নিষিদ্ধের খেলায় অন্তর্বর্তী খেলুড়েরা

রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে সস্তা বাহবা পেতে গিয়ে প্রকৃত জবাবদিহিতা, ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রকে উপেক্ষা করা হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সস্তা জনতোষণ যথেষ্ট হয়েছে।

নিষিদ্ধের খেলায় অন্তর্বর্তী খেলুড়েরা

আগস্টের এক তারিখ তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামী ও দলটির ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে। তাদের ওই পদক্ষেপ অবৈধ ছিল — কিন্তু সিদ্ধান্তটির গায়ে বৈধতার প্রলেপ দেয়া হয়েছিল সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী প্রচেষ্টার নাম করে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ২৪ আগস্ট ওই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

ঠিক এই কারণেই বিষয়টি আরও উদ্বেগের যে, জামায়াতের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের এক মাস যেতে না যেতেই একই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করে রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধের ক্ষমতা পেতে চায়। অথচ, তার আগের মাসেই নিউ ইয়র্কে যারপরনাই জনসংযোগ চালিয়ে উদার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ধ্বজা ধারণ করেছিল সরকার।

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কার্যকরভাবে চলার ন্যুনতম শর্তগুলোর অন্যতম হচ্ছে নাগরিকদের সমাবেশ ও সংগঠন করার স্বাধীনতা আর আইনের শাসন থাকতে হবে। কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার জন্য আইনগতভাবে গৃহীত অথবা বাস্তবায়িত যেকোনো কৌশল সংবিধান ও সাংবিধানিক চেতনার পরিপন্থী।

নিউ ইয়র্কে বিদেশী নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ করমর্দনের ছবি নিয়ে আত্মসন্তুষ্টিতে ভোগা অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্যরা ভুলতে বসেছেন যে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল নিয়ে তাদের প্রস্তাবিত সংশোধনী আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন — পাশাপাশি, সেই কারণে কোলাকুলি করে ছবি তুলে আসা ওই বিদেশী নেতাদের কাছেই ভবিষ্যতে তাদের জবাবদিহি করতে হবে।

সন্ত্রাসবাদবিরোধী আইনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ যেভাবে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করেছিল, সেই পথে না গিয়ে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের উদ্দেশ্যে দলটির সদস্যদের সংঘটিত মানবতা-বিরোধী অপরাধকে সামনে এনে নিজেদের পদক্ষেপকে জায়েজ করতে চায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই ধোঁয়াশা সৃষ্টি এমন সময়ে হচ্ছে যখন বাংলাদেশীদের প্রাপ্য ছিল সৎ শাসন।

অপরাধের দায়ভার অপরাধ সংঘটনে জড়িত ব্যক্তির ওপরই বর্তায়। অপরাধ সংগঠনের ষড়যন্ত্র ও যৌথ অপরাধমূলক কার্যক্রম উভয় ক্ষেত্রেই একই কথা প্রযোজ্য। আইন একজন ব্যক্তিকেই দায়ী ও দোষী সাব্যস্ত করে, কোনো প্রতিষ্ঠানকে নয়।

ন্যুরেমবার্গ প্রিন্সিপালস, যার মাধ্যমে নাৎসি পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, তা এখানে প্রযোজ্য নয়। প্রথমত, ন্যুরেমবার্গ প্রিন্সিপালস পৃথিবীতে এর আগে ছিল নজিরবিহীন। ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের পর এই প্রিন্সিপালস আর কোথাও প্রয়োগও হয়নি।

সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী আইনের মতোই, ন্যুরেমবার্গ প্রিন্সিপালসও এমন কোনো সংগঠনের ক্ষেত্রে আরোপ করা যাবে না, যাদের সাংগঠনিক মূলনীতিতে মানবতা-বিরোধী অপরাধের কথা উল্লেখ থাকে না।

বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দল মানবতা বিরোধী অপরাধ করার উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত হয়নি। বরং, কোনো দলের নেতা যদি মানবতা-বিরোধী অপরাধে নেতৃত্ব দেয় বা অংশগ্রহণ করে, তাহলে তারা বরং নিজ দলের নীতিমালা বিরুদ্ধে গিয়ে তা করেছে।

তাই দল নিষিদ্ধের অবৈধ এই আইন প্রণীত হলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আরও জটিলতার মুখোমুখি হতে হবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে। যদি কোনো দল কিংবা সংগঠন এই আইন দ্বারা মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের দায়ে স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ হতে পারে, তবে একই আইনের বলে (জুলাই ও আগস্টের কর্মকাণ্ডের কথা বিবেচনা করলে) পুলিশ, র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও সেনাবাহিনীকেও নিষিদ্ধ করতে হবে। কেবল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে এই সংস্থাগুলোকে দায়মুক্তি দেয়া হলে, তা হবে রাজনৈতিক প্রতিশোধ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে আইনের শাসনকে প্রকাশ্যে ধ্বংস করার শামিল। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সহিংস নিপীড়নে জড়িত সশস্ত্র বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে এখনও পদক্ষেপ না নেয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অবৈধ ও অ-গণতান্ত্রিক উদ্দেশ্যে আইনের অপব্যবহার শুরু করার আগে দুই মাসের চেয়ে বেশি সময় নেবে — অন্তত এতটুকু প্রত্যাশা তো ছিলই।

এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার আগের সময়টুকু সুশাসন প্রতিষ্ঠা, সুশাসনকে শক্তিশালী করতে সংস্কার প্রণয়ন, ক্ষমতাবানদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং জুলাই-আগস্টের ঘটনাবলীর পুঙ্খানুপুঙ্খ ও অরাজনৈতিক অনুসন্ধান করা — যেন বাছবিচারহীন সহিংসতায় জড়িত প্রত্যেক ব্যক্তিকে ন্যায়সঙ্গতভাবে বিচার ও দায়ী হলে যথাযথভাবে শাস্তি দেয়া যায় — সেই পথে ব্যয় করলেই ভালো করবে। নিষিদ্ধ করার জনতুষ্টিবাদী রাজনীতি হলো গণতন্ত্রের পরিপন্থী।●