পশ্চিমা বিশ্বের মুখাপেক্ষী বাংলাদেশের নির্বাচন
আসছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আগামী ২০ মাসের মধ্যে বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আর এই নির্বাচন নিয়ে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন: ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার এই নির্বাচনকে কতখানি সুষ্ঠু ও স্বাধীন হতে দেবে এবং এতে জনগণের ইচ্ছা সঠিকভাবে প্রতিফলিত হবে কিনা। নাকি গতবারের মতো এবারও পাতানো নির্বাচনের আয়োজন করবে আওয়ামী লীগ? ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচনের হিসাব দেখলে দেখা যাবে, মোট ৩০০ আসনের মধ্যে মাত্র ৭ টিতে জিততে দেয়া হয়েছিল বিরোধী দলকে।
আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে নির্বাচনের তো এখনও বেশ দেরি, দেড় বছরের মতো সময় হাতে আছে। তাহলে এখনই কেন এই প্রশ্ন নিয়ে কথা বলছি আমরা? কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের সম্প্রতি দেয়া বক্তব্য ধরে বলা যায়, “নির্বাচন ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে”।
গত ১৩ বছর ধরে বাংলাদেশে ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে তিনটি জাতীয় নির্বাচন হয়েছে: ২০০৮, ২০১৩ এবং ২০১৮ সালে। ২০০৬ ও ২০০৭ এই দুই বছর সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকার পর ২০০৮ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় আর সেই নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এবং ২০০৮ সালের সেই নির্বাচনই সর্বশেষ স্বাধীন ও সুষ্ঠু নির্বাচন হিসেবে স্বীকৃত। অর্থাৎ এরপরের দুইটি নির্বাচন পাতানো বলেই ধরে নেওয়া যায়।
ক্ষমতায় আসার তিন বছরের মাথায়, ২০১১ সালে, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবিধান থেকে অপসারণ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এর প্রতিবাদ স্বরূপ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেতৃত্বে ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট বা বর্জন করে বিরোধীদলগুলো। সেসময় তারা বলেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। কিন্তু তাদের বয়কটের সিদ্ধান্তকে আমলে না নিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বয়কটের ফলে ৩০০ আসনের অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাংসদ নির্বাচিত হয় আওয়ামী লীগের। বাকি অর্ধেক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা বলা হলেও ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা যেসব প্রার্থীর চেয়ে বেশি ভোট পেয়ে জিতেছিলেন তারা কেউই বিরোধীদলের ছিলেন না। অর্থাৎ সে বছর রীতিমতো ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে নিজেদের জয়ী ঘোষনা করে আওয়ামী লীগ।
এই নির্বাচনের পর বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র দুতাবাস থেকে বক্তব্য দেওয়া হয়, যেখানে বলা হয়: “সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনের ফলাফলে বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রকৃত প্রতিফলন হয়েছে বলে মনে হয় না” এবং “বাংলাদেশ সরকার ও বিরোধী দলগুলোর” উচিত “কিভাবে একটি স্বাধীন, সুষ্ঠু, হানাহানি-হীন, এবং আস্থাযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করা যায় তা নিয়ে অতিশীঘ্র আলোচনায় বসা…”।
সেসময় এই বক্তব্য শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, নির্বাচন নিয়ে প্রায় সব পশ্চিমা রাষ্ট্রের মনোভাবের প্রতিনিধিত্ব করে।
কিন্তু নির্বাচনের পর এর বিরুদ্ধে বড় কোন প্রতিবাদ বা অসন্তোষ দেখা যায়নি, এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও নতুন করে নির্বাচন করা নিয়ে চাপ দেয়া বন্ধ করে দেয় দ্রুতই।
এদিকে বিএনপির নির্বাচন বয়কট করার কারণটা বোধগম্য হলেও অনেকেই দলটির এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন। সমালোচকদের দাবি, নির্বাচনী জরিপে বেশ এগিয়ে থাকার পরও নির্বাচনে অংশ না নেয়াটা বিএনপির বোকামি ছিল। কেননা বিএনপি অংশগ্রহণ করলে নির্বাচনে কারচুপি করা এত সহজ হতো না আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে।
এরই ধারাবাহিকতায় চার বছর পর ২০১৮ সালে যখন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়া হয়, তখন তাতে অংশগ্রহণের জন্য বেশ চাপের মুখে পড়ে বিএনপি এবং দলটি সেই নির্বাচনে অংশও নেয়। নির্বাচনে বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণ আওয়ামী লীগের জন্য খুব জরুরি ছিল, কারণ তারা বারবারই বলে এসেছে যে তাদের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। এটা ছিল আওয়ামী লীগের জন্য একটা পরীক্ষা। যাই হোক, হয়ে গেল নির্বাচন। কিন্তু ২০১৪ সালে যা আশঙ্কা করে নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি, ঠিক সেসবই ঘটেছে ২০১৮ সালের নির্বাচনে। এই নির্বাচন হলো সম্পূর্ণ পাতানো।
২০১৮ সালের নির্বাচনের স্মৃতি এখনও দগদগে বিএনপির নেতাকর্মীদের মাঝে। আর তাই ২০২৩ এ অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন নিয়ে বিএনপির অবস্থান হলো “বর্তমান সরকারে অধীনে” তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না।
নির্বাচন শেষ পর্যন্ত কেমন হবে তা দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির উপর তেমন একটা নির্ভর করবে না, যদিও অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কিছুটা প্রভাব থাকবেই। বরং পশ্চিমা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকা এবং আওয়ামী লীগ সে ভূমিকাকে কতখানি গুরুত্বের সাথে দেখছে তার ওপর নির্ভর করবে এই নির্বাচনের রূপ।
যদি বহির্বিশ্ব থেকে কোন চাপ না আসে তাহলে ধারণা করা যেতে পারে যে এবারও ২০১৮ সালের মতোই কারচুপির নির্বাচন করবে আওয়ামী লীগ। যদিও সেবারের মতো শতভাগ কারচুপি খুব সম্ভবত হবে না। রাষ্ট্রযন্ত্রের জুলুম-নির্যাতনের ভয়, সেই সাথে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসতে সাধারণ মানুষের অনীহার কারণে এবারও আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় থেকে যাবে।
তবে পরিস্থিতি এমন হলেও সম্প্রতি তাতে কিছু পরিবর্তন এসেছে। কিভাবে? এই পরিবর্তনের নেপথ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্রের গ্লোবাল ম্যাগনিটস্কি এ্যাক্ট ২০১৬।
এই আইনের বদৌলতে বিশ্বের শক্তিধর দেশটি এখন মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতি ও গণতন্ত্রের ক্ষতিসাধনের অভিযোগে ব্যক্তির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের আইনি ক্ষমতা রাখে। মার্কিন এই আইন বলবৎ হয় ২০১৬ সালে, অর্থাৎ বাংলাদেশের ২০১৪ সালের নির্বাচনের পরে, এবং যুক্তরাষ্ট্র আইনটি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে প্রথম প্রয়োগ করে ২০১৮ সালে, একই বছর বাংলাদেশে একাদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কিছু আগে।
শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, ২০১৮ সালের ওই নির্বাচনের পর যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নও একই ধরনের বিধান প্রণয়ন করে। ইতোমধ্যে এই বিধানগুলো বেশ জোরেশোরেই প্রয়োগ করেছে তারা, যা শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমালোচনার ক্ষেত্রেই সীমিত থাকেনি, বরং পাতানো বা মেকি নির্বাচনের বিরুদ্ধেও প্রয়োগ করা হয়েছে — উদাহরণ হিসেবে ২০২০ এ বেলারুশের নির্বাচন এবং ২০২১ এর নিকারাগুয়ার নির্বাচনের কথা বলা যায়।
পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বন্ধুত্বেরই বলা যায়। আর সেজন্যই ২০১৮ সালের পর প্রণিত এই বিধানগুলো বাংলাদেশের ওপর কোন প্রভাব ফেলবে না বলেই খুব সম্ভব ভেবেছিল বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু এই ধারণা ভেঙ্গে যায় যায় ২০২১ এর ডিসেম্বরে। এসময় বাংলাদেশের বিশেষ বাহিনী র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে যুক্তরাষ্ট্র। নিষেধাজ্ঞা আরও আসে র্যাবের বর্তমান এবং প্রাক্তন বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর, যার মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশের বর্তমান পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদও।
নিষেধাজ্ঞাগুলো জারি হওয়ায় বেশ বড় ধাক্কা খেয়েছে বাংলাদেশ সরকার। ইতোমধ্যে বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিভিন্ন ফোরামে মত বিনিময় করেছেন বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা। আর এই সমস্ত আলোচনা থেকে একটি বিষয় তারা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছেন যে, অদূর ভবিষ্যতে নিষেধাজ্ঞাগুলো সরিয়ে নেওয়ার কোনও সম্ভাবনা আপাতত নেই।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বক্তব্যেও একথা পুনরায় প্রকাশ পেয়েছে। রাষ্ট্রদূত তার বক্তব্যে আরও বলেন যে যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হোক এবং সার্বিকভাবে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র সুরক্ষার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ কী ব্যবস্থা গ্রহণ করে তার ভিত্তিতেই কেবল নিষেধাজ্ঞা অপসারিত হতে পারে।
ডিসেম্বর ২০২১ এর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর বাংলাদেশকে অন্য কোনও রাষ্ট্রের তরফ থেকে নতুন কোনও নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতে হয়নি। জানা যায়, যুক্তরাজ্য সরকার বাংলাদেশের অন্তত কয়েকজন কর্মকর্তাকে জানিয়েছে যে তারা বাংলাদেশের কোনও কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে না। একই সঙ্গে বেশ কয়েকজন কূটনীতিক বিএনপির কয়েকজন নেতাকে জানিয়েছে যে তারা এই নিষেধাজ্ঞার ভয়কে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে গণতন্ত্র উন্নয়নে ও সুষ্ঠু স্বাধীন নির্বাচনের জন্য চাপ দিতে চান।
অর্থাৎ ভবিষ্যত কোনও নিষেধাজ্ঞার সরাসরি ঝুঁকি না থাকলেও একটি অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে আছে বাংলাদেশ সরকার। কেননা এবারও প্রয়োজনীয় পদ্ধতিগত সংস্কার না করেই যদি আরেকটি পাতানো নির্বাচনের আয়োজন করে তারা, সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে তীব্র তিরষ্কারের মুখে পড়বে কিনা তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না আওয়ামী লীগ।
বাংলাদেশ সরকার কোন একক সত্ত্বা নয়। এর বিভিন্ন ভাগ রয়েছে, যাদের আছে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। তবে গুরুত্বপূর্ণ সব সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই দিয়ে থাকেন। তা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক বিভিন্ন ফোরামে হওয়া আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে সরকারের কয়েকজন জেষ্ঠ্য সদস্য অন্তত অনুধাবন করছেন যে ২০১৮ সালের পাতানো নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি আর ঘটানো যাবে না, এবং পরিবর্তন আনতেই হবে।
পরিবর্তন আনার প্রচেষ্টা ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। সরকার সবধরনের গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ করেছে, যদিও এই দুই অপরাধ দেশে ঘটে বলেই তারা স্বীকার করে না। নিষেধাজ্ঞা আসার পর থেকে এসব ঘটনার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে এসেছে এবং ধারণা করা যায় যে এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকবে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এই লেখককে একটি বিশেষ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি জানান যে নির্বাচন পূর্ববর্তী সংস্কারের অংশ হিসেবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষিতে যে বাংলাদেশ সরকার পদক্ষেপ নিচ্ছে তা বোঝানোর জন্য সরকার যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডিত দুই জামায়াত নেতা, মীর কাসেম আলীর গুমকৃত ছেলে মীর আহমেদ এবং গোলাম আজমের গুমকৃত ছেলে ব্রিগেডিয়ার আব্দুল্লাহিল আমান আযমীকে নির্বাচনের আগে মুক্ত করবে। এই তথ্য যদি সত্য হয় তবে তা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত চাঞ্চল্যকর খবর।
২০১৬ সালের আগস্ট মাসে কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে এই দুজনকেই তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর থেকে গত প্রায় ছয় বছর ধরে এরা দুজনই নিখোঁজ রয়েছেন। যদিও এই ঘটনায় জড়িত থাকার কথা বরাবরই অস্বীকার করে এসেছে বাংলাদেশ সরকার, তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে, এই ঘটনার প্রচুর প্রত্যক্ষ সাক্ষী রয়েছে। একই মাসে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে সাজাপ্রাপ্ত বিএনপির আরেক নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরীকেও গুম করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কিন্তু হুম্মামকে আট মাস পর ঢাকার এক রাস্তায় ছেড়ে দেয়া হয়। তবে তার বন্দিত্ব নিয়ে জনসমক্ষে কোন কথা বলেননি হুম্মাম।
কেউই সম্ভবত কল্পনা করেনি যে দীর্ঘ ছয় বছর পরও গোপনে বন্দি এই দুজন বেঁচে আছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তাই ঘটেছে। “ওরা বেঁচে আছে,” সেই কর্মকর্তা জানান।
গুপ্ত বন্দিদের মুক্ত করা যেকোনও রাষ্ট্রের জন্য বরাবরই কঠিন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার ধারণা করছে আটকে রাখার চেয়ে এদের ছেড়ে দিলে সরকার বেশি উপকৃত হবে। তবে কিভাবে তাদের মুক্ত করা হলে বিশ্বাসযোগ্যভাবে দাবী করা যাবে যে তারা কখনোই সরকারের গোপন বন্দি ছিল না, তার জন্য একটা সন্তোষজনক গল্প ভেবে বের করতে হবে সরকারকে। গুম হওয়া অন্যান্য ব্যক্তিদের কপালে কী ঘটেছে তা নিয়ে এই কর্মকর্তার কাছ থেকে অবশ্য আর কোনও তথ্য জানা যায়নি।
ঊর্ধ্বতন এই কর্মকর্তা আরও দাবি করেন যে বাকস্বাধীনতার উপর চলমান খড়্গহস্ত দ্রুত শিথিল হবে এবং সেই সাথে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অবশেষে প্রণিধানযোগ্য কিছু সংস্কার আসবে।
এই সবকিছু বিবেচনা করে সরকার হয়তো বুঝতে পারছে যে আসন্ন নির্বাচনে ২০১৮ সালের পুনরাবৃত্তি করাটা বাস্তবিকভাবে সম্ভব না। যদিও এই কর্মকর্তা দাবী করেছেন যে ২০১৮ সালের নির্বাচনে যা ঘটেছে সরকার তেমনটা ঘটুক চায়নি। কিন্তু আওয়ামী লীগের এমপিদের নিয়ন্ত্রণ করা দুরূহ হয়ে উঠেছিল। সব আসনের আওয়ামী লীগ কর্মীরা চেয়েছিল যেন তাদের প্রার্থী বিশাল ব্যবধানে জেতে। সরকার তা দমাতে পারেনি।
তবে বিশ্বাসযোগ্যভাবে নির্বাচন আয়োজন করার একটিই উপায় আছে। আওয়ামী লীগকে যথেষ্ট সমঝোতা করতে হবে এবং এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে যাতে বিএনপি যৌক্তিকভাবে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করতে না পারে। আপাতত এই লক্ষ্য নিয়েই সরকার কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে। তবে ঠিক কোন কোন বিষয়ে সরকারকে সমঝোতা করতে হবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে এর ফলে বিএনপি নির্বাচনে ফিরে এলেই যে নির্বাচন সুষ্ঠু ও স্বাধীন হবে তা নয়। এমনকি এই সরকারি কর্মকর্তার বক্তব্যেও মনে হয়েছে যে এবারও আওয়ামী লীগ নিজের জয় নিশ্চিত করবে। পার্থক্য এই যে এবার নির্বাচন পূর্ববর্তী পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে এবং কারচুপি এত ব্যাপক আকারে না ঘটিয়ে নির্দিষ্ট কিছু গুরুত্বপূর্ণ আসনে সীমাবদ্ধ রাখা হবে।
পরিস্থিতি এমন হলে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো তা যথেষ্ট মনে করবে কিনা তা এখনই বোঝা যাচ্ছে না। সবকিছু বিবেচনা করে মনে হচ্ছে তারা খুব সম্ভবত আওয়ামী লীগ জিতুক তাই চাইবে। এর কারণ হিসেবে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা যতে পারে। যেমন, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতি, স্থিতিশীলতা এবং এর পাশাপাশি বিএনপি সরকার কেমন হবে তা নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর অনিশ্চয়তা ও মৌলবাদী জামায়াতে ইসলামির সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক ইত্যাদি। কাজেই গণতান্ত্রিক পাশ্চাত্য হয়তো আওয়ামী লীগের ছোটখাট কারচুপি নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য করবে না।
তবে এখানে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষেরও একটা ভূমিকা আছে কিন্তু। পশ্চিমা বিশ্ব কোন পদক্ষেপ নেবে তা নির্ভর করবে পাতানো নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে তার ওপর।
যদি বড় ধরনের কোনও প্রতিবাদ না ঘটে তবে পশ্চিমা বিশ্ব হয়তো সামান্য প্রতিক্রিয়া দেখাবে। কিন্তু যদি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ ঘটে, যেমন বেলারুশে হয়েছে, এবং সরকার তা শক্তি দিয়ে দমনের চেষ্ট চালায় তবে আন্তর্জাতিকভাবে বেশ শক্ত প্রতিক্রিয়া দেখা যেতে পারে।
বিশেষ করে ইউক্রেনের সংঘাতের ফলে কর্তৃত্ববাদী ও গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার পার্থক্য এই মূহুর্তে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে। বর্তমানে কর্তৃত্ববাদে পরিণত হওয়া বাংলাদেশ সরকার এই বিষয়টি যত দ্রুত অনুধাবন করবে ততই তাদের জন্য মঙ্গল।●
ডেভিড বার্গম্যান, (@TheDavidBergman), ব্রিটেন-ভিত্তিক সাংবাদিক — নেত্র নিউজের ইংরেজি বিভাগের সম্পাদক।