যুক্তরাষ্ট্রে হাসিনার পক্ষে প্রচারণার নেপথ্যে এক মিডিয়া-মালিক
ওয়াশিংটনে শেখ হাসিনার ইমেজ শক্তিশালী করতে যেভাবে গোপনে ডানপন্থী প্রচারযন্ত্রে অর্থায়ন করার মাধ্যমে আইন লঙ্ঘনের ঝুঁকি নিয়েছেন এক বাংলাদেশি উদারপন্থী প্রকাশক
বাংলাদেশের আর দশজন খানদানি ব্যক্তির মতো নন কাজী আনিস আহমেদ। জন্ম সেনা পরিবারে। যেই পরিবার আবার এখন বিশাল এক ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের মালিক। পড়াশুনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত আইভী লীগের বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরবর্তীতে তুলনামূলক সাহিত্যে পিএইচডি করেছেন নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ব্রিটিশ অভিনেত্রী টিলডা সুইংটনের সাথে আড্ডা কিংবা সাহিত্য সন্ধ্যা আয়োজনের পাশাপাশি প্রায়ই নিউ ইয়র্ক টাইমস বা গার্ডিয়ানের মতো খ্যাতনামা আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকায় বাংলাদেশ নিয়ে তার তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণধর্মী লেখা চোখে পড়ে। এছাড়া তিনি পেন ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ শাখার প্রধানের দায়িত্বেও আছেন — ফলে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ঝাণ্ডাও উড়ান তিনি।
তার নেতৃত্বে কাজী পরিবারের এক সময়ের আলোচিত মিডিয়া জগতের পুনর্জন্ম হয়েছে। যোগ হয়েছে একটি ছাপা কাগজ, একটি ডিজিটাল বাংলা সংবাদমাধ্যম, একটি সাহিত্য ম্যাগাজিন ও দুইটি প্রকাশনা সংস্থা। যদিও এসব প্রকাশনার কাটতি কতটুকু তা ভিন্ন আলাপ। এই প্রকাশনা সাম্রাজ্যের ‘মুকুট’ ঢাকা ট্রিবিউন আর্থিকভাবে দীর্ঘদিন ধরেই ত্রাহিত্রাহি অবস্থায়। নতুন খবর প্রকাশের চেয়ে নিজেদের বেতন কবে হবে তা নিয়েই বেশি উদ্বিগ্ন থাকতে দেখা যায় পত্রিকার সাংবাদিকদের। অন্যদিকে কাজী পরিবারের নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রকাশনা সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে লেখকদের পারিশ্রমিক দেয়া নিয়ে গড়িমসি করার অভিযোগ অন্তত অর্ধডজন লেখকের।
এতকিছুর পরও অবশ্য রাজনৈতিক তদবিরের উদ্দেশ্যে ওয়াশিংটনে কোটি কোটি টাকা পাঠাতে বেগ পেতে হয়নি ৫৪ বছর বয়সী আনিসের। শুধু তা-ই নয় — এই কাজে নীরবে ব্যবহার করেছেন নিজের দুবাই-ভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানকে। নেত্র নিউজের হাতে আসা নথিপত্র অনুযায়ী, গোপনে এই অর্থ ব্যবহার করা হয়েছে পতিত স্বৈরাচার ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইতিবাচক ইমেজ তৈরি এবং তার বিরোধীদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা চালানোর উদ্দেশ্যে। আর এর মধ্য দিয়ে বিভিন্ন দেশের আইন লঙ্ঘন করার ঝুঁকি নিতেও পিছপা হননি আনিস আহমেদ।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সঙ্গে কাজী পরিবারের গভীর সম্পর্কের বিষয়টি অজানা কিছু নয়। কিন্তু নেত্র নিউজের কাছে থাকা নথিপত্রগুলো থেকে দেখা যায় হাসিনার পক্ষে কাজ করতে রীতিমতো আদা জল খেয়ে নেমে গিয়েছিলেন কাজী আনিস আহমেদ। বাংলাদেশের শহুরে অভিজাত ব্যক্তিবর্গ কীভাবে জনগণের আস্থা হারাতে থাকা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে প্রাণান্ত চেষ্টা করে গেছেন — তারই যেন নজির সৃষ্টি করে গেছেন তিনি। এতে করে যদি ধর্মনিরপেক্ষতা ও প্রগতিশীলতার মূল্যবোধকে জলাঞ্জলি দিতে হয়, তাতেও যেন কসুর নেই।
প্রগতিশীল ব্যক্তির অর্থায়নে যখন ডানপন্থী তদবির
২০১৫ সালের ১০ মে ওয়াশিংটন-ভিত্তিক তদবিরকারী সেথ ওল্ডমিক্সন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ‘লিবার্টি সাউথ এশিয়া’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে নিজের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে নিবন্ধন করেন।
এক বছরের কিছু সময় পর তিনি তার নিবন্ধনের নথি পরিবর্তন করে ‘গ্রিন পার্সপেক্টিভ এফজেডই’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে বিদেশী অর্থদাতা হিসেবে যোগ করেন। নেত্র নিউজের হাতে প্রমাণ রয়েছে যে, দুবাইয়ে নিবন্ধিত এই ‘গ্রিন পার্সপেক্টিভ’ ছিল সরাসরি কাজী আনিস আহমেদের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি প্রতিষ্ঠান। ওল্ডমিক্সন নিজের তদবিরের জন্য পরের কয়েক বছরে মোট ৪৩০,০০০ মার্কিন ডলার (৪ কোটি টাকারও বেশি) খরচের হিসাব দাখিল করেন।
এই অর্থের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, কংগ্রেস সহ দেশটির ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক কমিশনেও তদবির করেন ওল্ডমিক্সন। মার্কিন কংগ্রেসে তিনি চারটি প্রস্তাবনা উত্থাপনে ভূমিকা রাখেন –- যার তিনটিই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বিতর্কিত দুই রাজনীতিবিদ তুলসি গ্যাবার্ড এবং জিম ব্যাংকসের পৃষ্ঠপোষকতায়।
এই প্রস্তাবনাগুলোতে বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে সেই সময় পরিচালিত বাঙালি-বিরোধী গণহত্যাকে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর চালানো হত্যাযজ্ঞ হিসেবে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছিল। পাশাপাশি, শেখ হাসিনার দীর্ঘদিনের শত্রু জামায়াতে ইসলামকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠনের তকমা দেয়া এবং বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কার্যক্রম নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয় প্রস্তাবনায়। অপর একটি প্রস্তাবনায় হাসিনা সরকারের রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট সমাধানের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়।
প্রস্তাবনাগুলোতে অন্যান্য বিভিন্ন বিষয় উল্লেখ থাকলেও, হাসিনা-বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে রাখা বার্তা সংবলিত অংশগুলো ‘লিবার্টি সাউথ এশিয়া’ আলাদা করে প্রচারেরও ব্যবস্থা করেছিল। প্রথম দেখায় এই প্রস্তাবনাগুলোকে হয়তো তেমন একটা বিতর্কিত মনে হবে না। কেননা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সাথে আঁতাত ও নিজেদের ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ সংক্রান্ত আদর্শের কারণে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে অনেকদিন ধরেই সমালোচনা ছিল। কিন্তু এই জামায়াত-বিরোধী প্রচারণায় ওল্ডমিক্সন জড়িত থাকার কারণে গোটা প্রক্রিয়া ভিন্ন এক রূপ ধারণ করেছে।
কেননা ওল্ডমিক্সনের সঙ্গে ‘মিডল ইস্ট ফোরাম’-এর মত সংগঠনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করা খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান ‘সাউদার্ন পোভার্টি ল সেন্টার’ এই সংগঠনটিকে “মুসলিম-বিদ্বেষী” হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।
নেত্র নিউজের হাতে আসা ২০১৯ সালের একটি ইমেইল অনুযায়ী, মিডল ইস্ট ফোরামের পদস্থ কর্মকর্তা ক্লিফোর্ড স্মিথ বাংলাদেশ বিষয়ে কংগ্রেস সদস্য জিম ব্যাংকসের করা একটি প্রস্তাবনা সমর্থন করে সাংবাদিকদের মধ্যে বিলি করেন। বাংলাদেশের একজন সাংবাদিকের কাছে পাঠানো ওই ইমেইলে ওল্ডমিক্সনের ‘লিবার্টি সাউথ এশিয়া’কে একটি “সহযোগী-সংস্থা” হিসেবে দাবি করেন ক্লিফোর্ড স্মিথ।
এর বাইরেও ওল্ডমিক্সন, মিডল ইস্ট ফোরামের স্যাম ওয়েস্টরোপ ও কংগ্রেস সদস্য জিম ব্যাংকসের সাথে রক্ষণশীল থিংকট্যাংক হাডসন ইন্সটিটিউটে বাংলাদেশ নিয়ে এক আলোচনায় যোগ দেন ‘ইনভেস্টিগেটিভ প্রোজেক্ট অন টেরোরিজমের (আইপিটি)’ -এর হিন্দুত্ববাদী বিশ্লেষক আভা শংকর। এই আইপিটিকে যুক্তরাষ্ট্রে একটি ইসলামবিদ্বেষী নেটওয়ার্কের অংশ হিসেবে আখ্যা করেছিল দেশটির খ্যাতনামা প্রগতিশীল সংগঠন ‘সেন্টার ফর অ্যামেরিকান প্রোগ্রেস’। এর বাইরে অ্যামেরিকান মুসলিমদের লক্ষ্য করে “গোপন গোয়েন্দা কার্যক্রম” বন্ধের জন্য সংগঠনটিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন নিউ ইয়র্কের অ্যাটর্নি জেনারেল।
এছাড়া বাংলাদেশ বিষয়ে নিজের তদবির কার্যক্রমের সঙ্গে মিল রেখে বেশ কয়েকটি মতামত নিবন্ধ প্রকাশ করেন ওল্ডমিক্সন। তিনি নেত্র নিউজের বিস্তারিত প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি।
আইনগত ও নৈতিক জটিলতা
নেত্র নিউজের অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ অনুযায়ী, কাজী আনিস আহমেদের অর্থায়নে পরিচালিত সেথ ওল্ডমিক্সনের এই গোপনে প্রভাব বিস্তারের কারবারে আইন লঙ্ঘনের ঝুঁকি ছিল।
২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল নাগাদ দুই ধাপে চলা এই গোপন তদবির কার্যক্রমের শুরু থেকেই কাজী আনিস আহমেদ তার সম্পৃক্ততাকে গোপন রাখতে চেয়েছেন। নথিপত্রে ‘লিবার্টি সাউথ এশিয়া’কে দেখানো হয়েছিল এই কার্যক্রমের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে। কিন্তু ওই প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে ছিলেন তদবিরকারী নিজেই।
এর বাইরে ‘এসপিআর কনসাল্টিং’ নামে নিউ ইয়র্ক-ভিত্তিক আরেকটি প্রতিষ্ঠানকে দেখানো হয়েছিল “সহযোগী সংগঠন” হিসেবে। কিন্তু এই নামে নিউ ইয়র্কে কোন অলাভজনক বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হদিস পাওয়া যায়নি।
বাস্তবে তদবিরের কাজে ব্যবহৃত হওয়া তহবিলের পুরোটা না হলেও, একটা বড় অংশেরই যোগান দিয়েছে আনিস আহমেদের মালিকানাধীন ‘গ্রিন পার্সপেক্টিভ [এফজেডসিও]’ নামে সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিবন্ধিত একটি কোম্পানি।
দুবাই সরকারের তথ্যভাণ্ডার ও নেত্র নিউজের হাতে আসা কোম্পানি গঠন সংক্রান্ত নথি থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে এই কোম্পানির মালিক কাজী আনিস আহমেদ। নথিতে আরও দেখা গেছে, ওল্ডমিক্সনের উল্লেখ করা বিদেশী অর্থদাতা কোম্পানি ও কাজী আনিস আহমেদের দুবাইয়ের কোম্পানির ঠিকানা একই।
দুবাইর নথি অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি চা, কফি এবং স্ন্যাকস জাতীয় খাবারের আমদানি-রপ্তানির সাথে যুক্ত।
বৈদেশিক মুদ্রা দেশের বাইরে পাঠানোর বিষয়ে বাংলাদেশের কঠোর আইনি বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও আহমেদ কীভাবে এই বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশ থেকে সরিয়েছিলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। কিন্তু তার আইনগত সমস্যা কেবল বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী, বিদেশী রাজনৈতিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট তদবিদকারীদের অবশ্যই ‘ফরেন এজেন্টস রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্টের’ অধীনে নিবন্ধিত হতে হয়। এই আইন অনুযায়ী, তদবিরকারীরা নিজেদের ‘বিদেশী এজেন্ট’ হিসেবে প্রকাশ্যে শনাক্ত করবেন এবং তদবিরের যাবতীয় কার্যক্রম ও বিস্তারিত জনসম্মুখে প্রকাশ করবেন।
কিন্তু তা না করে, ওল্ডমিক্সন নিবন্ধিত হয়েছেন ‘লবিং ডিসক্লোজার অ্যাক্ট’ নামে একটি আইনের অধীনে, যেটি শুধুমাত্র বাণিজ্যিক তদবিরের কাজে ব্যবহার করা যায়। এই আইনে নিবন্ধিত হওয়ার ফলে ওল্ডমিক্সনকে তার তদবির কার্যক্রমের অনেক কিছুই প্রকাশ করতে হয়নি। এছাড়া নিজেকে ‘বিদেশী এজেন্ট’ হিসেবে শনাক্ত না করায় তিনি মার্কিন নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে দেখা করতে সুবিধা পেয়েছিলেন। আর পুরো কার্যক্রমকে বাণিজ্যিক তদবিরের আদলে সাজাতে ‘গ্রিন পার্সপেক্টিভ এফজেডসিও’র মতো আমদানি-রপ্তানি প্রতিষ্ঠানকে জড়িত করা হয়েছে বলে একজন বিশেষজ্ঞ মত দিয়েছেন।
২০২১ সালে বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউট নামে একটি ঢাকা-ভিত্তিক থিংক-ট্যাংক যুক্তরাষ্ট্রে তদবিরকারী নিয়োগ দিয়েছিল। ওই তদবিরকারী নিজেদের কার্যক্রম নিয়মমাফিক রাজনৈতিক তদবির হিসেবে নিবন্ধন করে — যদিও কাগজে কলমে বাংলাদেশ সরকার তাদের অর্থদাতা ছিল না। ঠিক তেমনি কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করা আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য তাহজীব আলম সিদ্দিকী “ব্যক্তিগত” উদ্যোগে একটি লবিস্ট প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া করেছিলেন, যারা সঠিকভাবে নিজেদের বাংলাদেশ সরকারের এজেন্ট হিসেবে নিবন্ধিত করেছিল।
কিন্তু আনিস আহমেদের তদবির কার্যক্রম এই নিয়মগুলো অনুসরণ করেনি, যদিও তিনি আওয়ামী লীগের সাথে উতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। তার বাবা কাজী শাহেদ আহমেদ ছিলেন দলটির সাথে সম্পৃক্ত প্রবীণ ব্যবসায়ী, যিনি নব্বইয়ের দশকে শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে প্রচারণা চালাতে আজকের কাগজ নামে একটি সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা তার জীবনী গ্রন্থের একটি সংক্ষিপ্ত অংশ থেকে জানা যায়। আনিসের বড় ভাই কাজী নাবিল আহমেদ ছিলেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সদস্য। এমনকি আনিস আহমেদ নিজেও আওয়ামী লীগের দলীয় থিংক-ট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন’ থেকে প্রকাশিত ও হাসিনার ভাগ্নে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি সম্পাদিত হোয়াইটবোর্ড ম্যাগাজিনের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
ওয়াশিংটনে অবস্থিত কুইন্সি ইন্সটিটিউটের ‘ডেমোক্র্যাটাইজিং ফরেন পলিসি প্রোগ্রামে’র নিক ক্লিভল্যান্ড-স্টাউটের মতে, কোনো তদবির কার্যক্রম থেকে যদি বিদেশী কোনো রাজনৈতিক দল সুবিধা পায় তাহলে সেটিকে অবশ্যই ‘ফরেন এজেন্টস রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্টে’র অধীনে নিবন্ধন করতে হবে। কোনো রাজনৈতিক দল যদি সরাসরি এই কার্যক্রমে অর্থায়ন না-ও করে থাকে, তারপরও এই নিয়ম প্রযোজ্য হবে।
“এই তদবির কার্যক্রম থেকে বোঝাই যাচ্ছে যে এগুলো আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধীদেরকে আক্রমণ করেই করা হয়েছে,” নেত্র নিউজের কাছে মন্তব্য করেন তিনি। “সবকিছু বাদ দিয়েও যদি ধরি, সরকারে থাকা আওয়ামী লীগ যে স্পষ্টতই এই তদবির কার্যক্রমের অন্যতম সুবিধাভোগী, তা তো বোঝাই যাচ্ছে।”
ঠিক একই ধরণের অভিযোগে কয়েক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল ফ্লিনকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল। তদবিরকারী হিসেবে ফ্লিন তুরস্কের এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নেদারল্যান্ডসের একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক হিসেবে অর্থ নিয়েছিলেন। কিন্তু বিনিময়ে তিনি তুরস্কের পক্ষে রাজনৈতিক তদবির করেন। ফলশ্রুতিতে, তার উচিত ছিল ‘ফরেন এজেন্টস রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট’ অনুযায়ী নিবন্ধিত হয়ে সকল কার্যক্রম জনসম্মুখে প্রকাশ করা। কিন্তু তিনি তা না করে ওল্ডমিক্সনের মতো ‘লবিং ডিসক্লোজার অ্যাক্টে’ নিবন্ধিত হয়েছিলেন। এতে করে তিনি তদবির কার্যক্রমের অনেক বিস্তারিত প্রকাশ না করে রেহাই পেয়েছিলেন। এই অভিযোগে দেশটির একটি আদালতে দোষী সাব্যস্ত হন তিনি।
“বাংলাদেশের সরকারের সাথে সম্পর্ক রয়েছে এমন ব্যক্তির অর্থায়নে একজন তদবিরকারী যুক্তরাষ্ট্রে কী কী বিষয়ে তদবির করছে, কাদের সাথে যোগাযোগ করছে এবং কী ধরণের তথ্য সরবরাহ করছে, তা জানার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের জনস্বার্থ রয়েছে,” বলেন ক্লিভল্যান্ড-স্টাউট। “কিন্তু যেহেতু তারা ফরেন এজেন্টস রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্টের বদলে লবিং ডিসক্লোজার অ্যাক্টে নিবন্ধন করেছে, তাই এখন এই সম্পর্কে বিস্তারিত জানা সম্ভব হচ্ছে না।’
আইনি জটিলতার বাইরেও, আনিস আহমেদের এই ধরণের কার্যক্রম নৈতিকতার মানদণ্ডেও প্রশ্নবিদ্ধ।
যখন তিনিওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বা নিউ ইয়র্ক টাইমসে আওয়ামী লীগের বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে ‘মৌলবাদী’ বা ‘ভয়ঙ্কর উগ্রবাদী গোষ্ঠী’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন, তখন তিনি কি তাদের বিরুদ্ধে নিজের অর্থায়নে প্রচারণা চালানোর কথা উল্লেখ করেছিলেন? যদি এই সংবাদপত্রগুলো তার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকতো, তার নিবন্ধগুলো হয় সরাসরি বাতিল হয়ে যেত অথবা তার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য সংযুক্ত করে দেয়া হতো, যা তার লেখাকে অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত করতো।
এই পুরো বিষয়টি থেকে কাজী আনিস আহমেদের একটি ভিন্ন রূপের সন্ধান পাওয়া যায়, যিনি নিজেকে পৃথিবীর সামনে একজন প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী এবং বাকস্বাধীনতার স্বপক্ষের ব্যক্তি হিসেবে জাহির করেন। কিন্তু পর্দার আড়ালে, তিনি তার অর্থসম্পদ ব্যবহার করে ডানপন্থী ইসলাম-বিদ্বেষীদের প্রচারণা কার্যক্রমকে অর্থায়ন করছিলেন — তা-ও আবার একজন স্বৈরাচারী শাসকের আন্তর্জাতিক ইমেজ গড়ার কাজে।
কাজী আনিস আহমেদ নেত্র নিউজের কোনো প্রশ্নের জবাব দেননি।
সম্প্রতি হাসিনা-বিরোধী শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে, তখন কাজী আনিস আহমেদ নিজের ফেসবুকে এই আন্দোলনের ব্যাপক সমালোচনা করেন। শেখ হাসিনার নিরাপত্তা বাহিনী ও তার রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের গুণ্ডাপাণ্ডারা যখন শতাধিক বিক্ষোভকারীকে হত্যা করেছে, তখন তিনি তার ফেসবুক প্রোফাইলে উল্টো বিক্ষোভকারীদের সমালোচনা করেছেন। তার নেতৃত্বে থাকা পেন বাংলাদেশও এই ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চলাকালে নীরবতা পালন করেছে, যদিও পেন ইন্টারন্যাশনাল সরকারের মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগের কঠোর সমালোচনা করেছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তাক্ত বিক্ষোভে সাতশতাধিক মানুষ নিহত হওয়ার পর শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার পাঁচদিন আগেও ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে আনিস বলেন, “শেখ হাসিনা অন্যান্য বিকল্পের চেয়ে এখনও অনেক ভালো।” সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ্যে আসা অডিও রেকর্ডিং থেকে জানা যায়, তার মালিকানাধীন সংবাদমাধ্যম বাংলা ট্রিবিউনের সম্পাদক জুলফিকার রাসেল শেখ হাসিনার পদত্যাগের কিছুদিন আগেও তার সাথে দেখা করে তাকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিলেন এবং বিক্ষোভ দমনে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান।
কিন্তু হাসিনার পতনের পর থেকে আনিস আহমেদের নিয়ন্ত্রণাধীন সংবাদমাধ্যমগুলো ভিন্ন সুর ধরেছে।
ঢাকা ট্রিবিউন — যাদের সংবাদভাষ্য প্রায়শই হাসিনা সরকারের পক্ষে যেত — তারা এখন গণঅভ্যুত্থানের কড়া সমর্থকে পরিণত হয়েছে। পত্রিকাটির সম্পাদক জাফর সোবহান সম্প্রতি লিখেছেন, হাসিনা বাংলাদেশকে পরিণত করেছিলেন একটি “কাকিস্টোক্রেসিতে — অর্থাৎ সবচেয়ে জঘন্য মানুষদের শাসনব্যবস্থায়।” ●