মাজার ভাঙ্গা ধর্মের রুহানিয়াতের বিপরীত

ধর্ম কিংবা সমাজ বোঝাপড়ার যে রুহানিয়াত, তা যে কোনো আগ্রাসী ক্ষমতাকে অস্বীকার করতে শেখায়।

মাজার ভাঙ্গা ধর্মের রুহানিয়াতের বিপরীত

মাজার ভাঙচুর হচ্ছে ইদানীং। সহীহ মুসলমানরা অসহীহ যাবতীয় যা কিছু ধর্মাচার আছে, তার নিধনে নেমেছেন, সেই নিধনের ধারায় এসব মাজার ভাঙচুর হচ্ছে। ভাঙচুরের প্রধান কারণ, মাজারে শিরক হয়। মাজারে আল্লাহ বাদে অন্যের কাছে প্রার্থনা করা হয়। এই জন্য সমস্ত মাজার ভাঙতে হবে। ভাঙ্গাও পড়েছে বেশ অনেক কয়টি মাজার। ৪৩টি মাজারের একটি তালিকা পেয়েছি, সত্যাসত্য তো সেভাবে নির্ণীত হয়নি। কিন্তু যদি কোথাও একটি মাজারও ভাঙ্গা পড়ে, সেটাও ধর্মের রুহানিয়াতের বিপরীত। বেশ অনেক কয়টা কারণেই ধর্মের রুহানিয়াত মাজার ভাঙ্গাকে সমর্থন করে না, করতে পারে না।

প্রথমত, যারা মাজারকে নিজেদের ধর্মবোধের জন্য জরুরি ভাবেন, তারা কি আদতেও কিছু মাজারে চান? অর্থাৎ, আল্লাহর কাছে চাইতে হবে, এমন কিছু পীরবাবা বা মাজারের কাছে চান, যা ইসলামে স্পষ্ট শিরক? এমনটা প্রায় কেউই করেন না। ওনারা পীরের কাছে কিছুই চান না। পীরের ভায়া হয়ে আল্লাহর কাছে চান। এই সূত্র ধরে চাওয়ার ইতিহাস আসলে বেশ পুরনো, এই তর্কও পুরনো। কারুর উছিলা করে আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়া যাবে কী না, এই হচ্ছে তর্কের মূল প্রতিপাদ্য। অনেক ইসলামিক তাত্ত্বিক মনে করেন, জীবিত কারুর উছিলা করে চাওয়া যাবে। অনেকে মনে করেন জীবিত ও মৃত দুই ধরনের মানুষের উছিলা করেই চাওয়া যাবে আল্লাহর কাছে। মাজারে যাওয়া মানুষেরা মাজারে যিনি কবরস্থ আছেন, তার উছিলা করেই আল্লাহর কাছে যা কিছু চাওয়ার, চেয়ে নেন। এই চাওয়ার বেলায় তারা নানা রকম আয়োজন করেন, কেউ সেখানে গিয়ে দোয়া করেন, কেউ মাজারে চুমু খান। আর সেজদা করার ব্যাপারে প্রায় প্রতিটা মাজারেই নিষেধাজ্ঞা লেখা থাকে।

যারা মৃত মানুষের উছিলা ধরে আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়া যাবে না মর্মে সিদ্ধান্তে গেছেন, মূলত সালাফিরা, তারা মাজারে যাওয়াটাকেই শিরক ভেবে নিয়ে শিরকের বিনাশের লক্ষ্যে মাজার ভাঙ্গার আলাপ নানা মর্মে ও ফর্মেই দিয়ে থাকেন। এই জায়গাটা তাদের রাজনৈতিকতার অংশ। আমি আমার মাস্টার্সে থিসিস “রাজনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ওয়াজ” এ এই ব্যাপারটা খানিক দেখিয়েছি।

মাজার ভাঙ্গার পিছনে সালাফিদের পাশাপাশি কিছু কট্টর কওমী মাদ্রাসারও দায় আছে বলে আমি মনে করি। মাজার কালচারে, যিনি পীর থাকেন, তার সম্মানার্থে নানা আয়োজন করা হয়। সেসব আয়োজনকে নানাভাবে শিরক বলতে চান কওমিরাও। মাজারে চুমু, ফুল পরানো, চাদর পরানো এসবকে তারা শিরক ভাবেন।

কিন্তু মাজার কালচারে চুমু, ফুল বা চাদর পরানোকে খোদার জায়গাতে রেখে করা হয় না। বরং সম্মানের জায়গা থেকেই করা হয়। এই সম্মানকে অসম্মান করার অধিকার কারুর কীভাবে থাকে আমার জানা নেই!

🕌

ইতিহাস দেখলে দেখা যাবে, আমাদের এই অঞ্চলের মানুষ বড় মানুষের সঙ্গ, সংস্পর্শ সেভাবে পায়নি। কারুর মাধ্যম বা ভায়া হয়ে তাদের দরবারে, প্রাসাদে যেতে হয়েছে। ফলে, আমাদের চরিত্রে উছিলা, ভায়া, তদবির, সুপারিশের প্রবণতা অনেক বেশি। এবং আমাদের রাজনীতি, বোঝাপড়াতেও এই ব্যাপারটা এসে গেছে, আমরা একলা গিয়ে, চেয়ে কিছু পাব না, পাই না। ফলে, যেই মানুষটা কিংবা যা কিছু আমাদের কাঙ্ক্ষিত তার কাছে পৌঁছাতে, তা পেতে আমাদের মাধ্যম লাগবে। আমরা তাই রাজনৈতিক নেতাকে ধরি কার্যসিদ্ধির জন্য। কিংবা যে কাউকে, যার হয়ে পৌঁছে যাওয়া যাবে সহজেই।

আল্লাহর ধারণা আমাদের কাছে যে কোন সম্মানিত কিছুর চাইতেও মহান, মহিয়ান এবং গুরুত্বপূর্ণ। ফলে, আমরা যে সহজে, একলা, নিজের কাজে-ইবাদাতে আল্লাহ অবধি পৌঁছাতে পারব না, সেই মানসিকতা আমাদের মাথায় গেঁথে থাকে। আমরা তাই উছিলা চাই। আমরা চাই, যে আল্লাহর প্রিয়, তার মাধ্যমে আল্লাহ অবধি পৌঁছাতে। আমরা চাই, আমাদের যাবতীয় সমস্যা, আমাদের অসহায়তা, আমাদের যাবতীয় নালিশ, আমাদের কষ্ট সব যেন সোজা গিয়ে পৌঁছে আল্লাহর কাছে। তাই মানুষ খুঁজতে থাকে এরম কাউকে, যে আল্লাহর কাছে পৌঁছাতে পেরেছেন বলে লোকে মানে, বিশ্বাস করে। কাউকে পেয়ে গেলে মানুষ তখন দলবেঁধে হাজির হয় সেখানে। নিজের ফরিয়াদগুলো জানাতে থাকে।

মাজারের মানুষগুলোর ব্যাপারে লোকমুখে চর্চা থাকে, তারা আল্লাহর কাছে সম্মান নিয়ে পৌঁছেছেন। ফলে, মানুষেরা তার মাধ্যমে, তার উছিলা করে পৌঁছাতে চায়।

পুরান ঢাকার খানকা, মাজারগুলো নিয়ে একটা কাজ করছি। সেই কাজের সুবাদে নানা খানকায় যেতে হয়েছে, সেখানে মানুষের অসহায়তা দেখেছি, কাঁদতে দেখেছি জারজার হয়ে আল্লাহর কাছে পীরের হাত ধরে কিংবা পীরের বুকের সাথে লেগে। মানুষগুলো মনে করেন, পীর সাহেব তার মুশকিল আসান করে দেবেন।

মানুষের ভরসার জায়গাকে আপনি নষ্ট করে দিতে চাইলে, আপনি কখনও মুসলিম হয়ে উঠতে পেরেছেন বলে দাবি করতে পারেন না। পারবেন না। কারণ ইসলাম সমস্ত তাত্ত্বিক বিতর্কের পরেও প্রতিটা মানুষ; যে আল্লাহতে ঈমান এনেছে, তার ধর্ম পালনের স্বাধীনতা দিতে চায়, দেয়।

যদি তা নাই হতো, তাহলে হাদিসে ইসলামের ৭৩ দল, এবং এর মধ্যে কেবল একটা দল বেহেশতে যাবে, বাকিরা নিজেদের কাজের হিসেব দিয়ে তারপর বেহেশত পাবে মর্মে আলাপ আসত না। মজার ব্যাপার হলো, কোথাও নির্দিষ্ট করে বলা নেই ঠিক কোন দল বেহেশতে যাবে শুরুতেই। ফলে, কোন মুসলিম নিজেদের তাত্ত্বিক বিতর্ককে ধ্রুব ধরে নিয়ে বাকিদের বিনাশ চাইবে, সেই সুযোগও নেই আদতে।

🕌

ধর্ম কিংবা সমাজ বোঝাপড়ার যে রুহানিয়াত, তা যে কোনো আগ্রাসী ক্ষমতাকে অস্বীকার করতে শেখায়। রুহানিয়াতকে এম্পেথি বা সহানুভূতি অর্থে নেওয়া যায়। আপনি যখনই কোনো কাজের মধ্যে নিজেকে রেখে ব্যাপারটাকে দেখবেন, আপনি বুঝতে পারবেন, এর ভেতরকার হার্দিক আবেদনটা ঠিক কোথায়। ধর্মীয় তত্ত্ব কিংবা মানুষের সাইকি-মানসিকতার নানা রঙ-রূপের বৈচিত্র্য যদি আপনি বিশ্বাস করেন, মানেন। আপনি কখনও কারুর ওপর আগ্রাসী হতে পারবেন না।

🕌

মাজার ভাঙ্গাভাঙ্গির মধ্যে দিয়েও একটা মজার ব্যাপার খেয়াল করেছি। মূলত সেইসব মাজার ভাঙচুর হয়েছে, যেখানে টাকা কম, আধিপত্য কম। যেই মাজারগুলোতে পয়সার জৌলুশ, ক্ষমতার সাথে লিয়াজোঁ আছে, সেসবে কোন আঁচড় পড়েনি। পড়ার কথাও না। আমাদের বোঝাপড়ার অনেক কিছুই অর্থনৈতিকভাবে নির্ধারিত হয়।

কারুর বোঝাপড়া, তার দ্বীন ধর্মের প্রতি ভালোবাসা, সেটার বিনাশ কিংবা রক্ষার দায় যদি অর্থনৈতিকতা আর ক্ষমতার বোঝাপড়ার সাথে সমঝে চলে, সে আদতে ধর্মপ্রাণ নয়। বরং তার রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন বলেই এসব অনাসৃষ্টি করেছে, করছে।

ধর্ম বোঝাপড়ার নানা দল, উপদলও নিজেদের বোঝাপড়াকে রাজনৈতিক করতে চায়। সেই মর্মে তারা তাদের নানা বার্তাকে তাদের মাধ্যম দিয়ে ছড়িয়ে দেয়। আপনি তাই সালাফিদের ওয়াজ শুনলে দেখবেন এক রকম ইসলাম, দেওবন্দীদের বয়ানে অন্য ইসলাম পাবেন। আবার ক্ষমতার দৌড়ে থাকা জামায়াতের ইসলাম বয়ানে পাবেন ভিন্নতা।

এইসব রাজনৈতিকতা থাকবেই, চলবেই। প্রতিটা মানুষই তার বোঝাপড়ার সেরা ধর্মটুকুই মানবে, মানতে চাইবে, চর্চা করবে।

রাষ্ট্রের জন্যে তাই ইনক্লুসিভিটি বা বহুত্ববাদের চর্চা জরুরি, ধর্ম কিংবা আদর্শ ভিত্তিক কোনো ধরনের রাজনৈতিকতা যাতে রাষ্ট্রের আয়তনের মধ্যে ক্ষমতার চর্চা করতে না পারে । ব্যতিক্রম হলে সেই চর্চার বলি এবার হয়েছে মাজার। এরপর হয়ত কোনো এক মসজিদে হবে। ভেঙ্গে দেয়া হবে নানা ছুতোয়।●

মীর হুযাইফা আল মামদূহ — ইসলাম, সমাজ ও রাজনীতি বিষয়ক গবেষক।