আপনি কি দিল্লির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চান?
দাঁড়ানোর জন্য সঠিক সমশক্তির-প্রতিপক্ষ বেছে নিন। একটি কার্যকর মাঝারি মেয়াদী কৌশল তৈরি করুন। উত্তেজনা ছড়িয়ে বা উত্তেজিত হয়ে লাভ নেই। কৌশলে জয় আনুন।
এই শীতের দিনে রাস্তাঘাট ও বিকল্প মিডিয়ায় উত্তেজনার পারদ চড়ছে। পতাকা, সংখ্যালঘু, গ্রেপ্তার ও ত্রিপুরার একটি কনস্যুলেটের ওপর পরিকল্পিত আক্রমণের বিষয়গুলো ঘুরপাক খাচ্ছে অভিযোগ ও পাল্টা-অভিযোগের ভেতরে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি একসময় বিজেপির রেলমন্ত্রী ছিলেন, জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলাদেশিরা চেষ্টা করছে “জাতীয় ঐক্যের” চারপাশে একত্রিত হতে। কিন্তু কৌশলগত প্রতিক্রিয়া কবে কৌশলগত পদক্ষেপে রূপান্তরিত হবে, সে প্রশ্নই এখন বড় করে দেখা দিচ্ছে।
নানামুখী সংকটে ভারত
আমরা দক্ষিণ ভারতের ডেকান অঞ্চল থেকে শিখতে পারি। খোদ “দ্যা গ্রেট ইন্ডিয়ান এলিফ্যান্ট” কীভাবে ভেতর থেকে ভেঙে পড়ছে তা দেখতে পাচ্ছি।
চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ভারত হেরে গেছে। সরাসরি জিডিপির বিচারে চীনের অর্থনীতি এখন পাঁচগুণ বড় । মনে আছে, একসময় বলা হয়েছিল ভারত হবে প্রযুক্তির সুপার পাওয়ার আর চীন জানে শুধু “চুরি আর নকল” করতে। এখন চীন ভারতকে বহু মাইল পেছনে ফেলে দিয়েছে। নবায়নযোগ্য শক্তি, বৈদ্যুতিক যানবাহন, ৫জি ও ৫.৫জি, দ্রুতগামী রেল, তথ্যপ্রযুক্তি, রোবটিক্স এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় চীন এখন বিশ্বসেরা। আর ভারতে ৮০ কোটি মানুষ এখনও বিনামূল্যের খাবারের ওপর নির্ভরশীল।
“প্রতিবেশী প্রথম”- ভারতের এই নীতি আসলে নিজের আঙিনায় রাজত্ব করার কৌশল। তার প্রতিবেশীরাও সেটি বুঝতে পারে। নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে.পি. শর্মা ওলি ক্ষমতায় আসার পর প্রথমবার দিল্লি না গিয়ে বেইজিং গেছেন। ২০১৫ সালে নেপালের নতুন সংবিধানকে অজুহাত দেখিয়ে মোদি সরকার ছয় মাসের জন্য নেপালের ওপর অবরোধ আরোপ করেছিল, যা মানবিক ও অর্থনৈতিক সংকট ডেকে আনে।
অভিনাশ পালিওয়ালের India’s Near East: A New History বইটি এ অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে অবশ্যপাঠ্য হতে পারে। বইটিতে বাংলাদেশে ভারতের হস্তক্ষেপের পটভূমি তুলে ধরা হয়েছে—যেগুলো আমরা জানি এবং যেগুলো প্রায় কার্যকর হয়ে গিয়েছিল কিন্তু পরে সবগুলোই ব্যর্থতায় পর্যবশিত হয়।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল মিয়ানমারের তুলনায় অনেকটা কোমল সংস্করণ বলা যায়। এক বছরের বেশি সময় ধরে মণিপুরে জাতিগত সহিংসতা চলছে। মোদি সেখানে যেতে আগ্রহ দেখাননি। তিনি যেন বাংলাদেশি সংখ্যালঘুদের নিয়েই বেশি উদ্বিগ্ন, নিজের দেশের সংখ্যালঘুদের নিয়ে নয়। দেশটির ২০ কোটিরও বেশি মুসলিম এক দশক ধরে হিন্দুত্ববাদের নিপীড়নের শিকার। অথচ ভারতের বিশ্লেষকরা শুধু বাংলাদেশের দিকেই আঙুল তোলেন। কাশ্মীরের কথাও বলার কেউ নেই। আজ, কলকাতা বিপর্যস্ত, কারণ বাংলাদেশিরা এখন আর তাদের ছুটি কাটাতে বা চিকিৎসা নিতে সেখানে যাচ্ছে না। দিল্লি ৫ আগস্ট থেকে বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়া বন্ধ করেছে এবং এর ফলে নিজেরাই ক্ষতির মুখে পড়েছে।
প্রতিক্রিয়া ও সম্ভাব্য ফল
দিল্লি এখন লাগাতার চাপে রয়েছে। বিশেষ করে প্রাক্তন এক প্রধানমন্ত্রী, যিনি সম্প্রতি বাংলাদেশের ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয়েছেন, তাকে আশ্রয় দিয়ে পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত করে তুলেছে। সংকটকে করে তুলেছে আরও ঘনীভূত। এর ফলে হয়তো বাংলাদেশ সরকার আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পদক্ষেপ নিতে পারে।
হয়তো দলটিকে পাঁচ বছরের জন্য একটি নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হতে পারে, যতক্ষণ না পর্যন্ত দলটির নেতাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হওয়া মামলাগুলো নিষ্পত্তি হয়। যুক্তি হবে—এই দল ভারতের হয়ে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিল। মজার বিষয় হলো, এটি ঠিক জামাতের মতো, যাদের ওপর পাকিস্তানের পক্ষে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠেছিল।
ভারতের দ্য প্রিন্ট পত্রিকায় একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হলে একটি নতুন ছাত্র সংগঠন অভূতপূর্ব সাফল্য পেতে পারে। দেশীয় বিশ্লেষকরা একে অবিশ্বাস্য মনে করছেন। তাদের মতে, বিএনপি তখন একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করবে, যেমনটি ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ করেছিল। এটি একটি চমকপ্রদ রাজনৈতিক পরিবর্তন হতে পারে।
দিল্লির বিরুদ্ধে কৌশল কি
মধ্যম মেয়াদে ফলপ্রসূ হতে পারে এমন কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে-
১. চীনের কাছে আন্তরিকভাবে আবেদন করা, যাতে তারা তিস্তা নদীর সংকুচিত পানির সমস্যা সমাধানে তাদের প্রস্তাব নিয়ে ফিরে আসে। এটি উত্তরবঙ্গ এবং এর কৃষকদের জন্য জীবনরক্ষায় ভূমিকা রাখবে। এটি ভারতের জন্য একটি স্থায়ী কূটনৈতিক আঘাত হবে।
২. সার্ক পুনরুজ্জীবিত করার অনাবশ্যক প্রয়াস এড়িয়ে যাওয়া। এটি সত্তরের দশকে ঢাকায় সৃষ্টি এবং একে চব্বিশে এসে ঢাকাতেই সমাধিস্থ করতে হবে
৩. পূর্বদিকে এগিয়ে যাওয়া। ASEAN এবং RCEP-এ (ASEAN + চীন + জাপান + কোরিয়া) যোগ দেওয়ার জন্য কেবল নোটিশ পাঠানো নয়, কৌশলগতভাবে প্রস্তুতি নেওয়া। বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করা। আর, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) পুনরুজ্জীবিত করা।
৪. দিল্লির ধমক-ধামকি মোকাবিলা করা। স্পষ্ট করে দেওয়া যে, বাংলাদেশ বৃহত্তর একত্রীকরণের জন্য প্রস্তুত, কিন্তু সেটা হতে হবে সমতার শর্তে। চীন আরও আধুনিক এবং টেকসই অবকাঠামো নির্মাণে এগিয়ে আসতে পারে। ভারতের উচিত তার “সেভেন সিস্টারস”-এর অবহেলিত অবকাঠামো উন্নয়ন করা।
ভারতের সীমান্ত হত্যাকাণ্ড এবং বাংলাদেশের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য বন্ধ না হলে কোনো সম্পর্ক কার্যকর হবে না। ঢাকা তার সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার ব্যাপারে তার দায়িত্বে অটল থাকবে।
বিকল্প শক্তি
ভারতের সঙ্গে মোকাবিলায় চীনের সঙ্গে জোট গঠন ছাড়া আর কোনো বাস্তবিক পথ নেই। পাকিস্তানের সঙ্গে মিত্রতা তৈরির কোনো যৌক্তিকতা নেই। এটি সামরিকভাবে দুর্বল এবং অতীতের মত আবারও সমস্যার সৃষ্টি করবে।
চীনই পারে বাংলাদেশের সামরিক এবং কৌশলগত শক্তি বাড়াতে সাহায্য করতে। নতুন বাংলাদেশকে নতুন চিন্তা ও নতুন নেতৃত্বের মাধ্যমে এশিয়ার সমৃদ্ধির পথে এগোতে হবে।●
ফারিদ এরকিজিয়া বাকত একজন লেখক ও বিশ্লেষক।