কালো র‍্যাবের নীল হেলমেট

বাংলাদেশের “ডেথ স্কোয়াড” র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) সদস্যরা যেভাবে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে যোগ দিচ্ছেন — নেত্র নিউজ, ডয়েচে ভেলে ও স্যুদডয়চে সাইটুংয়ের যৌথ অনুসন্ধান।

কালো র‍্যাবের নীল হেলমেট

২০২২ সালের আগস্ট মাসের এক রৌদ্রোজ্জ্বল দিন। মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নিজেদের ঘাঁটিতে সমবেত হয়েছেন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী কন্টিনজেন্টের ১৮৭ জন সদস্য। গৃহযুদ্ধে পর্যুদস্ত দেশটিতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের ঊর্ধ্বতন এক বেসামরিক কর্মকর্তার আগমনকে ঘিরে ঘাঁটিতে তখন সাজসাজ রব। লিজবেথ কুলিটি নামক ওই কর্মকর্তা শিবিরে এসে পৌঁছালে তাকে গার্ড অব অনার দিয়ে সম্মান জানান  বাংলাদেশি সৈন্যরা। দীর্ঘদিন মানবাধিকার সংক্রান্ত দায়িত্ব পালন করে আসা জাতিসংঘের বর্ষিয়ান এই কর্মকর্তা কিছুক্ষণ পরই “সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ও সবচেয়ে বিপন্ন মানুষকে” সেবাপ্রদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশি কন্টিনজেন্টের কয়েকজন সদস্যকে জাতিসংঘ পদক পরিয়ে দেন।

পদকপ্রাপ্তদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর মাসুদ, যদিও লিজবেথ কুলিটি সম্ভবত তার অতীত ইতিহাস সম্পর্কে জানতেন না। মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে শান্তিরক্ষী হিসেবে যোগ দেয়ার ঠিক আগে আগে মেজর মাসুদ কাজ করে এসেছেন বাংলাদেশের র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নে (র‍্যাব), যেই সংস্থাটির বিরুদ্ধে রয়েছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, হেফাজতে নির্যাতনসহ অগণিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ। মাসুদ ছিলেন র‍্যাবের গোয়েন্দা শাখা বা ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। হেফাজতে থাকা ব্যক্তিদের উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা, প্রহার করা, সংবেদনশীল অঙ্গপ্রত্যঙ্গে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া ও হাত-পা বেঁধে নাকে-মুখে রুমাল পেঁচিয়ে পানি প্রবেশ করানোসহ (ওয়াটারবোর্ডিং) নিষ্ঠুর সব নির্যাতনী কলাকৌশল প্রয়োগ করার কুখ্যাতি রয়েছে ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের।

লিজবেথ কুলিটির কাছ থেকে জাতিসংঘ মেডেল গ্রহণ করছেন মেজর মাসুদ।

জার্মানির শীর্ষস্থানীয় দুই সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলেস্যুদডয়চে সাইটুংয়ের সঙ্গে নেত্র নিউজের করা যৌথ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, র‍্যাবের এই সাবেক কর্মকর্তার শান্তিরক্ষী বাহিনীতে পদায়ন কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পুলিশ ও সামরিক বাহিনী থেকে প্রেষণে র‍্যাবে দায়িত্ব পালন করেছেন এমন ১০০ জনেরও বেশি কর্মকর্তা বিভিন্ন সময় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালন করেছেন। এদের মধ্যে অন্তত ৪০ জনের পদায়ন হয়েছে গত পাঁচ বছরে।

র‍্যাবের কালো উর্দি পাল্টে তারা যেভাবে শান্তিরক্ষী বাহিনীর নীল হেলমেট পরতে পেরেছেন, সেই যাত্রা বিশ্লেষণ করলে শান্তিরক্ষী বাহিনীর যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার মৌলিক সব ত্রুটি স্পষ্ট হয়ে উঠে। গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত থাকতে পারেন এমন ব্যক্তিরাও যাচাই প্রক্রিয়ার ফাঁক গলে অনায়াসেই শান্তিরক্ষী মিশনে যোগ দিতে পারেন; অথচ, এসব মিশনের উদ্দেশ্যই থাকে সংঘাত-উপদ্রুত অঞ্চলে বিপন্ন বেসামরিক জনগণকে সুরক্ষা দেওয়া। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিভাগের উপপরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলির মতে, নিপীড়িত মানুষকে রক্ষা করতে নির্যাতক বাহিনীর কর্মকর্তাদের মোতায়েন করা হলে, “শান্তিরক্ষার উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়।”

নিন্দিত এক “জল্লাদ বাহিনী”

বাহিনী হিসেবে র‍্যাবের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইতিহাস গোপন কিছু নয়। ২০১৪ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বাহিনীটিকে “ডেথ স্কোয়াড” বা “জল্লাদ বাহিনী” হিসেবে আখ্যা দেয়। এরপর থেকে বারবার র‍্যাবকে বিলুপ্ত করে দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে নিউ ইয়র্ক-ভিত্তিক বৈশ্বিক মানবাধিকার সংগঠনটি।

২০১৮ সালে মানবাধিকার বিষয়ক যাচাই-বাছাইয়ে উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হওয়ায় র‍্যাবকে মার্কিন আর্থিক সহায়তা পেতে অনুপযুক্ত ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তিন বছর পর ২০২১ সালের ডিসেম্বরে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত থাকার অভিযোগে র‍্যাবের তৎকালীন প্রধানসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা ও সামগ্রিকভাবে বাহিনী হিসেবে র‍্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ ও রাজস্ব মন্ত্রণালয়।

জাতিসংঘের মধ্যেও র‍্যাব নিয়ে বিরূপ সমালোচনা আছে। বলপূর্বক অন্তর্ধান ও গুম বিষয়ক জাতিসংঘের একটি স্বাধীন বিশেষজ্ঞ প্যানেল ২০১৭ সালে এই ধরণের রাষ্ট্রীয় অপরাধে র‍্যাবের জড়িত থাকার বিষয়টি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করে

২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত নেত্র নিউজ ও ডয়েচে ভেলের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে হুইসেলব্লোয়ার হিসেবে কথা বলেন মাঠ পর্যায়ে র‍্যাবের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা দুইজন সাবেক কর্মকর্তা। কীভাবে কখনও কখনও সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে র‍্যাব বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কিংবা গুম সংঘটিত করে, সেই বিষয়ে আমাদেরকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছিলেন ওই দুই কর্মকর্তা।

“জল্লাদ বাহিনী” হিসেবে র‍্যাবের কুখ্যাতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের এত বিপুল সাক্ষ্য প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও, সংস্থাটির সাবেক কর্মকর্তারা অনায়াসেই যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার ফাঁক গলে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে উচ্চ বেতনে চাকরি করার সুযোগ পেয়ে আসছেন। আর এমনটা সম্ভব হয়েছে, কারণ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী যেন যোগ দিতে না পারেন, তা নিশ্চিতের দায়িত্ব অংশগ্রহণকারী দেশের উপরই ছেড়ে রেখেছে জাতিসংঘ। এমন প্রক্রিয়াকে মৌলিকভাবে ভয়াবহ ত্রুটিপূর্ণ বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

কালো পট্টি থেকে নীল হেলমেট

শান্তিরক্ষী বাহিনীতে কাজ করেছেন র‍্যাবের এমন কয়েকজন সাবেক কর্মকর্তাকে এখনও অতীতে তাদের নিজেদের করা কিংবা চোখে দেখা নৃশংসতা তাড়া করে বেড়ায়। এদের একজন হলেন আমাদের একজন হুইসেলব্লোয়ার। আফ্রিকার একটি দেশে শান্তিরক্ষা মিশনে মোতায়েন থাকা অবস্থায় তিনি একটি স্বীকারোক্তিমূলক ভিডিও রেকর্ড করে পাঠিয়েছেন। এই কর্মকর্তার পেশাগত পরিচয় ও সাবেক কর্মস্থলের বিবরণ নেত্র নিউজ ও আমাদের সহযোগী সংবাদমাধ্যমগুলো পৃথকভাবে নিশ্চিত করতে পেরেছে। তার বক্তব্য আমাদের প্রতিবেদনে ব্যবহারের পূর্বশর্ত হিসেবে তার নাম ও পেশাগত পরিচয় আমরা গোপন রাখতে সম্মত হই।

ইংরেজিতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক ভিডিওবার্তায় ওই কর্মকর্তা নিজে জড়িত ছিলেন কিংবা উপস্থিত ছিলেন এমন কিছু নৃশংস ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। ঠাণ্ডা-মাথায় এক খুনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “বুলেটটা যখন তার মাথার খুলিতে গিয়ে বিঁধলো, তার রক্ত ও মগজের অংশবিশেষ আমার পোশাকে এসে পড়ে।”

“আমি এখনও ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখি,” যোগ করেন তিনি।

তবে আমাদের এই হুইসেলব্লোয়ারই একমাত্র সাবেক র‍্যাব কর্মকর্তা নন যিনি একসময় ভয়ঙ্কর মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত থেকে বিদেশের মাটিতে শান্তিরক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছেন। কয়েক মাস ধরে বেশ কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান সামরিক ও জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের বিস্তারিত সাক্ষাৎকার গ্রহণ, শত শত পাতার গোপন সামরিক নথিপত্র ও মোতায়েনকৃত কর্মকর্তাদের তালিকা বিশ্লেষণ এবং ফ্লিকার, লিঙ্কডইন ও ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বহু একাউন্ট যাচাই-বাছাই শেষে নেত্র নিউজ ও সহযোগী সংবাদমাধ্যমগুলো ১০০ জনেরও বেশি শান্তিরক্ষীকে খুঁজে পেয়েছে যারা অতীতে র‍্যাবে কর্মরত ছিলেন।

এদের মধ্যে মেজর মাসুদ ছাড়াও আমরা র‍্যাবের আরও দুই জন সাবেক কর্মকর্তাকে শনাক্ত করেছি, যাদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার কিংবা নেতৃত্বমূলক দায়িত্বে (কম্যান্ড রেসপন্সিবিলিটি) থাকার অভিযোগ রয়েছে। এই দুইজন কর্মকর্তা হলেন মেজর নাঈম ও মেজর হাসান। আইনগত কারণে আমরা তাদের পূর্ণ নাম ও ছবি প্রকাশ করছি না। তবে এই দুই কর্মকর্তাই র‍্যাবের গোয়েন্দা শাখার উপপরিচালক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। দায়িত্বরত অবস্থায় গুম ও হেফাজতে নির্যাতনের ঘটনায় উভয়েই ব্যক্তিগতভাবে জড়িত কিংবা নেতৃত্বমূলক দায়িত্বে ছিলেন।

মেজর নাঈম ২০১৬ সালে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে র‍্যাবের কোম্পানি কমান্ডার থাকাকালে তিনজন ব্যক্তির গুমের ঘটনায় জড়িত ছিলেন — এমন তথ্য তখনই স্থানীয় বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়। পরের বছর তাকে ঢাকায় র‍্যাবের সদর দপ্তরে বদলি করা হয়। ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে কোনো এক সময় তাকে ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের উপপরিচালক হিসেবে পদন্নোতি দেওয়া হয়। আর ২০২২ সালে তাকে দেখা যায় গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী হিসেবে কর্মরত অবস্থায়।

মেজর নাঈম শান্তিরক্ষী বাহিনীর দুইজন সহকর্মীর সঙ্গে সেলফি তুলছেন।

অপরদিকে মেজর হাসানকে র‍্যাবের ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের অত্যন্ত প্রভাবশালী কর্মকর্তা হিসেবে বর্ণনা করেন তারই একজন সাবেক সহকর্মী। র‍্যাবে থাকাকালে সংস্থাটির নজরদারি কার্যক্রম, বিশেষ করে ডিজিটাল নজরদারির অবকাঠামো পরিচালনার দায়িত্ব ছিল তার। একাধিক হত্যাকাণ্ড ও গুমের উদ্দেশ্যে অপহরণ সংঘটনের কাজে ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের এই নজরদারি কার্যক্রম ব্যবহৃত হয়েছে। ওই সাবেক সহকর্মীর দাবি অনুযায়ী, ঢাকা বিমানবন্দর সংলগ্ন র‍্যাবের সদর দপ্তর ও উত্তরায় র‍্যাব-১ দপ্তরে থাকা দুইটি নির্যাতন কেন্দ্রের নেতৃত্বগত দায়িত্বে মেজর হাসানের অংশীদারিত্ব ছিলো; কিংবা তিনি সেখানকার নির্যাতনের ঘটনা সম্পর্কে সম্যক অবগত ছিলেন।

ব্যক্তিগত জীবনে একজন শখের দৌড়বিদ মেজর হাসান তার দৌড়ের অনুশীলন রেকর্ড করার জন্য একটি ফিটনেস অ্যাপ ব্যবহার করতেন। আমরা সেই ফিটনেস অ্যাপে তার প্রোফাইল থেকে বিভিন্ন সময়ে তার অবস্থান চিহ্নিত করেছি। যেমন, ২০২০ সালের নভেম্বরে তিনি র‍্যাব সদর দপ্তরের সামনে একটি হাফ-ম্যারাথনে অংশ নেওয়ার সময় ছবি তুলেছিলেন। এক বছর পর ২০২১ সালের নভেম্বরে তাকে মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের রাজধানী বাঙ্গুইতে গামাল আব্দেল নাসের সড়কে দৌড়াতে দেখা যায়। ওই সময় তিনি জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে (মিনুসকা) নিযুক্ত ছিলেন।

বাম থেকে ডানে — মেজর হাসান র‍্যাব সদর দপ্তরের সামনে সেলফি তুলছেন (নভেম্বর ২০২০); মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের রাজধানী বাঙ্গুইর গামাল আব্দেল নাসের সড়কে তার দৌড়ানোর ট্র্যাক (নভেম্বর ২০২১)।

যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার গোড়াতেই গলদ

মেজর হাসান ও মেজর নাঈম যথাক্রমে মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে ও গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে শান্তিরক্ষী হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন — এমন তথ্য নিশ্চিত করেছে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বিষয়ক দপ্তর (ডিপিও)।

তবে মেজর মাসুদ জাতিসংঘে দায়িত্ব পালন করেছেন এমন কোন তথ্য নিজেদের তথ্যভাণ্ডারে খুঁজে পায়নি ডিপিও। অথচ জাতিসংঘের নিজস্ব ছবি ও ভিডিওতে দেখা গেছে সংস্থাটির একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তাকে ২০২২ সালের আগস্ট মাসে মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে পদক প্রদান করছেন।

ডিপিও আরও জানিয়েছে, শান্তিরক্ষীরা নিজ দেশে অতীতে কোন কোন ইউনিটে কাজ করেছেন, তার বিস্তারিত তথ্য তারা সংরক্ষণ করে না। তাই র‍্যাবের কতজন সদস্য জাতিসংঘে কাজ করেছেন, তার সংখ্যা তাদের জানা নেই।

এক লিখিত বিবৃতিতে একজন ডিপিও মুখপাত্র বলেছেন, “সামরিক বা পুলিশ বাহিনীর যেসব সাবেক সদস্য শান্তিরক্ষী কন্টিনজেন্টে কাজ করেছেন, তাদের পেশাগত ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জাতিসংঘ সচিবালয় পায় না। কাজেই, কোনো নির্দিষ্ট দেশের মোতায়েন করা কন্টিনজেন্ট সদস্যদের কত জন সেই দেশের কোন কোন ইউনিটে অতীতে কাজ করেছেন, তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়।”

২০১৯ সালে জাতিসংঘের নির্যাতন-বিরোধী কমিটি “বাংলাদেশের প্রাথমিক প্রতিবেদনের বিষয়ে সমাপনী পর্যবেক্ষণ”-এ র‍্যাবের হেফাজতে নির্যাতন, নির্বিচার গ্রেপ্তার, গোপন বন্দিশালা পরিচালনা, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যায় সম্পৃক্ততার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। পাশাপাশি, মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত বাহিনীগুলোর জবাবদিহির অভাব ও দায়মুক্তির বিষয়টি উল্লেখ করে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে সামরিক ও পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি স্বাধীন যাচাই প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানানো হয় কমিটির পক্ষ থেকে। “নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ও অন্যান্য গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় সন্দেহভাজন কোনো ব্যক্তি বা ইউনিটকে [শান্তিরক্ষী] কার্যক্রমে যুক্ত না” করতে সুপারিশও করে ওই কমিটি।

কিন্তু কমিটির স্পষ্ট সুপারিশ সত্ত্বেও জাতিসংঘ তাদের শান্তিরক্ষী কার্যক্রমের সৈন্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক মানবাধিকার-সংক্রান্ত যাচাই-বাছাইয়ের কাজ বাংলাদেশ সরকারের উপরই ন্যস্ত রেখেছে।

“আমার দেখা মতে তো সবাই র‍্যাবে সার্ভ করে পিসকিপিং মিশনে চলে গেছেন” বলে জানান র‍্যাবের একজন প্রাক্তন কমান্ডার।

আরেকজন হুইসেলব্লোয়ার বিষয়টি আমাদের কাছে ব্যাখ্যা করে বলেন, “র‍্যাব এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী হচ্ছে দুইটা ভিন্ন সংস্থা। র‍্যাব থেকে যদি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছে [মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে] লিখিতভাবে না জানানো হয়, সেটা কোন আর্মি অফিসারের ক্যারিয়ারে কোন এফেক্ট করবে না, তারা র‍্যাবে যাই করুক না কেন।”

এখানে উল্লেখ্য যে, র‍্যাব সরাসরি বা স্থায়ীভাবে কোনো সদস্যকে নিয়োগ দেয় না; বরং, অন্যান্য বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থা, বিশেষ করে সামরিক ও পুলিশ বাহিনী থেকে স্বল্প মেয়াদে সদস্য সংগ্রহ করে থাকে।

আমাদের প্রশ্নের জবাবে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী বিষয়ক মুখপাত্র জানিয়েছেন, অংশগ্রহণকারী দেশই নিজ নিজ সদস্যদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত তথ্য দিয়ে থাকে; পাশাপাশি, মানবাধিকার বিষয়ক তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রে স্ব স্ব সরকারের দেওয়া প্রত্যয়নকেই যথেষ্ট ধরে নেওয়া হয়।

তিনি বলেন, মেজর নাঈম ও মেজর হাসান কোনো ধরণের “মানবাধিকার সংক্রান্ত আইন বা আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘন করেননি বা লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্তও হননি” মর্মে প্রত্যয়নপত্র দাখিল করেছিল বাংলাদেশ সরকার। তবে মুখপাত্র স্বীকার করেছেন যে, সরকারের দেওয়া এসব তথ্য পর্যালোচনা করার জন্য পর্যাপ্ত লোকবল জাতিসংঘের নেই।

এই প্রেক্ষিতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, কোনো কর্মকর্তা নির্যাতক ছিলেন কিনা তা নির্ণয়ের জন্য “নির্যাতক সরকারকেই জিজ্ঞেস করার” মতো শোনায় বিষয়টি।

“নির্মম কিছু সেনা”

বাংলাদেশে গত এক দশকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের ক্ষমতা সুসংহত করার ক্ষেত্রে অন্যতম বড় ভূমিকা ছিল র‍্যাবের।

আরেকটি পদক প্রদান অনুষ্ঠান: র‍্যাবে দায়িত্ব পালনের জন্য শেখ হাসিনার কাছ থেকে পদক গ্রহণ করছেন মেজর হাসান।

২০২৩ সালে নেত্র নিউজ ও ডয়েচে ভেলেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে একজন সাবেক র‍্যাব কমান্ডার বলেন, “পলিটিক্যাল যে কোনো টার্গেটের এনগেজমেন্টের ডিসিশান সর্বনিম্ন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আসবে, অর্থাৎ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই আদেশটা প্রদান করে থাকেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যদি কোনো একটা আদেশ প্রদান করে থাকেন, সেটা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অগোচরে হয়েছে এমন হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।”

শান্তিরক্ষী বাহিনীতে র‍্যাবের অংশগ্রহণের বিষয়ে প্রকাশ্যে সাক্ষাৎকার দিতে আমরা জাতিসংঘের সাবেক ও বর্তমান অনেক কর্মকর্তাকে অনুরোধ জানাই। তবে কেবল জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সাবেক সহকারী মহাসচিব অ্যান্ড্রু গিলমোর ক্যামেরার সামনে সাক্ষাৎকার দিতে সম্মত হন। আর ওই সাক্ষাৎকারে তিনি অকপটে জাতিসংঘের সীমাবদ্ধতাগুলো স্বীকার করে নিয়েছেন।

“যদি আমি এখনও জাতিসংঘে [কোন দায়িত্বে] থাকতাম, আমি সম্ভবত এতটা সরাসরি কথা বলতে পারতাম না,” বলেন গিলমোর। “[শান্তিরক্ষী বাহিনীতে] আমরা বেশ অকর্মণ্য এবং বেশ নির্মম কিছু সেনা পেয়ে থাকি।”

জাতিসংঘের এই সাবেক সহকারী মহাসচিবের মতে, যেহেতু খুব কম দেশই ঝুঁকিপূর্ণ শান্তিরক্ষী মিশনে নিজেদের সেনা পাঠাতে চায়, সেহেতু গুটিকয়েক অংশগ্রহণকারী দেশের প্রভাব থাকে অনেক বেশি, বিশেষ করে যাচাই-বাছাই সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে।

কিন্তু স্বাধীন যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের ব্যর্থতা শুধুমাত্র মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের পুরস্কৃতই করছে তা নয়; বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার ক্ষেত্রে সম্ভাবনাময় একটি উদ্যোগের কার্যকারিতাকেও খর্ব করছে।

২০২১ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র সরকার র‍্যাবের কিছু কর্মকর্তা ও সামগ্রিকভাবে বাহিনী হিসেবে র‍্যাবের উপর আর্থিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। যেসব কর্মকর্তা নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েন, তাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় ব্যক্তিগতভাবে সম্পৃক্ত থাকা কিংবা নেতৃত্বগত দায় থাকার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ওই পদক্ষেপের ফলাফলও মিলে তৎক্ষণাৎ — বাংলাদেশের মানবাধিকার কর্মীরা জানান, নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর র‍্যাব ও অন্যান্য বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুম সংঘটনের ঘটনা রাতারাতি কমে এসেছে।

কিন্তু মুদ্রার অপরদিকে রয়েছে আরেক চিত্র। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর খরচাখরচের সবচেয়ে বড় যোগানদাতাও যুক্তরাষ্ট্র। এই বছর শান্তিরক্ষী বাহিনীর মোট বাজেটের ২৫% বা ১৩৭ কোটি ডলার একাই সরবরাহ করেছে দেশটি। অর্থাৎ, দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে র‍্যাব সদস্যদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে গুরুতর পদক্ষেপ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র; অপরদিকে, দেশটির আংশিক অর্থায়নে পরিচালিত শান্তিরক্ষী বাহিনীতে নিয়োগ পেয়ে পরোক্ষভাবে পুরস্কৃতও হচ্ছে র‍্যাব।

মন্তব্য পাওয়া যায়নি

নেত্র নিউজ ও আমাদের সহযোগী সংবাদমাধ্যমগুলো বাংলাদেশ সরকার ও এই প্রতিবেদনে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়েছে তাদের কাছে বক্তব্য জানতে চেয়েছিল। তারা কেউ কোনো মন্তব্য করেননি। সহযোগী সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলে এই অনুসন্ধানের একটি সংস্করণ তথ্যচিত্র আকারে প্রকাশ করার পর বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর অধীনস্থ আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে তথ্যচিত্রটিকে “মিথ্যা ও বিভ্রান্তিমূলক” হিসেবে আখ্যা দেয়। তবে তথ্যচিত্রে উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো মন্তব্য বিবৃতিতে করা হয়নি।