নারী ও শরীরের মালিকানা প্রসঙ্গ
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের নামে গ্রামের আদিবাসী নারীর শরীরে পুশ করা জন্মবিরতিকরণ ইনজেকশন, বিবাহের বাইরে নারীর সন্তানধারণের অধিকার না থাকা, কর্পোরেট নারীর সন্তানহীন থাকার সিদ্ধান্তকে সম্মান না করা এবং বিলবোর্ডে অর্ধনগ্ন নারী শরীরের প্রদর্শন বা জিন্স বা শাড়ী বা বোরকা পরতে বলা বা নিষেধ করা আসলে একই ব্যাপার।
সম্প্রতি রাজধানী ঢাকার দুটো এলাকায় দুই ধরণের আগ্রাসী আচরণ দেখা গেছে। বাড্ডা এলাকায় মসজিদে মাইকে ঘোষণা করে বলা হয়েছে, অত্র এলাকায় মেয়েরা জিন্স পরে এবং ছেলেরা হাফপ্যান্ট পরে ঘোরাঘুরি করতে পারবে না। আমার জীবদ্দশায় পুরুষের পোশাক নিয়ে ফতোয়া এই প্রথম শুনলাম। এই যে শব্দটা লিখলাম, ফতোয়া, এই শব্দের বহুল ব্যবহার গণমাধ্যমে, মূলত পত্র-পত্রিকায় দেখা যেতো নব্বুইয়ের দশকে। গ্রামদেশে প্রায়ই ফতোয়া দিয়ে দোররা মেরে মানুষকে অত্যাচার করা হতো, বলাবাহুল্য নারীদের ওপর এই নিপীড়নের মাত্রা বেশি ছিলো। প্রত্যন্ত গ্রামদেশের ফতোয়া কালচার রাজধানীতে দেখা যাচ্ছে, তা-ও আবার ২০২৪ সালে এসে। যদিও আমার জানা মতে দেশে আইন করে ফতোয়াবাজি বন্ধ করা হয়েছে।
এ তো গেলো পোশাক নিয়ে ফতোয়া, আরও ভয়াবহ ফতোয়া দেখা গেলো রাজধানীর উত্তরায়। মিছিল করে বলা হয়েছে, উত্তরার একটি নির্দিষ্ট মাঠে দুর্গাপূজা করা যাবে না, কারণ সেখানে ঈদের নামাজ হয়। এর আগে আওয়ামী সরকারের সময়েও দেখা গেছে কলাবাগান মাঠের একাংশে শেখ রাসেল শিশুপার্ক ও আরেকদিকে ক্রিকেট মাঠ করতে। কিছু ক্রিকেটার যদি এখন এসে বলে পিচ নষ্ট হয়ে যাবে এখানে দুর্গাপূজা করা যাবে না, তাহলেও তার একটা যুক্তি খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের এ ধরণের ফতোয়াবাজীতে আগ্রহ প্রকাশ করতে আমরা আগে দেখেছি। নারীর কর্মক্ষেত্রে ও বিদ্যায়তনে আংশ নেওয়ার অধিকার নিয়ে কথা বলার আস্পর্ধা দেখিয়েছিলেন তরুণ ক্রিকেটার তানজিম সাকিব। যদিও ক্রিকেটে প্রচলিত জুয়া-বাজির মতন অনৈসলামিক বিষয়াদি সম্বলিত একটি ক্ষেত্রে কাজ করে রুটিরুজি আয় করার বৈধতা নিয়ে তার তেমন মাথাব্যাথা দেখা যায়নি। কিন্তু ঈদের নামাজের সঙ্গে দুর্গাপূজা হওয়ার সংঘর্ষ তেমন একটা নেই, আনটিল অর আনলেস কোন একটা ঈদ অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে পড়ে। ঈদ যেমন খ্রিষ্টীয় বছরের যে কোন মাসেই হতে পারে, পুজার সময়ও তেমন তিথিলগ্ন ভেদে আগে পরে হতে পারে। সেটা বছরের শুরুতে ঠিক করে নেওয়াও যেতে পারে। ফতোয়া দিয়ে পূজা বন্ধ করবার মামার বাড়ির আবদার কেন?
প্রথম ফতোয়াটিকে সামাজিক মাধ্যমে হাস্যরসের সঙ্গেই ডিল করা হলেও দ্বিতীয়টিকে হেসে উড়িয়ে দেওয়ার কিছু নেই। এমনকি আমার মতে প্রথম ফতোয়াটিও সমান আগ্রাসী ও আবদারমূলক। পুরুষের ওপরও দাদাগিরি হয়েছে বলে নারীর ওপর করা ব্যাটাগিরি কোন অংশে কমে যায়নি। এ প্রসঙ্গে বছরখানেক আগের একটা ভিন্ন আঙ্গিকে ফতোয়াবাজীর ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে কিছু নারী শিক্ষার্থী আপাদমস্তক বুরখায় আবৃত হয়ে প্ল্যাকার্ড ধরে মানব বন্ধন করেন। তাদের প্ল্যাকার্ডে লেখা থাকে, অশালীন পোশাক নারীকে বিজ্ঞানী করে না, পণ্য করে- এই জাতীয় বাণী। এমনকি, বোন তোমার পোশাক আমাকে বিব্রত করে- এমন ধরণের কথাও লেখা ছিলো। নারীরা প্ল্যাকার্ড ধরেছে বলে ওটা যে ফতোয়াবাজী ছিলো না এমনটা বলা যাচ্ছে না। বরং এমন সরাসরি নারীর বিরুদ্ধে নারীকে আক্ষরিক অর্থেই দাঁড় করিয়ে দেওয়া থেকে পুরুষতান্ত্রিক ষড়যন্ত্রটুকুই আরও বেশি মাত্রায় স্পষ্ট হয়।
দুর্গাপূজা বন্ধ করতে চাওয়ার পেছনে ইসলামপন্থীদের জায়গাজমি (এ ক্ষেত্রে মাঠ) দখলের ষড়যন্ত্র ছাড়াও আরও একটি অভিসন্ধি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। কাছাকাছি সময়ে দুই ফতোয়া আসায় যোগাযোগটাও বুঝতে সুবিধা হচ্ছে। দুর্গাপূজায় দুর্গা ঠাকুরের প্রতিমা শাড়ী পরে থাকেন, সন্তানসন্ততি নিয়ে মায়ের ভূমিকায় হাজির হলেও তার হাতে অস্ত্র থাকে, পায়ের কাছে থাকে আহত বা নতজানু মহিশাসুর। সব মিলিয়ে দৃশ্যটিতে নারীকে শক্তিমতি মনে হয়, দুর্বল নয়, কারো অধীন তো নয়ই। এই ভিজুয়াল নিতে পারা ফতোয়াবাজ এই হুজুরদের জন্য অনেক কঠিন। আজ যারা জিন্স পরতে মানা করছে, কাল তারা শাড়ী পরতেও মানা করতে পারে। সে ক্ষেত্রে উত্তরার ওই নির্দিষ্ট মাঠে কেন, যে সব জায়গায় কোন ঈদের নামাজ হয় না সেসব স্থানেও দুর্গাপূজা বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব হবে। এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কিছুদিন পরপরই নারীর পোশাক নিয়ে অর্থহীন কিছু আলাপ উঠতে থাকে কেন? দীর্ঘ আওয়ামী সরকারের আমলে এই ধরনের আলাপ উঠলে সন্দেহ করতাম, নিশ্চয়ই তলে তলে এমন কিছু হয়ে যাচ্ছে যা জনগণকে জানতে দিতে চায় না সরকার ও পা-চাটা মিডিয়াগুলো। নতুন সরকারের সময়েও এই সন্দেহ আমার মনে জারি আছে। কিন্তু তারপরও বিষয়গুলোকে হেসে উড়িয়ে দেয়ার বা চুপ থাকার বাস্তবতা আর নেই বলেই মনে হচ্ছে।
নারীর পোশাক নিয়ে টানাটানি কেন হয়? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমি যা দেখতে পাই তা হচ্ছে, এখনও কোথাওই নারীর নিজের শরীরের ওপর এজেন্সি নেই। কোথাও বলতে বুঝাচ্ছি, পরিবার, কমিউনিটি, আইন, ধর্ম, রাষ্ট্র এমন সকল কিছুকেই। এখনও পর্যন্ত আমাদের দেশের নারীর সন্তান নেয়ার বা না নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার নেই বললেই চলে। স্বেচ্ছায় মা হতে বা না হতে পারেন অনেক নারী, তারা সংখ্যায় অতি নগণ্য, ওই আর্থসামাজিক বাস্তবতা সবার থাকে না। । সন্তান ধারণ একজন মানুষের শরীর নিয়ে সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তের জায়গা। জগৎ জুড়ে নারীর শরীরের ওপর এই সিদ্ধান্ত নেয় ব্যক্তি পুরুষ বা পরিবার বা সমাজ বা আইন বা কমিউনিটি বা রাষ্ট্র। নারীর শরীরের ওপর জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির সবচেয়ে বড় বড় পরীক্ষা নিরীক্ষাগুলো করা হয়। নারীর শরীর কোনদিনও নারীর নিজের হয় না, হয়নি। ফলে নারীর পোশাক নিয়ে আলাপও নবনিযুক্ত ইউনুস সরকারের প্রতি সন্দেহ বা বিগত হাসিনা সরকারের প্রতি ক্ষোভের মতন জাতীয় ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে আলোচনার টেবিলে স্থান পায়। যে শরীরই ব্যক্তির নিজের হয় না, তা ঢেকে বা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার তার কই থেকে আসবে?
পাঠক যদি স্মরণ করতে পারেন, ঢাকাই ছবিতে এক সময় সহিংসতা ও যৌনতা সম্বলিত কাটপিস তথা ‘অশ্লীলতা’ নিয়ে বিরাট সব আলাপ আলোচনা সমালোচনা হয়েছিল। সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র ফিরিয়ে আনার আহ্বান এসেছিল সর্বস্তরে। এক সময় তথাকথিত সুস্থ চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে মধ্যবিত্ত দর্শক হলমুখী হলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আ-আল মামুন এক প্রবন্ধে ব্যখ্যা করে দেখিয়েছিলেন, কেমন করে মোস্তফা সারয়ার ফারুকী পরিচালিত ব্যাচেলর ও হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত চন্দ্রকথার মতো সুস্থধারার চলচ্চিত্রেও ভায়োলেন্স, সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স ও যৌন সুড়সুড়িমূলক আলাপ ও ঘটনা দেখানো জারি থাকে। এই উদাহরণটা এখানে দিলাম এজন্য যেন আমাদের বুঝতে সুবিধা হয় নারীর পোশাক নিয়ে কথা বলা, আলাপ তোলা, তর্ক বিতর্ক, পক্ষ বিপক্ষ সকলেই আসলে একই ধ্যানধারণা বহন করে। বোরকার বিরোধিতা করা আর বিকিনির বিরোধিতা করা আসলে একই বিষয়, পক্ষ বা বিপক্ষের যুদ্ধংদেহিতা প্রকৃত প্রস্তাবে একই মনোভাব থেকে আসা। আর তা হচ্ছে নারীর নিজের শরীরের ওপর এজেন্সি স্বীকার না করা। এই স্বীকার না করার দৌড়ে পিছিয়ে নেই কেউই। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের নামে গ্রামের আদিবাসী নারীর শরীরে পুশ করা জন্মবিরতিকরণ ইনজেকশন, বিবাহের বাইরে নারীর সন্তানধারণের অধিকার না থাকা, কর্পোরেট নারীর সন্তানহীন থাকার সিদ্ধান্তকে সম্মান না করা এবং বিলবোর্ডে অর্ধনগ্ন নারী শরীরের প্রদর্শন বা জিন্স বা শাড়ী বা বোরকা পরতে বলা বা নিষেধ করা আসলে একই ব্যাপার।
তাই আমার মনে হয় পোশাক নিয়ে যে কোনো একজন ফতোয়াবাজ হুজুর এসে কিছু বললেই লাফিয়ে উঠে তার বা তাদের পোশাক বিষয়ক বক্তব্যের বিরোধিতা না করে আমাদের উচিৎ হচ্ছে আইনি পদ্ধতিতে তাদের মোকাবিলা করা, সরকার ও রাষ্ট্রকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দায়িত্ব দেখিয়ে দেয়া। জাত-ধর্ম, শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে নারীর আত্মনিয়ন্ত্রণের, চলাচলের, সিদ্ধান্ত গ্রহণের, এমন হরেক স্বাধীনতার পক্ষে আওয়াজ তুলতে থাকলে আর কোন পক্ষই নারীর শরীর তো দূরের কথা শরীরের আবরণ যে পোশাক তা নিয়েও টানাটানি করতে আসতে সাহস পাবে না। পোশাক নিয়ে আলাপে পোশাক নিয়েই কথা বলতে থাকলে মুক্তির পথ কেবল দীর্ঘই হতে থাকবে। ●
উম্মে রায়হানা একজন কবি ও সাংবাদিক । পড়াশোনা করেছেন উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ এবং ম্যাস কমিউনিকেশন এন্ড জার্নালিজমে।