কেন যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমন করা যাচ্ছে না
শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রে ছাত্র বিক্ষোভ দমনের নিন্দা জানিয়েছিলেন। কিন্তু নিজ দেশের ছাত্র বিক্ষোভ দমন করতে চাইলেন তার চেয়েও নিষ্ঠুরভাবে।
ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে কয়েকদিন আগেই ফুঁসে উঠেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ইসরায়েলি হামলায় গাজায় হাজার হাজার শিশুসহ বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর দায় অনেকটাই বর্তায় দেশটির সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের উপর। দেশটির শিক্ষার্থীরা সেই বিষয়টিকেই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন।
দীর্ঘদিন এই আন্দোলন শান্তিপূর্ণ থাকলেও, কিছু কিছু ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পুলিশ ডেকে আনে। ফলশ্রুতিতে পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সহিংস সংঘাতও ঘটে। এখন ক্যাম্পাসগুলো শান্ত হয়ে আসলেও, শিক্ষার্থীদের বড় অংশ ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতি ধারণ করেন। আন্দোলন করতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের “ইহুদী-বিদ্বেষী” কিংবা “সন্ত্রাসবাদের সমর্থক” তকমাও পেতে হয়েছিল, কিন্তু তাদেরকে দমিয়ে রাখা যায়নি।
যেহেতু তরুণ এসব শিক্ষার্থীদের ডেমোক্রেটিক পার্টির সমর্থক হিসেবে দেখা হয়, সেহেতু দলটির নেতৃবৃন্দকে বিপাকে পড়তে হয়েছিল। এপ্রিলে পিউ রিসার্চ সেন্টারের জরিপে দেখা গেছে, ডেমোক্রেটিক পার্টির সমর্থক ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সী তরুণদের ৪৭% ফিলিস্তিনের প্রতি সহানুভূতি পোষণ করেন; আর মাত্র ৭% করেন ইসরাইলের প্রতি। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারার বয়স্ক রাজনীতিবিদরা এখনও মোটাদাগে ইসরায়েলের সমর্থক।
একদিকে নিজেদের তরুণ ভোটারদের ক্ষোভ নিবারণের চেষ্টা, অন্যদিকে মিত্র ইসরায়েলের প্রতি সামরিক, আইনি ও নৈতিক সমর্থন অব্যাহত রাখা — যেন “শ্যাম রাখি না কুল রাখি” অবস্থা। এই দোটানায় এক ধরণের কূটকৌশলের আশ্রয় নেয় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন। শিক্ষার্থীদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করার পাশাপাশি, বারবার প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়, বহিরাগতরা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অনুপ্রবেশ করেছে। বলাই বাহুল্য, এই বক্তব্য শিক্ষার্থীদের ক্ষোভকে প্রশমন করেনি।
এই আন্দোলন সামলাতে বাইডেনের যখন ত্রাহি ত্রাহি দশা, পৃথিবীর বিপরীত প্রান্তে বাংলাদেশে বসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতারা তখন ভিন্ন ছক কষছিলেন। সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে বাইডেন প্রশাসনের চাপের মুখে জেরবার হাসিনা “ঘর পোড়ার মধ্যে আলু পোড়া”র কৌশল অবলম্বন করলেন। যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশি ব্যবস্থার নিন্দা জানালেন তার দলের নেতা-মন্ত্রীরা। আলাদা করে “পুলিশি নিষ্ঠুরতা”র বিরুদ্ধে বক্তব্যও রেখেছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাসান মাহমুদ। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, “এ ঘটনা আমাদের দেশে বিক্ষোভ দমন করতে গিয়ে যদি পুলিশ করত, আমার প্রশ্ন এখন তাদের কাছে, তখন তারা কী করত?”
সচরাচর বাংলাদেশে বিক্ষোভ, বাকস্বাধীনতা সহ বিভিন্ন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো প্রায়ই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে। অতএব, যুক্তরাষ্ট্রের খেলায় যুক্তরাষ্ট্রকেই জব্দ করা গেছে — এসব ভেবে তখন আওয়ামী লীগ নেতারা পুলকিতও বোধ করেছেন হয়তো।
কিন্তু যখন বাংলাদেশের তরুণরা বিক্ষোভ শুরু করলেন, তখন হাসিনাশাহীর পুলিশ কী করলো?
গুলি চালিয়ে শিক্ষার্থীদের খুন করলো। সটান দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীর বুকে গুলি চালালো। নিষ্ঠুরভাবে বিক্ষোভ দমনের কারণে যুক্তরাষ্ট্র যদি এত নিন্দার্হ হয়, তাহলে আওয়ামী লীগ কেন বিক্ষোভ দমনের জন্য তার চেয়েও নিষ্ঠুরতর উপায় বেছে নিলো?
যুক্তরাষ্ট্রে যেমন শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে বহিরাগতদের অনুপ্রবেশের অভিযোগ তোলা হয়েছিল, শেখ হাসিনাও নিজের ভাষণে ঠিক তেমন দাবিই করলেন। সব দায় চাপালেন “বহিরাগত সন্ত্রাসী”দের উপর। অর্থাৎ, জনবিক্ষোভ দমনের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ সরকার মার্কিন সরকারের চেয়েও কয়েক কাঠি কঠোর।
যেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে হাসিনা এসব সহানুভূতির ভান ধরেছেন, সেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ হলো আন্তর্জাতিক আইনে নিরাপদস্থান হিসেবে স্বীকৃত হাসপাতালে হামলা করা। হাসপাতালের মতো আইন দ্বারা বিশেষভাবে রক্ষিত স্থানে গিয়ে হামলা করাকে মানবতা বিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। এমনকি সন্ত্রাসবাদীরাও সাধারণত হাসপাতালে হামলা করে না। সেখানে হাসিনার ছাত্রলীগ হাসপাতালে ঢুকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আক্রমণ করেছে একাধিকবার।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ আর ইসরায়েলপন্থী প্রশাসনের কাছ থেকে বিক্ষোভ দমনের কলাকৌশল আওয়ামী লীগকে শিখতে হয়নি। এগুলো আওয়ামী লীগের অনেক আগেই রপ্ত করা ছিল। কিন্তু, আওয়ামী লীগ যেটার জন্য প্রস্তুত ছিল না, সেটা হলো, বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাও যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষার্থীদের অনেক কৌশল রপ্ত করেছে। এই তরুণ প্রজন্ম, যাদেরকে জেনারেশন জি বা জেন-জি বলা হয়, তাদেরকে কোনো “ট্যাগ” দিয়ে কাবু করা যায় না। তারা এসব ট্যাগকে থোড়াই কেয়ার করে।
যুক্তরাষ্ট্রে যেমন শিক্ষার্থীদের “অ্যান্টি-সেমাইট” বা ইহুদী-বিদ্বেষী আখ্যা দিয়ে তাদের নৈতিক মনোবলকে দমানো যায়নি, তেমনি বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদেরও “জামাত-শিবির”, “ছাগু” কিংবা “রাজাকার” উপাধি দিয়ে দমানো যাচ্ছে না।
ইহুদী-বিদ্বেষ, মুসলিম-বিদ্বেষ বা কৃষ্ণাঙ্গ-বিরোধী বর্ণবাদ কোনটিই মিথ্যা নয়। এগুলোর অস্তিত্ব অবশ্যই আছে। কিন্তু যখন এসব বর্ণবাদের অজুহাত কাউকে কাবু করার জন্য অসৎ উদ্দেশ্যে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তখন এসব ট্যাগের ধার কমে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের তরুণ প্রজন্ম — এমনকি যারা ইহুদী তারাও — দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কে কেবল ইতিহাসের পাতাতেই পড়েছেন। পুরোনো প্রজন্মের অনেকে যেখানে অসহায় ইহুদীদের দেশ হিসেবে ইসরায়েলের প্রতি সহানুভূতি পোষণ করতেন, এখনকার প্রজন্ম সেখানে ইসরায়েলকে দেখছেন সম্পূর্ণ বিপরীতভাবে। তারা দেখছেন ইসরায়েল কোনো দুর্বল, দরিদ্র দেশ নয়, যাদেরকে প্রতি বছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সহায়তা দিতে হবে। আজকের ইসরায়েল দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিধর দেশগুলোর অন্যতম। তাদের রয়েছে পারমাণবিক অস্ত্র, শক্তিশালী সামরিক বাহিনী, যাদের উপর কোন আরব রাষ্ট্রই হামলা করতে চায় না, বরং বন্ধুত্ব পাতাতে চায়।
ইসরায়েল আর অত্যাচারের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে নেই, বরং তারাই এখন অত্যাচারী রাষ্ট্র — দখলদার শক্তি হিসেবে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করে রেখেছে, সামরিক শাসন জারি করে রেখেছে, তাদের উপর নিষ্ঠুর নির্যাতন, হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। এই ইসরায়েলের প্রতি এখন অনেক ইহুদী তরুণও সহানুভূতি পোষণ করেন না।
ঠিক তেমনই বাংলাদেশে একসময় হয়তো কেউ কেউ পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল, বা কেউ কেউ এখনও বাঙালিদের উপর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যাযজ্ঞের কথা অস্বীকার করার চেষ্টা করেন। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এসে এই প্রজন্ম দেখতে পাচ্ছে যে, স্বাধীনতা-বিরোধীতা এই দেশের প্রধান সমস্যা নয়। বাংলাদেশের কেউই মনে করে না বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়াটা ভুল ছিল।
বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা হলো, ঢাকাসহ সব বড় বড় শহর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠা, সামান্য স্বাস্থ্যসেবা পেতে ভারতে যাওয়ার দরকার পড়া, দেশের ব্যাংক লুট হয়ে যাওয়া, হাসিনার পিয়নদের শত কোটি টাকা বানানো আর পাচার করা, মূল্যস্ফীতির চাপে জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠা, তরুণদের কর্মসংস্থান না থাকা — এবং সর্বোপরি, এসব সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম এমন গণতন্ত্র না থাকা কিংবা দেশের শাসনপ্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণের কোন সুযোগ না থাকা। তরুণ প্রজন্ম আরও দেখতে পাচ্ছে যে, অত্যন্ত যৌক্তিক, রুটিরুজির প্রশ্নে কেউ কথা বললেও “জামাত-বিএনপি” কিংবা “রাজাকার” ট্যাগ পেতে হচ্ছে।
তাই শেখ হাসিনা যখন সার্টিফিকেট-ধারী মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতি ছাড়া গোটা বাংলাদেশের সকল মানুষকে রাজাকারদের কাতারে ফেলে দিলেন, শিক্ষার্থীরা ফুঁসবেনই। শিক্ষার্থীরা যখন রাগে-ক্ষোভে-অভিমানে “আমি রাজাকার” বলে স্লোগান দিলো, এর মানে এই নয় যে, তারা পাকিস্তান আমলে ফেরত যেতে চাইলো, যেখানে কিনা চাকরিবাকরিতে বাঙালিদের প্রতি বর্ণবাদমূলক বৈষম্য বিরাজ করছিল। তারা বরং “রাজাকার” শব্দটির ওয়েপনাইজেশন বা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের বিরুদ্ধেই কথা বললো। পাশাপাশি, তারা এও বুঝিয়ে দিলো, পুরোনো প্রজন্মের তৈরি করে আসা জঞ্জাল বহন করতে তারা ইচ্ছুক নয়। তারা সামনে যেতে চায়; প্রগতির পথে হাঁটতে চায়। তারা নতুন বাংলাদেশ দেখতে চায়। তারা স্বৈরাচারের বিদায় চায়।●