শিশুপালন কি নারীপ্রশ্ন?
বড় পরিসরে ধরতে গেলে শিশুকে বড় করার দায় আসলে রাষ্ট্রের। বাবা-মায়েরা সন্তানের জন্ম দেন ঠিক, কিন্তু বড় হয়ে রাষ্ট্রের একজন সুনাগরিক হবে একটি শিশু। তার শিক্ষা আর নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রেরই নেওয়ার কথা।
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, বিকাল তিনটায় ক্ষুব্ধ নারীসমাজের একটি সংলাপ ছিল রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর রুনি মিলনায়তনে। সেখানে আমিও উপস্থিত ছিলাম। ‘গণঅভ্যুত্থান ও নারীপ্রশ্ন’ শীর্ষক এই সংলাপে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার নারীরা অংশ নিয়েছিলেন। শহিদ ভাইয়ের বোনেরা ছিলেন, মায়েরা ছিলেন, আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করা নারী শিক্ষার্থীরা ছিলেন। বিভিন্ন বিষয়েই কথা হল। এর মধ্যে একটি প্রসঙ্গ ছিল কর্মজীবি নারীদের শিশুপালনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে। কর্মস্থলে শিশুদের রাখার জন্য ডে-কেয়ার ইত্যাদির দাবি তুলতে চাইলেন একজন বক্তা।
এর আগেও একবার এমন এক অল উইমেন গ্যাদারিংয়ে ছিলাম আমি। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য প্রফেসর ডক্টর সৌমিত্র শেখর দে শুধুমাত্র নারী শিক্ষকদের ডেকেছিলেন কর্মপরিবেশ ইত্যাদি নিয়ে উপাচার্য হিসেবে নিজের জানাবোঝা বাড়াতে। সেখানে দেখেছিলাম নারীরা শিশুদের রেখে অফিসে আসবার প্রতিবন্ধকতা ইত্যাদি নিয়ে কথা বলছিলেন, ক্যাম্পাসের কোথাও ডে-কেয়ার সেন্টারের ব্যবস্থা করা যায় কিনা সেসব আলাপ তুলেছিলেন। সেদিনও আমার যা মনে হয়েছিল, ক্ষুব্ধ নারীসমাজের আলোচনার দিনেও একই কথা মনে হয়েছে- শিশুপালন কি শুধু নারীর একার দায়? কর্মজীবি নারীদের মধ্যে যাদের পুরুষসঙ্গী নেই তাঁদের কথা একটু আলাদা। যাদের পুরুষসঙ্গী আছেন, সেই পুরুষসঙ্গীরা কি কখনো নিজেদের কর্মস্থলে গিয়ে ডে-কেয়ার সেন্টারের দাবি তোলেন? কখনো তুলেছেন? পুরুষ শিক্ষকদের মধ্যে যাদের স্ত্রীরা ‘স্টে অ্যাট হোম’ মাদার তাদের হয়ত এই তাগাদা নেই। কিন্তু অনেকেরই কর্মজীবি স্ত্রী আছেন। তারাও কি কখনো কোন সভায়, কোন দাবি-দাওয়া আদায়ের সময় ডে-কেয়ারের দাবি তুলেছেন? না তুলে থাকলে কেন তোলেননি? তারাও কি ধরে নিয়েছেন যে বাসায় ন্যানি বা আয়া না থাকলে কিংবা অনুপস্থিত থাকলে তাদের কর্মজীবি স্ত্রীরাই শিশুদের নিজের অফিসে নিয়ে যাবেন আর তাই দাবিটা তাদেরই তোলার কথা? স্যানিটারি প্যাড ভেন্ডিং মেশিন কিংবা পিরিয়ড লিভ চাইলে নাহয় বুঝতাম, নারীর বিশেষ প্রয়োজন নিয়ে কথা হচ্ছে- এটা তো মেয়েরাই বলবে। কিন্তু শিশু নারীর একার ব্যাপার নয়।
এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় শিশু বড় হয় পিতার পরিচয়ে। মাতৃত্ব ততক্ষণই মহান যতক্ষণ মায়ের একজন বৈধ স্বামী আছেন কিংবা ছিলেন এবং সেই বৈধ স্বামীর ঔরসেই সন্তানটি জন্মেছে। একজন নারী অবিবাহিত অবস্থায় মা হলে সমাজে নিজের পরিচয়ে সন্তানকে বড় করতে পারেন না। বিবাহিত নারীরাও সন্তানের নাম রাখবার সময় পিতার সারনেম ব্যবহার করেন। মায়েদের নাম অনেক সময় প্রচ্ছন্নভাবে যুক্ত হয়। কিন্তু সেটি সামাজিক ব্যবস্থা নয়, প্রচলিত নয়। আমাদের দেশে একটা সময় পর্যন্ত মেয়েদের নাম হত অমুক আক্তার তমুক বেগম, একেবারেই ফেমিনিন নাম। আমাদের প্রজন্ম থেকে মেয়েদের নামের পরে বাবার সারনেম জুড়ে দেওয়ার প্রচলন হয়েছে। মেয়েদের নামের শেষ অংশেও থাকে বাবার নাম- মেয়েদের নাম এখন হয় অমুক রহমান, তমুক ইসলাম। একজন মানুষের বড় হওয়ার পেছনে জৈবিকভাবে মায়ের অবদান যতই হোক, সামাজিক ভাবে বাবার অস্তিত্ব অনেক বেশি জরুরি। তাহলে একজন শিশুকে বড় করবার দায় মায়ের কেন বেশি হবে?
অনেক মা ডিভোর্সের পর সন্তানের কাস্টডি পান না, অনেকে আর্থিক অস্বচ্ছলতার জন্য চাইতেও পারেন না। অথচ ভরণপোষণ দিয়ে হলেও মায়ের কাছে সন্তানকে রাখবার কথা, আইন তাই বলে। ঘটনা হল, আইনের আশ্রয় নিতে যেতে পারার সামর্থ্য নেই এমন অনেক তালাকপ্রাপ্ত মাকেও আমি চিনি। তারমানে দেখা যাচ্ছে অধিকারের বেলায় বাপের ভাগ বেশি। অথচ খাওয়ানো, ধোয়ানো, পরানো জাতীয় ব্যাপারে মায়ের কর্তব্য বেশি। কর্মজীবি মায়ের বাচ্চা পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ করলে মায়ের দোষ, মা চাকরি করে বাচ্চাদের হোম ওয়ার্ক করায় না। পেটের অসুখ করলে মায়ের দোষ, মা খাওয়ানোর সময় হাইজিন মেইনটেইন করেনি। আবার অফিসে গিয়ে ডাবল খেটে প্রমাণ করতে হয় বাসায় বাচ্চা ফেলে এসে অফিসের কাজে অবহেলা করছি না কিন্তু!
বড় পরিসরে ধরতে গেলে শিশুকে বড় করার দায় আসলে রাষ্ট্রের। বাবা-মায়েরা সন্তানের জন্ম দেন ঠিক, কিন্তু বড় হয়ে রাষ্ট্রের একজন সুনাগরিক হবে একটি শিশু। তার শিক্ষা আর নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রেরই নেওয়ার কথা। সরকারি ডে-কেয়ার সেন্টার থাকা দরকার যেহেতু একান্নবর্তী পরিবারের প্রথা শহুরে সমাজে আর অবশিষ্ট নেই। কথায় বলে ‘ইট টেইক্স আ ট্রাইব টু রেইজ আ চাইল্ড’। একটা আস্ত কমিউনিটিকেই আসলে দরকার শিশুদের বড় করার জন্য। কিন্তু আমরা এখন আর প্রতিবেশীর বাসায় বাচ্চাকে রেখে যাওয়ার কথা ভাবতে পারি না, প্রতিবেশীদের সঙ্গে সেই সম্পর্কই আমাদের অনেকের নেই।
আমরা যেহেতু কল্যাণকর রাষ্ট্রে বসবাস করি না, এই ধরনের ব্যবস্থার আলাপ অনেকটাই ইউটোপিয়ান শোনায়। ছোট পরিসরে একটা ইউনিট ফ্যামিলিকেও যদি ধরি, একজন শিশুকে বড় করার জন্য করণীয়ের পঞ্চাশভাগ পিতার ওপর বর্তানো উচিৎ। সে হিসেবে পিতাকেও নিজের অফিসে গিয়ে ডে-কেয়ার সেন্টারের দাবি জানানো উচিৎ। কর্মজীবি স্ত্রীরা অফিসের কোনো জরুরি কাজে ব্যস্ত থাকলে কিংবা আরেকটি শিশু জন্মাতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে বাবারা কি সন্তানদের অফিসে নিয়ে যান না? আমার নিজের কর্মস্থলেই দুয়েকজনকে দেখেছি ছোট্ট বাচ্চাদের নিয়ে ক্যাম্পাসে আসতে। কিন্তু সেটা সংখ্যায় কম। নারী শিক্ষকেরা অনেকেই শিশুদের ক্যাম্পাসে নিয়ে যেতে বাধ্য হন। সেজন্য দাবিটাও তাঁদের দিক থেকেই আসে। আমার বক্তব্য হলো, শিশুপালন একটি নারী ইস্যু হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে- এই ধারণাটি ভুল এবং বদলের দাবি রাখে। শিশুপালনের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা যার কাছেই চাওয়া হোক, রাষ্ট্র কিংবা কর্মস্থল, চাইতে হবে পুরুষকেও। সবেতন ম্যাটার্নিটি লিভ চাইতে হবে এবং পিতৃত্বকালীন ছুটির দাবিও তুলতে হবে। ছয় মাস না হলেও অন্তত তিনচার মাস একজন কর্মজীবি পুরুষকে ছুটি দেওয়া হোক যেন তিনি সেই সময়টুকুতে প্রসূতি স্ত্রীর শারীরিক আর মানসিক দুর্বলতার সময়টুকুতে, পরিবর্তিত পারিবারিক পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে, শিশুর খাওয়ানো ও ঘুম পাড়ানো থেকে শুরু করে ন্যাপি পাল্টানোর ট্রেইনিং নিতে পারেন।
বাংলাদেশে দুই সন্তানের অধিক সন্তান জন্মদানে নিরুৎসাহিত করার জন্য ম্যাটার্নিটি লিভ দুইবারের বেশি দেওয়া হয় না এমন কথা শুনেছি। যেসকল অফিসে ম্যাটার্নিটি লিভ দেওয়া হয় সেখানে প্যাটার্নিটি লিভ দেওয়ার দাবি জানাতে চাই। যেসকল অফিসে ম্যাটার্নিটি লিভ দেওয়া হয় না সেখানে মাতৃত্বকালীন এবং পিতৃত্বকালীন উভয় ছুটি দিতে বাধ্য করা হোক। যে কোন সন্তানই মানবজাতির সন্তান, রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নাগরিক এবং পিতার পরিবারের বংশধর। তাহলে তাঁদের সুরক্ষার জন্য নারী একা নিজের ক্যারিয়ার জলাঞ্জলি দেবে কেন? কর্মস্থলে শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রের দাবি তুলে নারী একা চেঁচাবে কেন?
আমরা প্রায়ই দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর কথা বলি। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টালে যে কেউই বুঝতে পারবেন যে কী কর্মজীবি কী গৃহিণী, একজন নারীর ওপর সন্তানপালনের সবটুকু দায় চাপিয়ে দেওয়া একটি পুরুষতান্ত্রিক আচরণ। গৃহিণী মায়েরা দিনভর সংসারের সকল কাজ দেখভাল করেন এবং নিজেরা রান্না-খাওয়ার মতন সবচেয়ে মৌলিক অংশটুকুর প্রায় সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেন। কাজেই, শিশুপালনের বেলায় অতি অবশ্যই তাঁর কর্তব্যে ভাগাভাগি হওয়া দরকার।
লৈঙ্গিক বৈষম্য নিরসন করতে চাইলে নারীপ্রশ্নগুলো তুলে ধরতে পারাটা জরুরি। আরও জরুরি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আর রাষ্ট্রব্যবস্থাকে তাদের অংশের কর্তব্য মনে করিয়ে দেওয়া। নইলে তারা আজীবন নারীর ওপর ডাবল বার্ডেন চাপিয়েই যাবে। শিশুপালন নারীর একার কাজ নয় সেকথা পুরুষকে স্বীকার করতে হবে আর নিজের অংশটুকু পালন করতে পারার জন্য আওয়াজ তুলতেও হবে।●
উম্মে ফারহানা, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক।