ঋণ কেলেঙ্কারিতে শেখ হাসিনার গোপন হাত

জনকণ্ঠ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ মারা যাওয়ার পরপরই তার প্রতিষ্ঠানের ঋণ অনিয়মিত হয়ে পড়ে। তবে মৃত্যুর আগে তিনি রেখে গেছেন বিভিন্ন নথিপত্র যেখান থেকে ইঙ্গিত মেলে কীভাবে শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে তার পক্ষে হস্তক্ষেপ করেছেন। 

ঋণ কেলেঙ্কারিতে শেখ হাসিনার গোপন হাত

জনকণ্ঠ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ ২০২০ সালের ২৩ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্যতম প্রভাবশালী একজন উপদেষ্টার কাছে একটি চিঠি লিখেছিলেন। সালমান ফজলুর রহমানকে লেখা ওই চিঠিতে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক থেকে ২৫০ কোটি টাকা ঋণের ব্যবস্থা করার আবেদন জানান তিনি। প্রধামন্ত্রীর বিনিয়োগ ও শিল্প বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত সরকারি দপ্তরগুলোর উপর অনানুষ্ঠানিক কর্তৃত্ব ছিল সালমান এফ. রহমানের। তবে কাউকে ঋণ দিতে কোনো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে নির্দেশ দেয়ার এখতিয়ার তার ছিল না।

দেশে তার মতো উপদেষ্টা ছিলেন বেশ কয়েকজন; মন্ত্রী ছিলেন ডজনখানেক। কিন্তু সালমান এফ. রহমান যেনতেন কোনো উপদেষ্টা ছিলেন না। তিনি ছিলেন দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী বেক্সিমকো গ্রুপের হর্তাকর্তা। আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেও সরকারের কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও তার বড় ভূমিকা ছিল। তিনি ছিলেন “সর্বোচ্চ স্তরের একজন খেলোয়াড়,” বলছিলেন একজন পশ্চিমা বিশ্লেষক।

তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের (মাঝ) আয়োজিত একটি সংবর্ধনায় একজন অতিথির সাথে আলাপচারিতায় সালমান রহমান (ডান), ঢাকা, ২০২২। ছবি: ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস / ফ্লিকার

তবে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তিনিই আবার ছিলেন জনতা ব্যাংকের অন্যতম বৃহৎ গ্রাহক। আর জনতা ব্যাংক থেকেই সাহায্য চাইছিলেন মাসুদ। হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রকাশ পাওয়া বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বেক্সিমকো গ্রুপ ও অন্যান্য সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানের ঋণের অংক ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। আর এই বিপুল অর্থের ৬০ শতাংশেরও বেশি গেছে জনতা ব্যাংক থেকে। 

অর্থাৎ, জনতা ব্যাংকে মাসুদের সমস্যার সমাধান যদি কেউ দিতে পারতেন, তিনি ছিলেন সালমান এফ. রহমান। আর চিঠিতে মাসুদ এমন একজন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেছেন, যার মুখ দিয়ে উচ্চারিত কোনো কথা উপদেষ্টার জন্য ছিল শিরোধার্য। মাসুদ চিঠিতে লিখেছেন, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলে দিয়েছেন সালমান এফ. রহমান যেন তাকে ঋণ পেতে সহায়তা করেন। 

আগের কোনো আলাপচারিতার অবতারণা করে তাই মাসুদ চিঠিতে লিখেছেন, “গণভবনে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে বিষয়টি অবহিত করি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি অনুধাবন করে এই ঋণটি অবিলম্বে অনুমোদন করানোর জন্য আপনাকে দায়িত্ব প্রদান করেন।”

চিঠির প্রেক্ষিতে দ্রুতই পদক্ষেপ নিয়েছিলেন সালমান এফ. রহমান। জনতা ব্যাংককে পাল্টা চিঠি লিখে মাসুদের ঋণ অনুমোদনের সুপারিশ করেন। কাগজে কলমে তার ওই চিঠির কোনো আনুষ্ঠানিক প্রভাব থাকার কথা নয়, কারণ ওই চিঠি ছিল কেবলই সুপারিশমূলক। কিন্তু জনতা ব্যাংক সঙ্গে সঙ্গেই এই বিষয়ে ব্যবস্থা নিয়ে আতিকুল্লাহ খান মাসুদের ২২৫ কোটি টাকার ঋণ আবেদন মঞ্জুর করে — অথচ, একই আবেদন ব্যাংকটি এর আগে প্রত্যাখ্যান করেছিল। 

ঋণ অনুমোদনের প্রক্রিয়াকে ঘিরে এই অদ্ভুত ঘটনা ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ঢাকা পোস্টের একটি প্রতিবেদনে উঠে আসে। সম্প্রতি ডেইলি স্টারপ্রথম আলো পত্রিকায় এসেছে কীভাবে সালমান রহমান এই ঋণের পক্ষে প্রভাব খাটিয়েছিলেন। তবে এই ঋণ অনুমোদনের নেপথ্যে শেখ হাসিনার আশীর্বাদ থাকার বিষয়ে মাসুদের লেখা চিঠির বর্ণনা এর আগে কোথাও প্রকাশিত হয়নি।

গত ১৫ বছর শেখ হাসিনা দোর্দণ্ড প্রতাপে বাংলাদেশ শাসন করেছেন। দেশে এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল যেখানে বহু কেলেঙ্কারির খবর প্রকাশিত হলেও হাসিনার ব্যক্তিগত সম্পৃক্ততার খবর কখনও প্রকাশ পায়নি। মাসুদের লেখা চিঠিটি কোনো বড় ধরণের দুর্নীতিতে ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনার সম্পৃক্ত থাকার প্রথম জ্ঞাত নজিরগুলোর একটি। এছাড়া কীভাবে শেখ হাসিনাকে তার ঘনিষ্ঠ চক্র বিভিন্ন কেলেঙ্কারি থেকে সুরক্ষিত রেখেছিল, তারও ইঙ্গিত মেলে এই পুরো অধ্যায় থেকে।

শেখ হাসিনার আশীর্বাদ

“খসড়া” চিহ্নিত মাসুদের মূল চিঠিটি তার কোম্পানির অফিসিয়াল ইমেইল ঠিকানা থেকে পাঠানো হয়েছিল। তবে ওই চিঠি জনতা ব্যাংকে পৌঁছায়নি। কারণ, ওই চিঠিতে হাসিনার নাম উল্লেখ করায় মাসুদকে ভর্ৎসনা করেছিলেন সালমান এফ. রহমান। বিষয়টি নেত্র নিউজকে জানান ওই কথোপকথনের ব্যাপারে ওয়াকিবহাল একজন ব্যক্তি।

এরপর হাসিনার নাম মুছে মাসুদকে চিঠিটি পুনরায় লিখতে বলা হয়। মাসুদের লেখা চূড়ান্ত চিঠি শেষ পর্যন্ত সালমান এফ. রহমানের মাধ্যমে জনতা ব্যাংকের নির্বাহীদের টেবিলে পৌঁছেছিল। সেইমতো চিঠিতে হাসিনার বিষয়ে কোনো বক্তব্য ছিল না। 

চিঠির মূল সংস্করণে মাসুদ অন্তত আরও দুইটি পূর্ববর্তী ঘটনার কথা উল্লেখ করেছিলেন যখন হাসিনা তার পক্ষে হস্তক্ষেপ করেছিলেন।

চিঠির শুরুতে নিজের বিরুদ্ধে বিরোধীদের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বিবরণ দিয়ে তিনি দাবি করেন, ১৪ বছর আগে শেষ হওয়া বিএনপি সরকারের আমলে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের উপর ভূতাপেক্ষ কর আরোপ করা হয়। সেসময় অত্যন্ত আওয়ামীপন্থী বলে পরিচিত জনকণ্ঠ পত্রিকাকে ওই সময় সরকারি বিজ্ঞাপন থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল বলেও তার দাবি। 

এছাড়া পরবর্তী সেনা-সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুই বছর কারাগারে থাকায় তার ব্যবসার আরও ক্ষতি হয়। তিনি বলেন, “উপরোক্ত ২ সরকারের রোষানলে পড়ে আমার অধিকাংশ শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায় এবং জনকন্ঠসহ অন্যান্য ব্যবসা বাণিজ্যের ব্যাপক ক্ষতির মাধ্যমে চরম আর্থিক সংকটে পড়ি।”

আওয়ামী লীগের প্রতি নিজের আনুগত্যের বিবরণ দিয়ে তিনি লিখেছেন, “জন্মলগ্ন হতে আজ পর্যন্ত ২৭ বছর প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত জনকণ্ঠ কার্যালয়ে আমি নিজে উপস্থিত থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তথা আওয়ামী লীগকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে পত্রিকা বের করে আসছি। আমি মনে করি কোন সম্পাদক পত্রিকার জন্য এত সময় ব্যায় করে না।”

শেখ হাসিনা কীভাবে তার এই আনুগত্যের প্রতিদান দিয়েছিলেন, তারও ফিরিস্তি উঠে আসে আতিকউল্লাহ মাসুদের ওই বর্ণনায়। 

মাসুদের বয়ানে, তিনি প্রথমবারের মতো ২০১৪ সালে শেখ হাসিনার “সাহায্য” নিয়ে জনতা ব্যাংক থেকে ২২১ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছিলেন। তবে তার অনুযোগ, ওই ঋণ থেকে তিনি ১২০ কোটি টাকা ব্যবহার করতে পেরেছিলেন; বাকি অর্থ সোনালি ব্যাংকে থাকা পূর্বের ঋণ পরিশোধে ব্যায় হয়েছিল। 

কিন্তু এরপর দুই বছর বাদেই খেলাপি হয়ে যান তিনি। কিন্তু ফের শেখ হাসিনার তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। 

“ঐ সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার এ অবস্থা জানতে পেরে সাবেক অর্থমন্ত্রীর মাধ্যমে জনতা ব্যাংক থেকে আবার ঋণ নিতে বলেন,” স্মরণ করেন মাসুদ। শেখ হাসিনার পরামর্শে এরপর তিনি তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতকে জানিয়ে ২০১৬ সালের আগস্টে জনতা ব্যাংকের কাছে ২৫০ কোটি টাকা ঋণ চান। কিন্তু তার ওই প্রচেষ্টা তখন ব্যর্থ হয়। কারণ হিসেবে মাসুদ জনতা ব্যাংকের “কিছু কিছু সরকার বিরোধী উর্ধ্বতন কর্মকর্তার চরম বিরোধীতা”কে দায়ী করেন। ফলশ্রুতিতে ২০১৯ সাল নাগাদ মাসুদের আর্থিক সমস্যা চরমে পৌঁছে। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল সংসদে মাসুদের গ্লোব-জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারকে বাংলাদেশের শীর্ষ ৩০০ ঋণ খেলাপির একটি হিসেবে উল্লেখ করেন।

“...২৭ বছর প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত জনকণ্ঠ কার্যালয়ে আমি নিজে উপস্থিত থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তথা আওয়ামী লীগকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে পত্রিকা বের করে আসছি। আমি মনে করি কোন সম্পাদক পত্রিকার জন্য এত সময় ব্যায় করে না।”

এরপর আবারও দৃশ্যপটে আসেন হাসিনা। মাসুদের বক্তব্য অনুযায়ী, এবার তার ঋণের বিষয়টি সমাধানের জন্য সালমান এফ. রহমানকে দায়িত্ব দেন তিনি। এরপর আর হতাশ হতে হয়নি তাকে; সমস্যার সমাধান হয়ে যায় দ্রুতই।

তৎকালীন সরকারি দপ্তরের মাধ্যমে হাসিনার কাছে এই বিষয়ে প্রশ্ন পাঠায় নেত্র নিউজ; তবে তখন কোনো জবাব দেননি তিনি। প্রশ্ন পাঠালে জনতা ব্যাংকও এই বিষয়ে কোনো বক্তব্য দেয়নি। বিভিন্ন অভিযোগে বর্তমানে কারাবন্দী সালমান এফ. রহমানের বক্তব্য নেওয়াও সম্ভব হয়নি। তার পুত্র শায়ান রহমানের কাছে ইমেইলে যোগাযোগ করেছে নেত্র নিউজ, তবে তিনি সাড়া দেননি।

গ্লোব-জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের কর্মকর্তারা নেত্র নিউজকে নিশ্চিত করে জানাতে পারেননি প্রতিষ্ঠানটির প্রয়াত মালিক চিঠিগুলো সালমান এফ. রহমানকে পাঠিয়েছিলেন কিনা। বর্তমান চেয়ারম্যান মাসুদের স্ত্রী শামীমা এ. খান এই বিষয়ে জানেন না বলে দাবি করেন প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা আফিজুর রহমান। তিনি বলেন, “এই ইমেইলের ব্যাপারে বা এই [আলাপচারিতার] ব্যাপারে কোম্পানির পারস্পেক্টিভে চেয়ারম্যান ম্যাডামের কোনো জ্ঞান নেই।” তবে প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংকিং বিষয়ক কর্মকর্তা বাদল সাহা জানান, জনতা ব্যাংক থেকে সর্বশেষ পাওয়া ঋণটি বর্তমানে অনিয়মিত। ঋণ নিয়মিত করতে অবন্ধকী বিভিন্ন সম্পত্তি বিক্রির চেষ্টার কথাও জানান তারা। 

হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির দুই মাস আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের খেলাপি বা মন্দ ঋণ রেকর্ড ১৫০০ কোটি ডলারে পৌঁছে, যা দেশের মোট বার্ষিক উৎপাদন বা জিডিপির প্রায় ৪%। কোভিড-১৯ মহামারী চলাকালে মাত্র দুই শতাংশ ঋণ পরিশোধ করে মাসুদের মতো বড় ঋণখেলাপিদের সহজ শর্তে ঋণ পুনর্গঠন করতে দেয়া হয়। ফলে সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। গত বছর জনতা ব্যাংক নিজেদের মন্দ ঋণ পুনরুদ্ধারের যেই লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল, তার মাত্র ১৩ শতাংশ পূরণ করতে পেরেছিল, যা পুরো ব্যাংকিং খাতের মধ্যে সর্বনিম্ন।●

[চিঠির অংশবিশেষের অনুলিপি প্রকাশের স্বার্থে এই প্রতিবেদন ঈষৎ সম্পাদনা করা হয়েছে।]