গণধোলাই থেকে গণপিটুনি: মবতান্ত্রিক বাংলাদেশ

গবেষণায় দেখা গিয়েছে সাধারণ মানুষ যখন কোনো মবের অংশ হয়ে যায় তখন তার ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র‍্য অনেকখানিই লোপ পায়। ব্যক্তিগত আচরণ গ্রুপের চরিত্র দ্বারা পরিবর্তিত হয়ে মবের ধরন অনুসারে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে।

গণধোলাই থেকে গণপিটুনি: মবতান্ত্রিক বাংলাদেশ

গণধোলাই থেকে গণপিটুনি

বাংলা সাহিত্যে কি গণধোলাইয়ের কথা খুব বেশিবার এসেছে? শরৎচন্দ্রের বিলাসী (১৯১৮) গল্পে আমরা নিম্নবর্ণের বিলাসীকে গণধোলাইয়ের শিকার হতে দেখি, কিন্তু মারা যেতে দেখি না। সেই গণধোলাই মাত্র ৭৫ বছরের ব্যবধানে হয়ে ওঠে গণপিটুনি। হুমায়ূন আহমেদের ছোটো গল্প চোখে (এই আমি, ১৯৯৩) আমরা দেখতে পাই, চোর মতি মিয়া এই আশায় বসে আছে যে মমতামাখা চোখের কোনো নারী বা পুরুষ এসে নিশ্চিত গণপিটুনি থেকে এবং খেজুর কাঁটা দিয়ে চোখ তুলে নেয়া থেকে তাকে রক্ষা করবে। এই দুই গল্পের মাঝে পিটুনি শব্দটি ধোলাই হয়ে উঠেছে। আর হুমায়ূনের ভাষ্যে, এককালে ধোলাইয়ের লক্ষ্য মাথা কামিয়ে অপমান বা পা ভাঙাতে সীমাবদ্ধ থাকলেও নব্বইয়ের দশকেই এর উদ্দিষ্ট হয়ে গেছে চোখ তুলে নেয়া বা জানে মেরে ফেলা। থানা পুলিশ করে যে বিলাসীর জাতভ্রষ্টতা বা মতি মিয়ার চুরি - কোনোটার ক্ষেত্রেই যে কোনো “ফায়দা নাই” তা এই দুই গল্পে ভালোভাবেই বিধৃত। বাস্তবেও কি তাই? তোফাজ্জলের খুনীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে বলেছে, “প্রক্টরিয়াল টিমকে দিলে তাঁরা পুলিশকে দিবে, আর পুলিশ ছেড়ে দিবে” (১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, দেশ রূপান্তর)। আর এদিকে ২০২৪ সালেরই মার্চে নারায়গঞ্জের সোনারগাঁয় চারজন ব্যক্তিকে ডাকাত সন্দেহে হত্যা করা হয়। মসজিদের মাইকে এর আগে ঘোষণা দেয়া হয়। এই প্রেক্ষিতে এলাকার উপজেলা পরিষদ সদস্য বলে, “পুলিশ কখন আসে না আসে তার ঠিক নাই। আগেও অভিযোগ দিয়ে কোনো কাজ হয়নি (১৯ মার্চ ২০২৪, ডয়চে ভেলে)।” এই আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অনুপস্থিতিই কি গণের হাতে নির্বাহী ক্ষমতা তুলে নিতে চাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ? মব কেনো বাংলাদেশে একই সাথে জাজ, জুরি, ও একজিকিউশনারের ভূমিকায়? 

মব আসে কোথা থেকে  

১৬ বছরের মগের মুল্লুক থেকে কি দেশটা এখন “মবের” মুল্লুকে পরিণত হয়ে যাচ্ছে? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ধরনের শ্লেষাত্মক বা ঠেস দেয়া আশংকা প্রায়ই করা হচ্ছে। এই মবের আক্ষরিক বাংলা অর্থ কি? বাংলা একাডেমির ইংরেজি টু বাংলা অভিধান-এর ২০১৫ সংস্করণ অনুযায়ী, mob-এর বাংলা অর্থ “বিশেষত দুষ্কৃতি বা হামলার সমবেত উচ্ছৃঙ্খল জনতা”। অন্যান্য অর্থের মাঝে একই সাথে আছে সর্বহারা ও গুণ্ডাদল। mob oratory-এর অর্থ হিসেবে সর্বহারা শব্দের সাথে সাথে আছে, “যে ধরনের বক্তৃতায় জনতার আবেগকে নাড়া দেয়, কিন্তু তাদের বুদ্ধিবৃত্তিকে উদ্দীপ্ত করে না; লোক-খ্যাপানো বক্তৃতা।” সর্বহারাদের আবেগই সর্বস্ব, বুদ্ধি লাপাত্তা, এটাই কি বাংলা একাডেমির বক্তব্য? এতে বাদানুবাদে না গিয়ে আমরা ধরে নিয়েছি, mob মাত্রই বিক্ষুব্ধ গণসমাগম। আর এই গণসমাগম থেকেই তৈরি হয় গণধোলাই বা গণপিটুনির মতো ঘটনা। একাডেমিয়ার ভাষায় মব বলতে বিক্ষিপ্তভাবে জড়ো হওয়া মানুষের জটলাকে বোঝায় যেখানে সবাই কোনো ব্যাক্তি বা গোষ্ঠীর উপর আক্রমণাত্মক আচরণে লিপ্ত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে সাধারণ মানুষ যখন কোনো মবের অংশ হয়ে যায় তখন তাঁর ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র‍্য অনেকখানিই লোপ পায়। ব্যক্তিগত আচরণ গ্রুপের চরিত্র দ্বারা পরিবর্তিত হয়ে মবের ধরন অনুসারে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে।  

এই বিক্ষুব্ধ জনসমাগমের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে গুস্তাভ ল বোঁ (১৮৮৫) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ দা ক্রাউড: এ স্টাডি অফ দা পপুলার মাইন্ড (The Crowd: A Study of the Popular Mind)-এ উল্লেখ করেছেন, মব মূলত তিন ধাপে নিজেকে আবিষ্কার করে: তলিয়ে যাওয়া (submergence), আক্রান্ত হওয়া (contagion), এবং মন্ত্রমুগ্ধতা (suggestion)। প্রথম ধাপে অর্থাৎ তলিয়ে যাওয়ার সময়, মবের মধ্যে থাকা ব্যক্তিরা তাদের ব্যক্তিগত সত্তা এবং দায়িত্ববোধ হারিয়ে ফেলে। মবে ব্যক্তিপরিচয় না থাকায়, বা এনোনিমিটি বজায় থাকায়, এটি তাদের জন্য অনেক সহজ হয়। দ্বিতীয় ধাপে, যেটাকে ল বোঁ তুলনা করেছেন ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত হওয়ার সাথে, সেই ধাপে মবের মধ্যে থাকা ব্যক্তিরা অন্ধভাবে মেজরিটির ঠিক করে দেয়া চিন্তা ও আবেগকে অনুসরণ করে। ল বোঁর মতে, এই প্রভাব “তলিয়ে যেতে” থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে সংক্রামক রোগের মতো ছড়িয়ে পড়ে। এবং এটা ঘটে ঠিক সেই সময়ে, যখন মবের চিন্তা ও আবেগ একটি যৌথ সাবকনশাস মাইন্ডের মতাদর্শ থেকে উঠে আসে। মবে থাকা ব্যাক্তিরা তাঁর সাথে ঘটে যাওয়া পূর্বের কোনো চিন্তা বা আবেগের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল হয়ে ওঠে। শেষ পর্যায়ে মবের সদস্যেরা বিমুগ্ধ বালকের মতন মব নির্ধারিত কাজে লিপ্ত হয়, তাদের কোনো ব্যক্তিক এজেন্সি খুঁজে পাওয়া যায় না। 

এখন প্রশ্ন হতে পারে কেন এই মব জাস্টিসে সাধারণ জনগণ অংশগ্রহণ করে? ১৯৭০-এর দশকে মনোবিজ্ঞানী হেনরি তাজফেল এবং জন টার্নার এই ব্যাপারে সোশ্যাল আইডেন্টিটি থিওরি (Social Identity Theory) উল্লেখ করেছেন যেটি অনুসারে মূলত জনসাধারণ পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে গ্রুপের মতো আচরণ করে। নিজেকে গ্রুপের অংশীজন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে গ্রুপের অন্যান্য সদস্যদের মতো আক্রমনাত্মক হয়ে উঠে। 

মব জাস্টিসের সুলুক সন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায় (আসাফো-আদজেই, ২০২১) সাধারণত আটটি কারণে একটি সমাজে জনসাধারণ তাৎক্ষণিক বিচারিক প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়ে - (১) রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের প্রতি আস্থা বা বিশ্বাসের স্তরে পতন, (২) দারিদ্র্য, (৩) অপরাধবিচার প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি এবং বিলম্ব, (৪) নিম্ন স্তরের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন, (৫) উচ্চ অপরাধ হার এবং অপরাধের জন্য দায়মুক্তি, (৬) বেকারত্ব, (৭) রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার অভাব, (৮) রাজনৈতিক কারণ।

আজ থেকে প্রায় এক যুগ আগে বিএনপির-নেতৃত্বাধীন ১৮-দলের অবরোধ কর্মসূচি চলার সময় একটি আলোচিত হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে । ২০১২ সালের ৯ই ডিসেম্বর ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে দিনে দুপুরে খুন হন বিশ্বজিৎ দাস। খুনের ভিডিও সংবাদ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, কারণ ঘটনাটি ছিলো ভয়ানক নৃশংস। তৎকালীন ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন সদস্য মিলে ধারালো অস্ত্র দিয়ে বিশ্বজিৎকে জনসমক্ষে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। পরবর্তীতে কিছু ব্যাক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলেও রেহাই পায় অন্তত ছয়জন ছাত্রলীগ কর্মী (৬ অগাস্ট ২০১৭, বিবিসি)। এই মব লিঞ্চিং এর ঘটনাটি ছিলো রাজনৈতিক কারণপ্রসূত এবং যদিও দর্জির দোকানের কাটিং মাস্টার শহীদ বিশ্বজিৎ দাস ছাত্রলীগের কাছে পরিচিত মুখও ছিলেন না, তবুও মৃত্যুর পর বারবার প্রচার করা হয় তিনি ছিলেন শিবিরকর্মী (২৪ এপ্রিল ২০২২, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড)। 

কাছাকাছি ঘটনা ঘটে এ বছরের সেপ্টেম্বরে, জাহাঙ্গীরনগরের সাবেক শিক্ষার্থী শামীম মোল্লার সাথে। তবে তিনি শিবির সন্দেহে নয়, ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে জাহাঙ্গীররনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ২০ সেপ্টেম্বর তোফাজ্জলের হত্যার একই দিনে গণপিটুনির শিকার হন। পরে তাঁকে পুলিশের কাছে হস্তান্তরের পর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার পথে মৃত্যুবরণ করেন। এই ঘটনাটি ঘটেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সামনেই (২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, প্রথম আলো)। বিশ্বজিৎ দাস বা শামীম মোল্লা দুজনেই হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন একদল উন্মত্ত মানুষের হাতে এবং দুটি ক্ষেত্রেই কারণটি ছিলো মূলত রাজনৈতিক। 

মব লিঞ্চিং-এর পরিসংখ্যান ও অতীত 

বাংলাদেশে গণপিটুনি দ্বারা মৃত্যুর সংখ্যা গত পাঁচ বছর ধরে প্রতি বছরই আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী দুই অঙ্কে আটকে আছে। এই বছর হয়তো সংখ্যাটি ১০০ ছাড়াতে পারে, কারণ ১৫ জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত সংখ্যাটি এরই মাঝে ৩৩ পার হয়ে গেছে (২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, নয়া দিগন্ত)। এগুলো সবই অবশ্য বেসরকারি সংস্থা ও অনুসন্ধানী প্রতিবেদকদের রিপোর্ট — বাস্তব সংখ্যাটি হতে পারে এর অনেকগুণ বেশি। রাজবাড়ীতে, যেমন, গত ২১ সেপ্টেম্বর ৩৫ বছর বয়স্ক নাজমুল মোল্লা ট্রান্সফর্মার চুরির অভিযোগে গণপিটুনির শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেন (২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, বাংলা নিউজ ২৪)।

মব লিঞ্চিং-এর অন্যতম আলোচিত ঘটনা ঘটেছিলো ২০১১ সালের শবে বরাতের রাতে। রাজধানীর অদূরে সাভারের আমিন বাজারে ঘুরতে যায় ছয় যুবক। এলাকাবাসী ডাকাত সন্দেহ করে তাদের উপর আক্রমণ শুরু করে। ঘটনার এক পর্যায়ে মসজিদে মাইকিং করা হয়। তারপর গ্রামবাসী একযোগে গণপিটুনি দিলে তারা তখনই মৃত্যুবরণ করে (১৮ জুলাই ২০১১, বিবিসি বাংলা)। সাধারণত তরুণরা এই সব নৃশংসতার বলি হলেও নারী বা বৃদ্ধরাও এর বলয়ের বাইরে নন। যেমন দুই সপ্তাহ আগে, ১১ সেপ্টেম্বর ৮৩ বছর বয়সী বিল্লাল গাজী ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলায় ভ্যান চুরির চেষ্টার দায়ে একইভাবে মারা যান (১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, জাগো নিউজ)। ২০১৯ সালে পদ্মা সেতু নির্মাণকে কেন্দ্র করে এক ধরনের রহস্য সৃষ্টি হয়, যার মূলে ছিলো এক প্রাচীন বিশ্বাস যে কোনো বড় নির্মাণকাজ করতে গেলে বলিদানের প্রয়োজন। ফলে একটি গুজব চাউর হয় যে সেতুর নির্মাণস্থলে শিশুদের মাথা ফেলে রাখা হচ্ছে, যার ফলে কথিত ছেলেধরাদের বিরুদ্ধে মব কর্তৃক নৃশংসতা ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পায়। আর এর শিকার হন, অন্যান্যদের মাঝে, ৪২ বছর বয়স্ক তাসলিমা বেগম রেণু, যিনি সন্তান ভর্তির খবর নিতে গিয়ে উত্তর বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক স্কুলের সামনে সে বছরের ২০ জুলাই গণপিটুনির শিকার হয়ে মারা যান, আর রেখে যান দুইটি শিশু সন্তান (২০ জুলাই ২০২২, বিডিনিউজ ২৪)। 

মব লিঞ্চিং-এর কথা বললেই, বা গণের হাতে ক্ষমতা চলে যাওয়ার বললেই, চলে আসে লাতিন আমেরিকার কলম্বিয়ায় দশ বছর ধরে ঘটা (১৯৪৮-১৯৫৮) লা ভিওলেন্সিয়ার কথা, যা শুরু হয়েছিলো ৯ এপ্রিল ১৯৪৮-এ হোসে এলিয়েসের গাইতান নামক একজন রাষ্ট্রপতি প্রার্থী খুন হওয়ার পর। পরবর্তীতে কিউবায় প্রকাশিত অপারেশন প্যান্টোমাইম নামক নথি থেকে জানা যায়, এই খুন এবং এর পরবর্তী এক দশকের উন্মাদনা, যার মাঝে ছিলো বিভিন্ন অঞ্চল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অপরাধী পরিবারের কাছে ভাগ হয়ে যাওয়া (যার মাঝে আছে মেদেয়িন বা কালির মতন পরবর্তী মাদকদ্রব্যের অভয়ারণ্য, এবং যা আপনাকে মনে করিয়ে দিতে পারে কক্সবাজার আর নারায়নগঞ্জের কথা), বিভিন্ন অভূতপূর্ব নির্যাতন পদ্ধতি (যেমন জীবিত মানুষের গলা কেটে জিভ টেনে বের করে নিয়ে আসা, যার নাম দেয়া হয়েছিলো কলম্বিয়ান নেকটাই বা কোর্বাতা কলম্বিয়ানা), এবং কলম্বিয়ার চূড়ান্ত অর্থনৈতিক অবনতি, এর পেছনে ছিলো মার্কিন গোয়েন্দাবাহিনীর ইন্ধন। অপারেশন প্যান্টোমাইম ডকুমেন্ট বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদে এই ঘটনা ঘটেছিলো। বাংলাদেশের মতন একটি দেশে এক দিনের ব্যবধানে সামরিক বাহিনীর নাগরিক পরিমণ্ডলে নির্বাহী ক্ষমতা লাভ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতন দুইটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মব কর্তৃক জোড়া খুন, আর এর ঠিক পরেই মবের হাতে পাহাড়ে অনাসৃষ্টি, আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির এহেন অবনমন, পার্শ্ববর্তী দেশের আগ্রহে, বাংলাদেশেও অসম্ভব নয় বলেই আমাদের ভয়। যদিও এর সপক্ষে কোনো বিদেশী ইন্ধনের প্রমাণ পাওয়া যায় না, তবে ১৯৭২ সালে কাদের সিদ্দিকী কর্তৃক বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে সম্ভাব্য কোলাবরেটর হত্যার কথা তবুও আমরা ভুলতে পারি না, যেমন ভুলতে পারি না ভুয়া খবরের ভিত্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে ২০-২২ সেপ্টেম্বর ঘটে যাওয়া পাহাড়ি জনগণের ওপর হামলা।

প্রতি বছর কতজন মানুষ গণপিটুনির শিকার হয়ে মারা যায় (সূত্র: আইন ও সালিশ কেন্দ্র)

মব থেকে মব আসে, বিশুদ্ধতার ভিড় বাড়ায় 

মব জাস্টিস বা গণের এই বিচারের পেছনের কারণগুলি যদি আমরা পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখবো উপরে উল্লেখিত আটটি কারণই বাংলাদেশে বিদ্যমাণ। এর মাঝে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের প্রতি আস্থা বা বিশ্বাসের স্তরে পতন, বেকারত্ব এবং অপরাধবিচার প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি এবং বিলম্ব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশে চলমান গণপিটুনি মোটাদাগে দুইভাগে ভাগ করা যায়। কখনো কখনো গণপিটুনির ঘটনাগুলি পূর্বপরিকল্পিত থাকে, আবার কখনো তাৎক্ষণিক জনরোষে উৎপত্তি হয়। পূর্বপরিকল্পিত হত্যার ভেতর আছে ১৩ আগস্ট চট্টগ্রামে গান গাইতে গাইতে যে ছেলেটিকে খুন করা হয়, সেই শাহাদাত হোসেন, যার স্ত্রী বলেছেন, তার স্বামীকে ফোন করে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো (২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ঢাকা ট্রিবিউন)। অপরিকল্পিত হত্যার ভেতর চলে আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তোফাজ্জল বা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শামীম মোল্লার নামটি। 

তবে ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত হোক বা না হোক একটি বিষয় গণপিটুনির ক্ষেত্রে সাধারণত হয়ে থাকে, আর তা হলো সন্দেহ, সেটির উপর ভিত্তি করে আক্রমণ। সন্দেহের শুরুটা ঘটে ভুল তথ্যপ্রবাহের কারণে; যেটিকে ইংরেজি পরিভাষায় ফেইক নিউজ বলা হয়। যদিও বর্তমানে ফেইক নিউজ শব্দবন্ধ একাডেমিক পরিসরে ব্যবহার করা হয় না; বরং মিসইনফর্মেশন (Misinformation) এবং ডিজইনফর্মেশন (Disinformation) হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। মিসইনফর্মেশন ভুল তথ্য হলেও এটি ইচ্ছাকৃত ছড়ানো হয়না, অপরদিকে ডিজইনফর্মেশন ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য করা হয়। গণপিটুনির ক্ষেত্রেও মিসইনফর্মেশন বা ডিজইনফর্মেশনের এরকম ক্যাম্পেইন আলাদা করা যায়। ডিজইনফর্মেশনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কারণ বা ব্যাক্তিগত স্বার্থসিদ্ধিই মূখ্য যেখানে কোনো বিশেষ ব্যাক্তির উপরে ক্রোধ বা প্রতিশোধ স্পৃহা থেকে ভুল তথ্য ছড়ানো হয় যাতে আমজনতাকে খেপিয়ে তোলা যায়। অপরদিকে মিসইনফর্মেশন যখন ছড়িয়ে পড়ে, তখন সরাসরি কোনো স্বার্থ থাকেনা; কিন্তু আমরা দেখি যে, মানুষের ভেতর জমে থাকা পুঞ্জিভূত ক্ষোভ ডাকাত বা চোর সন্দেহে পেটানোর ফলে প্রশমিত হয়। এর বাইরে আছে ম্যাল-ইনফর্মেশন (Mal-information), যা মূলত মিথ্যা তথ্য নয়, বরং উদ্দেশ্যমূলকভাবে আংশিক সত্যের অপপ্রচার (বিভিন্ন ইউটিউবার, পডকাস্ট নির্মাতা ও ব্লগারের কার্যকলাপে এর উদাহরণ পাওয়া যাবে)।   

এইসব গণপিটুনি বা গণ-অত্যাচার সবসময়েই ক্ষমতাশীল রাষ্ট্রের স্বার্থে কাজ করে গেছে (যেমন বসনিয়ায় মিলোশেভিচ কর্তৃক চালানো গণহত্যা, বা রুয়ান্ডায় টুটসিদের উপর ১৯৯৪ সালে বা শ্রী লঙ্কায় তামিলদের উপর ১৯৮২ সালে আক্রমণ)। ক্ষমতাশীলদের পক্ষে যায় বলেই, ২০২১ সালে যখন প্রিয়ন্ত কুমার নামক এক ৪৯ বছর বয়স্ক শ্রীলঙ্কার প্রকৌশলী পাকিস্তানের শিয়ালকোটে দশ বছরের বেশি সময় চাকরি করার পর ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগে (অভিযোগটি ছিলো পোস্টার ছিড়ে ফেলার, কোনো বক্তব্য প্রদানের নয়) গণআক্রমণের শিকার হয়ে শাহাদাত বরণ করেন, তখন পাকিস্তানের ততকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পারভেজ খট্টক বলেছিলেন, “ইয়াং ছেলেপেলে খেপে গেলে খুনখারাপি হবেই” (৬ ডিসেম্বর ২০২১, নিউজ উইক পাকিস্তান)। এ কথা আমাদের নিয়ে যায় ১৯৭২ সালের ৩১ মার্চ, যেখানে ইন্দিরা গান্ধী মব লিঞ্চিং বিষয়ে সংবাদপত্রের প্রতিনিধিদেরকে বলেন, “... আমি যেকোনো হত্যাকাণ্ড এবং আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার বিরোধী। কিন্তু সবাইকে এর প্রেক্ষাপট বুঝতে হবে ...” (ইন্দিরা গান্ধী, ভারত ও বাংলাদেশ, নির্বাচিত বক্তব্য ও বিবৃতি, ওরিয়েন্ট লংম্যান, ১৯৭২, অনুবাদঃ মহিউদ্দিন আহমেদ)। মূলত শাসকগোষ্ঠীর হাত ধুয়ে ফেলার এক নির্মম সুযোগ, রক্তের দাগ সাধারণ মানুষের হাতে তুলে দেয়া। এভাবেই মানুষ ইতিহাসে বারবার আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছে, আর শাসকেরা কখনো বাম থেকে কখনো ডান থেকে, কিন্তু সব সময়েই উপর থেকে, কখনো ইন্দিরা গান্ধীর মতন আমাদের প্রেক্ষাপট চিনিয়েছে, আর কখনো প্রাক্তন ছাত্রলীগ নেতা, আনন্দবাজার পত্রিকার কলাম বক্তব্যে হুবহু কপি করা সাদ্দাম হোসেনের মতন আমাদেরকে বুঝিয়েছে, বড় একটা দেহে ভাইরাস থাকবেই, ছাত্রলীগের মতন সংগঠনে দুই চারটা খুনী বা সন্ত্রাসী থাকবেই। এভাবেই নিজেদের খুনগুলি তাদের কাছে হয়ে যায় গণপিটুনি, যার ফলে আওয়ামী লীগের নেতা শেখ সেলিম সুযোগ পায় “দেশে ফিরলে তারেক রহমান গণপিটুনিতে মারা যাবে” - এই ধরনের বলিহারি হুমকি প্রদানের (১২ নভেম্বর ২০২২, ঢাকা ট্রিবিউন)। আইনের এই গণধারণাটি বন্ধ হলেই হয়তো এদের বিনা পয়সার ভাড়াটে খুনী হওয়া থেকে আমরা মুক্তি পেতাম। শুধু যদি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের নব্বই দশকের নীল মুকুট পরা পুলিশের মতন কেউ এসে দেশবাসীকে বলতো, আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। ●

মিম আরাফাত মানব ইউনিভার্সিটি অফ লেওনে অধ্যয়নরত লেখক ও গবেষক এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।

মনজুরুল মাহমুদ ধ্রুব গথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী ও গবেষক।