শাসনামলে যেমন সত্য ছিল, এখন আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষেত্রেও তেমনই সত্য।
তবে সীমিত আকারে হলেও, অন্তত কিছু ঘটনায় বাংলাদেশের বাইরে এ ধরনের অপরাধের জন্য অপরাধীকে জবাবদিহির আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও এর কর্মকর্তাদের ওপর আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন ও গুমের মতো অপরাধের সঠিক তদন্ত ও স্বাধীন বিচার হলে যেই ধরণের জবাবদিহিতা অর্জন করা সম্ভব হতো, তার তুলনায় বিদেশী একটি রাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা তেমন কিছুই নয়। তারপরও, এই নিষেধাজ্ঞার কথা ভেবে ভুক্তভোগীরা অন্তত কিছুটা শান্তি পাবেন।
র্যাবের পর সম্প্রতি বাংলাদেশের এমন আরও একজন ক্ষমতার আশির্বাদপূষ্ট ব্যাক্তিকে নিজের কৃতকর্মের দায় নিতে হয়েছে। গুম-খুনের ঘটনার মতো ভয়াবহ না হলেও, তার ঘটনাটিও গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের রাজনীতির চরিত্রটাই এমন যে এখানে প্রায় সব রাজনৈতিক দল থেকেই মিথ্যা খবর ও বানোয়াট তথ্য ছড়ানো হয়ে থাকে। তবে এই মুহুর্তে মিথ্যা খবর ও বানোয়াট তথ্যের সবচেয়ে বড় উৎস হলো সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা ও অন্যান্য সংস্থার তৈরি করা বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এ্যাকাউন্ট। অপপ্রচারের এমন আরেকটি বড় উৎস হলো আওয়ামী লীগের দলীয় অপপ্রচার কেন্দ্রগুলো। সরকারের সমালোচনা করে থাকেন, এমন সাংবাদিকরা তাদের অন্যতম লক্ষ্যবস্তু। টার্গেটের বিরুদ্ধে তারা যা ইচ্ছা তা-ই প্রকাশ করতে পারেন। কোনো প্রমাণ বা সূত্র ছাড়াই মনগড়া মিথ্যা ও মানহানিকর বক্তব্য ছড়িয়ে দিতে তারা সিদ্ধহস্ত। দল বেধে সেসব মিথ্যা খবর ও অভিযোগ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় প্রচারকাজে নিয়োজিত আওয়ামী লীগ কর্মীরা। যেহেতু ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে ও মদতে এসব কাজ করা হয়, এর কোনো প্রতিকার পাওয়ার কথা চিন্তাই করা যায় না।
আর এই কাজে যুক্ত একজন প্রধান ব্যক্তি হলেন তন্ময় আহমেদ। তিনি আওয়ামী লীগের প্রপাগান্ডা বা অপপ্রচার ছড়ানোর প্রধান অঙ্গপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) সমন্বয়ক (কোঅর্ডিনেটর)। তিনি একই সাথে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ওয়েব টিমের প্রধান হিসেবেও কাজ করেন। আর আমাদের এই লেখা তন্ময় আহমেদকে নিয়েই।
সম্প্রতি নেত্র নিউজ এবং আমি সহ নেত্র নিউজের দুই জন সম্পাদকের বিরুদ্ধে “মিথ্যা খবর ও বানোয়াট তথ্য” ছড়ানোর অভিযোগে একটি আন্তর্জাতিক ফেলোশিপ প্রোগ্রাম থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছেন তন্ময়। যদিও ক্ষমা চাওয়ার শর্তে তাকে ফেলোশিপ সম্পন্ন করার সুযোগ দেয় আয়োজক প্রতিষ্ঠান, কিন্তু তিনি ক্ষমা চাইতে অস্বীকৃতি জানান ও নাম প্রত্যাহার করাকেই বেছে নেন।
রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রসিদ্ধ একটি প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম হলো জার্মানি-ভিত্তিক দ্য কনর্যাড আডেনাওয়া স্কুল ফর ইয়াং পলিটিশিয়ান (কেসিপ)। এই প্রোগ্রাম প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল “এশিয়ার রাজনৈতিক দলগুলোকে শক্তিশালী করা এবং একদল দায়িত্বশীল ও দায়বদ্ধ তরুণ রাজনৈতিক নেতা তৈরি করা।” ২০২১ সালেরমার্চে নামকরা দুই-বছর-মেয়াদি এই ফেলোশিপের জন্য নির্বাচিত হন সিআরআই সমন্বয়ক তন্ময়।
“একটি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেই সংগ্রাম করেছেন, তা থেকে আমি শিখেছি কিভাবে মানুষের সাথে মিশতে হয়।” — তার এই উক্তি সেসময় বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিল।
কিন্তু এর এক বছর পর কনর্যাড আডেনাওয়া ফাউন্ডেশনের রাজনৈতিক সংলাপ বিষয়ক পরিচালক ক্রিশ্চিয়ান একল্ নেত্র নিউজকে জানান যে তন্ময় এই ফেলোশিপে আর নেই।
তিনি বলেন, “আমাদের আশঙ্কা হলো, আমাদের বিবেচনায় ভুয়া ও মিথ্যা খবরকে ব্যবহার করে তন্ময় যেসব কর্মকাণ্ড করেছেন, তা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রগতিতে বিরুপ প্রভাব ফেলেছে। আর কেসিপ প্রোগ্রামের কোনও অংশগ্রহণকারী গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে আক্রমণ করবে, তা আমরা সমর্থন করতে পারি না।”
“রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম হিসেবে কেসিপ আশা করে যে আমাদের ফেলোরা দায়িত্বশীল নেতা হঅ্যার সর্বোচ্চ মানদণ্ডগুলো মেনে চলবেন। আমরা বাকস্বাধীনতা সমর্থন করি, কেননা তা গণতন্ত্রকে বলবান করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। আমরা ভুল তথ্য বা বানোয়াট তথ্য ছড়ানো একদমই বরদাশত করি না,” নেত্র নিউজকে বলেন একল্।
আওয়ামী লীগ নেতা এবং দলের গবেষণা সংস্থা সিআরআইয়ের জেষ্ঠ্য কর্মকর্তা তন্ময় এই পরিস্থিতিতে পড়েন নেত্র নিউজের সম্পাদকদের বিরুদ্ধে অনলাইনে বিশাল একটি অপপ্রচার কার্যক্রম চালানোর পর। এর জন্য তিনি সেসময় নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজ এবং আওয়ামী লীগের অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পেজ ব্যবহার করেন।
সংঘবদ্ধ এই অপপ্রচার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল হঠাৎ করেই। ২০২১ সালে একটি প্রতিবেদনের অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী, সিআরআইয়ের অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও ট্রাস্টি নসরুল হামিদ বিপুর সাথে নেত্র নিউজ যোগাযোগ করে।
৩০৫ মিলিয়ন ডলারের একটি সরকারি ও বেসরকারি অংশিদারিত্ব চুক্তিতে সম্ভাব্য দুর্নীতি নিয়ে নেত্র নিউজ একটি প্রতিবেদন প্রকাশের আগে বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে বিপুর জবাব জানতে চায় নেত্র নিউজ। আর এর ঠিক পর পরই নেত্র নিউজের বিরুদ্ধে তন্ময় আহমেদের অপপ্রচার কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়।
নেত্র নিউজের বিরুদ্ধে চালানো এই অপপ্রচারে যেসব অসত্য দাবি ও বানোয়াট তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে, তার তালিকা বেশ লম্বা। প্রথমত, তন্ময় অসত্য দাবি করেন যে, সুইডেন-ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম নেত্র নিউজ ও এর দুই সম্পাদক “অনলাইনে বাংলাদেশ-বিরোধী অপপ্রচার চালাতে কোটি কোটি ডলার খরচ করছে” এবং নেত্র নিউজ একটি “প্রপাগান্ডা মেশিন” যাদের “জামায়াত” (বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী)-এর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। তিনি আরও প্রচার করেন যে, নেত্র নিউজ “যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার অর্থায়নে পরিচালিত” এবং এর উদ্দেশ্য হলো “সরকার উৎখাতের পটভূমি তৈরি” করা।
এছাড়া তিনি আরও মিথ্যা দাবি করেন যে, আমি “২০১৩-১৪ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের লবিস্ট হিসেবে কাজ” করেছি, এবং “এর জন্য প্রাথমিকভাবে ২০০ মিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি হয়েছিল…”। তার আরও দাবি ছিল, নেত্র নিউজের প্রধান সম্পাদক তাসনিম খলিল ও আমি “বিএনপি-জামায়াত ও পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই”-এর সঙ্গে জড়িত।
“সেন্টার ফর ডিসইনফরমেশন” শিরোনামে আমার একটি কলামেও এ তথ্যগুলো উঠে আসে। একই সময় আমি জানতে পারি যে তন্ময় কেসিপের একজন ফেলো হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। এর প্রেক্ষিতে আমি প্রতিষ্ঠানটিতে ইমেইল পাঠিয়ে জানতে চাই “স্বতন্ত্র সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার কার্যক্রম চালানো কোনো ব্যক্তির কি আপনাদের প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করতে পারা উচিত” কি না।
ইমেইলে আমি আরও উল্লেখ করি যে তন্ময় আহমেদ “[নেত্র নিউজ ও এর সম্পাদকদের বিরুদ্ধে] গত ছয় সপ্তাহে ফেসবুকে অন্তত ২০ টি পোস্ট করেছেন যেগুলো অত্যন্ত মানহানিকর এবং যেখানে সত্যের লেশমাত্রও নেই।” ইমেইলের এই যোগাযোগকে দ্য কনর্যাড আডেনাওয়া ফাউন্ডেশন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ হিসেবে গ্রহণ করে। অভিযোগ খতিয়ে দেখতে দুই জন প্রাক্তন ফেলো ও দুই জন নিজস্ব কর্মকর্তার সমন্বয়ে একটি “এথিকস কমিটি” গঠন করে প্রতিষ্ঠানটি। কমিটি তন্ময়কে নেত্র নিউজ, তাসনিম খলিল ও আমার বিষয়ে তার মানহানিকর দাবিগুলোর পক্ষে প্রমাণ পেশ করতে অনুরোধ জানায়।
একল্ বলেন, “তন্ময় তার দাবি প্রমাণের জন্য যেসব আমাদের পাঠিয়েছেন, সেগুলো বিবেচনা করে এবং তাকে প্রশ্ন করার মাধ্যমে আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌছেছি যে, তন্ময় সুপরিকল্পিত ভাবে তার পোস্টে অসত্য, বানোয়াট ও অনির্ভরযোগ্য তথ্য যুক্ত করেছেন। এসবের ভিত্তিতে আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে তন্ময়কে এর জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে কিংবা ফেলোশিপ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিতে হবে। তিনি ফেলোশিপ থেকে বের হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।”
এই বিষয়ে তন্ময় আহমেদের মন্তব্য জানার জন্য যোগাযোগ করা হলে তিনি কোন সাড়া দেননি।
এই সাহসী ও ইতিবাচক সিদ্ধান্তের জন্য দ্য কনর্যাড আডেনাওয়া ফাউন্ডেশেনের সাধুবাদ প্রাপ্য। একই সাথে এই সিদ্ধান্ত বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে কেননা বাংলাদেশে এ ধরনের অন্যায় ও অপরধের কোন প্রতিকার পাওয়া অসম্ভব।
এ ঘটনা থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের শিক্ষা নেওয়া উচিত। তাদের উচিত স্বতন্ত্র সাংবাদিকদের উপর আক্রমণ বন্ধ করা এবং মিথ্যা খবর ছড়ানোর ওয়েবসাইটগুলো বন্ধ করা। পাশাপাশি, এসব মিথ্যা খবর ও অপতথ্য ছড়ানোর কাজে নিয়োজিত কর্মীদলকেও এ থেকে বিরত রাখা কিংবা বহিষ্কার করা।●
ডেভিড বার্গম্যান, (@TheDavidBergman), ব্রিটেন-ভিত্তিক সাংবাদিক — নেত্র নিউজের ইংরেজি বিভাগের সম্পাদক।
* প্রথম প্রকাশিত হয়েছে ইংরেজিতে, এপ্রিল ১৬, ২০২২