নতুন বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি যেমন হতে পারে

২০১৬ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন ফরিদপুরের অটোরিকশা চালকের ছেলে হাফিজুর মোল্লা। মাত্র এক মাস পর তার স্থান হয় মাটির সাড়ে তিন হাত নিচে, একটি কবরস্থানে। 

হাফিজুর সদ্য ক্ষমতাচ্যূত আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫ বছর ধরে যে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল তার শতাধিক ভুক্তভোগীর একজন। সরকারবিরোধী যেকোন ছাত্র আন্দোলন অঙ্কুরেই বিনষ্ট করার অভিপ্রায়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই অবাধ সন্ত্রাসের লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল ছাত্রলীগকে।

২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্রাবাসের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল ছাত্রলীগের হাতে। ছাত্রাবাসে, যা হল নামে অধিক পরিচিত, একটি সিট পাওয়ার জন্য প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের নবীন শিক্ষার্থীদের ছাত্রলীগের নিয়ম-কানুন ও নির্দেশ মানা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। হলের অন্যতম প্রধান নিয়ম ছিল ‘গেস্ট রুমে’ উপস্থিত থাকা এবং রাতের বেলা ছাত্রলীগ নেতারা যা করতে বলতো, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করা।

অন্যান্য সহপাঠীদের মতো হাফিজুরও ২০১৬ সালের শুরুর দিকে প্রচণ্ড শীতের রাতে রাজনৈতিক প্রোগ্রামে অংশ নিতে বাধ্য হন। হলে কোন কক্ষে জায়গা না হওয়ায় হাফিজুরকে ঘুমাতে হতো সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের বারান্দায়। তীব্র ঠান্ডা থেকে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে কিছুদিনের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে গেলে ছাত্রলীগ ক্যাডারদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মুক্তি পায়। এই অবস্থায় ফ্যাসিবাদী প্রবণতা রুখে দিতে সংস্কারের দাবি উঠছে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। 

শিক্ষার্থীদের এই নতুন স্বাধীনতাকে সুসংহত করার এবং ছাত্র রাজনীতি যাতে ইতিবাচক পরিবর্তন বয়ে আনতে পারে, তা নিশ্চিত করার জন্য নতুন কিছু সংস্কার নিয়ে চিন্তা-ভাবনার সময় এসেছে। এই নতুন ভোরের প্রারম্ভে ছাত্র রাজনীতির ভবিষ্যত নিয়ে কয়েকটি সহজ এবং বাস্তবসম্মত পরামর্শ দেয়ার আগ্রহ থেকে আমার এই লেখা।

কার্যকর ছাত্র সংসদ অপরিহার্য

প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদকে কার্যকর রাখা আবশ্যক, এবং নিয়মিত নির্বাচন আয়োজন করা উচিত। শিক্ষার্থীরাই নির্ধারণ করবে তাদের প্রতিনিধিদের মেয়াদ কতদিন হবে, তবে প্রতিনিধিদের অবশ্যই গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হতে হবে।

সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচনে আমরা দেখেছি যে, সুষ্ঠু ভোট আয়োজন করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অনলাইন ভোটিং এই সমস্যার একটি সম্ভাব্য সমাধান হতে পারে। যদি শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের সময় ডিজিটাল যোগাযোগের জন্য নিজস্ব নেটওয়ার্ক তৈরি করতে সক্ষম হয়, তাহলে একটি স্বচ্ছ ও নির্ভরযোগ্য অনলাইন ব্যবস্থা নির্মাণের বিষয়ে তাদের উপর ভরসা রাখা যেতেই পারে।

আমি সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদে অনলাইন ভোটিংয়ের মাধ্যমে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলাম। নির্বাচনে ভোটদানের প্রক্রিয়াটি বেশ সহজ ছিল। শিক্ষার্থীরা নিজেদের প্রাতিষ্ঠানিক ইমেইল ব্যবহার করে ইউনিয়নের ইলেকশন পোর্টালে লগ ইন করে এবং নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছিল। সন্ধ্যার মধ্যেই আমরা ফলাফল এবং নতুন কমিটি পেয়ে যাই। 

একটি সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে এবং দলবাজি রোধ করতে আমাদের প্যানেল গঠনের অনুমতি ছিল না। প্রত্যেক প্রার্থী স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নেয়। প্যানেল তৈরি করা অবৈধ ছিল এবং কেউ প্যানেল তৈরি করেছে, এমনটা প্রমাণিত হলে তার প্রার্থিতা বাতিল হওয়ার বিধান ছিল।

প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন লাভের জন্য প্রত্যেককে নির্ধারিত সময়ে পোর্টালে তাদের ইশতেহার জমা দিতে হতো এবং তা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত রাখা হতো যাতে স্বচ্ছতা বজায় থাকে। এমনকি নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরও আমাদের প্রোফাইল গুলোতে নির্বাচনী ইশতেহার সংযুক্ত ছিল, যাতে আমরা সবসময় আমাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকি।

হল গুলোকে রাজনীতির বাইরে রাখুন

যেহেতু বাংলাদেশের অধিকাংশ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এখন আর আবাসিক নয়, তাই ছাত্র সংসদ গুলোর উচিত হল ভিত্তিক নির্বাচনী ব্যবস্থা থেকে সরে আসা। এর পরিবর্তে বিভিন্ন অনুষদে আলাদা আলাদা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে, এবং অনুষদ ভিত্তিক নির্বাচিত কমিটি থেকে দুজন সদস্যকে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সভায় প্রতিনিধিত্ব করার জন্য পাঠানো যেতে পারে।

কক্ষ বরাদ্দ থেকে শুরু করে ক্যান্টিন তত্ত্বাবধান পর্যন্ত হলের সকল কার্যক্রম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ — প্রভোস্ট, হাউস টিউটর এবং অন্যান্য স্টাফ — পরিচালনা করবেন। শিক্ষার্থীরা যেন দ্রুততম সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে তাদের সমস্যা সম্পর্কে জানাতে পারে সেই ব্যবস্থা থাকতে হবে এবং হলগুলোর সমস্যা সমাধানে তাদের কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।

রাজনৈতিক কার্যক্রম, ব্যানার বা পোস্টার লাগানো এবং অন্যান্য প্রচার-প্রচারণা হলে বন্ধ রাখতে হবে। কোনো ছাত্র সংগঠনকেও হলভিত্তিক কমিটি গঠন করার অনুমতি দেয়া হবে না।

হল নিয়ন্ত্রণে রাখার রাজনৈতিক প্রণোদনা কমে গেলে হল কেন্দ্রিক সহিংস রাজনৈতিক কার্যক্রমও অনেকাংশে কমে যাবে।

ক্যাম্পাসে দলীয় ছাত্র রাজনীতি প্রসঙ্গে

বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় ছাত্র রাজনীতি থাকবে কি থাকবে না, এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের একটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা জরুরি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় ছাত্র সংগঠন গুলো নিষিদ্ধ না হলেও তাদের কার্যক্রম সীমিত করা প্রয়োজন।

রাজনৈতিক দলগুলো এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ এই সমস্যার সমাধান শান্তিপূর্ণভাবে করতে পারে।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের নিজ নিজ দলের অফিসে বা ক্যাম্পাসের বাইরের অন্য কোথাও রাজনৈতিক প্রোগ্রাম আয়োজন করতে পারে, যেখানে শিক্ষার্থীরা যোগদান করে তাদের মতামত জানাতে পারবে। এতে করে ছাত্র সংগঠনগুলো বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষার্থীদের অবস্থান জানতে পারবে এবং তাদের বিভিন্ন দাবি পূরণের জন্য যথাযোগ্য ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হবে। এক্ষেত্রে দলীয় রাজনীতির সাথে যুক্ত ছাত্র সংগঠনগুলো বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ ভিত্তিক কমিটির পরিবর্তে ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা এবং কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করতে পারে।

ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে রাজনৈতিক দলের অনুসারী ছাত্র সংগঠনের সদস্যদের তার পরিচয় এবং পদ সম্পর্কে ভোটারদের জানাতে হবে। তবে নির্বাচিত হলে তাদের সেই সংগঠন থেকে পদত্যাগ করতে হবে।

রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত বাংলাদেশের নতুন বাস্তবতাকে মেনে নেয়া এবং ছাত্রলীগ থেকে শিক্ষা নেয়া। মনে রাখতে হবে যে ১৫ বছর ধরে তারা হলগুলো নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং সেখান থেকেই নিজেদের কর্মী সংগ্রহ করেছে। কিন্তু জুলাইয়ের আন্দোলন যখন একটি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছায়, তখন তাদের হলছাড়া করতে লেগেছিল মাত্র কয়েক ঘন্টা। শিক্ষার্থীদের হাতে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী ও তাদের পৃষ্ঠপোষক আওয়ামী লীগ যে চূড়ান্তভাবে অপমানিত হয়েছিল, তা ছিল দেখার মত।

একটি নতুন ভোরের সামনে

জুলাই বিপ্লবে হাসিনার অপমানজনক পতনের সাথে সাথে তার ক্ষমতার ভিত্তিসমূহও তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে। তার ক্ষমতা কাঠামোর অন্যতম স্তম্ভ ছাত্রলীগেরও পতন হয়েছে আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে।

এখন আমরা সবাই জানি যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করে দীর্ঘমেয়াদে কোন লাভ হয়। বরং, ছাত্র সংগঠনের করা সহিংসতার ফলে রাজনৈতিকদলগুলো ভবিষ্যত ভোটারদের সমর্থন চিরতরে হারাতে পারে।

রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে তাদের ছাত্রনেতাদের সফলতার অন্যতম প্রধান মাপকাঠি হলো দলের সমাবেশে বড় জনসমাবেশ। সকল রাজনৈতিক দলকেই এই ধরণের মাপকাঠির ব্যবহার ও চর্চা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এর পরিবর্তে, ছাত্র রাজনীতির লক্ষ্য হওয়া উচিত ছাত্র সংসদে নির্বাচিত হওয়ার জন্য সমর্থন লাভ, যা বাস্তবসম্মত এবং ছাত্রবান্ধব নীতির মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব।

ছাত্র রাজনীতি আমাদের নতুন আশার আলোকবর্তিকা। রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এটা উপলব্ধি করা জরুরী যে, ছাত্র রাজনীতি নির্বাচনে জেতা বা রাজনৈতিক কর্মী সংগ্রহের কোনো হাতিয়ার নয়। বরং ছাত্র রাজনীতিকে ভবিষ্যৎ জাতি গঠনের একটি অপরিহার্য অংশ হতে হবে। 

জুলাই বিপ্লব প্রমাণ করেছে যে, দলীয় ছাত্র রাজনীতির প্রতিষ্ঠিত ধারা ধ্বংসাত্মক ছিল। এই ধারা আরও গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ ছাত্র রাজনীতি হাতে পরাজিত হয়েছে। এই বিষয়টি মেনে নেয়ার মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতির একটি গঠনমূলক ও ইতিবাচক ভবিষ্যতের সূচনা হতে পারে। যার হতে পারে বাংলাদেশের অগ্রগতির অন্যতম চাবিকাঠি।●

আকিব মো. সাতিল একজন গবেষক এবং নেত্র নিউজের কন্ট্রিবিউটর।