আয়নাঘর: ডিজিএফআইয়ের গোপন বন্দীশালা

আয়নাঘর নামে বাংলাদেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই পরিচালিত একটি গোপন বন্দীশালার কথা প্রকাশ করেছেন দুই জন ভুক্তভোগী।

আয়নাঘর: ডিজিএফআই -এর গোপন বন্দীশালা

২০১৬ সালের ২৯ মে।

গাজীপুরের কাপাসিয়ায় একটি গাড়ির বডি মেরামতের দোকানে অপেক্ষা করছিলেন শেখ মোহাম্মদ সেলিম। তার পরিবার দীর্ঘদিন ধরেই পরিবহন ব্যবসায় জড়িত, ফলে খুব আগ্রহ নিয়েই নিজেদের একটি বাস মেরামতের কাজ দেখছিলেন তিনি।

অকস্মাৎ একটি মাইক্রোবাস ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। সেলিমের মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে। কিছু বুঝে উঠার আগেই ৪-৫ জন লোক ওই মাইক্রোবাস থেকে বের হন। একজনের হাতে মনিটর সমেত একটি ডিভাইস। সাথে সাথেই সেলিমের পকেটে থাকা সেলফোন বেজে উঠে। তিনি ফোন ধরতে পকেটে হাত দিতেই লোকগুলো বুঝে গেলো, তারা তাদের টার্গেট খুঁজে পেয়েছে।

তএকজন এগিয়ে এসে তাকে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কি শেখ মোহাম্মদ সেলিম?”

হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন তিনি। আর সাথে সাথেই তার দুই পাশে দুই জন লোক তাকে চেপে ধরে জোর করে উঠিয়ে নিলেন তাদের মাইক্রোবাসে। হাত পেছন দিয়ে বাঁধা হলো। চোখ কাপড় দিয়ে বেঁধে উপরে একটি টুপি পরিয়ে দেয়া হলো।

সেলিমের কোন ধারণাই ছিল না যে কারা তাকে আটক করছেন। তাকে কেন তুলে নেয়া হচ্ছে — সেটা তো দূরের কথা। কিন্তু অল্প কিছুক্ষণ বাদেই তাকে “আয়নাঘর” নামে একটি অবৈধ কারাগারে বন্দী করা হবে, যেটি পরিচালনার দায়িত্বে আছে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর, ডিজিএফআই।

এই প্রথম বারের মতো কারাগারটির দুই জন সাবেক বন্দী — যাদের মধ্যে একজন সাবেক সামরিক কর্মকর্তাও রয়েছেন — প্রকাশ্যে এই গোপন বন্দীশালার বর্ণনা দিতে সম্মত হয়েছেন। পাশাপাশি, দুই জন সামরিক কর্মকর্তা এই বন্দীশালার অস্তিত্ব শুধু নিশ্চিতই করেননি; একইসাথে নেত্র নিউজকে কারাগারটির কয়েকটি কক্ষের ছবিও সরবরাহ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক কৃত্তিম উপগ্রহ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ম্যাক্সার টেকনোলজিসের স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত ছবির মাধ্যমে আমরা এই গোপন কারাগারটির অবস্থানও শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছি।

২০০৯ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে, বলপূর্বক অন্তর্ধান বা গুম হয়ে উঠেছে সরকারি নিপীড়নের একটি নিষ্ঠুর ও কার্যকর পন্থা। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের হিসাব অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অন্তত ৬০৫ জন ব্যক্তি বাংলাদেশে গুমের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে সন্ত্রাসবাদ ও অপরাধকর্মে জড়িত থাকার সন্দেহে আটক ব্যাক্তিরা যেমন রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন রাজনৈতিক ভিন্নামতালম্বী, শাসক দলের সমালোচক ও সেলিমের মতো একেবারেই সাধারণ মানুষজন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) সম্প্রতি ৮৬ জন ব্যাক্তির একটি তালিকা প্রকাশ করেছে, যাদেরকে অন্তত ১০ বছর ধরে বন্দী রাখা হয়েছে ও যাদের খোঁজ এখনও পাওয়া যায়নি। এই ব্যক্তিরা গোপন বন্দীশালায় আটক রয়েছেন অথবা হত্যার শিকার হয়েছেন বলে সংগঠনটি ধারণা করছে।

আরও পড়ুন: গোপন নথিপত্র ফাঁস: ইলিয়াস আলীকে অপহরণ করেছিলো র‍্যাব

“আয়নাঘর” নিয়ে আমাদের অনুসন্ধান থেকে ইঙ্গিত মিলেছে যে, এই বিশেষ কারাগারটি প্রধানত “হাই ভ্যালু” বন্দীদের আটক রাখার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। তবে সেলিম কোন “হাই ভ্যালু” বন্দী ছিলেন না — তার আটকের ঘটনাটি ঘটেছিলো ভুল পরিচয়ের কারণে।

আয়নাঘরে সেলিম

সেলিমের গ্রামের বাড়ি কাপাসিয়ায়। তার পারিবারিক গাড়ির ব্যবসা আছে। কয়েক বছর আগে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার আগে তিনি নিজেও ঢাকা ও গাজীপুর সড়কে বাণিজ্যিক গাড়ি চালিয়েছেন অজস্রবার। ফলে তাকে বহনকারী মাইক্রোবাস যখন রাজেন্দ্রপুর রেলক্রসিংয়ে পৌঁছালো অথবা রাজেন্দ্রপুর ক্যান্টমেন্টের ভেতর সেনা চৌকি পার হলো, তখন তার চোখ বাঁধা থাকলেও তিনি বুঝতে পারছিলেন এই সড়কটি (রাজেন্দ্রপুর-গাজিপুর-ঢাকা) কোথায়। তাকে ঠিক কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো সেটাও তিনি মোটামুটি ধারণা করতে পারছিলেন।

যখন তাকে অবশেষে মাইক্রোবাস থেকে বের করা হলো, তখন তিনি কলাপসিবল গেট — যাকে বাংলাদেশে অনেকে “কেঁচি গেট” বলে থাকেন — খোলার শব্দ শুনলেন। তারপর তাকে একটি সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে জানালাবিহীন একটি কক্ষে নেয়া হলো। একজন ডাক্তার এসে তার রক্তচাপ পরীক্ষা করলেন ও মেডিক্যাল চেকআপ করলেন। তারপর তাকে একটি সেলে নেয়া হলো।

এই গোপন কারাগারটির বিষয়ে খুঁটিনাটি কিছু তথ্য সেলিম আমাদের দিয়েছেন। যেমন, তাকে কী ধরণের জলখাবার (এনার্জি প্লাস বিস্কুট) দেয়া হতো বা কোন ব্র্যান্ডের (মাম) পানির বোতল দেয়া হতো, ইত্যাদি। তাকে যেই স্থানে রাখা হয়েছিল সেখানে প্রায় সারা দিন-রাত কয়েকটি অত্যন্ত উচ্চশব্দের এগজস্ট ফ্যান চলতো। তিনি মাঝে মাঝে একটি বিমানের উঠা-নামার কম্পন অনুভব করতেন — ফলে তিনি অনুমান করতে পেরেছেন যে পাশেই হয়তো কোন বিমানবন্দর বা ঘাঁটিতে বিমান উঠানামা করে।

আয়নাঘর: ডিজিএফআই -এর গোপন বন্দীশালা

সেলিমের আগে ওই কক্ষে যারা বন্দী ছিলেন, তারাও তার অপহরণকারীদের পরিচয় সম্পর্কে স্পষ্ট সূত্র রেখে গেছেন — অনেকেই খাবারের সাথে দেয়া মাংসের হাড় বা কোন শক্ত বস্তু দিয়ে ডিজিএফআইয়ের নাম কক্ষের দেয়ালে খোদাই করে লিখে গেছেন।

সম্প্রতি মালয়েশিয়া থেকে এক সাক্ষাৎকারে সেলিম নেত্র নিউজকে বলেন, “ওই রুমের ভিতরে আপনার অনেক লেখা। ওয়ালের মধ্যে খোদাই করে লেখা। আমার মনে হচ্ছে এখানে কতো লোককে যে রাখা হইছে এটা অনুভব করার মতো না। একেক জনের লেখার হাতের স্টাইল একেক রকম। ‘আমাকে ডিজিএফআই ধরে নিয়ে আসছে’, ‘আমাকে ডিজিএফআই এরেস্ট করছিলো বাড়ি থেকে’ — এইরকম অনেক লেখা। অনেকে আবার নাম্বার লিখে রাখছে যে যদি সম্ভব হয় আমার পরিবারকে কেউ বইলেন যে আমাকে যেন খোঁজ করে, আমাকে সরকার এইখানে এইভাবে বন্দী করে রাখছে।”

অপহরণকারীদের পরিচয় ততক্ষণে জানতে পারলেও, সেলিমের বিহ্বলতা উল্টো আরও বেড়ে যায়: ডিজিএফআই তাকে আটক করতে যাবে কেন?

আয়নাঘরে হাসিনুর রহমান

হাসিনুর রহমান সেলিমের পুরোই বিপরীত। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক এই লেফটেন্যান্ট কর্নেল শুরু থেকেই নিজের “হাই ভ্যালু” বন্দী হওয়ার বিষয়টি বুঝতেন। তাকে আটক করা হয় ২০১৮ সালের ৮ আগস্ট। তবে সেটি ছিল তার দ্বিতীয়বার গুম হওয়ার ঘটনা। তিনি প্রথমবার গুমের শিকার হয়েছিলেন ২০১১ সালের জুলাইয়ে। সামরিক বাহিনীতে তিনি পদকপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন; বীরত্বের জন্য পেয়েছিলেন “বীর প্রতীক” খেতাব। র‍্যাবের একটি ইউনিটের অধিনায়ক থাকাকালে তিনি বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ২০১২ সালে ২৮ বছর চাকরি শেষে তাকে বরখাস্ত করা হয়। অভিযোগ হলো, তিনি নিজেই জঙ্গিবাদে জড়িয়েছেন! এই অভিযোগ তিনি দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছেন।

মিরপুর ডিওএইচএস-এ নিজের বাসা থেকে তাকে যারা ২০১৮ সালে ধরে নিয়ে যায়, তাদের পরনে ছিল পুলিশের গোয়েন্দা শাখা বা ডিবির পোশাক (কাউকে আটক করার কোনো আইনি এখতিয়ার ডিজিএফআই-এর নেই; ফলে, কাউকে অপহরণ করতে হলে এই সংস্থার সদস্যরা বেসামরিক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় ধারণ করে)।

২০১৮ সালের আগস্টে তাকে তুলে নেয়ার পর হাসিনুর প্রায় ১৮ মাস “নিখোঁজ” ছিলেন। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। তখন অন্য অনেক গুমের শিকার ব্যক্তিদেরদের মতো তিনিও নিজের গুম হওয়া নিয়ে বেশি তথ্য দিতে সম্মত হননি। তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন ইস্যুতে সরব হয়েছেন। নেত্র নিউজের একজন সম্পাদক এই ইস্যুতে তার সাক্ষাৎকারের প্রস্তাব রাখলে তিনি সম্মত হন।

সেলিম তার গুমের বিষয়ে কিছুই না জানলেও, হাসিনুর ছিলেন সামরিক বাহিনীর ভেতরকার একজন লোক। তিনি এই গোপন বন্দীশালার অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্ট ও নিখুঁত বর্ণনা দিয়ে বলতে পেরেছেন।

তিনি বলেন, “উত্তরে ১৪ তলা বিল্ডিং, দক্ষিণে মেস বি, তার মাঝখানে হলো একটা মাঠ, মাঠের মাঝখানে [এই কারাগার]  — এর ঠিক পূর্ব পাশে হলো লগ এরিয়া হেড কোয়ার্টার, স্টেশন হেড কোয়ার্টার, এবং ইএনসির (প্রধান প্রকৌশলী) অফিস, পশ্চিম পাশে হলো এমটি শেড, ডিজিএফআইয়ের এমটি শেড, এবং উত্তর-পূর্ব কোনে হলো ডিজিএফআইয়ের মসজিদ। এই গুম হাউজটার ছদ্মনাম হলো আয়নাঘর।”

হাসিনুর রহমানের দেয়া এসব তথ্যের ভিত্তিতেই নেত্র নিউজ কারাগারটির অবস্থান শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। গুগল আর্থের স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত সাম্প্রতিক ছবি অনুযায়ী ওই ভবনটির ছাদ তারপুলিন বা ত্রিপল দিয়ে ঢাকা। হাসিনুর নিজেও সম্প্রতি পাশের একটি ভবনে গিয়ে নিশ্চিত হয়েছেন যে ভবনটি আসলেই ছাউনি দিয়ে আবৃত।

তবে আমরা ম্যাক্সার স্যাটেলাইট থেকে এই স্থাপনাটির আর্কাইভড ছবি সংগ্রহ করতে পেরেছি।

আয়নাঘর: ডিজিএফআই-এর গোপন বন্দীশালা

দুই বন্দীর একই রকম বর্ণনা

কয়েক মাস আগে সেলিম নেত্র নিউজের একজন সম্পাদকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

২০১৬ সালের মে মাসে তিনি যখন নিখোঁজ হন, তার ভাই গাজীপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়রি বা জিডি দাখিল করেছিলেন। পুরনো একটি সংবাদপত্রের কপিও আমরা আলাদাভাবে খুঁজে পাই যেখানে তার নিখোঁজ বা অপহরণের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।

তবে ডিজিএফআই-এর অপহরণকারীরা যেই ব্যাক্তিকে প্রকৃতপক্ষে আটক করতে চেয়েছিলেন, তিনি সেলিম ছিলেন না। তারা শিগগিরই বুঝতে পারেন যে তারা ভুল ব্যাক্তিকে ধরে এনেছেন। সেলিমকে তখন ছেড়ে দেয়া হয় তবে তার আগে তার বিরুদ্ধে একটি ভুয়া মামলা দায়ের করা হয়। তাকে ডিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়। ডিবি তাকে বানোয়াট অভিযোগে “আটক” করে আদালতে উপস্থাপন করে। কয়েক মাস পর তিনি জামিনে মুক্ত হন। এরপর তিনি তড়িঘড়ি করে মালয়েশিয়ায় ফিরে যান।

সেলিমের জবানবন্দীতে গোপন কারাগারের যেসব বৈশিষ্ঠ্যের কথা এসেছে, তা ডিজিএফআই, র‍্যাব ও ডিবি সহ বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নিরাপত্তা সংস্থার কর্মকর্তাদের জানায় নেত্র নিউজ। এদের মধ্যে দুই জন এই স্থাপনাটি চিনতে পারেন। এই দুই কর্মকর্তাই প্রথম এই বন্দীশালার কোডনেম যে আয়নাঘর তা আমাদের জানান। এদের একজন জানান, এই বন্দীশালায় ৩০টি সেল বা কক্ষ রয়েছে। আরও আছে কয়েকটি সাউন্ড-প্রুফ কক্ষ যেখানে বন্দীদের নির্যাতন করা হয়। এছাড়া এখানে বন্দী ছিলেন বা এখনও আছেন এমন কয়েকজন ব্যাক্তির তালিকাও তারা আমাদেরকে দেন।

এই সাবেক বন্দীদের একজন ছিলেন হাসিনুর রহমান।

“আমি যেহেতু আগে চাকরী করছি ঢাকা শহরে, মিলিটারি পুলিশের অপ্স অফিসার ছিলাম আর্মি এমপি ইউনিটের, তো আমি এলাকাটা চিনে ফেলি, স্থানটাও চিনে ফেলি,” জানান হাসিনুর। “নতুন যে [সেকশন] গুম হাউজের সেটা হলো পাঁচটা, পাঁচটা করে রুম। প্রতি পাঁচটা রুমের সাথে একটা করে বাথরুম। [...] যেই পাশে আমি ছিলাম অর্থাৎ পশ্চিম পাশের পাঁচটা রুমের সাথে যে বাথরুম সেই বাথরুমে দুইটা প্যান আছে — একটা লো প্যান, একটা হাই প্যান, হাই কমোড। [...] আমি হাই কমোডের উপর উঠে এগজস্ট ফ্যান দিয়ে বাইরে তাকাই, আমি দেখতে পাই পুরান বিল্ডিং এবং আমি চিনতে পারি মোটামুটি এটা এলাকাটা কোনটা।”

তিনি জানান যে, এই ভবনে দুইটি অংশ আছে — পুরনো অংশে আছে ১৬টি কক্ষ; আর নতুনটিতে ১০টি। প্রহরীরা সামরিক ও বেসামরিক লোকজন।

হাসিনুর রহমান ও শেখ মোহাম্মদ সেলিম একে অপরকে চেনেন না। তারা একই সময় এই কারাগারের বন্দী ছিলেন না: সেলিম ছিলেন ২০১৬ সালে; হাসিনুর ২০১৮ সালে।

কিন্তু নিজেদের সাবেক বন্দীশালা নিয়ে দুই জনের বক্তব্যে রয়েছে অনেক মিল। সেলিমের মতো হাসিনুরও বললেন যে, তাকে মাঝেমাঝে “এনার্জি প্লাস” বিস্কুট দেয়া হতো। উভয়েই জানান যে, তাদেরকে যেসব খাবার দেয়া হতো তার মান ছিল খুবই ভালো। দেয়া হতো “মাম” পানির বোতল।

সেলিম অনুমান করেছিলেন যে আশেপাশে হয়তো কোন বিমানঘাঁটি বা বিমানবন্দর আছে। তবে হাসিনুর নিশ্চিত করেই জানান যে, বিমান উঠানামার শব্দ আসতো তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে, যেখানে রুটিন বিমান বা বিমান ও সেনা বাহিনীর সেসনা প্লেন উঠানামা করে।

আয়নাঘর: ডিজিএফআই-এর গোপন বন্দীশালা

শেখ মোহাম্মদ সেলিম বলেন: “আর ফ্যান বন্ধ করলে আপনাকে আরেকটা জিনিস বলি, অনেক লোকের কান্নার শব্দ আসে, কিন্তু ওইটা ফ্যান ছাড়া অবস্থায় বোঝা যায় না।”

হাসিনুর রহমান বলেন: “কোন কিছু যাতে শোনা না যায় এবং ভিতরের কোন শব্দ যাতে বাইরে না যায়, বড় এগজস্ট ফ্যান ইউজ করে, খুব বড় বড়। যেমন ওই প্রতি পাঁচটা রুমের সাথেই দুইটা এগজস্ট ফ্যান, অর্থাৎ, ওই দশটা রুমের সাথে চাইরটা এগজস্ট ফ্যান, যাতে কোন শব্দ ভিতর থেকে বাইরে না যায়, বাইরের শব্দ ভিতরে না আসে।”

যেসব সেলে তারা বন্দী ছিলেন, সেসব সম্পর্কেও কাছাকাছি বর্ণনা দেন দুই জন। যেমন, সেখানে কোনো জানালা ছিল না। ছিল দুই অংশ-সমেত একটি দরজা: একটিতে ছিল লোহার শিকের দরজা, তারপর কাঠের দরজা, যেখানে একটি ছিদ্র করা।

যেই দুই সামরিক কর্মকর্তা আয়নাঘরের অস্তিত্ব সম্পর্কে নেত্র নিউজকে নিশ্চিত করেছিলেন, তাদের একজন এই কারাগারের কয়েকটি ছবিও আমাদের সরবরাহ করেন। সেই ছবিগুলোও এই দুই জনের বক্তব্যের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়।

আয়নাঘর: ডিজিএফআই-এর গোপন বন্দীশালা

ওই কর্মকর্তা আরও জানান যে, ডিজিএফআই-এর কাউন্টার টেরোরিজম ইন্টিলিজেন্স ব্যুরো (সিটিআইবি) এই স্থাপনার দায়িত্বে ছিল। ২০১৬ সালের পর থেকে চার জন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদমর্যাদার সামরিক কর্মকর্তা সিটিআইবির পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই একই সময়ে চার জন মেজর জেনারেল ছিলেন ডিজিএফআইয়ের মহাপরিচালক।

আয়নাঘর: ডিজিএফআই-এর গোপন বন্দীশালা

সামরিক বাহিনীর এই দুই সূত্র কারাগারের সাবেক ও বর্তমান বন্দীদের যেই তালিকা আমাদের দিয়েছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন মোবাশ্বের হাসান, যিনি ঢাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি নিখোঁজ হওয়ার পর ভারতের সংবাদ মাধ্যম দ্য ওয়্যারের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, তাকে ডিজিএফআই অপহরণ করেছে। সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান, যিনি নিজেও একজন সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, ও ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ কুমার রায় একসময় আয়নাঘরে বন্দী ছিলেন।

বর্তমানে যারা আটক রয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন দুই জন ব্যক্তি যাদেরকে ২০১৬ সালের আগস্টে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ধরে নিয়ে যায়। এদের একজন হলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর নেতা মীর কাসেম আলীর ছেলে মীর আহমেদ বিন কাসেম। আরেকজন হলেন আবদুল্লাহিল আমান আযমী, যিনি নিজেও সেনাবাহিনীর একজন সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। আযমী হলেন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক প্রধান গোলাম আযমের ছেলে। গোলাম আযমও একই আদালতে দণ্ডিত হয়েছিলেন।

মীর আহমেদ বিন কাসেম ও আবদুল্লাহিল আমান আযমীকে আয়নাঘরে দেখেছেন এমন দুই কর্মকর্তা বিষয়টি নেত্র নিউজকে নিশ্চিত করেছেন। এমনকি হাসিনুর রহমান যখন বন্দী ছিলেন তখন তিনিও আয়নাঘরে তাকে দেখেছেন। তাদেরকে রুটিনমতো টয়লেটে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বে যেসব প্রহরীরা ছিলেন, তাদের বিভ্রান্তির কারণে হাসিনুর টয়লেটে আযমীকে দেখে ফেলেন। পরবর্তীতে তিনি সেখানে কর্মরত এক বেসামরিক প্রহরীর মাধ্যমে বিষয়টি আরও নিশ্চিত হন।

আয়নাঘর: ডিজিএফআই-এর গোপন বন্দীশালা
আবদুল্লাহিল আমান আযমী ও মীর আহমেদ বিন কাসেম

“বাড্ডার লিটন”

সাবেক সেনা কর্মকর্তা হওয়ায় হাসিনুরকে কিছুক্ষেত্রে সুবিধা দেয়া হলেও, সেলিম ছিলেন সাধারণ কয়েদীদের মতোই। তাকে প্রায়ই প্রহার ও নির্যাতন করা হয়েছে।

এমন একটি ঘটনার স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, “ওইদিনকা খুব মাইরধর করে, মাইরধর করার পরে আমাকে আর ওই রুমে নিয়ে যাওয়া হয় না। আমাকে আপনার আরেকটা রুমে নিয়ে যায়, অনেক দূর হাটাই নিয়া যায়। অনেকদূর হাঁটানোর পরে একটা রুমে নিয়া যায় যেখানে প্রচন্ড গরম; প্রচন্ড গরম ফিল করি প্রথম অবস্থায়। তো ওই রুমে যাওয়া পরে আমি একজন ব্যক্তিকে দেখতে পাই, তো প্রথম অবস্থায় উনি ওনার নাম বলে না, উনি খুব চুপচাপ ছিলেন, একেবারে চিকনা ছিলেন, আর ওনার শরীর শ্যামলা ছিলো, লম্বা চৌড়া। তো সম্ভবত অনেকটা সময় যাওয়ার পরে উনি ওনার পরিচয় দিলো যে আমার নাম লিটন, আমার বাড়ি বাড্ডাতে; উনি বাড্ডার লিটন।”

লিটনের বিষয়ে আরও তথ্য দিয়ে সেলিম জানান, “উনি সম্ভবত ২০১৭ সালে বা ১৬ সালে বাংলাদেশ থেকে সরকারি ভাবে অলেম্পিকে মার্শাল আর্টে, আপনার অলেম্পিকে যোগ দেওয়ার জন্য যাওয়ার কথা ছিল। [...] ওই আপনার ওইটাকে মার্শাল আর্ট বলছিল না একজ্যক্টলি, মানে ক্যারাতি বলছিল আরকি। তো আমি বুঝি নাই তখন উনি মার্শাল আর্ট বলল আমাকে। ক্যারাতি সম্ভবত!”

তার বর্ণনার ভিত্তিতে অনুসন্ধান চালিয়ে নেত্র নিউজ আয়নাঘরের আরেক বন্দীর সন্ধান পায়। বাড্ডার লিটন বলে যাকে সেলিম চিনতেন, তার আসল নাম হলো শেখ মোহাম্মদ আবু সালেহ। তিনি ঢাকার একটি স্কুলে কারাতে প্রশিক্ষক ছিলেন। পুলিশের এলিট ইউনিট হিসেবে পরিচিত র‍্যাব ২০১৬ সালের নভেম্বরে তাকে “আটক” দেখায়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি জিহাদি সন্ত্রাসবাদে জড়িত ছিলেন। র‍্যাব আরও দাবি করে, আবু সালেহ ছিলেন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইসিস-এর কারাতে প্রশিক্ষক!

সেলিমকে যখন আবু সালেহর ছবি দেখানো হয়, তিনি নিশ্চিত করেন যে ইনিই বাড্ডার লিটন, যাকে তিনি আয়নাঘরে দেখেছেন। অর্থাৎ, আবু সালেহ উরফে লিটন উরফে হুরাইরার ভুয়া গ্রেপ্তার মঞ্চস্থ করেছে র‍্যাব। এই ভুয়া গ্রেপ্তারকে সংস্থাটি নিজেদের সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী সাফল্য হিসেবেও প্রচার করেছে।

ইংরেজি-মাধ্যম স্কুলের শিক্ষক

আয়নাঘরের অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে সেলিম বলেন, “আপনার নির্দিষ্ট একটা সময়ে ফ্যানটা একেবারেই বন্ধ করে দেওয়া হয়, একেবারেই নিঝুম হয়ে যায়। মনে হচ্ছিল যে আপনি পৃথিবী থেকে আলাদা কোন জায়গায় আসছেন, কোন শব্দ নাই, একেবারেই নিঝুম হয়ে যায়, এইটা নির্দিষ্ট, মেবি আপনার ৩০ মিনিট ৪০ মিনিটের জন্য।”

তিনি যোগ করেন, “এই সময় [লিটন এক ব্যাক্তির সাথে] কথা বলতো। তারা ওয়ালের মধ্যে আঘাত করতো, আঘাত করার পরে ওইপাশ থেকে কথা বলতো। [...] উনি [লিটনকে] বলছে যে হয়তো [সেলিম] খুব দ্রুত ছাড়া পাবে, তো আমার নাম্বারটা টয়লেটে লেখা আছে, সব টয়লেটে। উনি বলছে যে সব টয়লেটে ওনার নাম্বার উনি লিখে রাখছে। তো আমি অনেক টয়লেটে ওনার নাম্বার দেখছি। তো উনি তখন বলল যে, ওনার মা যেন সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করে, ওনাকে কাফরুলের আশেপাশে কোথাও রাখা হইছে। ওই লিটন আমাকে বলছে [পাশের রুমের ওই ব্যক্তি] ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের একজন টিচার ছিলেন, এতটুকুই।”

শেখ মোহাম্মদ সেলিম আরও বলেন, “মালয়েশিয়াতে আসার পরে আমি ওই নাম্বারে কল দেই, একজন বুড়া মহিলার সাথে আমার কথা হয়, উনি খুব কান্নাকাটি করে এবং আমাকে রিকোয়েস্ট করে আমি যেন ফোন না দেই। বলল যে আপনি যে ফোন দিছেন আপনিতো বিপদে পড়ে যাবেন। তো আমি বললাম যে কেনো? বলছে যে ওনার বাসার নাম্বার নাকি সব গভমেন্টের আওতায় ট্র্যাকিং করা নাকি। আমি বলছি যে আমি দেশের বাইরে থাকি, আর আমিতো কোন অপরাধী না, আমার ভয় পাওয়ার কোন কারণ নাই।”

নেত্র নিউজের দুই জন প্রতিবেদক ওই একই নম্বরে কল করেন। যেই নারী ফোন ধরেন তিনি ছিলেন মুমতাজ করিম, যিনি তেহজীব করিমের মা। তেহজীব করিম ২০১৬ সালের মে মাসে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে নিখোঁজ হন। তিনি আসলেই ঢাকার ইংরেজি-মাধ্যমের একটি স্কুলে শিক্ষক ছিলেন।

তিন বছর পর, ২০১৯ সালের মে মাসে, তাকে আদালতে উপস্থাপন করে বলা হয় তিনি জিহাদি সন্ত্রাসবাদে জড়িত। তেহজীব করিমের ভাই রাজীব করিমও যুক্তরাজ্যে সন্ত্রাসবাদ-সংশ্লিষ্ট অভিযোগে আটক ছিলেন। তেহজীবকে আটক ও তিন বছর পর আদালতে উপস্থাপনের ঘটনা থেকেও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর বেআইনি প্রবণতার ইঙ্গিত মিলে — মানুষকে তুলে নিয়ে গোপন কারাগারে মাসের পর মাস বা বছরের পর বছর আটক রাখা হয়, যা আইনের লঙ্ঘন; এরপর তাদেরকে আদালতে উপস্থাপন করা হয় এমনভাবে যেন তাদেরকে মাত্রই গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

ভুয়া অভিযোগ

শেখ মোহাম্মদ সেলিমকেও ২০১৬ সালের আগস্টে আদালতে উপস্থাপন করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি বাংলাদেশের একটি নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের সদস্য ছিলেন। তেহজীবের ক্ষেত্রে এই অভিযোগের সত্যতা থাকার সম্ভাবনা থাকলেও, সেলিমের বিরুদ্ধে এই অভিযোগের যে কোনো ভিত্তি নেই তা নেত্র নিউজ নিশ্চিত করতে পেরেছে।

সেলিমের ভাষ্য, “তো সম্ভবত একবারে সকালবেলা ফজরের সময়, মনে হয়, ওনারা আমাকে ওইখান থেকে চোখ-টোক বেঁধে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। তো ওইখানে আমাকে একজন মহিলা জিজ্ঞাসাবাদ করে, তো উনি আমাকে জিজ্ঞসাবাদ করলো, আমার নাম? আমার টোটাল পরিচয়? আমি কী করি, সম্ভবত আইএসএল, বা আইএসআইএল (আইএসআই), পাকিস্তানের একটা গোয়েন্দা সংস্থার কথা আমাকে জিজ্ঞেস করলো। তো বললো যে পাকিস্তানের [আইএসআই] ওইটার সদস্য নাকি আমি। আমি বলছি যে আমি এটার নাম শুনি নাই কোনোদিন। তো পরে ওনারা আমার বয়সটা নিয়ে — মানে আমার নাম জিজ্ঞেস করলও,  আমি বললাম শেখ মোহাম্মদ সেলিম, তো আমার পিতার নাম? তো ওইটা অনেকবার আমাকে জিজ্ঞেস করলো।”

“তো পরে ওনারা মানতে চাচ্ছিলনা যে আমার জন্ম তারিখ এক-এক উনিশো নব্বই, তো ওনারা ওইসময়ই মাইর শুরু করে, আপনার মানে কোন দিক থেকে বারি দেয় আমি অনুভব করতে পারি নাই বাট ডানে বামে, মানে আমি এই দিগে কাইত হইলে ওইদিগে বাড়ি দেয়, পায়ে বারি দেয় ডান পাশে বাম পাশে খুব জোরে জোরে মারে, তো আমিও খুব কান্নাকাটি করি। সব বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তো একটি চুপ করে রইলো ওনারা। ওই মহিলা হঠাত করে জিজ্ঞেস করলো, শেখ মোহাম্মদ সেলিম, আপনি কখনও পঞ্চগড় গেছেন? আমি বললাম যে, না।  তারপরে জিজ্ঞেস করলো যে, আমাকে সম্ভবত আপনার গোপালগঞ্জের যে কোন একটা এরিয়ার নাম বলল, যে আপনি গোপালগঞ্জ সম্ভবত কি জানি কোটোআলীপাড়া হয়তোবা মেবি এইরকমই কোন একটা নাম হতে পারে। যে ওইখানে আমি নাকি বোমা পুঁতে রাখছিলাম শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্য। আমি বলছি যে না, আমি ওই এলাকাতে কখোনো যাই নাই। তো ওনারা কেমন জানি মানতে ছিলোনা যে আমি আমার বাড়িটা কাপাসিয়া ৬ নং ওয়ার্ড।”

তাকে করা প্রশ্নের ভিত্তিতে নেত্র নিউজ মূল্যায়ন করছে যে তাকে আটকের ঘটনাটি সম্ভবত ভুল পরিচয়ের কারণে হয়েছে। ডিজিএফআই সম্ভবত এমন এক ব্যক্তির বিষয়ে আগ্রহী ছিল, যিনি “সেলিম” ছদ্মনামটি ব্যবহার করতেন, যিনি কিনা কোটালিপাড়ায় (কোটোআলীপাড়া নয়, যেমনটা সেলিম ভেবেছিলেন) শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে বোমা পুঁতে রাখার দায়ে অভিযুক্ত।

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে র‍্যাব ইকবাল হোসেন নামে এক ব্যাক্তিকে আটক করে। তখন র‍্যাবের সূত্রে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয় যে, ইকবাল হোসেন হরকাতুল জিহাদ নামে একটি নিষিদ্ধ জিহাদি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং তিনি ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মামলায় সন্দেহভাজন। সংবাদে আরও বলা হয় যে, ইকবাল হোসেন এতদিন মালয়েশিয়ায় লুকিয়ে ছিলেন এবং “সেলিম” ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন। তাকে ধরার জন্য সাভার ও গাজীপুরে একাধিক অভিযান পরিচালনার কথাও বলা হয়। এই সব কিছুই শেখ মোহাম্মদ সেলিমের পরিচিতির সঙ্গে মিলে যায়। কিন্তু ডিজিএফআই যখন বুঝতে পারলো যে তারা ভুল সেলিমকে ধরে এনেছে, তারা তাকে ডিবি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। ডিবি পুলিশ তাকে ভুয়া মামলায় আদালতে পাঠিয়ে দেয়।

সেলিম আরও অনেক বিস্তারিত তথ্য দিয়েছেন, যা থেকে নেত্র নিউজ খুঁজে বের করেছে কীভাবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট একটি ফলস-ফ্ল্যাগ বা ভুয়া অভিযানে বেশ কয়েকজন তরুণকে হত্যা করেছে। এই সংক্রান্ত প্রতিবেদন নেত্র নিউজ শিগগিরই প্রকাশ করবে।

প্রতিক্রিয়া

নেত্র নিউজের এই অনুসন্ধান নিয়ে কথা বলেছেন মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) দক্ষিণ এশিয়া পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি, “গুম নিয়ে আমাদের কাজের সূত্রে আমরা অবশ্যই জানতাম যে গোপন বন্দীশালা রয়েছে। তারপরও এটি ভীষণ হতাশাজনক যে এগুলোর অস্তিত্ব আসলেই  আছে — তাও আবার একটি সামরিক স্থাপনার অভ্যন্তরে এবং সামরিক বাহিনী যা সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে অবগত। আমরা আশা করি, এখন অত্যন্ত দ্রুতগতিতে একটি তদন্ত হবে, কেবল এই বন্দীশালা নিয়ে নয়, অন্যগুলো নিয়েও। যেসব মানুষকে এখানে রাখা হয়েছে — যাদের অনেককে বছরের পর বছর ধরে বন্দী রাখা হয়েছে, আর যাদের পরিবার এখনও তাদের ফেরার অপেক্ষায় আছে — সেই ব্যাক্তিদের অনতিবিলম্বে মুক্তি দেয়া উচিত। এরপর তাদের এভাবে গোপনে আটক রাখার জন্য কারা দায়ী, তা খুঁজে বের করতে একটি সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত।”

এই প্রতিবেদনের বিষয়ে বিস্তারিত প্রশ্ন সহ নেত্র নিউজ ডিজিএফআই-এর মুখপাত্রের সাথে যোগাযোগ করেছে, তবে আমরা সংস্থাটির কোনো প্রতিক্রিয়া পাইনি।●

সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের খান এই প্রতিবেদনে সহায়তা করেছেন।