ইউনূসের এক বছর ও দুরাশার সংস্কার
অগণতান্ত্রিক, অহংকারী, মানবাধিকারবিরোধী— ক্ষমতায় এক বছর কাটাতে না কাটাতেই মুহাম্মদ ইউনূসের যত্নে গড়া ভাবমূর্তি ভেঙে গিয়ে আসল চেহারা প্রকাশ পেয়েছে।

শেখ হাসিনা, যিনি দম্ভ করে বলতেন তিনি কখনো পালাবেন না, কিন্তু গণরোষের মুখে তাকে শেষ পর্যন্ত পালাতে হয়েছে। তার পালিয়ে যাওয়ার পরের প্রতিটি দিন তার সাড়ে পনেরো বছরের শাসনের তুলনায় ভালো কেটেছে। কিন্তু মানদণ্ডের দিক থেকে নিচুস্তরের এই শাসনকালকে ভাল থাকার মাপকাঠি হিসেবে দেখানো বাংলাদেশের নাগরিকদের প্রতি হাসিনার মতোই তাচ্ছিল্য প্রদর্শন।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি চ্যাথাম হাউসে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে নাগরিকদের প্রতি এই তাচ্ছিল্যই প্রদর্শন করেছেন নির্দ্বিধায়। সেখানে আরেকটি ব্যক্তিগত পুরস্কার গ্রহণের আগে তিনি এই মনোভাব দেখিয়েছেন। যদিও রাষ্ট্রের জন্য ওই পুরস্কার কোনো অর্থ বহন করে না। এরপরও সরকারি কর্মকর্তারা চিরাচরিতভাবে তার স্তুতিতে মুখে ফেনা তুলেছিলেন।
বাংলাদেশের নাগরিকদের ‘সবচেয়ে খারাপ’ বা ‘আগের চেয়ে ভাল আছে’র চেয়ে আরো অনেক ভাল কিছু প্রাপ্য। কিন্তু তাদের মানদণ্ডে বিচার করলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় থাকার মেয়াদ পার করে ফেলেছে ইতিমধ্যে।
ইউনুস কোনোদিনই বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে অতটা জনপ্রিয় ছিলেন না, যতটা তার তোষামোদকারীরা বিশ্বকে দেখাতে ও চাপিয়ে দিতে চেয়েছে। এ সত্য স্বীকার করার মতো বিনয় তার নেই। উপরন্তু আছে এক পর্বতসম অহংকার। ভাঙা সংবিধানকে পাশ কাটিয়ে সরকার চালাতে গিয়ে তিনি আমলাতন্ত্র ও বিচারব্যবস্থা তুলে দিয়েছেন ক্ষুদ্র স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর হাতে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দিয়েছেন সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে, আর রাজনৈতিক আদর্শ তুলে দিয়েছেন ধর্মীয় কট্টর ডানপন্থীদের হাতে।
এর ফলে গঠিত হয়েছে এমন এক সরকার, যারা সদর্পে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলেছে। এবং যে স্বৈরাচারী কাঠামো সংস্কারের কথা বলে দায়িত্ব নিয়েছে, তারা সেই স্বৈরাচারী কাঠামোই ব্যবহার করছে দৃঢ়ভাবে। ফলে জবাবদিহি ও ন্যায়বিচার, এবং তার জন্য একটি টেকসই ব্যবস্থা এখনও অধরা।
ইউনুস কোনোদিনই বড় রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ছিলেন না বা রাজনীতির ময়দানের বড় খেলোয়াড় তো ননই। তবুও, রাজনীতি নিয়ে তার বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে একটি বিষয় স্পষ্ট হয — তিনি নারী অধিকারের দৃঢ় সমর্থক। ২০০৭ সালে রাজনৈতিক দল গঠনের ব্যর্থ চেষ্টার সময় দ্য ডেইলি স্টার-এ তিনি এই ব্যাপারটিকে রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। শুধু এই একটি মাপকাঠি বিচার করলেও, নিজের প্রতিশ্রুতির মুখে তিনি নেতা হিসেবে ব্যর্থ হয়েছেন। নিজের বিশ্বাসকে সমুন্নত রাখার মতো সাহস তার নেই। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে নারীবিদ্বেষী ইসলামপন্থাকে জাতীয় মঞ্চ ও গুরুত্ব দিয়েছেন। যার ফলে নারীরা আজ বেশি ঝুঁকির মুখে এবং তাদের অধিকার ক্ষয়িষ্ণু।
সবচেয়ে বড় বিষয়, সাহস কখনোই ইউনুসের শক্তি ছিল না। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকারের কথা তিনি প্রায়শই বলেন, বিশেষত, যখনই তিনি পৃথিবী ঘুরে ঘুরে নিজের কার্বন ফুটপ্রিন্ট বাড়ান। কিন্তু বাংলাদেশের আদিবাসী, ধর্মীয়, লিঙ্গভিত্তিক ও রাজনৈতিক সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কার্যকরভাবে কথা বলা বা কাজ করার নজির তার ইতিহাসে নেই। তাই, তার শাসনকালে এসব সম্প্রদায়কে আরও প্রান্তে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
যখন একজন নেতা নিজ দেশের মানুষকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করার পক্ষে যুক্তি দেন এই বলে যে, সাধারণ মানুষ নির্বাচনের জটিলতা বোঝার মতো যথেষ্ট সক্ষম নয় এবং তাদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া তার কাছে গ্রহণযোগ্য — এ ধরনের নেতার কাছ থেকে মানবাধিকারের প্রতি সম্মান ও সুরক্ষার আশা করাটাই ভুল।
একজন অনির্বাচিত, অভিজাত প্রধান উপদেষ্টা এক বছর কাটিয়ে দিয়েছেন নিজের ব্যক্তিপূজার দুর্গ শক্তিশালী করতে। সেইসঙ্গে আত্ম-অহংকারের সাথে এমন এক সরকার চালিয়েছেন, যা জনগণের সেবায় বিনয়ী হওয়ার পরিবর্তে অগণতান্ত্রিক বাড়াবাড়িতেই আনন্দ পেয়েছে বেশি। ইংরেজিভাষী দুনিয়ার কিছু অংশে তার বেশ গ্রহণযোগ্যতা থাকলেও, বাংলাদেশের মানুষের কাছে ইউনুসের গন্ধময় পানীয়ের স্বাদ হাসিনার পচা মদের মতোই বিরক্তিকর। জনগণের কাছ থেকে দূরে, নিজের খোলসে বন্দী ইউনূস জনগণের ম্যান্ডেট পাননি। অবশ্য তা তিনি চানওনি।
তবে, অতি সম্প্রতি তিনি সুর পাল্টেছেন। তার সরকার যখন প্রথম বর্ষপূর্তি উদযাপন করছে, তিনি ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে সাধারণ নির্বাচন করার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেছেন।
হয়তো বাংলাদেশে এখনো সুস্থ বুদ্ধির জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়ে গেছে।●