হাসিনা সরকারের ইউনূস অভিযান

দুদকের আনীত নতুন অর্থ পাচারের অভিযোগ আর জোর খাটানোর তৎপরতা থেকে এটা পরিষ্কার যে সরকার এই বিশ্বখ্যাত নোবেল বিজয়ীকে একটি হুমকি বলে বিবেচনা করে।

হাসিনা সরকারের ইউনূস অভিযান
মুহাম্মদ ইউনূস। ফটো: আলামি

অর্থ পাচার আর ব্যাপকবিস্তৃত দুর্নীতিতে জর্জরিত বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গত আগস্ট মাসে এমন একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্ত চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে যাকে দেশটির সবচেয়ে স্বচ্ছ ভাবমূর্তিসম্পন্ন ব্যক্তিদের একজন বলা যেতে পারে। তিনি আর কেউ নন, শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ ইউনূস।

বর্তমান সরকারের বদৌলতে ইউনূস এখন বাংলাদেশের সর্বাধিক তদন্তকৃত ব্যক্তিদের একজন। এর আগে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) বহুবার তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আর কর প্রদানের হিসাব খতিয়ে দেখেছে। তবে এই প্রথম দুদক এই তদন্তে জড়াল। ফলে বিষয়টি খুবই জটিল হয়ে পড়েছে।

গত ৩ আগস্ট ২০২২ গ্রামীণ টেলিকমের (জিটি) বোর্ড সভাপতি ইউনূস ও বোর্ডের অন্যান্য সদস্যদের কাছে একটা চিঠি পাঠায় দুদক। উল্লেখ্য, গ্রামীণ টেলিকম একটি বেসরকারি ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, দেশের বৃহত্তম মোবাইল ফোন প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোনের মালিকানায় যার বিশাল অংশীদারিত্ব রয়েছে। তো, প্রেরিত চিঠিতে জানানো হয়, দুদক গ্রামীণ টেলিকমের বিরুদ্ধে থাকা বেশ কিছু অভিযোগ খতিয়ে দেখছে। অভিযোগগুলো হল: গ্রামীণ টেলিকম ২,৯৭৭ কোটি টাকা (৩১৪ মিলিয়ন ডলার) পাচার করেছে, ৪৫.৫ কোটি টাকা (৪.৮ মিলিয়ন ডলার) আত্মসাৎ করেছে, এবং দুদকের দেয়া হিসাব অনুসারে প্রায় ১৯.৬ কোটি টাকা (২ মিলিয়ন ডলারের বেশি) “ওকালতি ফি ও অন্যান্য ফির নামে” অবৈধভাবে হাতিয়ে নিয়েছে। ২৫ বছর আগে প্রতিষ্ঠা হওয়ার সময় থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত গ্রামীণ টেলিকমের সমস্ত হিসাবের কাগজ ও নথির বিস্তারিত দেখতে চেয়েছে দুদক। ইতোমধ্যে গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে অর্থ পাচার ও আত্মসাতের অভিযোগ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করেছে দুদক

অভিযোগগুলো অত্যন্ত গুরুতর এবং এর ফলে কয়েকটি প্রশ্ন অনিবার্যভাবেই উঠে আসে। এতকাল আমরা ইউনূসকে যেমনটা জেনে এসেছি, একজন দুর্নীতিমুক্ত ব্যক্তি বলে, সেই জানাটা কি ভুল ছিল? আমরা কি তাকে চিনতে ভুল করেছিলাম? নাকি এই তদন্ত তাকে হয়রাণি ও নাজেহাল করার উদ্দেশ্যে শুরু হয়েছে? আর এই ছুতোয় তার প্রতিষ্ঠানটিকে দখল করাও এই তদন্তের আরেকটা উদ্দেশ্য?

হাসিনা আর ইউনূস

শুরুরও একটা শুরু আছে। মুহাম্মদ ইউনূস যে শেখ হাসিনার চক্ষুশূল, তা কেবল আজকের কথা নয়। ১৯৯৬ সালে হাসিনা সরকার প্রথমবারের মত ক্ষমতায় আসে। তারপর ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি সই হয়। বাজারে এরকম একটা কথা চালু আছে যে, সেসময় হাসিনা আশা করেছিলেন এই চুক্তি বাস্তবায়নের পুরস্কার হিসেবে তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়ে যাবেন। কিন্তু সে আশার গুড়ে বালি। হাসিনার স্বপ্ন পূরণ না হলেও এর নয় বছর পর ২০০৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পের জন্য নোবেল জিতেন ইউনূস। আর সেই থেকেই শেখ হাসিনার চক্ষুশূল হয়ে উঠেন গ্রামীণ ব্যাংকের বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠাতা।

এখানেই শেষ নয়। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির পরের বছর ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিয়ে বসেন ইউনূস। তখনই ইউনূসের প্রতি হাসিনার আক্রোশের ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়ে ওঠে। এটি ইউনূসের নোবেল পুরস্কার পাবার এক বছর পরের ঘটনা, যার ঠিক এক মাস আগেই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভোট জালিয়াতি রুখতে ক্ষমতা দখল করেছিল সেনাবাহিনী। সেসময় সেনাবাহিনীর এই ক্ষমতা দখলকে সমর্থন জানিয়েছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু সেই ভুল ভাঙতে বেশিদিন সময় লাগেনি। কেননা কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল, সেনাবাহিনীর আসল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এই দুই রাজনৈতিক দলের পরম্পরার অবসান ঘটিয়ে তৃতীয় শক্তির উত্থানকে উৎসাহিত করা। সেই নয়া রাজনৈতিক দলের প্রধান হিসেবে হয়তো গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতাকে বিবেচনা করছিলেন তারা।

শুরুর দিকে রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়টি নিয়ে ইউনূস নিজেও বেশ উৎসাহী ছিলেন। একটি খোলা চিঠিতে এব্যাপারে জনগণের রায় চেয়েছিলেন। তবে এর ঠিক দুই মাস পরই ইউনূস ঘোষণা করেন যে এই বিষয়টা নিয়ে তিনি আর এগোতে চান না। সেই থেকেই ইউনূসকে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী আর শত্রু হিসেবে দেখতে শুরু করেন হাসিনা। সময়ের সাথে সাথে ইউনূসের প্রতি হাসিনার ব্যক্তিগত ঈর্ষা আওয়ামী লীগের দলগত ঘৃণায় রূপান্তরিত হয়।

২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করার পর হাসিনা সরকারের আক্রমণের অন্যতম প্রধান শিকারে পরিণত হন ইউনূস। প্রথমেই ২০১০ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে তাকে  সরিয়ে দেয়া হল। গণমাধ্যমে তার বিরুদ্ধে মানহানিকর প্রচারণা চালানো হল। পরবর্তী কয়েক বছর ধরে তার বিরুদ্ধে আর্থিক কেলেংকারির অভিযোগ এনে চালানো হল এমন সব তদন্ত আর অনুসন্ধান – যার কোনও ফলাফল আজও আমাদের চোখে পড়েনি।

সেই থেকে গত এক দশকে ইউনূসের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলার জন্য হেন কর্ম নেই যা হাসিনা সরকার করেনি। কখনও তার বিভিন্ন প্রকল্পে বাধা দেয়া হয়েছে, তার ও তার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ও অন্যান্য মামলা দায়ের করা হয়েছে, আবার কখনও তার বিরুদ্ধে মানিহানিকর বিভিন্ন কথা বলা হয়েছে। এসব দেখে আপাতদৃষ্টিতে অনেকের মনে হতে পারে, রাজনৈতিক দল গঠন করে রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ করতে চাওয়ায় ইউনূসকে শাস্তি দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু বিষয়টি সম্ভবত এখন আর সেখানেই সীমিত নেই। বরং এমনটা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে হাসিনা সরকারের আসল উদ্দেশ্য হল দুর্নীতির অভিযোগের মাধ্যমে ইউনূসকে সমাজের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করা। যেন তিনি বা অন্য কেউ রাজনীতিতে শেখ হাসিনার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে দাঁড়াতে না পারেন। যেন কেউই আর হাসিনাকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস না পান।    

আবারও তদন্ত আর “৩১৪ মিলিয়ন ডলার অর্থ পাচারের” অভিযোগ

এবার সরাসরি তদন্ত কাহিনীতে চলে আসা যাক।

বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বলেই জানি আমরা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতা আসলে বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী, নির্বাচন কমিশন বা আদালতের মতোই। অর্থাৎ আনুষ্ঠানিকতার বাইরে এর স্বাধীনতা সামান্যই আছে।

সরকার বা এর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা যা বলে, দুদক ঠিক তা-ই করে। ইউনূসের বিরুদ্ধে আর্থিক কেলেংকারি অনুসন্ধানও শুরু হয় সংসদে হাসিনার ভাষণের পরই, যেখানে হাসিনা গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতার বিরুদ্ধে দুর্নীতি আর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনেন।

এবার তাদের আক্রমণের শিকার হল গ্রামীণ টেলিকম, একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, ১৯৯৫ সালে ইউনূসের হাত ধরে যার যাত্রা শুরু হয়েছিল। গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অপসারণের পর এটিই সাবেক নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী ইউনূসের মূল কর্মক্ষেত্র। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের প্রথম এবং সর্ববৃহৎ মোবাইল ফোন প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোনের ৩৫% শেয়ারের মালিক। আর এখান থেকে আসা বার্ষিক লভ্যাংশের টাকা দিয়েই বিশাল আকারের বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন ইউনূস ও অন্যান্য বোর্ড সদস্যরা।

দুদক সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটিকে চিঠি দিয়েছে, যেখানে তারা অভিযোগ করেছে যে, ইউনূস আর গ্রামীণ টেলিকমের অন্যান্য বোর্ড সদস্যরা প্রতিষ্ঠানটির ৩১৪ মিলিয়ন ডলারের অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত। এটি অত্যন্ত গুরুতর একটি অভিযোগ, আর এই অভিযোগ যদি সত্যি হয়; তাহলে তাকে তার গুরুতর অপরাধের শাস্তি পেতে হবে।

তবে, এটা উপলব্ধি করতে খুব বেশি সময় লাগার কথা নয় যে, অভিযোগটা আসলে ভিত্তিহীন।

টেলিকম প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোন প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৭ সালে এবং এর বৃহত্তর অংশের মালিক নরওয়েজীয় প্রতিষ্ঠান টেলিনর। ১৯৯৯ সালে সোরোস আর্থিক উন্নয়ন তহবিল থেকে ১০.৬ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে গ্রামীণফোনের অংশীদার হয় গ্রামীণ টেলিকম। সোরোস আর্থিক উন্নয়ন তহবিল বিলিয়নিয়ার জনহিতৈষী জর্জ সোরোস কর্তৃক পরিচালিত ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশনের একটি অংশ।

গ্রামীণফোন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরবর্তী বেশ কিছু বছর, যখন বাংলাদেশের গ্রামীণ অঞ্চলগুলোতে মোবাইল ফোন ছিল রীতিমতো বিরল, প্রতিষ্ঠানটির প্রধান প্রকল্প ছিল “গ্রামীণ ফোন প্রকল্প”। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত নারীদের জন্য অর্থোপার্জনের সুযোগ তৈরি করা, যেখানে এই নারীরা তাদের আশেপাশে টেলিফোন পরিষেবা বিক্রি করে উপার্জন করার সুযোগ পেলেন। পুরস্কারপ্রাপ্ত এই প্রকল্প সমাজের সকল পর্যায়ে মোবাইল ফোনের ব্যবহার নিশ্চিত করতে বেশ কার্যকর ভূমিকা রেখেছিল; তাও আবার সেই সময়, যখন মোবাইল ফোন বাংলাদেশের বাজারে একেবারেই নতুন।

২০০৩ সালে গ্রামীণফোন তার অংশীদারদেরকে লভ্যাংশ দেয়া শুরু করে এবং তখন থেকে গ্রামীণ টেলিকম গ্রামীণফোনের বাৎসরিক আয়ের এক-তৃতীয়াংশ পেতে শুরু করে। বলা বাহুল্য, এতে প্রতিষ্ঠানটির ব্যালেন্স শিট বিশাল আকার ধারন করে। গ্রামীণফোনের বাৎসরিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১১ সাল থেকে গত ১১ বছরে এই আয় ১ বিলিয়ন ডলার এর চেয়ে কিছুটা বেশি (প্রায় ৯,৫১৭ কোটি টাকা), বছরে যা গড়ে প্রায় ৯০ মিলিয়ন ডলারের মতো (প্রদেয় কর সহ)। গ্রামীণ টেলিকমের নিজস্ব হিসাবপত্র অনুযায়ী, সমস্ত কর প্রদানের পর, ২০০৩ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটির লাভের পরিমাণ ৯১৯ মিলিয়ন ডলার (৮,৭৩৫ কোটি টাকা)।

যখন থেকে লভ্যাংশের টাকা আসতে শুরু করল, তখন থেকেই এই টাকা বিভিন্ন সামাজিক ব্যবসা বা  প্রকল্পে ব্যয় করতে আরম্ভ করে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ টেলিকম — কখনও ঋণ দিয়ে, কখনও বা সমান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে, আবার কখনও বা অনুদানের মাধ্যমে। এই বিনিয়োগগুলো থেকে তৈরি হয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি নার্সিং প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ক্যালেডোনিয়ান কলেজ অব নার্সিং। সারা দেশ জুড়ে ৪টি চক্ষু হাসপাতাল এবং ১৫০টি প্রাথমিক চিকিৎসা সেবাকেন্দ্র। একটি সৌরবিদ্যুৎ প্রতিষ্ঠান যা দেশের মোট গৃহ-সৌরবিদ্যুতের ৪০% স্থাপন করেছে। আরও অনেক কিছু। এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে যে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো স্থাপন করা হয়েছে সেগুলো অলাভজনক, এদের নীতিমালা অনুযায়ী অংশীদাররা এখান থেকে লাভের টাকা উঠিয়ে নিতে পারবেন না। শুধুমাত্র সর্বপ্রথম বিনিয়োগকৃত মূলধন তারা ফিরিয়ে নিতে পারবেন, কিন্তু তা অবশ্যই পূনরায় ব্যবসায় বিনিয়োগের মাধ্যমে ফিরিয়ে দিতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশের সভাপতি ইউনূস।

এতকিছু বলার উদ্দেশ্য হল এটি বোঝানো যে, গ্রামীণ টেলিকম ও এর অনুদানে পরিচালিত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সবই অলাভজনক। ইউনূস ও অন্যান্য পরিচালকগণ এই প্রতিষ্ঠানগুলোর লভ্যাংশের অংশীদার নন। এই প্রকল্পগুলো থেকে যা আয় হয়, তার কিছুই তারা নেন না। আয়ের সমস্ত টাকা প্রকল্পগুলোতে পুনঃবিনিয়োগ বা নতুন কোনও সামাজিক প্রকল্পে বিনিয়োগের জন্য প্রতিষ্ঠানের তহবিলে জমা থাকে। গ্রামীণ টেলিকমের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানের বোর্ড মিটিংয়ে অংশগ্রহণের জন্য ইউনূস বা অন্যান্য সদস্যরা কোনোপ্রকার সম্মানীও পান না।

তাহলে, এই ২,৯৭৭ কোটি টাকা (৩১৪ মিলিয়ন ডলার) পাচার বিষয়টির উদ্ভব আসলে কোথায়?

এই টাকা মূলত গ্রামীণ টেলিকম তাদের যেসমস্ত সামাজিক ব্যবসায় সরাসরি বিনিয়োগ করেছে তার পরিমাণ। তবে প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব হিসাবপত্র অনুযায়ী এর প্রকৃত পরিমাণ ৩,৪৫৩ কোটি টাকা (৩৬৩ মিলিয়ন ডলার)। ৩১৪ মিলিয়ন ডলারের এই হিসাব ইন্সপেক্টরেট অফ ফ্যাক্টরিস (কারখানা পরিদর্শক) কে সরবরাহ করে কোম্পানীর শ্রমিক ইউনিয়ন। অনুমান করা যায় যে টাকার অংক এখানে কম হয়েছে নিছকই ইউনিয়নের হিসাবের ভুলের ফলে। এই হিসাবই পরিদর্শক পরবর্তীতে দুদকে জমা দেন।

গ্রামীণ টেলিকম, যে প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পে বিনিয়োগ করে এবং যেখান থেকে এর পরিচালকদের কোনও রকমের আর্থিক সুবিধা নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তার কর্মকাণ্ড কীভাবে অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে সেটি একেবারেই স্পষ্ট নয়। এমনকি প্রতিষ্ঠানের নীতিমালার বাইরে কিছু করা হয়েছে এমন অভিযোগ আনারও কোনও সুযোগ নেই। প্রতিষ্ঠানটির মেমোরেন্ডাম অব অ্যাসোসিয়েশনে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অংশে উল্লেখ আছে যে, এই প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য হবে, “সর্বব্যাপী উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকল্প প্রচার করা, সহায়তা করা, নির্দেশনা দেওয়া, সংগঠিত করা, পরিকল্পনা, বিকাশ ও সমন্বয় করা এবং উৎপাদনশীল কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে, আত্মনির্ভরশীলতার প্রচার এবং দরিদ্র জনগণের জীবনমানের উন্নতির জন্য সচেতনতা তৈরিতে সহায়তা করা।”

একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান যা বাংলাদেশভিত্তিক বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পে বিনিয়োগ করে এবং যা প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে অনুসরণ করে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে, সেই প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ অর্থ পাচার হতে পারে না। দুঃখের ব্যাপার হল এই সহজ বিষয়টা বোঝার মতো ক্ষমতা বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নেই। এই তদন্ত রাজনৈতিক ভীতি প্রদর্শন ছাড়া আর কিছুই নয়।

অর্থ আত্মসাতের অন্যান্য অভিযোগ

উক্ত চিঠিতে দুদক আরও দাবি করেছে যে গ্রামীণ টেলিকমের পরিচালনা পরিষদের সদস্যদের বিরুদ্ধে ৪৫.৫ কোটি টাকা (৪.৮ মিলিয়ন ডলার) আত্মসাৎ এবং “ওকালতি ফি ও অন্যান্য ফির নামে” কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে গ্রহনের অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে।

এসব অভিযোগ অন্যান্য অভিযোগগুলোর মতোই বানোয়াট এবং এর প্রকৃতি বুঝতে হলে ২০০৬ সালের শ্রম আইন বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। ২০০৬ সালের আইন অনুযায়ী, একটি কোম্পানিকে তার লাভের ৫% কোম্পানির তৈরি বিভিন্ন তহবিলে জমা করতে হবে। এই ৫% এর ৮০% জমা করতে হবে কোম্পানি দ্বারা পরিচালিত “[শ্রমিক] অংশগ্রহণ তহবিলে” এবং তা কোম্পানির কর্মচারীদের মাঝে বন্টিত হবে; ১০% কোম্পানি দ্বারা পরিচালিত একটি “শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে” জমা হবে; এবং বাকি ১০% সরকার পরিচালিত “শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিলে প্রদান করিবে।”

যেহেতু গ্রামীণ টেলিকম কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছিল, এই আইন তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কিনা তা বিবেচনা করার দরকার আছে। কোম্পানির ভিলেজ ফোন প্রোগ্রামের মাধ্যমে তারা সারা দেশে নোকিয়া ফোন সরবরাহ করে এবং তার জন্য একসাথে ৩০০ জন পর্যন্ত কর্মচারী নিয়োগ দেয়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সংখ্যাটা ৬০-এর কাছাকাছি নেমে এসেছে।

গ্রামীণ টেলিকমের পরিচালনা পর্ষদ তাদের আইনজীবীদের পরামর্শ মোতাবেক ধরে নিয়েছিল, শ্রম আইনের কল্যাণ তহবিলের অংশ তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় যেহেতু তাদের কোম্পানি অলাভজনক। কাজেই বিতরণ করার জন্য কোন “মুনাফা” তাদের নেই। কিন্তু ২০১৭ সালে গ্রামীণ টেলিকমের সাবেক কিছু কর্মচারী শ্রম আদালতে মামলা দায়ের শুরু করেন। তারা দাবি করেন, শুধু যে গ্রামীণ টেলিকমের অংশগ্রহণ তহবিলের টাকাই তারা পাবেন তা না, বরং গ্রামীণ টেলিকম বাৎসরিক যে লভ্যাংশ  গ্রামীণফোন থেকে পায় তা কোম্পানির “মুনাফা” হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে; অর্থাৎ, সেই লভ্যাংশ তাদের প্রাপ্য অর্থের হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এর মানে দাঁড়ায় লভ্যাংশ থেকে ৫% সংগ্রহ করে তার বিশাল একটি অংশ নিলে যে টাকা হয়, যা শত শত কোটি টাকা হয় প্রতি বছর, তা মাত্র কয়েকশ কর্মচারীর মধ্যে বন্টন করে দিতে হবে।

গ্রামীণ টেলিকমের অবস্থান ছিল যে আদালতের মতে যদি কোম্পানির ৫% লভ্যাংশ কর্মচারীদের প্রাপ্য হয়, সেক্ষেত্রেও নিঃসন্দেহে গ্রামীণফোন থেকে প্রাপ্য লভ্যাংশ এই ৫% এ অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত নয়। কোম্পানির দৃষ্টিতে গ্রামীণ টেলিকমের কর্মচারীরা গ্রামীণফোনের কাজ করতেন না, তারা গ্রামীণফোনের বেতনভুক্ত ছিলেন না; এবং তারা গ্রামীণফোনের মুনাফা আয়ের জন্য কোনও কাজ করতেন না, কাজেই এতে তাদের শেয়ার থাকারও কথা না।

২০১৯ সালে কারখানা পরিদর্শক স্বয়ং এতে জড়িত হয়ে যান এবং ইউনূস ও কোম্পানির অন্যান্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে একটি ফৌজদারি মামলা দায়ের করেন। সেখানে দাবি করা হয়, তারা অংশগ্রহণ তহবিল থেকে কর্মচারীদের টাকা না দেয়া থেকে শুরু করে শ্রম আইনের বিভিন্ন অংশের লঙ্ঘন করেছেন। এই মামলা এখনও চলমান। তবে ইউনূস তার বিরুদ্ধে আনিত মামলা হাই কোর্টে কোয়াশ (নাকচ) করার চেষ্টা চালাচ্ছেন

এসব প্রক্রিয়া চলাকালীন গ্রামীণ টেলিকম কর্মচারী ইউনিয়ন কোম্পানি গ্রামীণ টেলিকমকে “ওয়াইন্ড আপ” (অবলুপ্ত) করে দেবার জন্য আদালতে একটি আবেদন দাখিল করেন। তাদের যুক্তি হলো যেহেতু কোম্পানির নোকিয়া ব্যবসা সমাপ্ত হয়ে গিয়েছে, ফলে গ্রামীণ টেলিকম আর সক্রিয় নেই। এপ্রিল মাসে কোম্পানি আদালত মামলাটি গ্রহণ করেন এবং অবলুপ্তির প্রক্রিয়া শুরু করেন।

এই গুরুতর পরিস্থিতিতে গ্রামীণ টেলিকমের পরিচালনা পর্ষদ দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন যে শ্রমিকদের কল্যাণ তহবিল হিসেবে ইউনিয়ন যে অর্থ দাবি করছে তা তারা পরিশোধ করবেন। কোম্পানি অবলুপ্ত হলে যে শুধু গ্রামীণ টেলিকমের মালিকানাধীন অর্থ হাতছাড়া হয়ে যাবে তাই না, বরং গ্রামীণফোনের উপরও এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে, যেহেতু গ্রামীণ টেলিকম গ্রামীণফোনের একটি বড় অংশীদার এবং গ্রামীণফোনের পরিচালনা পর্ষদেও তাদের পরিচালক রয়েছে।

মামলাকারী কর্মচারি ও গ্রামীণ টেলিকমের মধ্যকার ২৭ এপ্রিল ২০২২ তারিখ স্বাক্ষরিত চুক্তির অধীনে, যা নেত্র নিউজের নজরে এসেছে, কোম্পানি “এর নেট মুনাফার ৫% এর ৯০% [অর্থ এবং তার উপর] ২০১০ থেকে ২০২১-২০২২ বছরের ওপর ৪% সুদ হারে কর হিসাবের আগে” যে পরিমাণ দাঁড়ায় তা একটি “আপোসরফা অ্যাকাউন্টে… সাত কর্মদিবসের মধ্যে” পরিশোধ করবেন। এই পরিশোধিতব্য অর্থের মধ্যে কোম্পানির অংশগ্রহণ ও কল্যাণ তহবিল উভয়ই অন্তর্ভুক্ত। চুক্তি দলিল অনুসারে এর মোট পরিমাণ ৪৩৭ কোটি টাকা (৪৬ মিলিয়ন ডলার)। কিন্তু আপসরফা অ্যাকাউন্টে প্রদান করা হয় ৪০৯ কোটি টাকা (৪৩ মিলিয়ন ডলার)। এর কারণ, গ্রামীণ টেলিকমের ভাষ্যমতে, উভয় পক্ষই আবিষ্কার করে যে সুদের পরিমাণ হিসাব করতে গিয়ে একটি ভুল হয়েছিল। চুক্তিপত্রে বলা হয়েছে, “চুক্তি স্বাক্ষরের সময় ইউনিয়ন কোম্পানিকে সকল সদস্যের স্বাক্ষরকৃত একটি পত্র প্রদান করে যার মাধ্যমে ইউনিয়ন সব সদস্যের প্রতিনিধিত্ব করার মাধ্যমে তাদের পক্ষে চুক্তি করার অনুমোদন পায়।”

চুক্তি অনুসারে, আপোসরফা অ্যাকাউন্ট দুইজন ইউনিয়ন এবং একজন কোম্পানি প্রতিনিধি দ্বারা পরিচালিত হবে। কিন্তু অ্যাকাউন্টের নিয়ন্ত্রণ থাকবে ইউনিয়নের হাতে। চুক্তিতে বলা হয়েছে, “নির্ধারিত কোম্পানি প্রতিনিধি ইউনিয়ন কর্তৃক উপস্থাপিত চেক/বৈদ্যুতিন তহবিল ট্রানজ্যাকশন নির্দেশপত্রে তার সই দেবেন।” চুক্তিতে আরও উল্লেখ আছে যে “চাকুরির মেয়াদ ও সময়সীমার ভিত্তিতে কোম্পানি এবং ইউনিয়ন নির্ধারণ করবে কোন সদস্য কত টাকা পাবেন…।”

ইউনিয়ন এবং কর্মচারীদের জন্য এই চুক্তি ছিল সর্বোচ্চ প্রাপ্তি। এর বিনিময়ে ইউনিয়ন এবং কর্মচারীরা শ্রম ও কোম্পানি আদালত থেকে তাদের সব মামলা তুলে নেয় এবং চাকুরি থেকে ইস্তফা দিতে সম্মত হয়।

প্রাপ্ত অর্থ মোট ১৬৪ জন বর্তমান এবং সাবেক কর্মচারীর মধ্যে বন্টন হয়। তাতে গড়ে প্রতি কর্মচারী পাবার কথা ২.৫ কোটি টাকা (২,৬২,০০০ ডলার)। প্রত্যেক কর্মচারীর প্রাপ্য অর্থের  সুনির্দিষ্ট পরিমান ঠিক কত তা তারা কত বছর কোম্পানিতে চাকুরিরত ছিলেন তার ওপর নির্ভর করবে। চুক্তির ফলে এই কর্মচারীরা যে পরিমাণ অর্থ পেয়েছেন তা অভাবনীয়।

মোট প্রাপ্ত পরিমাণের মধ্যে শুধু ৮০% অংশগ্রহণ তহবিলের অর্থই অন্তর্ভুক্ত না, যা উপরে উল্লেখিত হয়েছে, শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের ১০% ও সেই সাথে যুক্ত। শুধু এই ১০% এর পরিমাণই ৪৫.৫ কোটি টাকা (৪.৮ মিলিয়ন ডলার)। দুদক দাবি করছে, এই ৪৫.৫ কোটি টাকা — যা আপোসরফায় প্রদত্ত টাকার অংশ — আত্মসাৎ করা হয়েছে। এই অভিযোগের ন্যূনতম কোন যৌক্তিক ভিত্তি নেই। এই অর্থ কর্মচারীদের আপোসরফার টাকা হিসেবে পরিশোধ করা হয়েছে।

দুদক আরও দাবী করেছে যে মোট টাকার যে ৬% কর্মচারীদের দেয়া হয়েছে তা গ্রামীণ টেলিকম “আত্মসাৎ” করেছে। মোট যত টাকা কর্মচারীদের দেয়া হয়েছে, ৪০৯ কোটি টাকা (৪৩ মিলিয়ন ডলার), সেই হিসাবে ৬% এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২৪.৫ কোটি টাকা (২.৩ মিলিয়ন ডলার)। কিন্তু গ্রামীণ টেলিকম বলছে যে শ্রমিক ইউনিয়ন চেয়েছিল যে এই ৬% যেন ৪৩৭ কোটি টাকার (৪৬ মিলিয়ন ডলার) ভিত্তিতে হিসাব করা হয়, যা আপোসরফা চুক্তিতে লেখা হয়েছিল। সেভাবে হিসাব করলে ৬% এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২৬.২২ কোটি টাকা (২.৭ মিলিয়ন ডলার)। কিন্তু এখানে কোন “আত্মসাৎ” নেই। ইউনিয়ন তাদের আইনজীবীদের ও আইনি খরচাদি এবং নিজস্ব পরিচালনা খরচ বহনের জন্য যা ব্যয় করেছে তার পরিমাণ হচ্ছে এই টাকা। এই টাকা কোম্পানি দেয়নি, বরং কর্মচারীরা থেকে যা পেয়েছেন সেখান থেকে প্রদান করা হয়েছে। গ্রামীণ টেলিকম তাদের প্রদেয় সব অর্থ পরিশোধের পর প্রত্যেক কর্মচারির প্রাপ্ত পরিমান থেকে থেকে ৬% কেটে রাখা হয়েছে এসব খরচ বহন করার জন্য।

জোর খাটানোর উদ্দেশ্যে আনা নতুন অভিযোগ

গ্রামীণ টেলিকমের পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে এখন একটি নতুন অভিযোগ আনা হয়েছে। এই অভিযোগ যেন আগের মিথ্যা অভিযোগের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা। নতুন এই অভিযোগে দাবি করা হচ্ছে যে গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক ইউনিয়নকে ঘুষ দেয়ার মাধ্যমে জোর খাটিয়ে আপোসরফায় রাজি করানো হয়েছে। বেশ কিছু ইউনিয়ন নেতা গ্রেফতার হবার পর এই অভিযোগ ওঠে।

নতুন এই দাবি কি পরিমাণ উদ্ভট তা বোঝার জন্য পুরো পরিস্থিতি একবার বিবেচনা করা যাক।

ইউনিয়ন/কর্মচারীরা দাবি তুলেছিলেন, প্রত্যেক কর্মচারীকে “অংশগ্রহণ তহবিল” থেকে টাকা দিতে হবে, এবং কী পরিমান টাকা তারা পাবে তার হিসাব নির্ধারন করতে গ্রামীণফোন থেকে অংশীদার হিসেবে গ্রামীণ টেলিকম যে লভ্যাংশ পায় সেই অর্থও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কোম্পানি এই দাবি মেনে নিতে অসম্মতি জানায়। তাদের যুক্তি ছিল, শ্রম আইন অনুযায়ী এই নিয়ম শুধুমাত্র লাভজনক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। গ্রামীণ টেলিকমের মতো একটি অলাভজনক কোম্পানির ক্ষেত্রে নিয়মটি খাটবে না। যদি প্রযোজ্য হয়েও থাকে সেক্ষেত্রেও গ্রামীণফোন থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। সরকারের কারখানা পরিদর্শকও গ্রামীণ টেলিকমের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন। এরপর শ্রমিক ইউনিয়ন কোম্পানি-আদালতে একটি মামলা করে, যার কারণে গ্রামীণ টেলিকমের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে যায়। ফলে বাধ্য হয়ে কোম্পানি কর্মচারীদের দাবীকৃত অর্থ পরিশোধ করে দেয় ঠিক যেভাবে তারা চেয়েছিল। যেভাবে শ্রম আইন প্রয়োগ হওয়া উচিত বলে ইউনিয়ন মনে করে তা মেনে নিয়ে আপোসরফা চুক্তি সম্পাদিত হয়। স্পষ্টতই, এখানে কারও প্রতি যদি জোর খাটানো হয়ে থাকে, তাহলে তা হয়েছে গ্রামীণ টেলিকমের ওপর।

তাহলে এই কর্পোরেট জোরজবরদস্তির অভিযোগ কোথা থেকে এল?

ইতোমধ্যেই আমরা দেখেছি, মোট পরিমাণ থেকে ২৪.৫ কোটি টাকা — যা কর্মচারীদেরকে প্রদেয় মোট অর্থের ৬% — কেটে নেয়া হয়েছিল এবং ইউনিয়নকে তাদের আইনি ও ব্যবস্থাপনা খরচ মেটাতে দেয়া হয়েছিল। ধারণা করা যায় এই টাকাকেই এখন ইউনিয়নকে ঘুষ দেয়া হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

নিঃসন্দেহে এই টাকার পরিমাণ সামান্য না এবং আইনজীবীদের বিশাল অংকের পারিশ্রমিক দেওয়া হয়েছে বলেই প্রতীয়মান। টাকার পরিমাণটা অস্বাভাবিক হতে পারে, কিন্তু ইউনিয়ন ও কর্মচারীরা যদি তা প্রদানে সম্মত হয়ে থাকে তবে তা অপরাধ হিসেবে গন্য হতে পারে না। দুদকের তদন্তের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি আরও গুরুত্ব দিয়ে খেয়াল করার মত, সেটি হল, এই অর্থ গ্রামীণ টেলিকমের না। ২৬.২২ কোটি টাকার পুরোটাই এসেছে কর্মচারীদের যে প্রাপ্য অংশ পরিশোধ করা হয়েছিল তা থেকে। এই অংশ কেটে নেয়ার সিদ্ধান্ত কর্মচারীরাই নিয়েছেন।

এসব বিবেচনা বাদ দিলেও, এই ঘুষ ঠিক কী কারণে গ্রামীণ টেলিকম দিতে চাইবে? কর্মচারীরা তাদের নিজেদের বিবেচনায় যে টাকা আইনের অধীনে তারা পান বলে মনে করেন এবং যার জন্য তারা আইনি ব্যবস্থা নিয়েছিলেন গ্রামীণ টেলিকম তাদের আপোসরফা চুক্তিতে ঠিক তাই দিতে সম্মত হয়েছে। কর্মচারীদের জন্য আপোসরফা এর চেয়ে বেশি লাভজনক হওয়া সম্ভব ছিল না। তারা যা চেয়েছিলেন ঠিক তাই নিতে রাজি করাবার জন্য কেন ঘুষ দিতে হবে?

অবশ্য আমরা কি এমনটা ভাবতে পারি না, যে এই আপোসরফা না ঘটলেই সরকার খুশি হত, কারণ সেই সুযোগে গ্রামীণ টেলিকমকে অবলুপ্ত করে দেয়া যেত?

অতঃপর…

বাংলাদেশে অনেক মানুষই আছেন, বিশেষত বিরোধী দলের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, যারা কোনও কারণ ছাড়াই জেলে ধুঁকে ধুঁকে দিন কাটাচ্ছেন। শুধুমাত্র শেখ হাসিনা সরকার যেন রাজনৈতিকভাবে আরামে থাকতে পারে, সেই কারণে এই মূল্য চুকাচ্ছেন তারা। দেশের পুলিশ ও আদালতের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বদৌলতে যাকে ইচ্ছা তাকেই আটক করে রাখতে পারে বর্তমান সরকার।

কিন্তু সরকারের দুর্ভাগ্য, এই কাজ ইউনূসের ক্ষেত্রে তারা করতে পারে না তার নোবেল পুরষ্কার খ্যাতি ও বিশ্বব্যাপী সুনামের কারণে। ইউনূসকে অন্তরীণ করা সরকারের পক্ষে শুধুমাত্র তখনই সম্ভব যদি তাদের হাতে অপরাধের অত্যন্ত শক্ত প্রমাণ থাকে। কিন্তু এত বছর ধরে খুঁজেও তারা এখনও এধরনের কিছু বের করতে পারেনি।

এখন যে তদন্তগুলো শুরু করা হয়েছে সেগুলোর মূল অর্জন হবে ইউনূসকে হয়রানি করা ও ভীতি প্রদর্শন। উদ্দেশ্য তাকে একজন বিতর্কিত ব্যক্তিতে পরিণত করা। ইউনূসের দিক থেকে যে হুমকির অনুমান প্রধানমন্ত্রীর আছে, তাও অকার্যকর হয়ে পড়বে। এটাই সরকারের আসল লক্ষ্য।

তবে তাদের আর একটি লক্ষ্যও থাকতে পারে। গ্রামীণফোনের যে লভ্যাংশ গ্রামীণ টেলিকম পায় তা কেড়ে নিতে পারার সুযোগ নিঃসন্দেহে হাতছাড়া করতে চায় না সরকার (এবং আওয়ামী লীগ)। এবং এই তদন্তগুলো হয়তো ইউনূস ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠানটির অন্যান্য পরিচালকের হাত থেকে শেয়ারের এই নিয়ন্ত্রণ ছিনিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টারই অংশ।●