বিশ্বাস ও বন্ধুত্ব
গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন শেখ হাসিনা। তার ক্ষমতাচ্যুতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান হয়েছে। কিন্তু হাসিনার এ পতন মেনে নিতে পারছে না ভারত। বাংলাদেশে নিজেদের অনুগত আওয়ামী লীগ সরকারকে হারানোর পর প্রতিক্রিয়া হিসেবে ভারত যেভাবে সংঘবদ্ধ অপপ্রচারে নেমেছে তাতে বাংলাদেশের সঙ্গে বৈরিতা প্রকাশ্য হয়ে উঠতে শুরু করেছে। এতে বাংলাদেশি জনগণের মধ্যে ভারতের ব্যাপারে মনোভাব আরও নেতিবাচক হয়ে উঠছে।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পলায়ন এবং গত ২ ডিসেম্বর ত্রিপুরায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হামলার ঘটনাকে অবিচ্ছিন্নভাবে দেখলে নানা বিষয়ের সমীকরণ সহজ হবে।
দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও বিশ্বাস মূল ভিত্তি হলেও, ভারতের অপরিপক্ব ও দায়িত্বহীন আচরণের কারণে বর্তমানে তা প্রায় শূন্যের ঘরে পৌঁছেছে। উগ্র হিন্দুত্ববাদকে বেছে নিতে গিয়ে ভারত তার প্রতিবেশী ও এক সময়ের বন্ধু বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে শুরু করেছে। সেইসঙ্গে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকেও ফেলেছে হুমকির মুখে।
সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদী অবস্থান বাংলাদেশকেও কট্টর ইসলামপন্থার দিকে ঠেলে দেবে। অথচ এক সময় বাংলাদেশে কট্টর ইসলামপন্থীদের প্রভাবশালী হয়ে উঠার যে কোনো সম্ভাবনাকে নাকচ করা হত। বলা হত বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলামপন্থীদের প্রভাবশালী হয়ে উঠার কোন ঝুঁকি নেই। আওয়ামী লীগের সদস্যরা সক্রিয়ভাবে দেশে ইসলামের প্রভাব নিয়ে ধূতর্তার সঙ্গে মিথ্যা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে আসছিলো। শেখ হাসিনার শাসনামল সমাপ্তির পর যা মিথ্যা প্রমাণ করা এখন আর বোধ করি কোন অপরাধ বলে গণ্য হবে না।
তবে ভারতবিরোধী চেতনা ছড়ানোর মাধ্যমে বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি সহিংস ও ধর্মান্ধ আচরণকে সহনীয় করারও অপচেষ্টা হয়েছে। যদিও ভারতে মুসলিম সংখ্যালঘুদের ওপর চলা অন্যায় আচরণও এসব সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে বৈধতা দিতে পারে না। তবুও ভারতের ক্রমাগত কর্তৃত্ববাদী আচরণ, সাম্প্রদায়িক উসকানি ও অপপ্রচারের প্রভাব কিছুটা হলেও বাংলাদেশে পড়েছে এবং সংখ্যালঘু হিন্দু নিপীড়নের বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। যদিও ভারতের আঞ্চলিক কর্তৃত্ববাদী আচরণকে হিন্দু ধর্মের বিশ্বাসের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
ভারতে ঠিক যেভাবে একটি হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকার সাম্প্রদায়িক ও উগ্রবাদকে উস্কে দিচ্ছে, তেমনি এটিও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রেরও এর আদিবাসী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর বৈষম্য আরোপের ইতিহাস রয়েছে।
অন্যদিকে, যেহেতু বাংলাদেশে মৌলবাদী মতাদর্শ ও গোষ্ঠীর অস্তিত্ব রয়েছে, সেহেতু তারা সাম্প্রতিক ভারতবিরোধী মনোভাবে ব্যাপক আবেদন খুঁজে পেতে পারে। তবে এটিও সত্য যে, ভারত যেভাবে একটি ধর্মীয় মৌলবাদী দলের হাতে শাসিত হচ্ছে, বাংলাদেশে সেরকম কোনো ঝুঁকি এখনো পর্যন্ত নেই। তবে শুধুমাত্র মৌলবাদকে প্রশ্রয় দেওয়ার মধ্য দিয়েই তেমন শঙ্কা তৈরি হতে পারে।
মনে রাখতে হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ধর্ম পালনের স্বাধীনতা অর্জিত হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠদের ঘৃণামূলক বক্তব্য জবাবদিহিতার বাইরে থেকে যাবে। এমনটা দেখা যায় ভারতে। সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উপর সংখ্যাগুরুদের নানামাত্রিক ঘৃণামূলক বক্তব্য রীতিমতো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পায়। সংখ্যালঘুদের ধর্ম পালনের স্বাধীনতা কেবল বাগাড়ম্বর হয়েই থাকে। এর বিপরীতে কার্যকর পদক্ষেপের তীব্র অনুপস্থিতি লক্ষ করা যায়।
এখন, এসব সঙ্কট স্বীকার করাই হবে সাম্প্রদায়িকতা রুখে দিয়ে ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিতের পথে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাথমিক পদক্ষেপ। ভারত এই পদক্ষেপটি নিতে অক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। তাই বলে বাংলাদেশও ভারতের মতো অক্ষমতার পুনরাবৃত্তি হতে দিতে পারে না।
ভারত শুধু নৈতিক দায়িত্ব থেকেই দূরে সরেনি বরং একসময়ে দক্ষিণ এশিয়ায় ধর্মনিরপেক্ষতার বাতিঘর হিসেবে থাকা নিজের অবস্থানকেও ব্যাহত করেছে। পতিত আওয়ামী লীগ- যারা বাংলাদেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে ভারতের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে গেছে, তাদের পতনের পর বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষা ও এ অঞ্চলের ধর্মনিরপেক্ষতা নিশ্চিতে সক্ষমতার লক্ষণ স্পষ্ট হয়েছে।
আর এসব ভূ-রাজনীতির মিথষ্ক্রিয়ায় যারা বন্ধুত্ব চাইছে, তাদের সঙ্গে সংযোগের ক্ষেত্রে ‘আন্তরিক বিশ্বাস’ ভিত্তি হিসেবে গণ্য হবে। বন্ধুত্ব ও বিশ্বাস কখনো একচেটিয়া নয় বরং পারস্পরিক সংযোগ ও সহযোগিতার। ভারত এটি কখনো বিশ্বাস করতে প্রস্তুত ছিল না আর তারা বাকিদেরও তাদের অপপ্রচারে বিশ্বাস করাতে ব্যস্ত। কিন্তু আওয়ামী লীগমুক্ত বাংলাদেশকে আর কখনোই ভারতের নেতৃত্বকে অনুসরণ করতে হবে না- এটিই এই সময়ের বাস্তবতা।●