হিন্দু জনগোষ্ঠীর আস্থা অর্জনে ব্যর্থ বাংলাদেশের রাজনীতি

নীতি নির্ধারণ ও বাস্তব পদক্ষেপের পরিবর্তে শুধুমাত্র আক্রমণাত্মক গণসংযোগের ওপর ভর করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ফলে তারা দেশটির সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠীর আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে।

হিন্দু জনগোষ্ঠীর আস্থা অর্জনে ব্যর্থ বাংলাদেশের রাজনীতি

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশটিতে বসবাসরত হিন্দু জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। গত ১৮ ডিসেম্বর নেত্র নিউজে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বী নাগরিকেরা চরম আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। আতঙ্কের কারণ যা-ই হোক না কেন, বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে রেখে এটি দূর করার দায়িত্ব সরকারেরই।

সংখ্যালঘু হিন্দুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং তাদের উদ্বেগের কারণগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণের বদলে ইউনূস সরকারকে আক্রমণাত্মক প্রচারণায় ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে। বাংলাদেশের হিন্দু নাগরিকদের উদ্বেগকে দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে আখ্যা দিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সেইসঙ্গে উদ্বেগ মোকাবিলার বিষয়টিকে একরতরফাভাবে ভারতের সঙ্গে পররাষ্ট্রনৈতিক সঙ্কট মোকাবিলার বিষয়র সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছে। এবং সরকার এ ক্ষেত্রে অনেকটা একরোখা, কাণ্ডজ্ঞানহীন মনোভাব দেখিয়ে চলেছে।

সরকারের নেতৃত্ব মেনে দেশটির রাজনৈতিক দল, তাদের নেতাকর্মী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বিভিন্ন মাধ্যমে বাংলাদেশের সহিষ্ণুতা ও বহুত্ববাদী ঐতিহ্যের গৌরব প্রচারে মনোযোগ দিয়েছেন। এসব পদক্ষেপ মূলত নেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতীয় গণমাধ্যমের অনরবত মিথ্যা ও উসকানিমূলক প্রচারণার বিরুদ্ধে । এমন পদক্ষেপে যুক্ত হয়েছে সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর এমন কিছু দল ও নেতৃত্ব যাদের বিরুদ্ধে অতীতে হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু নির্যাতনে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।

 ভারতীয় গণমাধ্যমের অপতথ্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বিষয়টি অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রধান কৌশল হিসেবে বিবেচনা করছে সরকার। এর অনিবার্য ফল হিসেবে স্পষ্ট হয়েছে হিন্দু জনগোষ্ঠীর আতঙ্ক। হিন্দুদের যৌক্তিক উদ্বেগ আমলে নেওয়া এবং এর সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের বদলে অন্তর্বর্তী সরকারকে অনাবশ্যক ও অকার্যকর কিছু তৎপরতায় সময় ব্যয় করতে দেখা যাচ্ছে। উদ্দেশ্যমূলকভাবে ভারতবিরোধী মনোভাব এবং হিন্দুত্ববাদ ও হিন্দুবিরোধী ঘৃণাকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে সংখ্যালঘুদের নিয়ে আগে থেকেই বিদ্যমান কিছু ভ্রান্ত ধারণা নতুন মাত্রা পাচ্ছে। এ নিয়ে সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর খুব ছোট্ট অংশের মধ্যেই দায় স্বীকার ও গ্লানি প্রকাশের প্রবণতা লক্ষ করা যায়।

দীর্ঘদিনের এ সঙ্কটকে অস্বীকার করে এবং সমমর্যাদা নিশ্চিত করে সংখ্যালঘুদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হওয়ার পরিবর্তে ভারতীয় অপপ্রচারকে প্রাধান্য দেওয়া শুধু অযৌক্তিকই নয়, আত্মঘাতীও বটে। হালের জনপ্রিয়তার ওপর ভর করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশের হিন্দুদের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টিকে ঠিক সেভাবে মোকাবিলা করছে যেভাবে ভারতীয় মুসলমানদের ভয় ও উদ্বেগকে অবহেলার সঙ্গে মোকাবিলা করে ভারত সরকার। ভারতীয় গণমাধ্যমের অপতথ্য এবং সংখ্যালঘুদের সুরক্ষায় বিগত দিনে আওয়ামী লীগের

ব্যর্থতার দোহাই দিয়ে বর্তমান বাস্তবতায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায় এড়ানোর কোন সুযোগ নেই।

সম্প্রতি সেনাবাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতার মেয়াদ ৬০ দিন বর্ধিত করা হয়। কিন্তু সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা ইস্যুতে তারা সফল দৃষ্টান্ত দেখাতে পারেনি, উপরন্তু এ ক্ষেত্রে তাদের তৎপরতা দুর্বলভাবে দৃশ্যমান হয়েছে। সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্বহীন সরকার, সংখ্যালঘু সংক্রান্ত যথাযথ সংযোগের অনুপস্থিতি আতঙ্কিত হিন্দুদের আস্থা ফেরাতে পারেনি। তাদের শঙ্কা আরও বাড়তে পারে যখন প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় নির্বাচনের রূপরেখা ঘোষণা করবেন। কারণ, অতীতে বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন পরিস্থিতিতে সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার নজির আছে।

বর্তমান সরকার, যার ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রধান একটি গোঁড়া ইসলামী সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যার সংস্কার কমিশন একটি অস্পষ্ট গণতান্ত্রিক রোডম্যাপের দিকে এগোচ্ছে যা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি ঐতিহাসিক অসহিষ্ণুতাকে স্বীকার করতে অপারগ, যারা হিন্দু জনগোষ্ঠীর সঙ্গে একটি স্বচ্ছ সংলাপের উদ্যোগ নিতে অক্ষমতা প্রদর্শন করছে অথচ অপরিহার্য এ উদ্যোগটিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে ভয় দূর করে তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনা যেত।

বাংলাদেশের হিন্দু নাগরিকরা প্রকৃতপক্ষেই অরক্ষিত এবং সংক্ষুব্ধও বটে। তাদের যে সহিষ্ণু, ঐক্যবদ্ধ ও সম্প্রীতির পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে বলা হচ্ছে তা তাদের স্মৃতি বা বাস্তব অভিজ্ঞতায় অস্তিত্বহীন। এর পরও ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের প্রেক্ষাপটে ড. মুহম্মদ ইউনূস এবং তাঁর সরকার এমন আত্মবিশ্বাসের ঢেকুর তুলছেন যা প্রকারান্তরে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আত্মপ্রসাদের সামিল।

সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহীনতার প্রতিকার না হলে আরও নতুন সঙ্কটের ঝুঁকি তৈরি হবে। ফটোসেশন, করমর্দন, হাসি হাসি মুখের ছবি ফলাও করে প্রচার করার মধ্যে এ সঙ্কটের কোন সমাধান নেই। এগুলো কেবল নিষ্ক্রিয়তাকে আরও বাড়িয়ে তুলবে এবং সঙ্কটকে আরও জটিল স্তরে নিয়ে যাবে।●