স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলন এগিয়ে নিতে হবে প্রবাসেও

ঐক্যবদ্ধ প্রবাসীরাও হতে পারে বাংলাদেশের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী হাতিয়ার।

স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলন এগিয়ে নিতে হবে প্রবাসেও
অলঙ্করণ: নেত্র নিউজ

মাত্র অল্প কয়েকটা দিন পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে আমরা প্রবাসীরা উদ্বেগ- উৎকণ্ঠায় ছিলাম। অথচ বাংলাদেশে অন্তত ২০৯টি পরিবার আর কখনও তাদের প্রিয়জনকে ছুঁয়েও দেখতে পারবে না। অনেক পরিবার এখনও হয়তো জানেই না যে তাদের স্বজনের লাশ কোথায় পড়ে আছে — আদৌ দাফন হয়েছে কিনা।

আন্দোলনকারী নিরীহ ছেলেগুলিকে একের পর এক গুলি করা হচ্ছে। তাদের শরীর নিথর হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। কোনো বন্ধু তখনও চেষ্টা করছে তাকে টেনে এক পাশে নিয়ে যেতে। কিন্তু গুলি থামছেই না। এই দৃশ্য আমাদের পরিচিত: হয়তো কোনো সিনেমায় বা নেটফ্লিক্স সিরিজে দেখেছি। কিন্তু এই দৃশ্য বাস্তবে রূপ নেবে — ঢাকার রাস্তায়, স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর, তা আমরা বিশ্বাস করতে চাই না। মনে মনে বার বার আশা করেছি, কোনো ফ্যাক্টচেকার এসে বলুক যে এসব ভুয়া ভিডিও। কোনো নির্ভরযোগ্য মিডিয়া বলুক এগুলো গুজব। কিন্তু যখন এই নিবন্ধ লিখছি, তখন ২০৯ জন নিহত, কয়েক হাজার আহত। চলছে ব্যাপক ধরপাকড়।

জার্মানির বার্লিন শহরে বসে এসব দেখছি। এখন এখানে গ্রীষ্মকাল। তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস; সূর্য ঝলমল করছে। সবাই সারা বছর এই সময়ের জন্য অপেক্ষা করে। চারিদিকে কিছু না কিছু ঘটেই চলছে। কিছুক্ষণ আগে এক বন্ধু ফোন করে জানতে চাইলো প্রাইডে কখন কোথায় দেখা করবো। আর বার্লিন থেকে ঠিক সাত হাজার কিলোমিটার দূরে, যেখানে আমার জন্ম, আমার বেড়ে ওঠা, সেখানে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। গণতন্ত্রের মৌলিক অধিকার চর্চা করতে গিয়ে, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে, কোটা সংস্কারের ন্যায়সঙ্গত দাবিতে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ।

কিন্তু বার্লিনের এই উল্লাস, এই স্বাধীনতা কেন আমাকে অনুশোচনা দিচ্ছে?

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের হিসাবে সারা বিশ্বে প্রায় ৮০ লাখ বাংলাদেশি প্রবাসী বসবাস করছে। আমাদের সবারই কি এমন অনুভূতি হচ্ছে? হয়তো সবার না। গণতান্ত্রিক দেশে বসবাস করছি, সামাজিক নিরাপত্তা পাচ্ছি, যে কোনো অন্যায় বা অপরাধের বিরুদ্ধে প্রশাসনের সক্রিয় সহায়তা পাচ্ছি। এই বিশেষাধিকার কি এই মুহূর্তে আমাদের পীড়ন দিচ্ছে না? কিন্তু পীড়ন হোক আর দায়বদ্ধতা হোক — আমরা প্রবাসীরা ঠিক এই মুহূর্তে আমাদের বিশেষাধিকার ব্যবহার করেও এই আন্দোলনের পাশে দাঁড়াতে পারি।

২০২২ এর সেপ্টেম্বরের কথা মনে আছে? ইরানে জিনা মাহসা আমিনী নামের এক তরুণীকে ঠিকভাবে হিজাব না পরার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। পরবর্তিতে তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী বিক্ষোভ শুরু হয়। ইরানে এক অভ্যুথানের জন্ম নেয়। ফলশ্রুতিতে দেশটিতে প্রায়ই বন্ধ করে রাখা হয় ইন্টারনেট। তা সত্ত্বেও ইরানি প্রবাসীরা এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। সরকারকে আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে রেখেছে।

আধুনিক যুগে একনায়কতান্ত্রিক সরকারের একটি প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট। বাংলাদেশে আবারও ইন্টারনেট বন্ধের মতো ঘটনা ঘটবে। কিন্তু আজ যদি ৮০ লাখ প্রবাসীর মধ্যে ২০ লাখও ঐক্যবদ্ধ হতে পারে এবং এই আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানাতে পারে, তা হবে বাংলাদেশের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার।


এই সময়ে বারবার মনে পড়ছে শাহবাগের দিনগুলোর কথা। আমরা সত্যিই বিশ্বাস করেছিলাম যে বাংলাদেশের পরিবর্তন আসবে। কিন্তু আমাদের সেই স্বপ্নগুলো ধীরে ধীরে ঝরে পড়লো। গত ১২ বছরে তরুণ প্রজন্ম যখনই প্রতিবাদ করেছে, আওয়ামী লীগ প্রথমে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে। না পারলে সেই আন্দোলন দমন করেছে। আর ঢাল হিসেবে সরকার বারবার সেই পুরানো বয়ান বিক্রি করে আসছে: আওয়ামী লীগের কোনো গণতান্ত্রিক কিংবা ধর্মনিরপেক্ষ বিকল্প নেই। কিন্তু আজকের কোটা আন্দোলন সেই ঢালে ফুটো তৈরি করে দিয়েছে। এই আন্দোলন আর কোটার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই; এখন বিক্ষোভকারীদের দাবি একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের।

এই প্রজন্ম রাজনৈতিকভাবে সচেতন; তারা এই সরকার ছাড়া আর কোনো সরকার দেখেনি। তারা ক্লান্ত, হতাশ ও সহযোদ্ধা হারিয়ে দিশেহারা। এই প্রজন্মকে পুরানো কৌশলে দমন করা যাবে না। তাদের দাবি স্পষ্ট: সত্যিকারের গণতন্ত্র ও ন্যায্যতা। সেনা নামিয়ে, ইন্টারনেট বন্ধ করে, হাজার হাজার লোকের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে এবার আর কাজ হবে না।

সেই ছোটবেলায় শেখ হাসিনাকে টিভিতে দেখলেই শিহরিত হতাম, আর এখনো হই। কিন্তু এই শিহরনের মধ্যে তফাত আছে; তখন সেটা ছিল সম্মান, আর এখন ভীতির। তার পরিবারের সঙ্গে যা হয়েছে, নির্বাসন থেকে ফিরে এসে তার রাজনৈতিক লড়াই—এবং তিনি একজন নারী। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকা ব্যাক্তিটি একজন নারী — একজন নারীবাদী হিসেবে এটি আমার জন্য গর্বের বিষয় হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এ যেন লজ্জার। কারণ স্বৈরাচার হওয়ার জন্য কোনো নির্দিষ্ট লিঙ্গের প্রয়োজন হয় না।

আমরা কি তবে এই ক্ষমতার নির্মম পরিণতির দেখতে যাচ্ছি?

ক্ষমতা শব্দটির সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আমার এক অন্যরকম সম্পর্ক রয়েছে। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে বাবাকে ছাড়া একলা মায়ের সঙ্গে বেড়ে ওঠার কারণে ক্ষমতাহীন অসহায় জীবনের সংগ্রাম আমি পরতে পরতে বুঝতে পারি।

তাই ছোটবেলা থেকেই ক্ষমতাবানদের পর্যবেক্ষণ করতে পারার প্রবণতা ছিল আমার। বিখ্যাত জার্মান সাংবাদিক বেটিনা গাউস লিখেছিলেন, “Je weniger Macht jemand hat, desto mehr weiß sie oder er über die Mächtigen.” যার হাতে যত কম ক্ষমতা থাকে, ক্ষমতাশালীদের সম্পর্কে সে তত বেশি জানে। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষরাই ক্ষমতাশালীদের সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জানে। দুর্নীতিগ্রস্ত দেশে উচ্চবিত্তদের কিছুই যায় আসে না। তাই এই আন্দোলনে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের সংখ্যা হয়তো কম।


বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের মধ্যে ইতোমধ্যে দলমত নির্বিশেষে প্রবাসীরা সংগঠিত হয়ে কাজ করে যাচ্ছে। বিদেশে আন্দোলন সংগঠিত করা ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে অবহিত করার চেষ্টা চলছে।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর দৃষ্টিতে বাংলাদেশ বিশেষ কোনো গুরুত্ব বহন করে না। তৈরি পোশাক ও জলবায়ু পরিবর্তন ছাড়া বাংলাদেশ-সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে শুরু করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষার পত্রপত্রিকায় বাংলাদেশের এই আন্দোলন নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে।

জার্মানির এক প্রথম সারির দৈনিক পত্রিকা টাগেসস্পিগেলের ছাপা সংস্করণের শিরোনাম হয়েছে, “বাংলাদেশে প্রাণঘাতী নীরবতা।” নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, “একজন অনমনীয় নেতার দমন-পীড়নে বাংলাদেশে বিপর্যয় নেমে এসেছে।” যেসব পত্রিকা বাংলাদেশ নিয়ে কোনোদিন লেখেওনি, তাদেরও শিরোনাম হচ্ছে বাংলাদেশের আন্দোলন।

বার্লিনের স্বাধীনতা আজকাল নিজেকে ভীষণ পীড়ন দিচ্ছে। সেজন্য মাঝে মাঝে কি নিজেকে স্বার্থপর মনে হয়? হ্যাঁ, মনে হয় — তাই হয়তো প্রবাস থেকে কিছু করার চেষ্টা করি। কিন্তু এই কিছু করার চেষ্টাটা কি নিজের মনকে সান্ত্বনা দেবার জন্য? নিজে ভালো থাকার জন্য? যদি তাইও হয়, এই মুহুর্তে প্রবাসীদের চেষ্টাই হয়ে উঠতে পারে বিদ্রোহের এক শক্তিশালী অংশ। ●

শাম্মী হক জার্মান সংবাদ মাধ্যমে কর্মরত একজন বাংলাদেশী সাংবাদিক।