নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার: একটি সাংবিধানিক সমাধান
সরকার চায়; বিরোধীদল চায়; আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও চায় — বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক পক্ষই এই বছরের শেষে বা আগামী বছরের শুরুতে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। অন্তত, এ প্রশ্নে কোথাও কোনো বিতর্ক নেই। সরকারের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধান বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দ, জাতিসংঘের কর্মকর্তাগণ, মার্কিন-ব্রিটিশ-ইউরোপীয় কূটনীতিকগণ সকলেই প্রকাশ্যেই কথাগুলো বলছেন।
আর যেই নাগরিকগণ প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অন্তর ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন বা পুনঃনির্বাচন করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত, তারাও যে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
কিন্তু সকল পক্ষের এই ঐক্যমত্য সত্ত্বেও, কীভাবে এই নির্বাচন সংবিধানের মধ্যেই একটি বিশ্বাসযোগ্য (অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী অবাধ ও সুষ্ঠু হিসেবে স্বীকৃত) ও অংশগ্রহণমূলক (অর্থাৎ, বৃহৎ দলগুলো বর্জন করবে না) পদ্ধতিতে সম্পন্ন হবে, তা নিয়ে দৃশ্যত পরস্পরবিরোধী দু’টি অবস্থানের কারণে এক ধরণের রাজনৈতিক সংকট রয়ে গেছে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও অন্যান্য বড় বিরোধী দলগুলো বর্তমান সরকারকে বিশ্বাস করে না; ফলে এই সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার কোনো তাগিদ তারা বোধ করছে না। কারণ, তাদের আশঙ্কা এতে করে কেবল ২০১৮ সালের নির্বাচনেরই পুনরাবৃত্তি ঘটবে।
অপরদিকে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচনকালীন তত্বাবধায়ক সরকার চায় না। তাদের আশঙ্কা হলো, সেক্ষেত্রে ২০০৭ সালের মতো সামরিক বাহিনী-সমর্থিত সরকারের উদ্ভব ঘটতে পারে।
উভয় পক্ষের আশঙ্কাই যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত। একই আশঙ্কা দেশের সাধারণ নাগরিকদেরও রয়েছে। কিন্তু উভয় পক্ষই নিজ নিজ দাবিতে জোরালো অবস্থানে থাকলেও, বাস্তবে দুই দলের অবস্থান আবশ্যিকভাবে পরস্পরবিরোধী নয়।
১৯৭৩ সালের পর থেকে বাংলাদেশে কোনো দলীয় সরকার যে কোনো অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করেনি, এটি একটি নির্মোহ ঐতিহাসিক সত্য। এটি এতটাই সত্য যে ১৯৯৫-৯৬ সালে ঠিক এই কারণেই তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ একটি তত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবি জানিয়েছিল। আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই বলতে চাইবে না যে, কেবল বিরোধী দলে থাকলেই তারা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়।
অপরদিকে বিএনপিও নিশ্চয়ই চাইবে না তথাকথিত এক-এগারোর সরকারের পুনরাবৃত্তি ঘটুক। কেননা, সেই সরকারের হাতেইতো দলটির নেতাকর্মীরা নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। এমনকি সেনা হেফাজতে দলটির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সনই নির্যাতিত হয়েছিলেন।
অর্থাৎ, আমরা সাহস করেই বলছি যে, এই প্রশ্নে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অবস্থানে কোনো ভিন্নতা নেই। দুই দলের অবস্থান যেহেতু এক্ষেত্রে অভিন্ন, সুতরাং বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার একটি সমাধান বাংলাদেশের সংবিধানের মধ্যেই খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা আমরা করতেই পারি।
বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দলগুলো চায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে তার পদে না রেখে নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকার একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করবে।
কিন্তু আওয়ামী লীগের মতে, এটি হবে অসাংবিধানিক। দলটির জ্যেষ্ঠ নেতারা বলেছেন, বর্তমান সংকটের যেকোনো সমাধান বর্তমান সংবিধান থেকেই আসতে হবে। “সংবিধানের মধ্যেই সমাধান খুঁজুন,” বলেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
আমরা এই নিবন্ধে ঠিক তাই প্রস্তাব করছি। অর্থাৎ, এমন একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা, যেটি কিছুটা আনকোরা হলেও সংবিধান-সম্মত। এই ব্যবস্থায় একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে বিএনপির দাবি যেমন পূরণ হবে, তেমনি এক-এগারোর মতো একটি দুর্বৃত্ত সরকার আসার বিষয়ে আওয়ামী লীগের যেই আশঙ্কা, তাও দূর হবে।
সংবিধান পঠন
বাংলাদেশের সংবিধানের একটি মৌলিক পঠন শেষে আমরা চারটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাই।
ক. প্রধানমন্ত্রী নয়, রাষ্ট্রপতির নামে নির্বাহী বিভাগ পরিচালিত হয়
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির পদটি অলঙ্কারমাত্র। তবে রাষ্ট্রপতির নামেই নির্বাহী বিভাগের সকল সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সংবিধানের ৫৫.৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: “সরকারের সকল নির্বাহী ব্যবস্থা রাষ্ট্রপতির নামে গৃহীত হইয়াছে বলিয়া প্রকাশ করা হইবে।”
অপরদিকে ৫৫.২ অনুচ্ছেদে — যেখানে প্রধানমন্ত্রীর হাতে নির্বাহী ক্ষমতা ন্যাস্ত করা হয়েছে — সেখানে বলা হয়েছে: “প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বা তাঁহার কর্তত্বে এই সংবিধান-অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রযুক্ত হইবে।”
এই দুই অনুচ্ছেদ একত্রে পড়লে বোঝা যায় যে, নির্বাহী বিভাগের বিধিসম্মত প্রধান হলেন প্রধানমন্ত্রী; তবে রাষ্ট্রপতি হলেন রাষ্ট্রের বিধিসম্মত প্রধান।
রাষ্ট্রপতির এই উচ্চতর অবস্থান সম্পর্কে আরেকটি নিশ্চয়তা পাওয়া যায় সংবিধানের ৫৪ অনুচ্ছেদে, যেখানে বলা হয়েছে যে কোনো কারণে রাষ্ট্রপতির পদ খালি হলে (৫০.৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পদত্যাগের কারণে হলেও), সংসদের স্পিকার তার স্থলে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন: “রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হইলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোন কারণে রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হইলে ক্ষেত্রমত রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত কিংবা রাষ্ট্রপতি পুনরায় স্বীয় কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্পীকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করিবেন।”
সংবিধানের তৃতীয় তফশিলও (গোপনতার শপথ বা ঘোষণা) এই ব্যবস্থা সমর্থন করে। এই তফশিল অনুযায়ী, স্পিকার “কখনও আহুত হইলে রাষ্ট্রপতির কর্তব্য” বিশ্বস্ততার সাথে পালন করার শপথ গ্রহণ করেন।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যদি অসুস্থতা, অনুপস্থিতি বা অন্য কোনো কারণে তার কর্তব্য পালন করতে না পারেন, সেই বিষয়ে কোনো সাংবিধানিক এন্তেজাম আমরা খুঁজে পাইনি।
অর্থাৎ, বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতির পদে সবসময়ই কাউকে না কাউকে অবশ্যই থাকতে হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর পদ খালি না রাখার বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নেই।
খ. নির্বাচনকালীন সরকারে প্রধানমন্ত্রী থাকার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নেই
সংবিধানের ৫৬.১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের একজন প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। ৫৫.১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, একটি মন্ত্রীসভাও থাকবে, যার প্রধান হবেন প্রধানমন্ত্রী। একইসঙ্গে ৪৮.৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, গুটিকয়েক ব্যতিক্রম ছাড়া রাষ্ট্রপতিকে সকল ক্ষেত্রেই প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন: “রাষ্ট্রপতি তাঁহার [...] দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন।”
৫৬.৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি অবশ্যই একজন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করবেন, যিনি হবেন সংসদের একজন সদস্য, যার পেছনে সংসদের বেশিরভাগ সদস্যের সমর্থন থাকবে।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর পদ যদি কোনো কারণে শূন্য হয়ে যায়, সেই পদে নতুন কাউকে নিয়োগ দেয়ার বিষয়ে রাষ্ট্রপতির উপর কোনো সময়সীমা আরোপ করা হয়নি।
অর্থাৎ, রাষ্ট্রপতি যদি প্রধানমন্ত্রী নিয়োগে কয়েক দিন, এমনকি কয়েক মাসও গ্রহণ করেন, সেই বিষয়ে সংবিধানে কোনো বিধিনিষেধ নেই। হ্যাঁ, কোনো রাষ্ট্রপতি যদি কোনো কারণে দুর্বত্ত (rogue) হয়ে উঠেন এবং সংসদের নির্বাচিত একজন প্রধানমন্ত্রীকে নিয়োগ দিতে অস্বীকৃতি জানান, সেক্ষেত্রে সংসদ অবশ্যই তাকে অভিশংসন করতে পারে। কিন্তু সেটি আলাদা বিষয়।
অন্য কথায় বলতে গেলে, বাংলাদেশের সংবিধান এমনভাবে প্রণয়ন করা হয়েছে যেন বাংলাদেশের একজন প্রধানমন্ত্রী থাকবেন; কিন্তু সবসময়ই একজন প্রধানমন্ত্রী থাকতেই হবে, তা নয়। অপরদিকে, সকল সময়েই এই প্রজাতন্ত্রের একজন রাষ্ট্রপতি থাকতে হবে।
এবং, যেই সকল সময়ে বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী-বিহীন থাকতে পারে, তার একটি হলো নির্বাচনকালীন সময়। অর্থাৎ, সংসদ ভেঙ্গে দেওয়া ও নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার গঠনের মধ্যবর্তী সময়কাল।
সংবিধানের ১২৩.৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নির্বাচনকালীন সময় হলো সর্বোচ্চ ৯০ দিন। সংবিধানে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই যে, পদত্যাগ, অসামর্থ্য বা মৃত্যুসহ কোনো কারণে প্রধানমন্ত্রীর পদ খালি হলে, তার স্থলে রাষ্ট্রপতিকে এই ৯০ দিনের মধ্যেই নতুন একজন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করতে হবে। আমরা এখানে স্পষ্ট করতে চাই যে, পূর্বের বাক্যটি সম্পূর্ণই অনুমানমূলক এবং আমরা বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।
সংবিধানের ৫৭.৩ অনুচ্ছেদে বলা আছে: “প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল থাকিতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই অযোগ্য করিবে না।” অর্থাৎ, নতুন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের আগ পর্যন্ত, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর স্বপদে বহাল থাকতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু এই অনুচ্ছেদে এমন বাধ্যবাধকতাও নেই যে, নতুন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত বিদ্যমান প্রধানমন্ত্রীকে দায়িত্ব পালন করে যেতেই হবে। বিদ্যমান প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব পালনে অস্বীকৃতি জানালে বা সামর্থ্য হারালে কী হবে, সেই বিষয়েও এই অনুচ্ছেদে কিছু বলা নেই। পাশাপাশি, নির্বাচনের সময়কালে বিদ্যমান প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী দায়িত্ব গ্রহণের আগ পর্যন্ত তাকেই স্বপদে থেকে যেতে বলার জন্য রাষ্ট্রপতির উপরও কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
গ. নির্বাচনকালীন সময়ে বা তার আগে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলেও, মন্ত্রীগণ (অনির্বাচিত টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীসহ) দায়িত্ব পালন করতে পারবেন
যদি প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হয়ে যায়, তাহলে নতুন কেউ তার স্থলে নিয়োগ পাওয়ার আগ পর্যন্ত মন্ত্রীসভার সদস্যগণকে (মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী — টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীসহ) দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে — এই মর্মে কিন্তু সংবিধানে বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
সংবিধানের ৫৮.৪ অনুচ্ছেদে এটি স্পষ্ট করে বলা হয়েছে: “প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করিলে বা স্বীয় পদে বহাল না থাকিলে মন্ত্রীদের প্রত্যেকে পদত্যাগ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে; তবে এই পরিচ্ছেদের বিধানাবলী-সাপেক্ষে তাঁহাদের উত্তরাধিকারীগণ কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তাঁহারা স্ব স্ব পদে বহাল থাকিবেন।”
প্রধানমন্ত্রী-শূন্য মন্ত্রীসভায় যেসব সদস্যরা দায়িত্ব পালন করে যেতে পারবেন, তাদের মধ্যে অনির্বাচিত মন্ত্রীরাও থাকতে পারবেন, যাদেরকে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিয়েছিলেন। ৫৬.২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, মন্ত্রীসভায় প্রতি ৯ জন নির্বাচিত সদস্যের বিপরীতে প্রধানমন্ত্রী সর্বোচ্চ ১ জন অনির্বাচিত সদস্য রাখতে পারবেন। অর্থাৎ, ১০ জন সদস্যের মন্ত্রীসভায় একজন অনির্বাচিত টেকনোক্র্যাট সদস্য থাকতে পারবেন।
মন্ত্রীসভায় একজন বা একাধিক টেকনোক্র্যাট সদস্য রাখার বিষয়টি সাংবিধানিক ও বৈধ হিসেবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ সকল বড় দলের কাছেই গ্রহণযোগ্য। এমনকি, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রীসভাতেই একাধিক অনির্বাচিত টেকনোক্র্যাট সদস্য রয়েছেন।
আর প্রধানমন্ত্রী যদি নির্বাচনকালীন সময়ের পূর্বে বা ওই সময়ে পদত্যাগ করেন, তাহলে যতদিন একটি নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন মন্ত্রীসভা গঠন না হবে, ততদিন ওই টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রীরা তাদের নিজ নিজ পদে বহাল থাকবেন।
ঘ. একজন “নির্বাচন বিষয়ক মন্ত্রী” ও প্রধানমন্ত্রী-বিহীন নির্বাচনকালীন মন্ত্রীসভার সাংবিধানিক সুযোগ
সংবিধানের ৫৫.২ অনুচ্ছেদে যেমনটা আমরা দেখি, প্রধানমন্ত্রী বা তার কর্তৃত্বে প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয়। তার পরামর্শেই রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীসভার অনুয়ান্য সদস্যকে নিয়োগ দিয়ে থাকেন। মন্ত্রীসভার সদস্যদের দায়িত্বভার বা পদ প্রদানের জন্যও তিনি ক্ষমতাপ্রাপ্ত।
অর্থাৎ, একজন অনির্বাচিত ব্যাক্তিকে যদি প্রধানমন্ত্রী টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী — অথবা একজন “নির্বাচন বিষয়ক মন্ত্রী” — হিসেবে নিয়োগ দিতে চান, যার প্রধান দায়িত্ব হবে নির্বাচন কমিশনকে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, বিশ্বাসযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনে সহায়তা করা, সেক্ষেত্রে সাংবিধানিক কোনো বিধিনিষেধ নেই।
এই “নির্বাচন বিষয়ক মন্ত্রী” এই সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনের জন্য সকল গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হবেন — এর মধ্যে প্রতিরক্ষা, জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থাকতে পারে।
সংসদের বাইরে থাকা দলগুলোসহ, সকল বড় দলের ঐক্যমতের ভিত্তিতে সকল সংসদীয় দলের সদস্যগণকে নিয়ে নতুন নির্বাচনকালীন মন্ত্রীসভা গঠন করার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর উপর কোনো বিধিনিষেধ নেই।
৯০ দিনের নির্বাচনকালীন সময়ে বা তার পূর্বে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ করা এবং নতুন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে স্বপদে বহাল থাকতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করার উপর সাংবিধানিক বাধা নেই। আর প্রধানমন্ত্রীর পদ যদি এই পদত্যাগের কারণে শূন্য হয়, তখন সংসদ নির্বাচনের পর নতুন মন্ত্রীসভা গঠনের আগ পর্যন্ত নির্বাচন বিষয়ক মন্ত্রী ও নির্বাচনকালীন মন্ত্রীসভার সদস্যরা নিজ নিজ পদে থেকে যাবেন।
জাতীয় সংলাপের প্রয়োজনীয়তা
প্রধানমন্ত্রী-বিহীন একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার এবং একজন টেকনোক্র্যাট “নির্বাচন মন্ত্রী” নিয়োগ সাংবিধানিকভাবে সম্ভব। তবে একে বাস্তবে রূপ দিতে হলে, সকল বড় দলের মধ্যে একটি জাতীয় সংলাপ হতে হবে। কিন্তু দুই দলের মধ্যে যেহেতু ভয়াবহ অবিশ্বাস বিদ্যমান, তাই বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অংশীদাররা একটি ঘোষিত আলোচ্যসূচী ও রূপকল্পের ভিত্তিতে এই ধরণের সংলাপ আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।
একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে সকল বড় রাজনৈতিক দলের (বিশেষ করে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) মধ্যে সংলাপের মাধ্যমে ছয়টি মূল বিষয়ে ঐক্যমত্য প্রয়োজন:
১. বর্তমান সংসদের মাধ্যমে নির্বাচিতব্য সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় নতুন একজন রাষ্ট্রপতির বিষয়ে ঐক্যমত্য;
২. নির্বাচন বিষয়ক মন্ত্রীর পদে কে থাকবেন, সেই বিষয়ে ঐক্যমত্য; এই মন্ত্রীকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেবেন;
৩. নির্বাচনকালীন মন্ত্রীসভায় কারা থাকবেন, সেই বিষয়ে ঐক্যমত্য; এই মন্ত্রীসভা কেবল নিত্যনৈমিত্তিক নির্বাহী দায়িত্ব পালন করে যাবে;
৪. একটি নতুন নির্বাচন কমিশনের বিষয়ে ঐক্যমত্য, যেটি রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেবেন;
৫. নির্বাচনের পূর্বে বর্তমান সংসদ কখন ভেঙ্গে দেওয়া হবে, সেই বিষয়ে ঐক্যমত্য;
৬. বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ঠিক কোন তারিখে পদত্যাগ করবেন, সেই বিষয়ে ঐক্যমত্য।
এই মডেল অনুযায়ী নতুন রাষ্ট্রপতি কেবলমাত্র নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারের অভিভাবকই হবেন না; তিনি হবেন সকল বড় দলের ঐক্যমত্যে গঠিত “নিরাপদ প্রস্থান” বিষয়ক চুক্তির জিম্মাদার; এই সংক্রান্ত আলোচনা হতে পারে জাতীয় সংলাপের আলোচ্যসূচীর সপ্তম দফা।
সংবিধান বিশেষজ্ঞরা কী বলেন?
এই নিবন্ধের একটি খসড়ার বিষয়ে আমরা তিনজন সংবিধান বিশেষজ্ঞের মতামত জানতে চেয়েছিলাম। এরা হলেন শাহদীন মালিক, আসিফ নজরুল ও রিদওয়ানুল হক।
তিনজনই আমাদের সংবিধান-পঠনের যথোপযুক্ততা নিশ্চিত করেছেন।
রিদওয়ানুল হক বলেছেন, “এটি আইনগত ব্যাখ্যার তুলনায় বরং সময়ের প্রয়োজনে করা রাজনৈতিক ব্যাখ্যা। সংবিধান একটি রাজনৈতিক দলিল এবং এই দলিলের রাজনৈতিক পঠন বা ব্যাখ্যা করার মধ্যে অসুবিধা নেই।”
শাহদীন মালিক বলেছেন, “প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও প্রধানমন্ত্রীর পদের অবাধ্যতামূলক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যেই বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তা সংবিধানের প্রাসঙ্গিক পাঠগত ব্যাখ্যা হিসেবে সঠিক হতে পারে।”
এরপর প্রধানমন্ত্রী পদ শূন্য রাখার প্রশ্নে বিশেষজ্ঞরা তাদের মতামত দিয়েছেন।
আসিফ নজরুল বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হয়ে গেলে ওই পদে “অবিলম্বে নিয়োগ দেয়ার বিষয়ে সাংবিধানিক প্রথা রয়েছে।”
শাহদীন মালিকের মতে, “সংবিধানের মর্ম ও সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রচলিত অনুশীলন থেকে ইঙ্গিত মিলে যে, একটি রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর পদ বেশিকাল খালি থাকতে পারবে না। সম্প্রতি, ইসরায়েল ও লেবাননে প্রধান নির্বাহীর পদ দীর্ঘকাল ধরে শূন্য ছিল। আর সেই কারণে ওই দেশগুলোতে সরকার পরিচালনায় বিশৃঙ্খলা লক্ষ্য করা গেছে।”
রিদওয়ানুল হক এই বিশৃঙ্খলা এড়াতে আরেকটি সমাধান প্রস্তাব করেছেন। তিনি বলেছেন, “[প্রধানমন্ত্রীর] পদত্যাগ ও সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার পর, ‘নির্বাচন বিষয়ক মন্ত্রী’কেই (যদি টেকনোক্র্যাটও হন) তত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন বা ভারপ্রাপ্ত [প্রধানমন্ত্রী] হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। সংসদ যদি ভেঙ্গে দেওয়া হয়, [সংবিধানের] ৫৬.৩ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘিত হবে না; কেননা, সংসদ ইতোমধ্যেই ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে এবং তিনি ৫৬.৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী নন; বরং একজন ভারপ্রাপ্ত [প্রধানমন্ত্রী] যাকে সংবিধানের মধ্য থেকেই একটি অভূতপূর্ব পরিস্থিতি (বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব চালিয়ে যেতে অনিচ্ছুক) মোকাবিলা করতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে মন্ত্রীসভারও একজন প্রধান থাকবে। এই পদ্ধতিতে যদি কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি পাওয়া যায়, তাহলে পরবর্তী সংসদে তা ঠিক করে নেয়া যাবে।”
এখানে আসিফ নজরুল বিদ্যমান বা বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা তুলে ধরেছেন: “যদি [প্রধানমন্ত্রী] দায়িত্ব চালিয়ে যেতে চান, তাহলে তিনি পারবেন। যদি রাষ্ট্রপতি তাকে দায়িত্বে বহাল রাখতে না চান, তাহলে রাষ্ট্রপতির অভিশংসনের প্রশ্ন আসতে পারে — আইন এখানে ব্যাখ্যাসাপেক্ষ। এক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টকে পরামর্শমূলক এখতিয়ারের অধীনে সিদ্ধান্ত দিতে বলা যেতে পারে।”
অন্য কথায় বলতে গেলে, নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার উপরই নির্ভরশীল। বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে কি না, তা নির্ভর করছে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার গঠনে তার আন্তরিক প্রচেষ্টা গ্রহণের উপর। যদি তিনি স্বপদে বহাল থাকতে চান, তাহলে সংবিধানের কোনো কিছুই তাকে বারিত করতে পারবে না। কিন্তু তিনি যদি একজন নির্বাচন বিষয়ক মন্ত্রীর (বা যে নামেই আমরা তাকে ডাকি না কেন) কাছে নৈমিত্যিক নির্বাহী দায়িত্ব অর্পণ করে পদত্যাগ করেন, তাহলে বর্তমান সংবিধান সেক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়ে উঠবে না। সিদ্ধান্ত নেয়ার পালা এখন তার।●
তাসনিম খলিল, এডিটর-ইন-চিফ, নেত্র নিউজ।