মুক্ত সাংবাদিকতায় বাংলাদেশ কেন আফগানিস্তানের চেয়েও পেছনে
কিছুদিন আগে ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর গুলিতে আল জাজিরার সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহর নিহত হওয়ার ঘটনায় বিশ্বব্যাপী আলোচনা ও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। ইউক্রেনে যুদ্ধের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে আক্রমণের শিকার হয়ে হতাহত হয়েছেন সাংবাদিকরা। যুদ্ধের খবর প্রকাশের জেরে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন বহু রাশিয়ান সাংবাদিক। আফগানিস্তানে নারী উপস্থাপকদের মুখ আবৃত রাখার নির্দেশ দিয়েছে দেশটির তালেবান-নিয়ন্ত্রিত সরকার। ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে সম্প্রতি আটক হয়েছেন খ্যাতনামা সাংবাদিক ফাহাদ শাহ। বাংলাদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ বা সংঘাতের সময়ও সাংবাদিকরা যেন সকল পক্ষের চক্ষুশূল। এছাড়া সরকার ও আওয়ামী লীগের আক্রোশের শিকার হয়েছেন সাংবাদিক, আলোকচিত্রী, কার্টুনিস্টসহ অনেকে।
এসবের মাঝেই প্রতি বছরের মতো এবারও “মুক্ত গণমাধ্যম সূচক” প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন রিপোর্টাস উইদাউট বর্ডারস। গত কয়েক বছরের ন্যায় এ বছরেও বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে পিছিয়েছে বাংলাদেশ। শুধু এ বছরেই নয়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর গত ১৩ বছরে মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে কখনই আগায়নি বাংলাদেশ। এমনকি ১৮০ টি দেশের মধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়া আর তালেবান-শাসনাধীন আফগানিস্তান থেকেও পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।
আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে যখন সরকার গঠন করে, তখন মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২১ তম। গত ১৩ বছরে বাংলাদেশ এসে পৌঁছেছে ১৬২ তম অবস্থানে। লিবিয়ার অবস্থান ১৪৩-এ, আর আফগানিস্তানের ১৫৬ তম।
রিপোর্টাস উইদাউট বর্ডারসের সূচক প্রকাশের পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তার গতানুগতিক শ্লেষাত্মক ভাষায় মন্তব্য করেছেন, “এখন সবাই কথা বলতে পারেন, টক শো করতে পারেন। অবশ্য এটা আমি জানি। অনেক কথা বলার পরে বলবেন, আমাদের কথা বলতে দেওয়া হয় না। কিন্তু যখন টক শোতে কথা বলেন, কেউ তো আপনাদের মুখ চেপেও ধরেনি বা গলা টিপেও ধরেনি। সবাই যার যার ইচ্ছে মতো বলতে পারেন।”
যদিও বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা।
মুখ চেপে ধরার আক্ষরিক উদাহরণ দিয়েই যদি শুরু করা যাক, এর সবচেয়ে ভালো নজির ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী, সাংবাদিক শহিদুল আলম। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলন নিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার এক অনুষ্ঠানে সরকারের কড়া সমালোচনা করেছিলেন তিনি। এর কিছু সময় পরই তিনটি গাড়িতে করে সাদা পোশাকধারী পুলিশের লোকজন শহিদুল আলমকে তার ঢাকার বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। তীব্র চাপের মুখে পুলিশ যখন তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে প্রকাশ্যে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়, তখনও মুখ চেপে ধরে আদালত প্রাঙ্গণে আনা হয় শহিদুল আলমকে যাতে তিনি কিছু বলতে না পারেন।
কিংবা বলা যেতে পারে সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের কথা। এক সময় দৈনিক সমকাল ও বণিক বার্তায় ফটো সাংবাদিক হিসেবে কাজ করা কাজল “পক্ষকাল” নামের একটি পাক্ষিক পত্রিকা সম্পাদনা করছিলেন। একটি ফেসবুক পোস্ট দেয়াকে কেন্দ্র করে ২০২০ সালের ৯ মার্চ ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় মাগুরা-১ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শিখর তার বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। এরপর বাংলা একাডেমীর সামনে থেকে কাজলকে চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে ৫৩ দিন গুম করে রাখা হয়। শেষে তাকে যশোরের বেনাপোল সীমান্ত থেকে নিজ দেশেই অনুপ্রবেশকারী হিসেবে গ্রেপ্তার দেখায় বিজিবি।
সাংবাদিকতা নিয়ন্ত্রণে ডিজিটাল অস্ত্র
গত ১১ মে রিপোর্টাস উইদাউট বর্ডারসের সূচক প্রত্যাখ্যান করে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, “সাংবাদিক যদি নিজে ভয় পান, সরকারের কিছু করার থাকে না।” অর্থাৎ, ভয় পাওয়ার দায় সাংবাদিকের, কিন্তু ভয়ের পরিবেশ ও সংস্কৃতি তৈরি করার দায় সরকারের নয়। এর চেয়ে পরিহাস আর কী হতে পারে?
একই অনুষ্ঠানে তথ্যমন্ত্রী দাবি করেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সাংবাদিকদের হেনস্তা করতে প্রণয়ন করা হয়নি। অথচ, তথ্য ও উপাত্ত বলছে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা।
মানবাধিকার সংগঠন আর্টিকেল নাইনটিনের হিসাব-উপাত্ত অনুযায়ী, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন হওয়ার প্রথম ১৭১ সপ্তাহে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ১৭৩টি মামলা হয়। ২০১৯ সালে এই আইনে মামলা হয় ৬৩টি। ২০২০ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে হয় ৪১টি মামলা, এসব মামলায় ৭৫ সাংবাদিককে আসামি করা হয়। এর মধ্যে ৩২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০২১ সালে দায়ের করা হয় ৩৫টি মামলা, আসামি করা হয় ৭১ সাংবাদিককে। এর মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয় ১৬ জনকে।
আর্টিকেল নাইনটিন জানিয়েছে, ২০২১ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ আরও অন্যান্য আইন মিলিয়ে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মোট মামলা হয়েছে ১৮৮টি৷ আসামি করা হয়েছে ৩৫৩ জনকে৷ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে করা এসব মামলার ৫১টি করেছে পুলিশ ও র্যাব৷ ৭৯টি করেছে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের সদস্যরা৷ ভুয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে ১৩০টি মামলা৷ শতকরা হিসাবে এ ধরনের মামলা ৬৯%৷ মানে হয়রানি করাই এসব মামলার একমাত্র উদ্দেশ্য।
বেসরকারি গণমাধ্যম উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান “সমষ্টি”র গবেষণা মতে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ২৫০টি মামলা হয়েছে। এর মাত্র ১৮% মামলায় সাইবার অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। বাকি ৮২% অনলাইন বা সংবাদপত্রে তথ্য বা মতামত প্রকাশের মাধ্যমে অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ। এদিকে এই ৮২% মামলার ৪৬% দায়ের করেছেন রাজনীতিক (তথা আওয়ামী লীগ) বা (দলটির) রাজনৈতিক দলের অঙ্গ-সংগঠনের নেতারা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা স্বপ্রণোদিত হয়ে মামলা করেছেন ২৩%। আর মামলার বিবাদীদের মধ্যে ২৯% সাংবাদিক।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য মতে, আওয়ামী লীগ শাসনামলের গত ১০ বছরেই ২ হাজার ৩১২ জন সাংবাদিক লাঞ্ছনা, হয়রানির শিকার এবং গুম ও প্রাণনাশের হুমকি পেয়েছেন। হত্যা, গুম, অপহরণের শিকার হয়েছেন আরও ৩০ জন সাংবাদিক।
দলীয় প্রচারমাধ্যমে রূপান্তর
সাংবাদিকদের মুখই কেবল চেপে ধরে রাখা হয়নি, দেশের বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যম গত ১০ বছরে কার্যত দলীয় প্রচারযন্ত্রের মতো আচরণ করছে।
ওয়াশিংটন ভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের (আইআরআই) করা এক জরিপ থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশের ৬৮% মানুষই সংবাদের উৎস হিসেবে নির্ভর করে টেলিভিশনের উপর। আর রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চ্যানেল বাদে দেশে এই মুহূর্তে ৩০টি টিভি চ্যানেল রয়েছে। এরমধ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ক্ষমতায় থাকাকালীন (২০০১ থেকে ২০০৬ সাল) সময়ে এই ৩০ টির মাঝে ৫টি (যমুনা, বৈশাখী, বাংলা ভিশন, আরটিভি এবং দেশ টিভি) চ্যানেল অনাপত্তি সনদ পায়; বাকি ২৫টি চ্যানেল অনাপত্তি সনদ পায় ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালে, অর্থাৎ আওয়ামী লীগ আমলে। এছাড়াও আওয়ামী লীগ আরও ১৫টি টিভি চ্যানেলের জন্য অনাপত্তি সনদ দিয়েছে। কিন্তু এই চ্যানেলগুলোর ফ্রিকোয়েন্সি হয় এখনো অনুমোদিত হয়নি বা ফ্রিকোয়েন্সি পেলেও সম্প্রচার শুরু করেনি।
সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজের (সিজিএস) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এই টিভি চ্যানেলগুলোর বেশির ভাগের মালিকানার বিস্তারিত তথ্য উঠে এসেছে। তা থেকে একটি বিষয় খুব স্পষ্ট, আর তা হলো, প্রায় এক তৃতীয়াংশ টিভি চ্যানেলের সম্পূর্ণ বা আংশিক মালিকানা আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত (যেমন: সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যবসায়ী ইত্যাদি) এমন ব্যক্তিদের হাতে।
উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে ফারাক সামান্যই
বাংলাদেশে ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর, নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে খ্যাতনামা পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনের সূচনাতেই বলা হয়েছিল, এই নির্বাচনের ফলাফল যেন সিরিয়া বা উত্তর কোরিয়ায় হওয়া কোনো নির্বাচনী ফলাফলের প্রতিফলন।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নেও তাই বাংলাদেশের তুলনা উত্তর কোরিয়ার সাথেই।
মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে সবচেয়ে তলানিতে থাকা দেশটির নাম উত্তর কোরিয়া (১৮০ তম)। একনায়কতান্ত্রিক এই দেশটি জনগণের উপর শতভাগ কর্তৃত্ব কায়েমের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত।
দেশটির সিংহভাগ মানুষের সংবাদ প্রাপ্তির প্রধান উৎস মূলত একটিই: রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোরিয়ান সেন্ট্রাল টেলিভিশন। যা মূলত উত্তর কোরিয়ার একমাত্র রাজনৈতিক দল, অর্থাৎ ওয়ার্কার্স পার্টি অফ কোরিয়ার মুখপত্র।
উত্তর কোরিয়ায় ব্যক্তিমালিকানাধীন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই, নেই কোনো কর্পোরেট পুঁজি। বিদেশি গণমাধ্যম বলতে কেবল এএফপি ও কিয়োদো নিউজের সংবাদ সংগ্রহের কার্যক্রম আছে দেশটিতে, যা কিনা সরকারি বাহিনীর দ্বারা খুবই কঠোরভাবে নজরদারির মধ্যে থাকে।
বাংলাদেশে অবশ্য ব্যক্তিমালিকানাধীন গণমাধ্যম রয়েছে। গণমাধ্যমের রয়েছে কর্পোরেট পুঁজি এবং বিদেশি বড় বড় সব সংবাদ সংস্থারই সংবাদ সংগ্রহের কার্যক্রম রয়েছে বাংলাদেশে। শুধু এ কারণেই হয়তো এখনও মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে উত্তর কোরিয়া থেকে ১৮ ধাপ এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।●