বাংলাদেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিতে হবে জাতিসংঘকে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সম্প্রতি ভাঙ্গা কিছু কাঁচের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে তার অতি-চর্চিত স্বভাবসুলভ কান্না-ভরা ভঙ্গিতে ছবি তুলেছেন। তার এই ফটোসেশনে অনুপস্থিত ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে নিরপরাধ প্রাণ সংহারের নির্মম সব দৃশ্য। এতগুলো ঝরে যাওয়া প্রাণকে বয়ান থেকে একেবারেই মুছে ফেলা হয়েছে।
হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতারা এখন তাদের চিরচেনা চিত্রনাট্য মেনে চলছে: কোনোভাবেই দায় নেয়া যাবে না, বিরোধী দলগুলোকে দোষারোপ করতে হবে, তদন্ত ও শাস্তির ওয়াদা দিতে হবে আর বিক্ষোভে রাস্তাঘাটের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে মায়াকান্না করতে হবে।
কিন্তু যেই শাসকগোষ্ঠী মানুষের প্রাণের চেয়ে সহায়-সম্পত্তিকে বেশি মূল্য দেয়, তাড়া এত এত মানুষ হত্যার তদন্ত করবে তা বিশ্বাস করা যায় না। যেই সরকার পরিণতির তোয়াক্কা না করে নাগরিকদের জখম ও খুন করে যেতে পারে, তারা নিজেদের কৃতকর্মের জন্য নিজেদেরকেই জবাবদিহির আওতায় আনবে — তা বিশ্বাস করা যায় না।
এই সরকার মিথ্যা বলে — যেমনটা বিক্ষোভের সময় ইন্টারনেট বন্ধ থাকা অবস্থায় সরকারি অপপ্রচার থেকে দেখা গেছে। তাই এই সরকার কোনো অবস্থাতেই নিজেদের অগুনতি মানবাধিকার লঙ্ঘনের সত্য প্রকাশ করবে না, করতে পারবেও না।
হাসিনা, আওয়ামী লীগ, তাদের ছাত্র সংগঠন ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী — এরা সবাই নিজেদের ধরাছোঁয়ার উর্ধ্বে মনে করে। আর বাংলাদেশে এই বিশ্বাসই নির্মম বাস্তবতা। তারাই নির্ধারণ করে দেয় সত্য কী। অধিকার ও ন্যায়বিচারের দাবি তাদের এক কান দিয়ে ঢুকেছে, অপর কান দিয়ে বের হয়েছে।
কেবলমাত্র বাংলাদেশের বাইরে থেকেই তাদের এই মিথ্যার বসতি উন্মোচন করার উপায় আছে। সৌভাগ্যক্রমে, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের সঙ্গে আপস না করেও এই মিথ্যা উন্মোচন করে দেয়ার আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা পৃথিবীতে বিদ্যমান রয়েছে।
২০২২ সালে জিনা মাসা আমিনির মৃত্যুর পর ইরানের বিক্ষোভে হতাহতের ঘটনা অনুসন্ধানের জন্য চাপের মুখে পড়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ। তারই ফলশ্রুতিতে জাতিসংঘ তদন্তের উদ্যোগ নেয়। জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনের দায়িত্বের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাসমূহ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করা, সত্যতা প্রতিষ্ঠা করা, ভবিষ্যতের আইনি কার্যক্রমের জন্য প্রমাণ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা এবং সংশ্লিষ্ট আংশীদারদের সম্পৃক্ত করা।
আবু সাঈদও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সাহস নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। নিজের প্রতিবাদের অধিকার প্রয়োগ করেছিলেন। তাকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। তার মৃত্যু ভিডিওতে ধারণও করা হয়। কিন্তু তাকে গুলিবিদ্ধ করা পুলিশ সদস্য কিংবা তাদের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা কিংবা এই সহিংস দমনপীড়নের পরিকল্পনায় জড়িত আওয়ামী লীগ নেতাদের কোনো বিচার হয়নি।
এই ধরণের অসংখ্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত হত্যার ঘটনা জবাবদিহিতার দাবি রাখে।
কিন্তু আওয়ামী লীগের অধীনে তেমনটা কখনই ঘটবে না। জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের স্বাধীন তদন্ত তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘের দায়টা এখানে একটু বেশিই — কেননা তাদের শান্তিরক্ষী কার্যক্রমে ব্যবহৃত যানবাহন ব্যবহার করে বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে। আর যারা সেই হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, তাদেরকেই জাতিসংঘ আবার সুদূর কোনো মহাদেশে শান্তিরক্ষী হিসেবে নিয়োগ দেয়।
বাংলাদেশের তরুণ আন্দোলনকারীরা সতর্কঘণ্টা বাজিয়েছে। এখন জাতিসংঘকে এমন একটি তদন্তের জন্য চাপ দেওয়ার দায়িত্ব বর্তায় দেশে ও বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি জনগণ ও বৈশ্বিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর উপর।
দিনশেষে জবাবদিহিতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করতেই হবে।