লন্ডনে শেখ রেহানার বসবাস মিলিয়ন পাউন্ডের বাড়িতে, মালিক বেক্সিমকোর শায়ান
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্নভাবে সরকারের আনুকূল্য পেয়ে লাভবান হয়েছে বেক্সিমকো। আর সেই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেরই মালিকপক্ষের বাড়িতে বিনা ভাড়ায় বসবাস করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রভাবশালী বোন — এতে গুরুতর স্বার্থের দ্বন্দ্ব দেখছেন দুর্নীতি-বিরোধী বিশেষজ্ঞরা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রভাবশালী বোন শেখ রেহানা বিনা ভাড়ায় বসবাস করেন উত্তর লন্ডনের একটি বাড়িতে। কাগজে কলমে এই বাড়ির মালিক আহমেদ শায়ান ফজলুর রহমান, যিনি বেক্সিমকো গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক। তার পিতা সালমান ফজলুর রহমান প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও ভাইস চেয়ারম্যান এবং একইসঙ্গে সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী-পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা। পিতা-পুত্র উভয়েই এই সংস্থানের সঙ্গে জড়িত।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে ব্যাপকভাবে লাভবান হয়েছে দেশের অন্যতম বৃহত্তম ব্যবসায়ী গোষ্ঠী বেক্সিমকো। রেহানা বিনা ভাড়ায় যেই বাড়িতে থাকছেন — এই ধরনের বাড়ির মাসপ্রতি ভাড়া যুক্তরাজ্যের এস্টেট এজেন্টদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৪,০০০ পাউন্ড বা ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা। আর ১১ বছর আগেই এই বাড়িটি কেনা হয়েছিল বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৫.৪ কোটি টাকা দিয়ে।
দুর্নীতি-বিরোধী বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই গোপন বন্দোবস্তে স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি হওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। তবে আইনজীবী ও প্রতিনিধির মাধ্যমে দেয়া বক্তব্যে শায়ান রহমান, তার পিতা সালমান রহমান ও শেখ রেহানা বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।
শেখ রেহানা লন্ডনে যেই বাড়িতে থাকেন, তার প্রকৃত মালিকানা কার তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই ধোঁয়াশা ছিল। ২০১১ সালে বাড়িটি কেনা হয় লেডিবার্ড প্রোপার্টিজ নামে একটি অফশোর প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে।
গোপনীয়তা ও কর সংক্রান্ত সুযোগসুবিধার জন্য বিশ্বের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু দ্বীপ রাষ্ট্র বা অঞ্চলের কুখ্যাতি রয়েছে। অফশোর শব্দটির ব্যাকরণগত বিভিন্ন অর্থ থাকলেও, ওই ধরণের কুখ্যাত দ্বীপ রাষ্ট্র বা অঞ্চলকেই অফশোর বোঝানো হয়।
ঠিক এমনই একটি অফশোর “ট্যাক্স হ্যাভেন” হিসেবে পরিচিত দ্বীপ হলো “আইল অফ ম্যান” নামের স্বায়ত্বশাসিত ব্রিটিশ উপনিবেশ, যেটি যুক্তরাজ্যের মূল ভূখন্ডের গা ঘেঁষে অবস্থিত। এখানেই নিবন্ধিত হয়েছে লেডিবার্ড প্রোপার্টিজ।
যুক্তরাজ্যের কোম্পানি নিবন্ধকে সংরক্ষিত নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, লেডিবার্ড প্রোপার্টিজের মালিকানায় রয়েছে অনেকগুলো খোলস বা শেল কোম্পানি। ওই শেল কোম্পানির মালিকানায় রয়েছে আরও অনেকগুলো শেল কোম্পানি। এভাবে খোলসের পর খোলস দিয়ে গোপন রাখা হয়েছে লেডিবার্ড প্রোপার্টিজের আসল মালিকের নাম ও পরিচয়।
তবে নেত্র নিউজের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এই লেডিবার্ড প্রোপার্টিজ, অর্থাৎ শেখ রেহানা যেই বাড়িতে থাকেন, তার প্রকৃত মালিক হলেন শায়ান ফজলুর রহমান।
বেক্সিমকোর নিজস্ব ওয়েবসাইট ও অন্যান্য নথিপত্রে তাকে বেক্সিমকোর পরিচালনা পর্ষদের উপদেষ্টা বলা হয়েছে। তবে বিভিন্ন সময় তিনি নিজেকে গ্রুপের পরিচালক পরিচয় দিয়েছেন। বেক্সিমকোর বিভিন্ন অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের পরিচালকও তিনি। তিন বছর আগে তাকে গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির একটি সংবাদ-বিজ্ঞপ্তিতে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়।
শায়ান রহমান হলেন সালমান ফজলুর রহমানের ছেলে। বেক্সিমকোর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমান ভাইস-প্রেসিডেন্ট সালমান এফ রহমান সরকারি দলের একজন সংসদ সদস্য এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা। শেখ রেহানাকে বিনা ভাড়ায় লন্ডনের বাড়িটিতে থাকতে দেয়ার যেই বন্দোবস্ত, তাতে সালমান ও শায়ান রহমান উভয়েরই সম্পৃক্ততা রয়েছে।
যুক্তরাজ্যের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতি-বিরোধী চর্চা বিষয়ক অধ্যাপক রবার্ট ব্যারিংটন নেত্র নিউজের অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে বলেন, “এটি শেল (খোলস) কোম্পানির মাধ্যমে মালিকানা লুকিয়ে রাখার বেশ পরিচিত একটা পদ্ধতি এবং এই পদ্ধতি প্রায়ই লন্ডনে কাজে লাগানো হয়।”
তিনি আরও বলেন, “এখানে যেই প্রশ্নের উত্তর নেই, তা হলো এক পক্ষকে সুবিধা দেয়ার বিনিময়ে অন্য পক্ষ অনৈতিক উপায়ে আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছে কিনা। কোনো সন্দেহ যেন না থাকে, সেজন্য এটি প্রত্যাশা করাই যুক্তিযুক্ত হবে যে, ওই প্রতিষ্ঠান ও সরকারের মধ্যে এখন পর্যন্ত যত ধরণের লেনদেন হয়েছে, সেগুলোর সকল তথ্য সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে দেয়া হোক।”
“স্বার্থের দ্বন্দ্ব”
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে বেক্সিমকো গ্রুপ যেসব বিশেষ সুবিধা ভোগ করেছে বলে জানা যায় তার মধ্যে রয়েছে সরকারি ব্যাংকে বেক্সিমকোর বিশাল অংকের অপরিশোধিত ঋণের পুনঃতফসিলিকরণ ও কোভিড-১৯ টিকার একমাত্র পরিবেশক হওয়ার সুযোগ পাওয়া।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফিরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সালমান এফ রহমানকে তার ব্যক্তিগত বেসরকারি খাত উন্নয়ন বিষয়ক উপদেষ্টা নিয়োগ করেন। পরবর্তীতে, ২০১৮ সালের বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর হাসিনা সালমান এফ রহমানকে বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টার আনুষ্ঠানিক পদে নিয়োগ দেন।
বাংলাদেশে সরকারি কর্মচারি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের উপহার বা উপঢৌকন গ্রহণ করার বিষয়ে বিধিমালা রয়েছে। এই বিধিমালার অধীনে সরকারি কর্মচারিরা এমন কোনো উপহার গ্রহণ করতে পারবেন না যার কারণে “উপহারদাতার প্রতি তাদের কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়।” এছাড়াও বাংলাদেশের একটি আইন রয়েছে যার অধীনে মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তারা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মূল্যের অধিক কোনো উপহার পেলে তা সরকারি তোষাখানায় জমা দিতে বাধ্য থাকবেন।
সরকারি কর্মচারিদের জন্য এধরণের আচরণবিধি থাকলেও, সংসদ সদস্য ও তাদের নিকটবর্তী পারিবারিক সদস্যরা যেন স্বার্থের দ্বন্দ্ব (কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট) ঘটে এমন আর্থিক বা অন্যান্য সুবিধা নিতে না পারেন তা নিশ্চিত করার কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই, যা অন্য অনেক দেশে রয়েছে।
স্বার্থের দ্বন্দ্ব যেন না থাকে তা নিশ্চিত করা সুশাসনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। অরগানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) তাদের টুলকিটে স্বার্থের দ্বন্দ্ব এড়াবার বিষয়ে উল্লেখ করেছে, “স্বার্থের দ্বন্দ্ব চিহ্নিত করা ও দূর করা করা সুশাসন ও গণপ্রতিষ্ঠানের উপর বিশ্বাস সমুন্নত রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
রেহানাকে বিনা ভাড়ায় বাড়িতে থাকতে দেয়ার কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বেক্সিমকো গ্রুপের মধ্যকার সম্পর্ক আসলে কেমন তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। বিশেষত, যেসব সরকারি সিদ্ধান্তে বেক্সিমকো লাভবান হয়েছে তার সাথে প্রধানমন্ত্রীর বোনকে দেয়া এই উপহারের যোগসূত্র রয়েছে কিনা সেই বিষয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়।
এছাড়া বেক্সিমকোর প্রতিও এই অভিযোগ করার সুযোগ সৃষ্টি হয় যে, প্রধানমন্ত্রীর বোনকে উপঢৌকন দিয়ে তারা ব্যবসায়িক বা অন্য সুবিধা আদায় করতে চেয়েছে। কিন্তু এই ধরণের সরাসরি কোনো তথ্য নেত্র নিউজের কাছে নেই। আর শেখ রেহানার বাড়ি সংক্রান্ত বিষয়ে অবৈধ বা অন্যায় কিছু করেননি বলে দাবি করেছেন শায়ান ও সালমান এফ রহমান।
অফশোর কোম্পানি ব্যবহার করে যুক্তরাজ্যে, বিশেষ করে লন্ডনে, সম্পত্তি কেনার যেই সুযোগ রয়েছে তা দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি-বিরোধী সংগঠনগুলো সমালোচনা করে আসছে। এসব সমালোচনার জেরে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে এই বছরের আগস্টে “ইকোনমিক ক্রাইম (ট্রান্সপারেন্সি অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট) অ্যাক্ট ২০২২” বলবৎ করা হয়। এই আইনের বিধান অনুযায়ী, ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে সম্পত্তি বা জমি ক্রয়, বিক্রয়, মালিকানা বদল করতে চায় এমন সকল অফশোর কোম্পানিকে “ইউকে কোম্পানিজ হাউজে” নিবন্ধিত হতে হবে এবং কোম্পানির “বেনিফিশিয়াল ওউনার” বা মূল মালিকের তথ্য প্রদান করতে হবে।
ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে ইতিমধ্যেই সম্পত্তির মালিকানা আছে এমন সকল কোম্পানির ক্ষেত্রেও এই আইন প্রযোজ্য। এ ধরণের কোম্পানির মূল মালিকের পরিচয় ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারির মধ্যে নিবন্ধিত হতে হবে। লেডিবার্ড প্রোপার্টিজ লিমিটেড তেমনই একটি কোম্পানি হওয়ায়, এর মালিক শায়ান রহমানের মালিকানার তথ্যও এই সময়ের মধ্যে নিবন্ধিত করতে হবে। এই প্রতিবেদন প্রকাশের সময় পর্যন্ত লেডিবার্ড প্রোপার্টিজ যুক্তরাজ্যের কোম্পানিজ হাউজে নিবন্ধিত হয়নি।
খ্যাতনামা দুর্নীতি-বিরোধী বৈশ্বিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল-এর যুক্তরাজ্য শাখার প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা বেন কাউডক নেত্র নিউজকে বলেন, “যুক্তরাজ্যে অবস্থিত রিয়েল এস্টেট সম্পত্তির প্রকৃত মালিকানা গোপন রাখতে দীর্ঘদিন ধরে আইল অফ ম্যানের মতো গোপনীয়তা-সহায়ক অধিক্ষেত্রে (জুরিসডিকশন) প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি ব্যবহৃত হচ্ছে। বাইরের দেশে স্বার্থের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হওয়ার মতো বন্দোবস্ত সহ অন্যান্য ইস্যু যদি নতুন সম্পত্তি নিবন্ধকে তুলে ধরতে হয়, তাহলে এই সংক্রান্ত বিধিবিধান কার্যকর করতে কোম্পানিজ হাউজকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া আবশ্যক।”
যুক্তরাজ্যের সংসদ সদস্যের যোগসূত্র
শেখ রেহানার বিনা ভাড়ার বাড়িতে থাকা নিয়ে আরও একজন ব্যাক্তি বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে পারেন। তিনি হলেন তার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক, যিনি যুক্তরাজ্যের লেবার দলের সংসদ সদস্য। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে টিউলিপ সিদ্দিক লেবার দলের ছায়া অর্থনীতি-বিষয়ক মন্ত্রী মনোনীত হন। ছায়া অর্থনীতি-বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে তার দায়িত্বের মধ্যে ছিল অফশোর কোম্পানি নিয়ে নতুন যে আইন যুক্তরাজ্যে হয়েছে সেই বিষয়ে লেবার দলের প্রতিনিধিত্ব করা। এই আইনের অধীনে অফশোর বা যুক্তরাজ্যের বাইরে অবস্থিত যেসব কোম্পানির যুক্তরাজ্যে সম্পত্তি রয়েছে, তারা তাদের মালিকের পরিচয় প্রকাশ করতে বাধ্য।
টিউলিপ সিদ্দিক ২০২২ সালের মার্চে এক বক্তব্যে বলেন, “রাশিয়া এবং অন্যান্য স্থান থেকে দীর্ঘকাল ধরে নোংরা অর্থ যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করলেও কনজারভেটিভ দল এ নিয়ে নিষ্ক্রিয় থেকেছে। একারণেই কোম্পানিজ হাউজ বিষয়ক সরকারের যেই প্রস্তাব তা যথাযথভাবে খতিয়ে দেখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবার আগে টিউলিপ সিদ্দিক আওয়ামী লীগের কাজ করতেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল ফোর নিউজের একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ টিউলিপের নির্বাচনি প্রচারণায় ব্যাপকভাবে কাজ করেছিল। তারা লেবার পার্টির ভাড়া করা একটি অফিসও কার্যত এ কাজের জন্য নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। তবে টিউলিপ সিদ্দিক বলেছেন এসব দাবি সম্পূর্ণ অসত্য।
আবাসন সংকট চলাকালে অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে লন্ডনে জমি ও বাড়ির মালিকানা থাকার বিরোধিতা টিউলিপ অনেক আগ থেকেই করে এসেছেন। অথচ, তার নিজের মা ওই ধরণের একটি বাড়িতে বিনা ভাড়ায় থাকছিলেন।
যেমন, ২০১৫ সালে টিউলিপ সিদ্দিক যখন প্রথম এমপি হবার জন্য প্রচারণা চালাচ্ছিলেন তখনও তিনি বিদেশি ক্রেতার কাছে সম্পত্তি বিক্রি নিষিদ্ধ করার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এমপি হিসেবে নির্বাচিত হবার পরপরই তিনি অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে লন্ডনে সম্পত্তি কেনার সমালোচনা করেন।
তিনি তখন অভিযোগ করে বলেছিলেন, “বর্তমানে এভাবে সম্পত্তির মালিকানা অর্জনের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধের যেই অভাব রয়েছে তা মেনে নেওয়া যায় না। এর ফলে নিজেদের শহরেই ভবিষ্যতে ঠাঁই পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠছে লন্ডনবাসীদের জন্য।”
“বিভিন্ন অফশোর ট্রাস্ট নতুন সব সম্পত্তি কিনে নেবার কারণে কৃত্রিমভাবে বাড়ির মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং এই পরিস্থিতি নিরসনে সরকার কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি, [এবং] তা থেকেই প্রমাণিত হয় যে আবাসন খাতের সংকট মোকাবেলায় সরকার ব্যর্থ হয়েছে ,” বলেন টিউলিপ।
টিউলিপ সিদ্দিকের সংসদীয় কার্যালয় থেকে দেয়া একটি বক্তব্যে বলা হয়েছে, তার মা যেই বাড়িতে থাকেন সেখানে তিনি “কখনও বসবাস করেননি”। বিবৃতিতে বলা হয়, “তার মার বসবাসের যেই বন্দোবস্ত তাতে তিনি জড়িত নন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাবার পর থেকে তিনি কখনোই তার মার সাথে বসবাস করেননি।”
“কোন অনুচিত সম্পর্ক নেই”
নেত্র নিউজ সালমান এফ রহমান, শায়ান রহমান, শেখ রেহানা ও শেখ হাসিনার কাছে তাদের বক্তব্য জানতে চেয়েছে।
আইনজীবীর মাধ্যমে শায়ান রহমান জানান, তিনিই ওই বাড়ির মূল (বেনিফিশিয়াল) মালিক এবং সেখানে থাকার জন্য শেখ রেহানা চুক্তি করেছেন। অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে কেন মালিকানা গোপন রাখা হলো, সেই বিষয়ে তিনি সরাসরি কোনো মন্তব্য করেননি।
তবে তিনি বলেছেন, বাড়িটি কেনা হয়েছে সম্পূর্ণ বৈধ প্রক্রিয়া ও নীতিমালা অনুসরণ করে। একটি প্রতিষ্ঠিত, লাইসেন্সকৃত, স্বাধীন কর্পোরেট ও ট্রাস্ট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মালিকানা ধারণ করা হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানটি আইল অফ ম্যান দ্বীপে অবস্থিত এবং মালিকানা ধারনকারী কোম্পানি সকল ধরণের কর নীতিমালা মেনে চলে।
তিনি ও তার পিতা সালমান এফ রহমান আরও দাবি করেছেন যে এই বাড়িতে বিনা পয়সায় শেখ রেহানাকে থাকতে দেয়ার বিনিময়ে সরকারের সঙ্গে তাদের কোনো অনুচিত আর্থিক সম্পর্ক তৈরি হয়নি।
শায়ানের পিতা সালমান এফ রহমান শেখ রেহানাকে আর্থিক সহায়তা প্রদানের একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তার বক্তব্য, ১৯৭৫ সালের আগস্টে এক অভ্যুত্থানে শেখ রেহানার পিতা, বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের যেই ১৬ সদস্য নিহত হন, তাদের মধ্যে ছিলেন সালমান এফ রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু শেখ কামাল। এ ঘটনার পর তিনি কামালের বোন শেখ রেহানাকে সহায়তা করাটা নিজের দায়িত্ব বলে মনে করেন।
সালমান এফ রহমান জানান, শেখ কামালের অনুপস্থিতিতে তার এতিম বোনের বড় ভাইয়ের ভূমিকা পালনের তাগিদ অনুভব করেছেন। তার ভাষ্যমতে, শেখ রেহানার সঙ্গে তার দীর্ঘকালের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বাংলাদেশে সুবিদিত। তাদের উভয়ের নিজ নিজ সন্তানরাও পরস্পরের ঘনিষ্ঠ পারিবারিক বন্ধু।
সালমান এফ রহমান আরও বলেন যে, বেক্সিমকোর সাফল্যের পেছনে রয়েছে প্রতিষ্ঠাতাদের ব্যবসায়িক মেধা। এই সাফল্য সরকারের অনুগ্রহে ঘটেনি।
তিনি বলেন, ঋণ পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে বেক্সিমকো কোনো ধরনের অন্যায় সুবিধা ভোগ করেনি। ২০১৫ সালে “লার্জ লোন রিস্ট্রাকচারিং পলিসি (বৃহৎ ঋণ পুনর্গঠন নীতিমালা)” নামে বাংলাদেশ ব্যাংকের যেই নীতিমালা হয় তার অধীনে অনেকগুলো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান তাদের ঋণ পুনর্গঠন করতে সক্ষম হয়। বেক্সিমকো ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম মাত্র।
তবে তখন বাংলাদেশের সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে উঠে আসে যে, বেক্সিমকোর আবেদনের প্রেক্ষিতেই বাংলাদেশ ব্যাংক ওই নীতিমালা করে। আর বেক্সিমকোর ঋণ ছিল মোট পুনর্গঠিত ঋণের এক-তৃতীয়াংশ।
সালমান এফ রহমান আরও দাবি করেন, করোনাভাইরাসের টিকা পরিবেশনের অনুমোদন পাবার ক্ষেত্রে তিনি কোনো অন্যায় সুবিধা গ্রহণ করেননি। বেক্সিমকো ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যকার চুক্তিটি শুধুমাত্র তার কোম্পানিকে একচেটিয়া ব্যবসা করার সুযোগ দেয়নি। বরং অন্য সব প্রতিযোগী কোম্পানিকেও টিকা পরিবেশনের অনুমোদন গ্রহণের জন্য উৎসাহিত করা হয়েছিল। তিনি আরও দাবি করেন যে, বাংলাদেশ সরকারকে বিপুল পরিমাণ টিকার সংরক্ষণ ও পরিবেশন সেবা বেক্সিমকো বিনামূল্যে প্রদান করেছে।
তবে এক আর্থিক প্রতিবেদনে বেক্সিমকো ফার্মা নিজেই উল্লেখ করেছিল যে, ভ্যাকসিন পরিবেশন ফি বাবদ লাভের কারণে ২০২১-২২ অর্থবছরে তাদের বার্ষিক মুনাফা ৪১% বৃদ্ধি পায়।
বেক্সিমকোর ভাইস-চেয়ারম্যান দাবি করেন যে, তিনি ২০০০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত দীর্ঘকাল আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করছেন। শেখ রেহানার সাথে তার বন্ধুত্ব ও বাসস্থানের বন্দোবস্ত থেকে তিনি কোনো রাজনৈতিক ফায়দা লাভ করেননি।
সালমান এফ রহমান ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা হওয়ার অনেক আগেই শেখ রেহানার সেই বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। তিনি আরও বলেন, তার ব্যবসায়িক সাফল্যের কারণে নির্বাচনের পর তিনি মন্ত্রী হবেন এমন কথা গণমাধ্যমে প্রচার হলেও তিনি মন্ত্রী পদ পাননি। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্তি তার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতারই ধারাবাহিকতা মাত্র।
শেখ রেহানার আইনজীবীদের সঙ্গেও নেত্র নিউজের কথা হয়েছে। সেই কথোপকথন অনুযায়ী, শেখ রেহানা মেনে নিয়েছেন যে, তিনি শায়ান রহমানের মালিকানাধীন বাড়িতেই বিনা ভাড়ায় থাকেন। তবে তিনি বলেন, রহমান পরিবারের সঙ্গে যেই বন্দোবস্ত, তাতে অনুচিত কিছু নেই, কেননা রহমান পরিবারের সাথে তার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব রয়েছে। তিনি আরও দাবি করেছেন যে, এই ব্যবস্থার ফলে রহমান পরিবারের অতিরিক্ত সুবিধা হয়েছে এতটুকু যে, তাদের বাড়িটি ভালোভাবে দেখভাল করে রাখছেন এমন একজন ব্যাক্তি, যাকে তারা বিশ্বাস করেন।
নেত্র নিউজ আরও অবগত যে, রেহানা দাবি করছেন, ওই বাড়িতে থাকার ফলে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে, যেহেতু তিনি বিশ্বাস করেন বাড়ির ঠিকানা প্রকশিত হলে তার নিরাপত্তা হুমকিতে পড়তে পারে। কিন্তু অফশোর কোম্পানির মালিকানাধীন বাড়িতে থাকলে বাড়ির ঠিকানা বা বাড়ির অধিবাসীদের পরিচয় গোপন থাকে না, যেমনটা রেহানার আইনজীবীরা পরোক্ষভাবে দাবি করেছেন। আমরা যুক্তরাজ্যে বাড়ি খোঁজার সুপরিচিত ও জনপ্রিয় মাধ্যম ব্যবহার করে খুব দ্রুতই রেহানার ঠিকানা খুঁজে পেয়েছি।
অফশোর কোম্পানির মালিকানাধীন বাড়ি থাকার একমাত্র অতিরিক্ত সুবিধা হলো, বাড়ির মালিকের পরিচয় গোপন থাকে। অফশোর কোম্পানির বদলে প্রকাশ্য ব্যাক্তি-মালিকানাধীন কোনো বাড়িতে শেখ রেহানা থাকলে তার বসবাসের ঠিকানা ফাঁস হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যেত বা কমে যেত — এমনটা মনে করার যুক্তিযুক্ত কারণ নেই।
নেত্র নিউজ এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও যোগাযোগ করে। তবে তিনি মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেননি।
উত্তর লন্ডনের বাড়ি
উত্তর লন্ডনের এক শান্ত, অভিজাত এলাকায় একটি সেমি-ডিটাচড বাড়ি। ২০১১ থেকে যুক্তরাজ্যে এলেই এই বাড়িতে বাস করেন ৬৫ বছর বয়সী শেখ রেহানা। বাড়িটি কেনা হয় ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের এক বছরের কিছু সময় পর। বাড়িটি ১২ লাখ পাউন্ড (প্রায় ১৫.৪ কোটি টাকা) দিয়ে কেনে লেডিবার্ড প্রোপার্টিজ লিমিটেড।
যুক্তরাজ্যের ভূমি নিবন্ধন রেকর্ডের তথ্য থেকে ইঙ্গিত মেলে, বাড়িটি কোনো বন্ধক ছাড়াই কেনা হয়েছিল। অর্থাৎ নগদ টাকায় বাড়িটি কেনা হয়েছে বলে ধারণা করা যায়। তবে ১৪ মাস পর, অর্থাৎ ২০১২ সালের এপ্রিলে এবং ২০১৮ সালের এপ্রিলে দুইবার এই বাড়ির বিপরীতে পৃথক পৃথক মূল্য নিবন্ধিত করে বার্কলিস ব্যাংক। এ থেকে ধারণা করা যায়, লেডিবার্ড প্রোপার্টিজ এই সম্পত্তির বিপরীতে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে।
বাড়িটিতে আছে চারটি শোবার ঘর, দু’টি হলওয়ে, একটি অভ্যর্থনা কক্ষ, একটি স্টাডি, একটি টিভি লাউঞ্জ, একটি ডাইনিং রুম, একটি রান্নাঘর। সেই সাথে আছে কয়েকটি ইউটিলিটি ও স্টোর রুম। ২০২০ সালে একটি চিলেকোঠা স্থাপন ও অন্যান্য সংস্কারের জন্য অনুমোদন গ্রহণ করা হয়। সংস্কার কাজ সমাপ্ত হয়েছে কিনা তা অস্পষ্ট। কিন্তু হয়ে থাকলে পরিকল্পনাপত্র অনুযায়ী, এতে করে বাড়িতে আরও দু’টি শোবার ঘর যুক্ত হয়েছে। সেক্ষেত্রে বাড়িটিতে শোবার কক্ষ থাকবে ছয়টি।
যখন নেত্র নিউজ জানতে পারে যে শেখ রেহানা এই বাড়িতে বসবাস করছেন, তখন আমরা জানার চেষ্টা করি, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর একমাত্র বোন, যার উল্লেখযোগ্য আয়ের কোনো উৎস বা রেকর্ড নেই, তিনি কী করে এমন একটি বাড়িতে বসবাসের ব্যয় বহন করতে পারেন?
যদি তিনি বাড়ির মালিক হয়ে থাকেন, তাহলে প্রশ্ন ওঠে কীভাবে তিনি এই বাড়ি কিনতে সক্ষম হলেন। যদি না হয়ে থাকেন, তবে তিনি কী করে প্রতি মাসে প্রায় ৫ লাখ টাকা ভাড়া দিয়ে থাকছেন। এরপরই বাড়ির মালিক লেডিবার্ড প্রোপার্টিজ নিয়ে আমরা অনুসন্ধান শুরু করি।
আইল অফ ম্যান কোম্পানি নিবন্ধকে দেখা যায় যে, লেডিবার্ড প্রোপার্টিজ লিমিটেডের মালিক হলো ট্যানউড লিমিটেড নামের আরেকটি আইল অফ ম্যানে নিবন্ধিত শেল কোম্পানি। ট্যানউড লিমিটেডের মালিক হলো আরেকটি কোম্পানি যার নাম অ্যাস্টন ইন্টারন্যাশনাল। এটিও আইল অফ ম্যানে নিবন্ধিত।
তবে এগুলোর অফিসের ঠিকানা একই। এদের অনেকগুলো কোম্পানিরই নমিনি পরিচালক ছিল অভিন্ন। শেল কোম্পানির আড়ালে প্রকৃত মালিকের পরিচয় গোপন রাখতে এই কৌশল ব্যবহার করা হয়। ফলে এই নথিগুলো থেকে লেডিবার্ড প্রোপার্টিজের প্রকৃত মালিকের পরিচয় তখন জানা যায়নি।
ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের ভূমি নিবন্ধন রেকর্ডে পাওয়া যায় কিছু প্রশ্নের উত্তর। সেখানে এই সম্পত্তি ক্রয়ের রেকর্ড পাওয়া যায়। ভূমি ক্রয়ের রেকর্ডে, লেডিবার্ড প্রোপার্টিজের ঠিকানায় উল্লেখ আছে “প্রযত্নে জসওয়াল জনস্টন”।
এই সূত্র ধরে খুঁজতে গিয়ে আমরা জানতে পারি জসওয়াল জনস্টন হলো লন্ডনের একটি আইনি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে বলা হয়, জসওয়াল জনস্টন “অতি সম্পদশালী স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যক্তিবর্গ ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের” “অত্যন্ত বিশ্বস্ত পরামর্শক” হিসেবে কাজ করে থাকে।
প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে এই বিষয়ে নেত্র নিউজ যোগাযোগ করে। তখন সেখান থেকে জানানো হয়, “এই বিষয়ে কোনো তথ্য সরবরাহ করার নির্দেশনা নেই।”
তবে জসওয়াল জনস্টনের একটি বাংলাদেশ-সংযোগ খুঁজে পাওয়া যায়। নেত্র নিউজ যোগাযোগের আগ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম অংশীদার মালিকানাধারী আইনজীবী সন্দ্বীপ জসওয়াল সম্পর্কে তাদের ওয়েবসাইটে লেখা ছিল, তিনি “বাংলাদেশের বৃহত্তম ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর পক্ষে বহুবিধ বিষয়ে কাজ করছেন।”
বিভিন্ন ব্যবসায়ী সূত্রের মাধ্যমে নেত্র নিউজ নিশ্চিত হয় যে, যুক্তরাজ্যে বেক্সিমকোর অন্যতম প্রধান আইনজীবী হলেন জসওয়াল জন্সটন। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনে ২০১৬ সালে শায়ান রহমানের সংযুক্ত আরব আমিরাত-ভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানের দাখিল করা নথিতে দেখা যায়, জসওয়াল জনস্টন ছিলেন শায়ান রহমানের আইনজীবী।
এখান থেকে লেডিবার্ড প্রোপার্টিজ ও বেক্সিমকোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ যোগসূত্র পাওয়া যায়। এরই সূত্র ধরে বেক্সিমকোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যাক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করে নেত্র নিউজ। এদের একজন নেত্র নিউজকে জানান যে, লন্ডনের বাড়িটির মালিক এর ভাইস-প্রেসিডেন্ট সালমান এফ রহমান নন, কেননা বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে তিনি দেশের বাইরে সম্পত্তির মালিক হতে পারেন না। এর মালিক হলেন বেক্সিমকোর অন্য একজন সদস্য যিনি ব্রিটিশ নাগরিক। এরপর থেকে আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় তার ছেলে শায়ান রহমানের দিকে, কারণ আমরা জানতে পারি যে শায়ানের ব্রিটিশ নাগরিকত্ব রয়েছে।
যুক্তরাজ্যের কোম্পানিজ হাউজে তথ্য খুঁজতে গিয়ে আমরা শায়ান রহমান ও লেডিবার্ড প্রোপার্টিজ লিমিটেডের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে পাই। বাড়িটি কেনার আগে, অর্থাৎ ২০০৭-২০১০ পর্যন্ত শায়ান এস গেমস লিমিটেড নামে যুক্তরাজ্যের একটি কোম্পানির পরিচালক ছিলেন। তবে পরবর্তীতে এই এস গেমস লিমিটেড-এর শেয়ারধারী বনে যায় দুটি কোম্পানি। এর একটি হলো গারউড লিমিটেড। আরেকটি হলো ট্যানউড লিমিটেড। এই ট্যানউড লিমিটেডই লেডিবার্ড প্রোপার্টিজের অন্যতম মালিক। অপরদিকে গারউড লিমিটেডও আইল অফ ম্যানে নিবন্ধিত। আবার এই গারউড লিমিটেড হলো অ্যাস্টন ইন্টারন্যাশনালের অন্যতম মালিক। আর অ্যাস্টন ইন্টারন্যাশনাল হলো ট্যানউড লিমিটেডের অন্যতম মালিক।
এভাবেই আমরা লেডিবার্ড প্রোপার্টিজের সঙ্গে শায়ান রহমানের সংশ্লিষ্টতার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাই। পরবর্তীতে শায়ান রহমান নিজেই বিষয়টি স্বীকার করেন।
শেখ রেহানা
১৯৭৫ এর আগস্টের অভ্যুত্থানে পিতা, মা, ভাই সহ পরিবারের ১৬ সদস্য হত্যাকাণ্ডের শিকার হবার পর অত্যন্ত মর্মান্তিক পরিস্থিতিতে লন্ডনে পৌঁছান শেখ রেহানা। এই হত্যাযজ্ঞ যখন ঘটে তার আগে রেহানার পিতা, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া চালাচ্ছিলেন। তিনি সব স্বাধীন গণমাধ্যম বন্ধ করে দিয়েছিলেন এবং শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক দল থাকার বিধান করেছিলেন, যার নাম ছিল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল)।
যখন হত্যাকাণ্ডটি ঘটে তখন রেহানা ছিলেন জার্মানিতে। কিন্তু তিনি এরপর দ্রুত যুক্তরাজ্যে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন এবং পেয়ে যান।
ওই সময়কার স্মৃতিচারণে তিনি বলেন, “আমি মরিয়া হয়ে চাকরি খুঁজে বেড়াতাম কিলবার্নের রাস্তায় রাস্তায় কারণ আমার থাকারও কোনো জায়গা ছিল না। আমার খাবার কিছু ছিল না। আমি কোথায় যাব তাও জানতাম না।”
পরবর্তী ১৫ বছর বাংলাদেশ কার্যত সামরিক শাসনাধীন ছিল। গণঅভ্যুত্থানে জেনারেল এরশাদের পতনের পর দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসে ১৯৯০ সালে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়, কিন্তু ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে জিতে দলটি ক্ষমতায় আসে। আওয়ামী লীগ তার পরের নির্বাচনে ২০০১ সালে পরাজিত হলেও ২০০৯ সালে আবার বিজয়ী হয়। দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার সময় অনেকেই জোরালোভাবে আশা করেছিলেন যে বাংলাদেশের মানবাধিকার ও সুশাসন পরিস্থিতি এবার হয়তো উন্নতির দিকে যাবে।
২০০৯ সালের পর থেকে হাসিনার অধীনে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটেছে। কিন্তু বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, বিরোধীদের দমন এবং গণমাধ্যমের উপর সেন্সরশীপ চাপিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি হয়েছে ভয়াবহ। ফলে বিশ্লেষকরা নিয়মিতই হাসিনাকে “স্বৈরাচারী” হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকেন। ২০১৪ সালে হাসিনার অধীনে প্রথম জাতীয় নির্বাচন সব বিরোধী দল বর্জন করে করে। অপরদিকে, ২০১৮ সালের নির্বাচন সম্পূর্ণ জালিয়াতির মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে বলে বিবেচিত হয়।
১৯৭৫ সালে লন্ডনে যাবার পর থেকে বেশিরভাগ সময় — শুধু ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৩ এই চার বছর ব্রুনাইয়ে থাকার সময় বাদে — শেখ রেহানা লন্ডনেই থেকেছেন। সেখানেই তিনি বড় করেছেন তার তিন সন্তানকে: রাদওয়ান সিদ্দিক (ববি), রেজওয়ানা সিদ্দিক (টিউলিপ) ও আজমিনা সিদ্দিক। রেহানা পরিবার নিয়ে প্রথমে দক্ষিণ লন্ডনের মিচামে ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি উত্তর লন্ডনের বিভিন্ন বাড়িতে থাকেন। রেহানা একসময় একটি স্থানীয় লাইব্রেরিতে কাজ করতেন, কিন্তু এছাড়া তিনি আর কোনো চাকরি করেছেন কিনা তা জানা যায় না। রেহানা ২০১১ সালে যখন লেডিবার্ডের মালিকানাধীন বাড়িতে উঠেছেন, ততদিনে তার দুই মেয়ে নিজেদের কেনা ফ্ল্যাটে চলে গিয়েছেন। অপরদিকে রাদওয়ান বাংলাদেশে চলে এসেছেন।
বাংলাদেশে রেহানা আওয়ামী লীগের কোন আনুষ্ঠানিক পদ ধারণ করেন না। কিন্তু একথা সুবিদিত যে তিনি দলের ভেতর অত্যন্ত প্রভাবশালী। প্রধানমন্ত্রীর কাছেও তার উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব রয়েছে। এছাড়া রেহানাকে প্রায়ই সরকারি প্রতিনিধি দলের সাথে দেখা যায়।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওয়েবসাইটে দুই বোনের একত্রে বিভিন্ন ছবি ব্যানারে প্রদর্শিত হয়। ২০১৭ সালের রোহিঙ্গা শরনার্থীদের জন্য দেশের সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেবার সিদ্ধান্তের পেছনে রেহানার ভূমিকা ছিল তা শেখ হাসিনা নিজেই বলেছেন। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের শেষকৃত্যে অংশগ্রহণের সময় শেখ হাসিনার সঙ্গে লন্ডনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে উপস্থিত ছিলেন রেহানা। “বিশ্ব নেতৃবৃন্দের” সমবেদনা জ্ঞাপনের বইতেও তিনি স্বাক্ষর করেছেন। একটি ছবিতে দেখা যায় রেহানা সেই স্মারক গ্রন্থে স্বাক্ষর করার সময় বাংলাদেশের হাই কমিশনার তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার একটি আইন করে যার অধীনে দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতির পরিবারের সদস্যদের একটি করে বাড়ি দেয়ার দায়িত্ব বর্তায় বাংলাদেশের সরকারের ওপর। ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয় যে শেখ রেহানাকে নামমাত্র মূল্যে একটি বাড়ি দেয়া হয়েছে।
রেহানার আইনজীবীর মাধ্যমে দেয়া বক্তব্যে শেখ রেহানা দাবি করেন যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে যুক্ত হবার কোনো ইচ্ছা তার নেই। তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন তার বোনকে সমর্থন দেয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু তিনি মূলত বাংলাদেশ থেকে দূরে একজন মা ও মাতামহী হিসেবেই নির্ঝঞ্জাট জীবন যাপন করেন।
বেক্সিমকো ও রহমান পরিবার
বাংলাদেশ এক্সপোর্ট ইমপোর্ট কোম্পানি লিমিটেড বা সংক্ষেপে বেক্সিমকোই বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম ব্যবসায়িক গোষ্ঠী। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই সালমান রহমান, বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির ভাইস-চেয়ারম্যান এবং তার বড় ভাই সোহেল রহমান, বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান, এটি প্রতিষ্ঠা করেন।
বর্তমানে তৈরি পোশাক শিল্প, আবাসন উন্নয়ন, নির্মাণ শিল্প, ক্রয়-বিক্রয় বাণিজ্য, সামুদ্রিক খাদ্য, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, গণমাধ্যম, আর্থিক পরিষেবা এবং জ্বালানিসহ নানাবিধ শিল্পখাতে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। এই ব্যবসা গোষ্ঠীর ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো ফার্মা লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত প্রথম বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান। এই গ্রুপের অধীনে রয়েছে চারটি পাবলিক কোম্পানি এবং অসংখ্য ব্যাক্তিমালিকানাধীন কোম্পানি।
ঋণ খেলাপি হিসেবে বাংলাদেশে বেক্সিমকোর বিশেষ পরিচিতি রয়েছে। ২০০৭ সালে মার্কিন এক কূটনৈতিক বার্তায় বলা হয়, সালমান রহমান “বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক ঋণ খেলাপিদের একজন হিসেবে অভিযোগ রয়েছে”। ২০০৯ সালে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরপরই, ৩৫৩.৮৯ কোটি টাকার ঋণ বকেয়া থাকায় বেক্সিমকো টেক্সটাইলকে দেশের বৃহত্তম ব্যাংক ঋণ খেলাপি প্রতিষ্ঠান হিসাবে চিহ্নিত করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। শুধু তাই নয়, সেসময় তিনি আরও জানিয়েছিলেন যে, ব্যাংকের ঋণ খেলাপ করা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় বেক্সিমকোর অন্যান্য অঙ্গ-প্রতিষ্ঠানগুলোও উল্লেখযোগ্য অবস্থানে আছে। ১৩৪.৩৫ কোটি টাকা (১১.৫ মিলিয়ন পাউন্ড) খেলাপি ঋণের অভিযোগ নিয়ে তালিকার ষষ্ঠ স্থানে ছিল বেক্সিমকোর শাইনপুকুর হোল্ডিংস। আর বেক্সিমকো নিটিং সেসময় ৮১.০৬ কোটি টাকা (৭ মিলিয়ন পাউন্ড) ঋণ খেলাপ করে। সেসময় বেক্সিমকোর ঋণ খেলাপি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করায় দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্র প্রথম আলোর বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দেন সালমান রহমান। তিনি দাবি করেন, প্রতিবেদনের তথ্য পুরোনো। এই ঘটনার কয়েক মাস পরই সরকার ঘোষণা দেয় যে বেক্সিমকোর ঋণ খেলাপি নয়।
২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা নির্বাচিত হবার পর, বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিরা ইঙ্গিত করেন যে, বেক্সিমকো তার ব্যাংক সংক্রান্ত বেশিরভাগ কর্মকাণ্ড বেসরকারি মালিকানাধীন ব্যাংক থেকে সরকারি ব্যাংকগুলোর দিকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পাঁয়তারা করছে। ২০১৪ সালের আগস্টে বেক্সিমকো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের শরণাপন্ন হয় বলে জানা যায়। ওই সময় প্রতিষ্ঠানটির বকেয়া ঋণ ছিল ৫,২৪৫ কোটি টাকা (৫০৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এই ঋণ পুনঃতফসিল করার আবেদন জানায় প্রতিষ্ঠানটি।
শুধুমাত্র এই আবেদনের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহৎ ঋণ পুনঃতফসিল করার বিষয়ে সম্পূর্ণ নতুন একটি নীতিমালাই প্রণয়ন করে বসে। তবে সেক্ষেত্রে শুধু বেক্সিমকো নয়, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকেও আবেদন করার সুযোগ দেয়া হয়। ডেইলি স্টারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেসময় ১১টি বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠী এই সুযোগটি গ্রহণ করে। তবে এর মধ্যে বেক্সিমকোর ঋণই ছিল মোট পুনঃনির্ধারিত ঋণের এক-তৃতীয়াংশ।
তিন বছর পর বেক্সিমকো আবারও ঋণ সংক্রান্ত সমস্যায় পড়ে। এবার সরকারি মালিকানাধীন সোনালি ব্যাংকের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ শোধ করতে আবারও ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারস্থ হয় বেক্সিমকো। বাংলাদেশ ব্যাংক এতেও সম্মতি দেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান এর সমালোচনা করে বলেন: “পরিচয় বা ক্ষমতা যাই হোক না কেন, কোনো ঋণ খেলাপিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি নির্ধারণ করে দেয়া ও ব্যাংককে তার নিজেরই নীতিসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করানোর ক্ষমতা দেয়া যাবে না। বিশেষ আনুকূল্যে প্রাপ্ত অফুরন্ত পুনঃতফসিলের মেয়াদ অসাধুভাবে বৃদ্ধি করার ক্ষমতা দেয়া যাবে না। পাশাপাশি, বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেকে এভাবে জিম্মি বানিয়ে ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিতে পারে না।”
এর জবাবে, বেক্সিমকো তাদের আর্থিক দুরবস্থার জন্য বিগত সরকারকে দায়ী করে। এক চিঠিতে প্রতিষ্ঠানটি লিখে, “বেক্সিমকোর বিরুদ্ধে বিএনপি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলের সাত বছরে ক্রমাগত বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে, যার ফলে প্রতিষ্ঠানটির মধ্যে তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়। যার ফলস্বরূপ আমরা ব্যাংকগুলোকে সময়মতো অর্থ ফেরত দিতে পারি নি। আমাদের মতো একটি বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য এসব এতটাই গুরুতর ছিল যে আমরা এখনও এর প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারিনি।”
এছাড়া নিউইয়র্ক টাইমসকে লেখা এক চিঠিতে সালমান এফ রহমান দাবি করেন: “[ঋণ] পুনঃতফসিল করা না হলে আমরা আমাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হতাম, যার ফলে ৬০,০০০-এরও বেশি মানুষ কর্মসংস্থান হারাতো, যা দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলতো।”
এই বেক্সিমকো গ্রুপের “নির্বাহী পরিচালক” এবং “উপদেষ্টা” উপাধি ছাড়াও, শায়ান রহমান বেক্সিমকোর বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক। তিনি ব্রিটিশ এশিয়ান ট্রাস্টের উপদেষ্টা বোর্ডেরও সদস্য। ইংল্যান্ডের বর্তমান রাজা তৃতীয় চার্লস যুবরাজ পদে থাকা অবস্থায় ব্রিটিশ এশিয়ান ট্রাস্ট গঠন করেন এবং এই ট্রাস্টের বাংলাদেশ বিভাগের চেয়ারম্যান শায়ান।
দুর্নীতি-বিরোধী বিধিমালা
বিশ্বের অনেক দেশেই সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের উচ্চ নৈতিক মানদণ্ড বজায় রাখতে এবং স্বার্থের দ্বন্দ্ব বা দ্বন্দ্বের উপস্থিতি পরিহার করতে আচরণবিধি বা আইন প্রণয়ন করেছে। যেমন, যুক্তরাজ্যে মন্ত্রীদের জন্য নির্ধারিত আচরণবিধি অনুযায়ী, “মন্ত্রীদের এমন কোনো উপহার বা আতিথেয়তা গ্রহণ করা উচিত নয় যা তাদের বিচার-বিবেচনায় আপোষ করতে উদ্বুদ্ধ করে বা তাদের একটি অনুপযুক্ত বাধ্যবাধকতার অধীনে রাখতে পারে।” “যদি তাদের পরিবারের কোনো সদস্যকে উপহার ইত্যাদি দেওয়ার চেষ্টা করা হয়,” সেক্ষেত্রেও এই বিধিমালা প্রযোজ্য।
বাংলাদেশেও “সরকারি কর্মচারি (আচরণ) বিধি” শিরোনামে ১৯৭৯ সালের একটি প্রবিধান রয়েছে যেখানে একজন সরকারি কর্মচারি বা তার পরিবারের সদস্য কারও কাছ থেকে উপহার গ্রহণ করার ব্যাপারে স্পষ্ট বিধিনিষেধ রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, “কোনো সরকারি কর্মচারি, সরকারের পূর্ব অনুমোদন ব্যতীত, তার পরিবারের কোনো সদস্যকে, কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে এমন কোনো উপহার গ্রহণ করার অনুমতি দেবেন না, যাতে করে উপহার প্রাপ্তি তাকে উপহারদাতার প্রতি কোনো ধরনের বাধ্যবাধকতার অধীনে রাখবে।”
বাংলাদেশে সংসদ সদস্য বা মন্ত্রীদের ক্ষেত্রে অনুরূপ কোন বাধ্যবাধকতা নেই। সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী ২০১০ সালে একটি বিল উত্থাপন করেছিলেন, “দ্য কোড অব কন্ডাক্ট অব দি এমপিস বিল” বা “সংসদ সদস্যদের জন্য আচরণবিধি” শিরোনামে, যেখানে স্বার্থের দ্বন্দ্ব সীমিত করার জন্য সাতটি নির্দেশিকা ছিল। কিন্তু বিলটি সংসদে বিতর্কের জন্য উঠেনি।
এই ধরণের আচরণবিধি বা নির্দেশাবলি সাধারণত দুর্নীতির চেষ্টা এবং দুর্নীতির উপস্থিতি প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে প্রণয়ন করা হয়। ২০২১ সালে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল নিচের দিকে – বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৪৭তম।
২০১৩ সালে, পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে প্রদেয় ১২০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ চুক্তি বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। এক্ষেত্রে “বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে উচ্চ-স্তরের দুর্নীতির ষড়যন্ত্র”-কে কারণ হিসেবে উল্লেখ করে প্রতিষ্ঠানটি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য বিশ্বব্যাংকের এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে দাবি করেন, এটি দেশের বিরুদ্ধে “একটি ষড়যন্ত্র”।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন যে তিনি “দুর্নীতি সহ্য করেন না”, তার পরিবারের নামে প্রতারণার বিরুদ্ধে সতর্ক করেছেন, এবং বেশ কয়েকটি দুর্নীতিবিরোধী অভিযানও তার সরকারের অধীনে পরিচালিত হয়েছে৷ সমালোচকরা অবশ্য বলেছেন যে সরকারের দুর্নীতি-বিরোধী অভিযানগুলো মূলত সুবিধাবাদী বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য-প্রণোদিত। দেশের বহুখাতে দুর্নীতি বিরাজ করলেও সরকার নিষ্ক্রিয়।●
সংশোধন, ২০ ডিসেম্বর ২০২২: এই প্রতিবেদনে ব্রিটিশ পাউন্ড থেকে বাংলাদেশি টাকার বিনিময় মূল্যের একটি ভুল রূপান্তর সংশোধন করা হয়েছে।