বাংলাদেশের নতুন অধ্যায়?
শেখ হাসিনার পতন ঘটিয়ে বিক্ষোভকারী ছাত্ররা শুধু তার কর্তৃত্ববাদী শাসনেরই ইতি ঘটায়নি, একইসঙ্গে তার দলের সুবিধাবাদী জাতীয়তাবাদের দিকেও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে।
স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে আসছিল আওয়ামী লীগ। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেয় দলটি। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত টিকে থাকা সামরিক শাসন অবসানের পর প্রায় দুই দশক ধরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সঙ্গে পালা বদল করে দেশ শাসনের দায়িত্ব পালন করেছে। তবে ২০০৮ সালে সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর আওয়ামী লীগ দেশকে একদলীয় শাসনের দিকে টেনে নিয়ে যায়। তিনটি উত্তরোত্তর কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে মাধ্যমে দলটি ক্ষমতা ধরে রাখে।
কোনো দলই বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিকভাবে শাসন করেনি। কিন্তু বাংলাদেশের প্রচলিত ধারণা হলো, এই ধরণের রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক পরিবেশে এই দুই দলের বাইরে কোনো বিকল্প ছিল কিনা। কিন্তু ২০২৪ সালের গ্রীষ্মের গণঅভ্যুত্থান এই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেছে।
বাংলাদেশে ‘মনসুন রেভোলিউশন’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এই পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল সরকারি চাকরিতে থাকা কোটা-প্রথাকে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশের মোট কর্মসংস্থানের মাত্র ৩ শতাংশের কিছুটা বেশি পূরণ করে সরকারি চাকরি। কিন্তু এই চাকরি আরাধ্য বস্তুর মতো: অনিশ্চয়তার মরুভূমিতে এ যেন এক চিলতে মরূদ্যান। ঐতিহাসিকভাবেই রাষ্ট্রীয় এসব চাকরির ১৫ শতাংশ নারী, হিজড়া (এক ধরণের ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়) ও আদিবাসীদের (অবাঙালি ও অমুসলিম আদিবাসী গোষ্ঠী) জন্য সংরক্ষিত ছিল। এই পদ্ধতি দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে জোরালো অগ্রাধিকারমূলক ব্যবস্থা ছিল বটে। কিন্তু জান্তা-শাসন-পরবর্তী জমানায় নিজেদের প্রথম ক্ষমতার মেয়াদে (১৯৯৬-২০০১) আওয়ামী লীগ মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান-সন্ততির জন্য সরকারি চাকরির ৩০ শতাংশ বরাদ্দ করে। একইসঙ্গে প্রাথমিক স্তরের সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত কোটা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। প্রথমদিকে সাময়িকভাবে চালু হলেও ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর এই কোটা-প্রথাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পাকাপোক্ত করা হয়। ফলশ্রুতিতে তখন জালিয়াতি করে বা অন্য কোনো অবৈধ পন্থায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা-সার্টিফিকেট লাভের ছোটোখাটো কুটির শিল্পের প্রসার ঘটে দেশে।
২০১৩ সালে নির্বাচন-পূর্ববর্তী সময়ে এসে একটি কোটা-বিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। কিন্তু তৃণমূল পর্যায়ে শুরু হওয়া এই আন্দোলন সে সময়কার নির্বাচন-কেন্দ্রিক রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে বেশিদূর এগোতে পারেনি। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সংঘর্ষে পাঁচ শতাধিক মানুষ প্রাণ হারান। ২০১৮ সালে এসে কোটা-বিরোধী আন্দোলন আবারও চাঙ্গা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হয়ে এটি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের ওপর র্যাব, পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে লেলিয়ে দেন। কিছুদিন পরে একক ক্ষমতাবলে হাসিনা পুরো কোটা-ব্যবস্থাকেই বাতিল করে দেন—যেটা ছিল পুরোপুরিভাবে বেআইনি।
এটি ছিল রাজনীতির একটি পুরোনো চাল। জন-দাবির মুখে হাসিনা প্রায়শই দাবি মেনে নেয়ার ভান ধরতেন, স্বেচ্ছাচারী নির্বাহী আদেশ জারি করতেন যেন তা আবার পরবর্তীতে আদালতের আদেশে অবৈধ ঘোষণা করা যায়। ২০১১ সালে তিনি যেমন উচ্চ-আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে বহাল রেখেছিলেন। তার এমন কাজের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে করা রিট এখনো উচ্চ-আদালতে আটকে আছে। নির্বাহী ক্ষমতার এরকম যথেচ্ছ ব্যবহারের সুবিধা হচ্ছে যে দ্বিধান্বিত উচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে নিজেকে সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপন করা যায়।
আওয়ামী লীগ-ঘনিষ্ঠ ছয় মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য স্বাভাবিকভাবেই যথাসময়ে হাইকোর্টে আপিল দাখিল করলেন। এই বছরের জুন মাসে এসে আদালত কোটা-প্রথা পুনর্বহাল করলেন। আদালতের আদেশ এমন সময়ে এলো যখন তরুণ-বেকারত্ব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। একইসঙ্গে তখন প্রাক্তন এক পুলিশ কর্মকর্তা, সাবেক সেনাপ্রধান এবং বেশ কয়েকজন আওয়ামীলীগ নেতার দুর্নীতি নিয়ে বেশ সমালোচনা চলছে। মুক্তিযোদ্ধা কোটাকে ঘিরে এবার এতদিনের পুঞ্জীভূত জনরোষ প্রকাশের একটি সুযোগ তৈরি হলো। ছাত্ররা আবারও রাস্তায় নেমে এল, এবার আরও দৃঢ়চিত্তে।
হাসিনা আবারও নিজের বদমেজাজি স্বভাবের পরিচয় দিলেন। ছাত্রদেরকে ‘রাজাকার’ হিসেবে আখ্যায়িত করে আওয়ামী লীগের ছাত্র-সংগঠনগুলোকে তাদের ওপর লেলিয়ে দিলেন। মধ্য-জুলাইয়ে এসে পরিস্থিতি খারাপের দিকে মোড় নিলো। কারফিউ জারি করা হলো এবং পুলিশ, আধা-সামরিক বাহিনী এবং শেষ পর্যন্ত আর্মিকে বলা হলো সর্বশক্তি দিয়ে আন্দোলনকারীদের দমন করতে। বাইশ দিনের বেশি সময় ধরে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের ঘটনা ঘটল। সাতশ’র বেশি মানুষ মারা গেল এবং আহতের সংখ্যা দশ হাজার ছাড়িয়ে গেল। নিহত এবং আহতের সংখ্যা আরও বেশি হওয়ার আশংকা আছে।
এই অভূতপূর্ব ঘটনা কীভাবে সম্ভব হলো? বিগত ১৫ বছরে হাসিনা রাষ্ট্র-যন্ত্রের কব্জা নিয়েছিলেন, বিভিন্ন বিরোধী দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন, বুদ্ধিজীবীদের দলদাসে পরিণত করেছিলেন, এবং সুশীল সমাজকে অকার্যকর করে ফেলেছিলেন। ভিন্নমত প্রকাশের কোনো সুযোগই অবশিষ্ট ছিল না। কিন্তু এই গ্রীষ্মে এসে দেখা গেল যে হাসিনা তরুণ-সমাজের মন জয় করতে ব্যর্থ হয়েছেন। হাসিনার পতনকে বুঝতে হলে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদেরর ইতিহাসকে পুনর্পাঠ প্রয়োজন। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের একদলীয় কৃতিত্ব নেবার পর হাসিনা নিজেকে রাষ্ট্রক্ষমতার একচ্ছত্র দাবিদার হিসেবে তুলে ধরেছেন। কিন্তু ছাত্র-জনতা যখন তার এমন দাবির প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল, হাসিনার মসনদ ভেঙে পড়ল।
*
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে। আওয়ামী লীগ ৭০ এর নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬৭ টি আসন (পূর্ব-পাকিস্তানে ১৬২ আসনের ১৬০ আসন) জেতার পরও যখন ইসলামাবাদ ভোটের ফল প্রত্যাখান করল, তখন পূর্ব পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জনতা-সেনার সংঘর্ষ শেষ পর্যন্ত গেরিলা-যুদ্ধে রূপ নেয়। নয় মাসের যুদ্ধে প্রায় তিরিশ লাখের কাছাকাছি বাংলাদেশির প্রাণের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সম্মানসূচক বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রাপ্ত আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। ক্ষমতা গ্রহণের পর এক পর্যায়ে তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী তাজউদ্দিন আহমেদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলামের মতো নেতাদের দূরে সরিয়ে দেন। ১৯৭৫ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে মুজিব ও তাঁর পরিবারের বেশিরভাগ সদস্য প্রাণ হারান। কেবল দেশের বাইরে অবস্থানকারী তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রাণে বেঁচে যান।
তখন থেকেই বাংলাদেশে সামরিক শাসনের সূচনা। ১৯৯০ সালে এসে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপির যুগপৎ স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের পুনর্বহাল হয়। দুই নেত্রীই পরবর্তী তিনটি নির্বাচনে একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন। গোল বাঁধল ২০০৬ সালের নির্বাচনে এসে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাকর্মীদের তুমুল সংঘর্ষের প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ জরুরী অবস্থা ঘোষণা করতে বাধ্য হলেন। সেনাবাহিনীও হস্তক্ষেপ করলো। ২০০৮ সালে এসে আবারও নির্বাচন হলো। নির্বাচনে জয়ী হয়ে শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে কুক্ষিগত করতে মনোযোগী হলেন। তিনি একদিকে যেমন কোটাপ্রথার সর্বোত্তম ব্যবহার করলেন অন্যদিকে তেমনি প্রশাসন, বিচারবিভাগ ও আইনশৃঙ্গলা বাহিনীকে দলীয়করণ করলেন। একইসঙ্গে বিএনপি-জামায়াতকে “রাষ্ট্রবিরোধী” তকমা দিলেন। জঙ্গি-দমন ও রাষ্ট্রবিরোধীদের দমনের নামে আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধীদলের নেতাকর্মী, শ্রমিক, ছাত্রদের বিরুদ্ধে আটক, গুম, বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো কার্যক্রম চালাতে লাগল। বিএনপি-জামায়তকে সাংগঠনিকভাবে এতটাই দুর্বল করে দেয়া হলো যে এবছরের আন্দোলনে তাদের কোনো সরব উপস্থিতিই চোখে পড়েনি।
হাসিনা সরকার একইসঙ্গে সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) নামের একটি প্রপাগান্ডা প্রতিষ্ঠান গঠন করে। এর নেতৃত্বে ছিলেন হাসিনার ভগ্নীপুত্র রাদওয়ান এম সিদ্দিক। অন্যদিকে হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় প্রতিষ্ঠানটির ইয়ং বাংলা ইনিশিয়েটিভ এর দায়িত্বে ছিলেন। সিআরআই শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘিরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস লেখার জন্য একটি পিআর স্ট্র্যাটেজি তৈরি করে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে কেন্দ্র করে জয়-বাংলা কনসার্ট আয়োজন করা হতে লাগল যেখানে একদা প্রথাবিরোধী শিল্পীদের দিয়ে গান গাওয়ানো হতো। কার্টুনিস্টদের দিয়ে মুজিবের অটোবায়োগ্রাফীর উপর ভিত্তি করে গ্রাফিক নভেল বানানো হলো। চলচিত্র পরিচালকদের দিয়ে মুজিবের বায়োপিক এবং হাসিনার ওপর ডকুমেন্টারি বানানো হয়। একই সঙ্গে সরকার-বান্ধব লেখক ও শিল্পীদের পুরস্কার, গবেষণা অনুদান ও শিক্ষকতার সুযোগ দেয়া হয়। সরকার-বান্ধব শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদেরকে সরকার-ঘনিষ্ট ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলোর মালিকানাধীন মিডিয়াতে প্রতিষ্ঠিত হবার সুযোগ করে দেয়া হয়।
সিআরআই ও দেশের দুটি প্রধান এনজিও, বিল্ডিং রিসোর্সেস অ্যাক্রোস কমিউনিটি (ব্র্যাক) এবং জাগো ফাউন্ডেশনের মধ্যে একটি রিভলভিং দরজা খোলা হয়েছিল। ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ এবং জাগোর প্রতিষ্ঠাতা করভি রকশন্দ ধ্রুব প্রতিটি সুযোগে হাসিনার পাশে উপস্থিত থাকতেন। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে হাসিনা সরকারের সঙ্গে তাঁরা ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। এমনকি বিদেশী সংস্থাগুলির স্থানীয় শাখাগুলোকেও করায়ত্ব করা হয়। ঢাকা ট্রিবিউন ও বাংলা ট্রিবিউনের প্রকাশক এবং আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্যের ভাই কাজী আনিস আহমেদ-এর নেতৃত্বে পেন বাংলাদেশ হাসিনার স্বৈরাচার সম্পর্কে সম্পূর্ণ নীরব থাকে। (প্রতিষ্ঠানটি মন্তব্য করার অনুরোধে সাড়া দেয়নি।)
*
ভারতের সঙ্গে এক গভীর অসম সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে হাসিনা শাসনক্ষমতায় টিকে ছিলেন। নরেন্দ্র মোদি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে তাকে নিঃশর্তভাবে সমর্থন করতেন। এর বিনিময়ে তার সরকার বাংলাদেশের ওপর বৈষম্যমূলক বাণিজ্য ও অবকাঠামোগত নীতির বোঝা চাপিয়ে দিত। (মোদি তার বন্ধু বিলিয়নিয়ার গৌতম আদানিকে বাংলাদেশের কাছে উচ্চ মূল্যে বিদ্যুৎ বিক্রির জন্য একটি চুক্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।) মে মাসে মোদি পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পরে হাসিনা দ্বিপাক্ষিক শীর্ষ বৈঠকের জন্য দুবার দিল্লি যান। ভারতীয় জনতা পার্টির বাংলাদেশিদের সন্ত্রাসী ও অনুপ্রবেশকারী হিসেবে গণ্য করার বিষয়টি আলোচনার এজেন্ডায় ছিল না। ন্যায্য পানি বণ্টন চুক্তিও হয়নি। হাসিনা বরং মোদিকে বাংলাদেশের সার্বভৌম ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে একটি রেল নেটওয়ার্ক স্থাপনের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, যা বাংলাদেশের পূর্বে অবস্থিত রাজনৈতিকভাবে অস্থির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলির সঙ্গে ভারতের মূল ভূখণ্ডকে সংযুক্ত করবে। ( বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলো এই পদক্ষেপের নিন্দা করেছিল।) তারপর হাসিনা বেইজিং সফরে যান। ৫ বিলিয়ন ডলারের কথিত ঋণের আশায় গেলেও মাত্র ১৪০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ নিয়ে হাসিনা তাড়াতাড়ি দেশে ফিরে আসেন।
ততক্ষণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়ে উঠেছে। ১৪ জুলাই চীন সফর সম্পর্কে একটি সংবাদ সম্মেলনে নিজের পররাষ্ট্র নীতির ব্যর্থতা থেকে মনোযোগ সরানোর জন্য হাসিনা ছাত্রদের ওপর ক্ষোভ উগড়ে দেন। আন্দোলনরত ছাত্রদের “রাজাকারের বংশধর” বলে তিরস্কার করেন। সাধারণত এই ধরনের অপবাদ জনগণের কাছে যেকোনো আন্দোলনকে অন্যায্য প্রমাণ করতে সাহায্য করে। কিন্তু এবার কাজ হলো না। শিক্ষার্থীরা শব্দটি নিয়ে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, সিলেট ও খুলনার রাজপথে স্লোগান দিতে থাকে: “আমি কে? তুমি কে? রাজাকার। রাজাকার। কে বলেছে? কে বলেছ? স্বৈরাচার। স্বৈরাচার”। ওই রাতেই তারা বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠনকে বের করে দেয়।
এরপর আওয়ামীলীগের প্রোপাগান্ডা মেশিনকেও কাজে লাগানো হলো। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ঘোষণা দিলেন যে তার দলের ছাত্রসংগঠনগুলো স্বাধীনতা যুদ্ধের অবমাননা ও রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে যুক্ত হওয়া যে কাউকে শক্ত হাতে দমন করবে। ১৬ থেকে ১৮ জুলাই ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ এবং যুবলীগের কর্মীরা পুলিশ ও র্যাবের সঙ্গে যৌথভাবে আন্দোলনকারীদের ওপর আক্রমণ চালায়। বিজিবিও পরবর্তীতে যোগ দেয়। ওবায়দুল কাদের দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেন।
সোশাল মিডিয়ায় পুরো আন্দোলনই সরাসরি দৃশ্যবন্দী হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের দৃশ্যগুলোও ভাইরাল হয়ে যায়। তেইশ বছর বয়সী আবু সাঈদ হাত তুলে সারেন্ডার করার ভঙ্গি করা সত্ত্বেও তাকে খুব কাছে থেকে ছররা গুলি ছুড়ে হত্যা করা হয়। পুলিশের প্রথম রিপোর্ট অনুযায়ী “একজন ছাত্রকে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখা গিয়েছে”। আন্দোলনকারীদের মধ্যে পানি বিতরণ করা মীর মুগ্ধকে মাথায় গুলি করা হয়। ঐ বাহাত্তর ঘণ্টায় মৃতের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে হতাহতদের পরিবারের সদস্য ও হাসপাতালগুলোর ওপর মুখ বন্ধ রাখার চাপ আসে। প্রথম আলোর এক রিপোর্ট অনুযায়ী, আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ চলাকালীন সময়ে পুলিশ একটি বাসার ওপর গুলি চালিয়ে ক্লাস ফাইভে পড়ুয়া সাফকাত সামির নামের এক শিশুকে হত্যা করে। পরবর্তীতে পুলিশ তার বাবাকে মামলা না করার জন্য চাপ দেয়।
১৮ জুলাই হাসিনা জাতির উদ্দেশ্যে এক ভাষণ দেন যেখানে তিনি নিজের পিতার হত্যাকাণ্ডের কথা স্মরণ করেন। উদ্দেশ্য ছিল, নিজের পরিবারের মর্মান্তিক ইতিহাস ও শেখ মুজিবকে ঘিরে যে কাল্ট তৈরি হয়েছে সেটাকে কাজে লাগিয়ে ছাত্রদের ওপর চালানো নিষ্পেষণকে বৈধতা দেয়া। হাসিনার ভাষণ শেষ হবার পরই দেশব্যাপী ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হলো। বাংলাদেশকে পুরো পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হলো। কারফিউ জারি হলো এবং সেনাবাহিনী জাতিসংঘের প্রতীকবাহী সাঁজোয়া যান নিয়ে রাস্তায় নেমে এল। আওয়ামী লীগ-ঘেঁষা স্থানীয় টেলিভিশনগুলো জনগণকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে বলে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়ানো ছবিগুলোর কথা কেউ তখনো ভোলেনি। আকাশে তখনও হেলিকপ্টার উড়ছে। মুহুর্মুহু গুলি ছোড়া হচ্ছিল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তখনো প্রায় নিশ্চুপ। শুধুমাত্র পেন ইন্টারন্যাশলনাল সাংবাদিকদের সুরক্ষা দেয়া ও ইন্টারনেট সেবা পুনরায় চালু করার আহবান জানায়। জাতিসংঘের প্রতীকবাহী যান ব্যবহার করে বেসামরিক জনগণের ওপর হামলা চালানোর কারণে প্রতিষ্ঠানটির মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনার ভোলকার টুর্ক উষ্মা প্রকাশ করেন। একইসঙ্গে তিনি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় উদ্বেগ ও এসব ঘটনার তদন্তের আহবান জানালেন।
এক বিবৃতিতে আন্দোলনরত ছাত্ররা জানাল যে তারা নেতৃত্ববিহীন একটি আন্দোলন চালাচ্ছে কারণ অতীতে আওয়ামী লীগ সরকার সরকারবিরোধী আন্দোলনের নেতাদের হয় নিজ দলে ভিড়িয়েছে কিংবা নির্যাতন করেছে। তা সত্ত্বেও, রাষ্ট্রীয় জুলুম যখন আরও বৃদ্ধি পেল, তখন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মুখপাত্র হিসেবে নাহিদ ইসলাম এবং আসিফ মাহমুদের মতো ব্যক্তিরা আত্মপ্রকাশ করলেন। ১৯ জুলাই সুইডেনভিত্তিক গণমাধ্যম নেত্র নিউজের (যেখানে আমি ম্যানেজিং এডিটর এর দায়িত্বে আছি) সঙ্গে এক ইন্টারভিউয়ে নাহিদ ইসলাম যে বর্বর হত্যাকাণ্ড চলছিল তার বিবরণ দেন। একই সঙ্গে তিনি কারফিউয়ের বিরোধিতা করেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারদলীয় কর্মীদের মাঠ ছাড়ার আহবান জানান এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যাবার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়িয়ে সরকারের সঙ্গে কোনো প্রকার আলোচনায় বসতে তিনি অস্বীকৃতি জানালেন। এমন পদক্ষেপ নিহতদের স্মৃতির প্রতি অবিচার হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা এই সংকটময় সময়ে আন্দোলনে যোগ দেয়। এর মাধ্যমে শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণী প্রথমবারের মতো দৃঢ়ভাবে আন্দোলনে সামিল হয়। ওদিকে আন্দোলনের পক্ষে জনসমর্থন বেড়েই চলেছে। রিকশাচালকরা বিক্ষোভকারীদের স্যালুট জানালেন এবং রিকশাগুলো অ্যাম্বুলেন্সের ভূমিকা পালন করতে লাগল। গ্রাফিতি শিল্পীরা শহরের দেয়ালগুলো সরকারবিরোধী কটুক্তিময় রঙ্গ ও স্কেচ দিয়ে রাঙিয়ে দিলেন। আন্দোলনের জন্য র্যাপার সেজান “কথা ক” এবং হান্নান “আওয়াজ ওঠা” এর মতো গান প্রকাশ করলেন। প্রবাসী বাংলাদেশিরা এশিয়া, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা জুড়ে সংহতি প্রদর্শন করলেন। অভিবাসী শ্রমিকরা কাতারে এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে গ্রেপ্তারের ঝুঁকি নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।
এদিকে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী তৎপরতা থেমে থাকেনি। সরকারদলীয় ক্যাডাররা চাপাতি ও বন্দুক নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি চিকিৎসারত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালাল। (ডেইলি স্টার একটি অভিযানের ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করে।) পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ছাত্রদের অপহরণ ও আটক করল। ৪,৫০,০০০ এর বেশি নামহীন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হলো, যা পরবর্তীতে আটককৃতদের ওপর চাপানো হতো।
২৪ জুলাই ইন্টারনেট পুনরায় চালু হবার পর কিছু অফিসিয়াল ছবি প্রকাশ হলো যেগুলোতে হাসিনাকে দেখা গে্লো একটি সরকারি ভবনের ভাঙ্গা কম্পিউটার পর্দার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে টিস্যু চেপে কাঁদছেন। হাসিনার পুত্র ও তার তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা এবং ইয়ং বাংলার প্রধান সজীব ওয়াজেদ এবং তথ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত জানালেন যে সরকারি একটি ডাটা সেন্টারের ওপর একটি সন্ত্রাসী হামলার কারণে সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল। আন্দোলনকারীরা সেখানে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল এমন ইঙ্গিতও তারা দিলেন (এরকম কোনো ঘটনার প্রমাণ পাওয়া যায়নি)। আরাফাতের মতে, ছাত্ররা নেশাগ্রস্থ অবস্থায় আন্দোলন চালাচ্ছিল। আওয়ামীলীগের সমর্থকরা সোশাল মিডিয়া ও নিউজ চ্যানেলগুলোতে হাসিনার প্রতি নিজের অকুণ্ঠ সমর্থন এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার নিন্দা জানান। নাহিদ ইসলামকে আটক করে নির্যাতন করা হয়। একবার ছেড়ে দেবার পর তিনি আবারও আটক হন এবং পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মধ্যাহ্ন চা পানের ছবি তুলতে বাধ্য হন। চাপে পড়ে তাকে আন্দোলন প্রত্যাহারের একটি ঘোষণাও দিতে হয়।
*
আন্দোলনের যখন এই পর্যায়ে এসে খেই হারাতে বসল তখন ২৭ জুলাই ছাত্রদের মধ্য থেকে তিনজন নতুন প্রতিনিধি আব্দুল হান্নান মাসুদ, মাহিন সরকার এবং রিফাত রশিদ অজ্ঞাতস্থান থেকে একটি অনলাইন প্রেস কনফারেন্স আয়োজন করলেন। তারা কোটা আন্দোলনকে ঘিরে আওয়ামী লীগের কার্যক্রমকে পাকিস্তানি বাহিনীর চালানো অপারেশন সার্চলাইটের সঙ্গে তুলনা করলেন। এমন তুলনা টেনে তারা পাশার দানই উলটে দিলেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজাকার যদি কেউ হয় তাহলে তা আওয়ামী লীগই। তাদের পক্ষ থেকে আন্দোলন চালিয়ে যাবার ঘোষণাও এল যতক্ষণ না দাবি মেনে নেয়া হচ্ছে। দাবিগুলো হচ্ছে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের পদত্যাগ, আন্দোলন চলাকালীন সময়ে দায়িত্বে থাকা আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের প্রত্যাহার ও তদন্তের সম্মুখীন করা, আন্দোলনকারীদের আইনি হয়রানি থেকে মুক্তির নিশ্চয়তা, স্থগিত শিক্ষাক্রম পুনরায় চালু করা, ক্যাম্পাসগুলো থেকে ছাত্রলীগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করা, এবং প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ক্ষমা চাওয়া। হাসিনা ব্যবসায়ী নেতাদের ও আইনশৃংখলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুটো বৈঠক করলেন। কিন্তু তিনি ছাত্রদের দাবি মেনে নিলেন না।
৩ আগস্ট সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান, যিনি আবার হাসিনার ফুফাতো বোনের স্বামী, সেনাবাহিনীকে দেশে শৃংখলা ফেরানোর আদেশ দিলেন। কিন্তু একইসঙ্গে তিনি আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালাতে নিষেধ করলেন। সেনাপ্রধানের উদ্বেগের কারণ ছিল। এতোক্ষণে আন্দোলনে সাধারণ মানুষের নিহতের সংখ্যা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে একে লুকানো কিংবা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় পড়ার আশংকা বাড়ছে। সেনাবাহিনীকে আন্তজার্তিক শান্তি রক্ষায় মিশন থেকেও নিষিদ্ধ করার সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া সেনাবাহিনীর সদস্যরাও জনগণের ওপর তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলমান হত্যাযজ্ঞ দেখে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।
নয় দফার আন্দোলন এবার একদফা আন্দোলনে পরিণত হলো- প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে। ৩ আগস্ট আন্দোলনকারীরা ৫২’র ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি-বিজড়িত শহীদ মিনারে লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়ে জমায়েত হলেন। তাদের সঙ্গে পোশাক শ্রমিক, স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী, মধ্যবিত্ত পেশাজীবী, বিনোদন জগতের তারকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ যোগ দিলেন। দেশাত্ববোধক গান, নাচ, চিত্রাংকন করা হলো এবং হাসিনার বিরুদ্ধে শ্লোগান দেওয়া হল।
৪ আগস্ট আবারও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া হলো। ঐদিন ছিল আন্দোলনের সবচেয়ে রক্তাক্ত দিন। আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে সেদিন শতাধিক মানুষ প্রাণ হারায়। এতো হত্যাযজ্ঞের পরেও কাজ হলো না। ৫ আগস্ট আন্দোলনকারীরা গণভবন অভিমুখী পদযাত্রার ডাক দিলেন। সবাই যখন শহীদ মিনারে জমায়েত হতে শুরু করেছে তখন খবর এলো যে হাসিনা পদত্যাগ করেছেন এবং সেনাবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমানে করে ভারতে পালিয়েছেন। সেনাপ্রধান হাসিনা এবং তার বোনকে বহনকারী বিমান বাংলাদেশের আকাশসীমা অতিক্রান্ত করা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। তারপর তিনি জাতির উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ দিলেন। এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একটি চরম বিদ্রোহের সুযোগ তৈরি হল। শতকোটি টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে নির্মিত শেখ মুজিবের ভাস্কর্যগুলোর মাথা কেটে দেওয়া, সেগুলোকে টেনে মাটিতে নামানো এবং ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটল। তাঁর স্মৃতি-বিজড়িত ধানমন্ডি ৩২ এর বাড়িটিতে আগুন লাগানো হলো।
*
উদ্ভুত রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণে একজন অন্তর্বতী সরকারপ্রধান নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতি ও সেনাপ্রধান আন্দোলনের সমন্বয়কদের সঙ্গে আলোচনা করলেন। সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে নোবেল বিজয়ী এবং গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ ইউনুসকে মনোনীত করা হলো। ইউনুস ক্লিনটন দম্পতি ও গেটস ফাউন্ডেশনের বন্ধুস্থানীয় হলেও প্রগতিশীল অর্থনীতিবিদদের মতে তিনি উচ্চ-সুদের ঋণের মাধ্যমে গরীব ঋণগ্রহীতাদেরকে ঋণের বেড়াজালে আটকে দেন।
ইউনুসের সঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অম্লমধুর সম্পর্কটি এড়িয়ে যাবার সুযোগ নেই। ২০০৬–০৮ এর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সময় সেনাবাহিনী সাময়িকভাবে ক্ষমতায় এসে গুম, আটক ও বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো কর্মকাণ্ডগুলোতে ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়ে, যেগুলো আওয়ামী লীগ পরবর্তীতে ক্ষমতায় এসে জারি রাখে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ২০০৭ সালে ইউনুস নিজেই একটি রাজনৈতিক দল গড়ার কথা চিন্তা করেছিলেন। তখন ওয়াশিংটন পোস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউনুস এই বলে আশ্বস্ত করেছিলেন যে দূর্নীতিবাজ আমলাদের আটক করে সেনাবাহিনী দেশকে পরিচ্ছন্ন করছে।
ইউনূস ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে শপথ নেন। সালেহ ও রাকশন্দ তার ব্যক্তিগত উপদেষ্টা দলের অংশ। মন্ত্রণালয়গুলোর দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টাদের মধ্যে ছাত্রনেতা নাহিদ ইসলাম এবং আসিফ মাহমুদ, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা এবং বেশ কয়েকজন ইসলামী মতাদর্শী রয়েছেন। আদিবাসী প্রতিনিধি রয়েছেন মাত্র একজন। তিনি হলেন সুপ্রদীপ চাকমা, যাকে চাকমা সম্প্রদায়ের মানুষ কট্টর আওয়ামী লীগার বলে মনে করেন। চাকমা সার্কেলের প্রধান উপদেষ্টা রানী ইয়ান ইয়ান প্রকাশ্যে তার নিয়োগের বিরোধিতা করেছেন।
ইউনুস সরকারের শুরুর দিনগুলো আশা জাগানিয়া নয়। জাগো এনজিওর স্বেচ্ছাসেবকরা বৈপ্লবী গ্রাফিতি মুছে দিয়ে তার ওপর বিভিন্ন নিজেকে-গড়ি বই এর উক্তি লিখে দিচ্ছে। মন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টারা জবাবদিহিতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা নিয়ে গালভরা বক্তব্য দিলেও আওয়ামী লীগের রেখে যাওয়া দলীয় পৃষ্ঠপোষকতার ব্যবস্থাকে এখনও বাতিল করতে পারেননি। ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার পরিবর্তে সেনাবাহিনী বরং ষাট দিনের জন্য ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা পেয়ে নিজের শক্তিমত্তা প্রদর্শন করছে। কুখ্যাত সেনা অফিসার জিয়াউল আহসানকে আটক ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আর কাউকেই আন্দোলন চলাকালীন সময়ে তাদের ভূমিকার জন্য বিচারের আওতায় আনা হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থনে নিজেদের দায় স্বীকার না করে গণমাধ্যমগুলো বরং ইউনুস সরকারের গুণগান গাইতে ব্যস্ত। যদিও সেনাবাহিনী সম্পর্কে তাদের কোনো কিছু বলতে দেখা যায়নি।১
অন্যদিকে ইসলামিস্ট, দলীয় ক্যাডার ও কিছু ছাত্ররা সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণে ব্যস্ত। তারা সুফি মাজার, হিন্দু মন্দিরে হামলা থেকে শুরু করে নারী এবং এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানুষদেরকে হয়রানি করছে। এক ডজনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, এদের মধ্যে চারজন আবার সেনাবাহিনীর জিম্মায় থাকা অবস্থায়। খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে বাঙালিদের দুটো ভিন্ন হামলায় চারজন আদিবাসী নিহত হয়েছেন। একশোরও বেশি আহত হয়েছেন এবং পঞ্চাশটির বেশি দোকানে আগুন দেওয়া হয়েছে। বিবেকবান নাগরিকরা এই বিদ্বেষের প্রতিবাদে সরব হয়েছেন। কিন্তু রাষ্ট্রের কোনো পদক্ষেপ এখনো দেখা যায়নি। বরং আওয়ামী লীগের রেখে যাওয়া মতপ্রকাশের অধিকার বিরোধী আইনগুলো এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে।
২২শে সেপ্টেম্বর থেকে ছাত্রছাত্রীরা পুনরায় শ্রেণীকক্ষে ফিরেছে। শ্রেণী ও মতাদর্শের বিভেদ ভুলে তারা বিবেকের তাড়নায় আন্দোলন করেছিল, ক্ষমতার জন্য নয়। তারপরও তারা স্বৈরাচারকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। তাদের জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো চলমান সহিংসতার দায়ভার এই ছাত্রছাত্রীদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। আন্দোলনকারী ছাত্রদের একটি অংশ রাজনীতিতে যোগ দেবার আগ্রহ দেখিয়েছে। গতানুগতিক ধারার রাজনীতিবিদদের আশংকা যে আন্দোলনকারীরা মতাদর্শগত ঐক্য গড়ে তুলে একটি রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হতে পারে। ঐ পথে ধাবিত হতে চাইলে তাদের সামনে অনেক বাধা অপেক্ষা করছে। জনগণের কাছে আপাতভাবে গ্রহণযোগ্যতা না থাকলেও বিবদমান রাজনৈতিক দলগুলো এতো সহজে হাল ছেড়ে দেবে না। সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।●
ইখতিশাদ আহমেদ নেত্র নিউজের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক।
লেখাটি ২৮ সেপ্টেম্বের ২০২৪ তারিখে “A New Chapter for Bangladesh?” শিরোনামে প্রথম The New York Review of Books-এ প্রকাশিত হয়। লেখাটির বাংলা অনুবাদ যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতিক্রমে প্রকাশ করা হলো।
১ প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দুঘন্টাব্যাপী একটি আলোচনা স্মরণ করে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, “যখন প্রফেসর ইউনুস সম্পাদকদের দৃঢ়কণ্ঠে তার ক্যাবিনেটের যেকোনো কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করার জন্য আহবান জানালেন তখন কী এক সতেজ অনুভূতি হলো। বিশেষভাবে আমাদের মতো মানুষের জন্য যারা বিগত পনের বছর ধরে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সত্য বলে আসছি”। ঢাকা ট্রিবিউনের সম্পাদক জাফর সোবহান ইউনুসের নিউইয়র্ক ভ্রমণের প্রসংগ টেনে বলেন, “এমনকি আমরা যারা বিশ্বমঞ্চে তাঁর ক্যারিশমা এবং প্রতিভার সঙ্গে পরিচিত, আমাদের জন্যও গত সপ্তাহে ইউএনজিএ-তে ডক্টর ইউনূসের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখার মতো ছিল” অন্তর্বতী সরকারের বৃহত্তর সম্ভাবনা সম্পর্কে সোবহান বলেন যে, “এর চেয়ে বড় দায়িত্ব আর কিছু হতে পারে না, তবে এই সময়ে এই বোঝা কাঁধে নেয়ার মতো যোগ্য আর কেউ নেই। আমাদের পূর্ণ বিশ্বাস আছে তিনি অর্পিত দায়িত্ব সফলভাবে পালন করবেন, বাংলাদেশকে গর্বিত করবেন, যেমনটা তিনি অতীতেও বহুবার করেছেন। সঠিক সময়ে সঠিক লোকের আগমন ঘটেছে”।