স্বাধীনভাবে সাংবাদিকতা করার খেসারত
নেত্র নিউজের সঙ্গে আমার যাত্রা একেবারে শুরু থেকেই, মানে ২০১৯ সাল থেকে। সময়টা ঘটনাবহুল এবং নিঃসন্দেহে স্মরণীয়। কিন্তু এই মাসে আমি নেত্র নিউজের ইংরেজি বিভাগের সম্পাদক হিসেবে আমার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিতে যাচ্ছি। নেত্র নিউজের জন্য আর কখনোই লিখব না তা বলছি না, কিন্তু বাংলাদেশ যে আমার সাংবাদিকতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ছিল, তার ইতি ঘটতে চলেছে।
বেশ কিছু কারণেই এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে আমাকে। তবে এর মধ্যে যে কারণটি উল্লেখ করা জরুরি তা হলো আমার পরিবারের ওপর আমার সাংবাদিকতার সরাসরি প্রভাব। বাংলাদেশ সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘন থেকে শুরু করে সুশাসন ও গণতন্ত্রের অভাব ইত্যাদি বিষয়ে খোলামেলা সমালোচনা করে, এবং দেশের ক্ষমতাসীন ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক গোষ্ঠীর দুর্নীতি উন্মোচনে সক্রিয়, এমন একটি সংবাদ মাধ্যমে সহ-সম্পাদনার জন্য যে মূল্য আমার পরিবারকে দিতে হচ্ছে সেটাই আমার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কারণ।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য বাকস্বাধীনতা অসহনীয় হয়ে উঠেছে। কোনওরকম সমালোচনা সহ্য করার মতো মানসিকতা এই দলটির নেই। বরং ক্ষমতা যত দীর্ঘায়িত হচ্ছে, বাকস্বাধীনতার ওপর তত বেশি খড়্গহস্ত হয়ে উঠছে এই সরকার। একথা সত্য যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে সব সরকারই স্বাধীন সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ করার চেষ্টা করেছে, কখনো কম, কখনো বেশি। কিন্তু এখন আওয়ামী লীগের অধীনে যে পরিস্থিতি তাকে ঘোরতর খারাপ ছাড়া অন্য কোনোভাবেই বর্ণনা করার উপায় নেই। এদেশে যারা নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করে তাদের ভয়াবহ মূল্য দিতে হয়। বহু সাংবাদিকই বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হুমকির শিকার হয়েছেন, গ্রেফতার হয়েছেন।
২০১৭ সাল থেকেই আমি বাংলাদেশের বাইরে। ১৩ বছর এদেশে বাস করার পর সরকার আমার থাকার অনুমোদন বাতিল করে। দেশের বাইরে থাকার ফলে সরকারের হুমকি-ধমকি ও আক্রমণের সবচেয়ে ভয়াবহ দিকগুলো থেকে আমি বেঁচে গিয়েছি। কিন্তু আমার পরিবার ছিল বাংলাদেশে। সাংবাদিক হিসেবে আমার কাজের সঙ্গে তাদের ন্যূনতম সম্পর্ক নেই। কিন্তু তাতে কিছু এসে যায়নি। সরকারের উষ্মা আর ক্রোধের সব প্রভাব গিয়ে পড়ে তাদের ওপর।
নেত্র নিউজের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা ও কাজের জন্য বহুদিন ধরেই আমার পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন সময়ে সরকারের রোষের শিকার হতে হয়েছে এবং তারা এর পরিণতি সহ্য করে গেছেন। যদিও এমন পরিণতি শুধু আমার পরিবার নয়, বাংলাদেশে আরও অনেক পরিবারকে সহ্য করতে হয়েছে, কারণ তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিরা বাংলাদেশের বাইরে থেকে স্বাধীনভাবে লেখালেখি করেন। এখন আমি নেত্র নিউজ থেকে পদত্যাগ করলে আমার পরিবারের সদস্যরা এই হেনস্তা থেকে নিস্তার পাবেন বলে আমি আশা করি। আর হয়তো দেশে ফেরার ও সেখানে তাদের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য ভিসাও পেয়ে যাব আমি!
যেহেতু নেত্র নিউজের প্রকাশনা মূলত আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক, তাই আওয়ামী লীগারদের ধারণা নেত্র নিউজ হয়তো পক্ষপাতদুষ্ট। কিন্তু বাস্তবতা এমনটা নয়। নেত্র নিউজ প্রতিষ্ঠা হয় ২০১৯ এর শেষের দিকে। সেই সময় আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যে প্রায় ১১ বছর ধরে ক্ষমতায়। শুধু তাই নয়, এর পর থেকে এখনও পর্যন্ত এই দলই ক্ষমতায়। আওয়ামী লীগের জায়গায় যদি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সরকারে থাকতো এবং বর্তমান সরকারের মতোই কর্তৃত্ববাদী শাসন পরিচালনা করতো, তাহলেও নেত্র নিউজ ঠিক একইভাবে সেই সরকারের দুঃশাসন জনগণের সামনে উন্মুক্ত করে দেয়ার লক্ষ্যে সাংবাদিকতা করে যেত। যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, এবং তথ্য প্রমাণ যেদিকেই নির্দেশ করুক না কেন, আমি নিশ্চিত নেত্র নিউজ দুর্নীতি, অপশাসন, এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা উন্মোচনের কাজ করে যাবে।
একথা স্মরণ করা জরুরি যে নেত্র নিউজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এমন সময় যখন বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সম্পূর্ণ সংকুচিত হয়ে এসেছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন (২০০৬) এবং পরবর্তীতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (২০১৮) — এ দুই আইনের প্রেক্ষিতে দেশের গণমাধ্যম এমনভাবে সেলফ-সেন্সরশিপ শুরু করে যা এর আগে কখনও ঘটেনি। সেসময় সরকারের দ্বারা হয়রানির ভয়ে কেউই সংবেদনশীল বিষয়গুলো নিয়ে সহজে কোনও খবর বা লেখা প্রকাশ করতে চাইত না, এবং এই পরিস্থিতি এখনও বহাল রয়েছে।
দেশের বাইরে অবস্থানের ফলে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোর যেসব ঝুঁকি তার অনেকখানিই নেত্র নিউজ এড়িয়ে যেতে পেরেছে। এবং এর ফলে নেত্র নিউজ এমন সব খবর ও লেখা প্রকাশ করতে পেরেছে যা স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমের পক্ষে প্রকাশ করা অসম্ভব। এর ফলে একেবারে প্রথম থেকেই সরকার নেত্র নিউজকে তাদের জন্য একটি হুমকি হিসেবে বিবেচনা করেছে। একজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার গুমে জড়িত থাকার অভিযোগ, পার্বত্য চট্টগ্রামে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাবের) ভূমিকা — এসব খবর নিয়ে প্রথম অনলাইনে আত্মপ্রকাশ করে নেত্র নিউজের ওয়েব সাইট। যেদিন সাইটটি অনলাইনে আসে সেদিনই সরকার বাংলাদেশে তা ব্লক করে দেয়।
তারপর থেকে শুধু নেত্র নিউজের মিরর সাইট বা ফেসবুক এবং ইউটিউবের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে কেউ আমাদের প্রকাশিত কিছু দেখতে পান। এত বাধা বিপত্তির পরও বেশ কিছু চমকপ্রদ খবর উন্মোচনের মাধ্যমে, এমনকি মাঝে মাঝে শুধু বিশ্লেষণী লেখার মাধ্যমেও জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে নেত্র নিউজ। নেত্র নিউজের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বড় ও সম্মানজনক পুরস্কারের জন্যও মনোনীত হয়েছে। অনেক খবর ও লেখা জাতীয়ভাবে মনোযোগ আকৃষ্ট করতে না পারলেও এই তিন বছরে সামান্য বাজেট নিয়ে নেত্র নিউজ ক্রমাগত সরকারের প্রশ্নবিদ্ধ হবার মতো কর্মকাণ্ড নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা চালিয়ে গিয়েছে। এবং এর পাশাপাশি যখন প্রযোজ্য, এই সরকারের সাফল্যের কথা প্রকাশ করতেও ইতস্তত করেনি।
শুধু তাই নয়, নেত্র নিউজ তাদের অর্থায়নের উৎস নিয়ে সব সময়ই স্বচ্ছ থেকেছে। সংবাদ মাধ্যমটির অর্থায়ন করছে ন্যাশনাল এনডাওমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি (এনইডি)। এনইডি একটি বেসরকারি, বাইপার্টিসান (দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত) মার্কিন সংগঠন, যারা যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস থেকে (সরকার নয়) অর্থ পায়। এই অর্থ তারা শত শত গণতন্ত্র সমর্থক সংগঠনকে দিয়ে থাকে। এসব সংগঠন পৃথিবীর জুড়ে বিভিন্ন দেশে অবস্থিত। এর মধ্যে অনেক সংগঠন রয়েছে খোদ বাংলাদেশেই, যারা এনইডির অর্থায়নে পরিচালিত হয়।
এনইডির অর্থায়নের ফলে নেত্র নিউজ যা করতে পারে তা হলো অর্থের যোগান নিয়ে চিন্তা না করে স্বাধীনভাবে সাংবাদিকতার দিকে মনোনিবেশ করতে পারা। এনইডি নেত্র নিউজের কাজে কোনো নির্দেশনা দেয় না, কোনো বিধি-নিষেধ আরোপ করে না এবং কিভাবে কোন খবর ও লেখা প্রকাশিত হবে তা নিয়ে কোনো শর্ত প্রদান করে না। নেত্র নিউজ এনইডির অর্থায়নের ফলে এই বড় সুবিধাটি পায় যা বাংলাদেশের কোনো গণমাধ্যমই সম্ভবত উপভোগ করে না। নেত্র নিউজের কোনো কর্পোরেট বা রাজনৈতিক মালিকানা নেই। এর একমাত্র কাজ ভালো, নির্ভুল, তথ্য-প্রমাণ ভিত্তিক সাংবাদিকতা করা। জনগণের স্বার্থ রক্ষার পক্ষে সাংবাদিকতা করা নেত্র নিউজের একটি মূলমন্ত্র।
এখন এই কাজ করার জন্য নেত্র নিউজ, এবং এর সঙ্গে যারাই কোনোভাবে যুক্ত রয়েছেন তারা নিরবচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন ভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আক্রমণের শিকার হয়। সরকারের এজেন্সি দ্বারা পরিচালিত ওয়েব সাইট থেকে তাদের নামে মিথ্যা খবর রটানো হয়। দুঃখজনক হলেও এই হলো নেত্র নিউজে সাংবাদিকতা করার মূল্য।
নেত্র নিউজে আমার যাত্রা এখানেই শেষ। কিন্তু আমি জানি নতুন যারা আছেন তারা এই সংবাদ মাধ্যমে অসাধারণ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন এবং ক্ষুরধার বিশ্লেষণ প্রকাশ করে যাবেন। আর আমার পক্ষ থেকে নেত্র নিউজের জন্য সব সময়ই থাকবে শুভ কামনা।●