বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশনে হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর হামলা, উত্তেজনা বাড়ছে
ভারতীয় ক্ষমতাসীন দলের সাথে গভীর সম্পর্ক রয়েছে এমন একটি সংগঠনের নেতৃত্বে হওয়া এই হামলায় শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে ক্রমেই খারাপ হতে থাকা বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে প্রভাব পড়তে পারে।
ভারতের শাসক দলঘনিষ্ঠ হিন্দু জাতীয়তাবাদী একটি গোষ্ঠী ২ ডিসেম্বর আগরতলায় বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশনে হামলা চালিয়েছে। হামলাকারীরা কূটনৈতিক মিশনের ভেতরে প্রবেশ করে ভাংচুর চালায় ও বাংলাদেশ পতাকা ছিঁড়ে ফেলে। বাংলাদেশ সরকার এই হামলাকে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক আইন ভিয়েনা কনভেনশন ১৯৬১-এর লঙ্ঘন হিসেবে উল্লেখ করেছে। বাংলাদেশের বক্তব্য, এই হামলার সময় ভারতীয় পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল, কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হামলার ঘটনা স্বীকার করে দুঃখপ্রকাশ করেছে। তবে দেশটির পক্ষ থেকে ঘটনার নিন্দা জানানো কিংবা দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়নি।
এই হামলা বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে উদ্বেগজনক, কারণ ঘটনার ঠিক কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারকে দেশের কূটনৈতিক মিশনের নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য একটি আনুষ্ঠানিক আবেদন জানিয়েছিল।
সর্বশেষ হামলার পর ভারত সরকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার কথা বললেও, বাংলাদেশের অনুরোধ সত্ত্বেও আগেই কেন নিরাপত্তা জোরদার করা হয়নি, এ নিয়ে ভারতের কাছ থেকে কোনো সুষ্পষ্ট জবাব নেই।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের হামলা কেবল বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আক্রমণ নয়, এটি আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মর্যাদা ও নিরাপত্তা সম্পর্কিত গুরুতর বিধানের লঙ্ঘনও।
বাংলাদেশের অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শহীদুল আনাম খান মন্তব্য করেছেন, “ভারতীয় পুলিশের দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশ মিশনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, যা তারা পালন করতে পারেনি।”
সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবি ও ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, হামলাকারীরা গেরুয়া পতাকা বহন করছিল, যা হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদী প্রতীক হিসেবে পরিচিত। একটি ভিডিওতে বাংলাদেশের পতাকা ছিঁড়ে ফেলার দৃশ্য দেখা যায়। হামলাকারীদের হাতে অন্তত একজনকে আক্রান্ত হতে দেখা যায়।
নিরাপত্তা বাহিনী পরে প্রতিবাদকারীদের মিশন থেকে বের করে দেয়। তবে এই প্রতিবেদনের প্রকাশকাল অব্দি এই হামলার জন্য কাউকেই আটক বা গ্রেপ্তার করা হয়নি।
আগস্ট মাসের শুরু থেকেই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মধ্যে টানাপোড়েন বেড়েছে, যখন ভারত সমর্থিত আওয়ামী লীগ গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা হারায়, যার ফলে ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে ভারতের গণমাধ্যমে উত্তেজনাপূর্ণ মন্তব্য এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদী জনতার সামাজিক মাধ্যমগুলোতে মিথ্যা তথ্য ও বিদ্বেষপূর্ণ ভাষার ব্যাবহার দুই দেশের সম্পর্ককে আরও তিক্ত ও জটিল করেছে এবং পরিস্থিতিকে সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
এই রাজনৈতিক অস্থিরতা বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘুদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে, যারা ঐতিহ্যগতভাবে আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলেন এবং বর্তমানে তারা নিপীড়ন ও আক্রমণের মুখে পড়ছেন। অন্যদিকে, ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলো বাংলাদেশী হিন্দুদের অধিকারের আন্দোলনকে লুফে নিয়েছে।
হিন্দুস্তান টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগরতলায় সহিংস প্রতিবাদগুলো আয়োজন করেছিল হিন্দু সংঘর্ষ সমিতি, যা বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (VHP)-এর একটি শাখা। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ একটি উগ্র জাতীয়তাবাদী সংগঠন, যারা ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সঙ্গে জড়িত থাকার জন্য পরিচিতি পায়। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর থেকে সংগঠনটি ভারতের ডানপন্থী রাজনীতির অগ্রভাগে অবস্থান করছে, যা আজও ভারতীয় সমাজ ও রাজনীতিতে তীব্র আলোচনার বিষয়।
“বিশ্ব হিন্দু পরিষদ একটি হিন্দু সন্ত্রাসী সংগঠন—এটি অগণতান্ত্রিক এবং ইসলামবিদ্বেষী,” পর্তুগালের কোয়েম্ব্রা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু জাতীয়তাবাদী গবেষক আমিত সিং নেত্র নিউজকে বলেন। “এটি হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ববাদী আদর্শ প্রচার করে।”
সংগঠনটি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের অধীনে প্রতিষ্ঠিত একটি সংগঠন, যা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপির মাতৃ-সংগঠন হিসেবে পরিচিত।
“এই ধরনের আক্রমণে মোদি সরকারের ভূমিকা থাকার কথা অস্বীকার করা কঠিন,” সিং বলেন। “এই উগ্রপন্থী সংগঠনগুলো প্রায়ই সরকার থেকে পৃষ্ঠপোষকতা ও অভয় পায় তাদের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চালানোর জন্য।”
“ভারতীয় সরকারের দুঃখপ্রকাশটি যেন কূটনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণে করা হয়েছে, প্রকৃত উদ্বেগের প্রতিফলন হিসেবে নয়,” তিনি যোগ করেন।
বাংলাদেশ সরকার এরই মধ্যে ভিয়েনা কনভেনশন ১৯৬১-এর অধীনে কূটনৈতিক মিশনের অখণ্ডতার বিষয়টি তুলে ধরে এই হামলার নিন্দা জানিয়েছে। বাংলাদেশের বিবৃতিতে বলা হয়, “আগরতলা হামলা ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী কূটনৈতিক মিশনের পবিত্রতা ভঙ্গ করেছে।”
পশ্চিমবঙ্গে প্রতিবাদ হয়েছে, যেখানে বিজেপির নেতা শুভেন্দু অধিকারী বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানি বন্ধ করার হুমকি দিয়েছেন। তার আগে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশী হিন্দুদের সুরক্ষায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীর হস্তক্ষেপের প্রস্তাব দিয়েছেন। মুম্বাই থেকেও প্রতিবাদের খবর এসেছে।
ঢাকায়, এই হামলা বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে ভারতের প্রতি কঠোর অবস্থান গ্রহণের দাবিকে আরও জোরালো করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান মুহাম্মদ ইউনূসের ওপর ইতিমধ্যেই চাপ বাড়ছে যেন তিনি সরকারের ভেতরে থাকা আপাতদৃষ্টিতে ভারতপন্থী হিসেবে বিবেচিত পক্ষগুলোকে অপসারণ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাসিনা হটানোয় ভূমিকা রাখা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ছাত্ররা সমাবেশ করেছে, যেখানে তারা ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আহ্বান জানিয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের ছাত্র নেতা আসিফ মাহমুদ জাতিসংঘকে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে শান্তিরক্ষা বাহিনী পাঠানোর জন্য অনুরোধ করেছেন।●