রোহিঙ্গাদের অকেজো করে রাখার অধিকার আমাদের নেই

মিয়ানমার জান্তার নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আশ্রয়শিবিরগুলোতে মানবেতর দিন কাটাচ্ছে। এই উন্মুল জনগোষ্ঠীকে চাইলে বাংলাদেশ কাজে লাগাতে পারে। শিক্ষা ও কর্মের সুযোগ দিয়ে এ জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে রূপান্তরের উদ্যোগ নিতে পারে।

রোহিঙ্গাদের অকেজো করে রাখার অধিকার আমাদের নেই
ছবি: জীবন আহমেদ/নেত্র নিউজ

এক.

শরণার্থী শিবিরের (ক্যাম্পে) জীবন কি আদৌ কোনো জীবন? সেই বিষয়ে আলাপ আসলে অনেকেই করেছেন। কিন্তু সেটা যে জীবন না, সেই না জীবন যে কতটা “না” — তা আসলে শিবিরে যাওয়া ছাড়া বোঝা যাবে না। 

বাসায় এসে মাপছিলাম— আমার একার থাকার কক্ষের সমান জায়গাটা পেলে একটা রোহিঙ্গা পরিবার খুশি হয়ে যাবে। এইটুকু জায়গা এখন বরাদ্দ অন্তত দুই পরিবারের জন্য। আর রোহিঙ্গাদের যে পরিবারে মানুষ কম, সে পরিবারেও নিদেনপক্ষে পাঁচজন থাকেন। এই মানুষগুলো বড় হয়ে বিয়ে করেন, তাতে থাকার জায়গার বরাদ্দ বাড়ে না, বরং ঘরের কোথাও জায়গাটা করে নিতে হয়। 

পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়সী এক ছেলেকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “সেক্স করো কেমনে?” বলেছিল, “সবাই ঘুমায়ে যাওয়া ছাড়া তো সম্ভব হয় না। আর সবাই ঘুমায়ে গেলেও সামলে করতে হয়, যাতে বাকিরা টের না পায়।”

দুই.

একটা টংয়ে বসে ছিলাম। সেখানে আলাপ হয়েছিল এক মাস্টারের সাথে। ক্যাম্পের বাসিন্দাদের মধ্যে মাস্টার্স করা অল্প কয়েকজনের একজন তিনি। ২০১৭ সালে ক্যাম্পে আসার পর এনজিওদের পাঠ্যক্রম সাজানোর দায়িত্ব পেয়েছিলেন। টং আবার একটা ডাস্টবিনের পাশে। তীব্র গন্ধে নাক ভরে আসছিল। সেই গন্ধের মধ্যেও বসেছিলেন। বলছিলেন, ক্যাম্পে যারা থাকেন, তাদের মধ্যে প্রায় আশিভাগ মানুষের চলতে হয় রেশন থেকে। সেই রেশনের একজনের ভাগে পড়ে মাসে সাড়ে বারো ডলার। অর্থাৎ এক বেলা খাবারের জন্য একজন মানুষের ভাগে পড়ে ষোল টাকা করে। আগের সন্ধ্যায় আমার কক্সবাজারের হোটেল রুমে রাতের খাবারের অর্ডার দিয়েছিলাম। বিল হয়েছিল আট শ টাকা। আট শ টাকা লাগে না একবেলা খেতে, কিন্তু ষোল টাকায় কীভাবে এক বেলার খাবার হয়, সেই হিসাব মেলাতে পারিনি এখনো।

তিন.

মসজিদের ইমাম সাহেব। পাঁচ বেলা নামাজ পড়ান। ২০১৭ সালে ক্যাম্পে আসার পর একবার কেবল ইজতেমায় এসেছিলেন। এছাড়া ক্যাম্প থেকে বের হতে পারেননি একবারও। মসজিদে নামাজ পড়িয়ে চার হাজার টাকা পান। সেই টাকা তোলা হয় ব্লকের বাসিন্দাদের কাছ থেকে। পঞ্চাশ, এক-দুই শ টাকা করে যে যেভাবে পারে দেয়। এতে কিছুই হয় না তাঁর। তবুও আল্লাহর ওপর ভরসা করে বসে আছেন, থাকছেন। বেশ ভাল অবস্থা ছিল রাখাইনে। আর এখানে থাকছেন পরিবার নিয়ে, ছোট একটা ঘরে। কোনো একদিন দেশে ফিরবেন সেই আশায় এখনো বুক বেঁধে আছেন।

 আরেক ভদ্রলোক গত সেপ্টেম্বরে এসেছেন বাংলাদেশে। বার্মার সিতওয়ে ইউনিভার্সিটি থেকে বার্মিজ ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স-মাস্টার্স করেছেন। তারপর সেখানেই পড়াতেন। ফলে এখানকার অনেক মানুষের শিক্ষক তিনি। তাদের নয় জনের পরিবার এসে উঠেছেন ভাইয়ের ঘরে। ভাই পাশের মক্তবের শিক্ষক। পরিবারের মানুষদের কেউ ভাইয়ের বাসায় থাকেন। কেউ থাকেন পাশের আরেক আত্মীয়ের বাসায়। নতুন করে বাসাও পাচ্ছেন না। নতুন যারা এসেছেন তাদের কেউ ঘর পাচ্ছেন না। এখানে বসবাসকারী আত্মীয় কিংবা পরিচিতদের ঘরে থাকছেন। কিন্তু সেই সাড়ে বারো ডলারও তাদের জুটছে না ভাগ্যে। মাত্র একবারের রেশন পাওয়া গেছে, তা দিয়ে চলছে এখনও। 

চার.

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কিছু এনজিও চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকে। সেখানে ফান্ড আসে অনেক। কিন্তু সেবা পায় না ক্যাম্পের মানুষ। নামমাত্র চিকিৎসাসেবা আর ওষুধ দিয়ে বিদায় করে দেওয়া হয়। এনজিওতে কাজ করা এক রোহিঙ্গা যুবক বলছিলেন, সেখান থেকে সিটামল দিয়ে বিদায় করে দেয়। অথচ সব ওষুধই থাকে। কেউ পরিদর্শনে এলে, সে সময় যারা চিকিৎসা নেয়, তারা সব ওষুধই পায়। ক্যাম্পে এটা প্রাইমারি মেডিকেল ক্যাম্প। এখান থেকে জটিল রোগীদের বাইরে রেফার করে দেওয়ার কথা। রেফার করা হয় না। মরেও যায় ম্যালা মানুষ। কথা বলেন না কেন জিজ্ঞাসা করতেই বলল, “কথা বলে কি চাকরিটা খোয়াবো নাকি!” অথচ মুখে মুখে বরাদ্দের অংক যা শুনেছি, তাতে ক্যাম্পেই একটা আস্ত স্পেশালাইজড মেডিকেল হাসপাতাল স্থাপিত হয়ে যাওয়ার কথা!

পাঁচ.

শিক্ষার কোন ব্যবস্থা নেই। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ক্যাম্পের এনজিওদের লার্নিং সেন্টার আছে। তাতে অল্প দুই ক্লাস পড়িয়েই দায়িত্ব সারা হয়। আর সেই সারিয়ে দেওয়াটাও কিছুটা এনজিওকেন্দ্রিক। তাতে পড়াবার চেয়ে দেখনদারি বা হইচইটাই বেশি হয়। 

রোহিঙ্গারা তাদের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে মাদ্রাসা আর প্রাইভেট এডুকেশন সিটেমের মধ্যে দিয়ে। মাদ্রাসাগুলোর প্রায় সবগুলোই কওমি। চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসা বা পটিয়া মাদ্রাসার সিলেবাসে চলে এসব। প্রতিটা ক্যাম্পেই মাদ্রাসা আছে এক-দুটো করে। আর ক্যাম্পের প্রায় ব্লকেই আছে মক্তব, হেফজখানা। সেখান থেকে ধর্ম শিখছে রোহিঙ্গারা। আর আছে একটা প্রাইভেট এডুকেশন। এনজিও লার্নিং সেন্টারের সময়সূচির আগে-পরে প্রাইভেট এডুকেশন সেন্টারে পড়াশোনা হয়। সকাল ছয়টা থেকে আটটা আর বিকেলে চারটা থেকে ছয়টা-সাতটা অবধি ক্যাম্পের শিক্ষিতরা মিলে মিয়ানমারের সিলেবাসে এই প্রাইভেট সেন্টারে শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। তাতে বারো ক্লাসের সমমান পড়ানো হয়। আমি যে স্কুলে গিয়েছিলাম সেখানে জীববিদ্যা, ইংরেজি ও পদার্থবিদ্যা পড়াতে দেখেছি। বার্মিজ ভাষায় শিক্ষাদানের দায়িত্ব নিয়েছেন নতুন আসা সেই শিক্ষক।

ছয়.

ক্যাম্পের পুরুষেরা ঘর থেকে বেরুতে পারেন। মেয়েরা তা পারেন না। ওই একটা ছোট্ট জেলখানায় কাটিয়ে দিতে হয় একটা জীবন, একটা গোটা জীবন। আর রোহিঙ্গা পুরুষেরা নারীর ব্যাপারে খুবই “পুরুষ” হয়ে ওঠেন। ওইটুকু বন্দি জীবনে তিনি থাকেন “রাজা”। আর ঘরের নারীরা হন দাসী। এক নারী তাদের অসহায়ত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে বলছিলেন, “একবার এক রাতে আমার পাশের বাসার রোহিঙ্গা পুরুষটা কই যেন চলে গিয়েছিল, ফিরতে ফিরতে রাত বারোটা পার হয়ে যায়। একটা কাজে আমরা জেগে ছিলাম। সেই লোকের স্ত্রীর বাচ্চা হয়েছে চল্লিশ দিনও হয়নি। ক্লান্ত শরীর নিয়ে স্ত্রী অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। সেই লোক ঘরে ফিরে কড়া নাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রী কেন দরজা খোলেননি, সেই জন্যে চুলের মুঠি ধরে পেটাচ্ছিলেন স্ত্রীকে। 

বলছিলেন, “নারীদের জন্য সেলাই শেখার একটা কোর্স করেছিলাম। সেটাতেই হাজারো প্রশ্ন! কেন আমরা নারীদের ঘরের বাইরে বার করছি। নষ্ট হয়ে যাবে নারীরা। অথচ পেটের দায়ে শরীর বিক্রি করতেও হচ্ছে অনেক রোহিঙ্গা নারীকে।”  

সাত.

এতক্ষণ যাদের কথা উল্লেখ করেছি, এই সব ক’টা মানুষই ফিরতে চান নিজ দেশে। কিন্তু কীভাবে— সেটা জানা নেই কারোরই। মসজিদের ইমাম বলছিলেন, “প্রতি জুমাতেই আমরা নিজ দেশে যাওয়ার জন্য মোনাজাত করি। আমরা ফিরব হয়ত। কিন্তু কখন ফেরা হবে জানি না।”

মাদ্রাসার শিক্ষক বলছিলেন, “কেউ যদি সংগ্রামের ডাক দেয়, আমি এই মুহূর্তে চলে যাব। একটা ফোন করে কাউকে বলার মতো পিছুটানও নেই আমার। আমার সাথের অনেক মানুষেরই একই অবস্থা। আমরা কাউকে পাচ্ছি না, যার পেছনে দাঁড়িয়ে আন্দোলন করব, সংগ্রাম করব, লড়াই করে অধিকার আদায় করে নেব। অথচ একটা গোটা জন্মভূমি হারিয়ে বন্দি হয়ে আছি এই এইটুকু একটা জায়গায়। একটা ধুসর স্বপ্ন বুকে নিয়ে অপেক্ষ করছি দেশে ফেরার।” 

আমার মনে হচ্ছিল, ফিলিস্তিন নিয়ে আমরা বেশ কথা বলি, দুঃখ করি, প্রতিবাদ জানাই। অথচ একটা আস্ত ফিলিস্তিন জন্ম নিয়েছে আমার ঘরের পাশেই। কিন্তু তাদের ব্যাপারে সেভাবে খোঁজ আমরা নিই না। প্রতিনিয়ত মানুষকে ঘরছাড়া করা হচ্ছে রাখাইনে। নৃশংসতার মাত্রা ছাড়ানো সব খুন করছে মিয়ামনমারের জান্তা সরকার। সেসব খুনের ছবি, ভিডিও দেখে কোনো মানুষের স্বাভাবিক থাকা সম্ভব নয়। সংবাদমাধ্যমে সেসব খবর সেভাবে আসছে না। একটা গোটা জাতি নিজেদের জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে, স্বজনহারা হয়ে স্রেফ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তিলে তিলে।

আট.

জন্মভূমিতে ফেরত যাওয়া নিয়ে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কথা বলছিলেন। তিনি নাকি সেই সময় একবার নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে তৎকালীন বর্মা সরকারকে বলেছিলেন, “কালকের মধ্যে ফেরত না নিলে (রোহিঙ্গাদের) ওদের হাতে অস্ত্র তুলে দেব। ওরা নিজেদের মাতৃভূমি নিজেরাই উদ্ধার করে নেবে”। পরের দিনই নাকি উদ্বাস্তু হয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত নিয়ে গিয়েছিল বর্মা সরকার। কিন্তু, এই সময়ে এসে রোহিঙ্গারা সশস্ত্র সংগ্রামের জড়িয়ে পড়লে তার নানা দিক তৈরি হবে, রাজনীতি হবে। দেখা যাবে, বিশ্বের কাছ থেকে রোহিঙ্গারা যেটুকু অধিকার পাচ্ছে, সেটাও হারাবে। 

আমাদের সরকার সেইদিকে না গিয়ে এই নিপীড়িত জনগোষ্ঠীটিকে জনসম্পদে রূপান্তর করতে পারে। এদের পড়াশোনার অনুমতি দিয়ে দেশের কাজে লাগাতে পারে। যতদিন না তাদের ফেরার কোনো পথ বা জোরালে প্রক্রিয়া তৈরি হচ্ছে, ততদিন কারিগরি নানা প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। এরপর তাদের নানা কাজে লাগানো যেতে পারে। শ্রম-সহায়তা নেওয়া যেতে পারে তাঁদের কাছ থেকে। এতে করে প্রত্যাবাসনের জন্য প্রয়োজনীয় নানা বিষয়ে তারা নিজেরাই ভূমিকা রাখতে পারবে। আর থাকার জায়গাটা না হয় রইলই। অন্তত দুই বেলা খাবার খেতে ভাবতে হবে না কারোর। সবচেয়ে বড় ব্যাপার— একটা বিশাল জনগোষ্ঠী তখন এভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে না। একটা মানুষের, একটা প্রাণের অনেক মূল্য। আমরা লাখ লাখ মানুষকে ক্যাম্পে বন্দি রেখে, স্রেফ বসিয়ে রেখে, ধ্বংস হতে দিতে পারি না। কয়েকটা প্রজন্মকে অকেজো করে রাখতে পারি না। মানুষ হিসেবে এ অধিকার আমাদের নেই।●

মীর হুযাইফা আল মামদূহ — ইসলাম, সমাজ ও রাজনীতি বিষয়ক গবেষক।