নিষ্ক্রিয়তার ফলশ্রুতিতে সংবাদমাধ্যমে হামলা
সংকটকালে বারবার কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে বিরত থেকে উগ্র ডানপন্থীদের সহিংসতাকে দায়মুক্তি দেয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য এক আপদে পরিণত হয়েছে ইউনূসের সরকার।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্য অনুযায়ী, “কয়েকটি বিচ্ছিন্ন উগ্র গোষ্ঠী”ই যথেষ্ট বাংলাদেশকে অতল গহ্বরে ঠেলে দেওয়ার জন্য। “ধ্বংসাত্মক সকল কর্মকাণ্ডকে” তিনি “দৃঢ় ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিন্দা” করেন। আমরা তার প্রতি যারপরনাই কৃতজ্ঞ যে তিনি সাহসী শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করে দেশকে রসাতলে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। তবে তার প্রেস সচিবের জন্যও কিছুটা করুণা বোধ করুন। শফিকুল আলম “লজ্জায় নিজেকে মাটিতে পুঁতে ফেলতে” চান, কারণ তাকে ও তার নেতার বুকে পাথর চাপা দিয়ে নিজেদের চেনাজানা প্রেশার গ্রুপগুলোকে সহিংসতায় সক্ষম দাঙ্গাবাজ হিসেবে উল্লেখ করতে হচ্ছে!
১৮ ডিসেম্বর রাত থেকে ১৯ ডিসেম্বরের প্রথম প্রহর পর্যন্ত নিখুঁত পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে একের পর এক সহিংস হামলায় ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো পত্রিকার কার্যালয় এবং ছায়ানট সংস্কৃতি ভবনে ভয়ানক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। পত্রিকা দুটির কার্যালয় ও ছাপাখানায় হামলার সময় ভেতরে কাজ করছিলেন বেশকিছু কর্মী। হামলাকারীরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে উদ্ধারকাজেও বাধা দেয়। ডেইলি স্টারের কার্যালয়ের বাইরে হামলায় বাধা দিতে গেলে নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নূরুল কবিরকে মৌখিক ও শারীরিকভাবে হেনস্তা করা হয়। অথচ, প্রায় একঘণ্টা ধরে ইউনূসের দপ্তর, যার অতি সক্রিয় প্রেস উইং সাধারণত তাকে নিয়ে লাগাতার প্রশস্তিবাক্যে ডিজিটাল দুনিয়ায় বন্যা বইয়ে দেয়, তারা এক অস্বাভাবিক মৌনব্রত পালন করে বসে থাকে। আলমের নিজের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, এই সময়ে দিশাহারা অন্তর্বর্তী সরকার “উপযুক্ত ব্যক্তিদের ফোন করে সহায়তার ব্যবস্থা করার” চেষ্টা করছিল।
ইসলামিস্ট গোষ্ঠীগুলো যেখানে দিনের পর দিন প্রকাশ্যে তাদের পরিকল্পনাগুলো জানান দিয়ে যাচ্ছিল, এমনকি শরীফ ওসমান বিন হাদির মৃত্যুক্ষণকেই নিজেদের আক্রমণ শুরু করার সংকেত দিচ্ছিল, সেখানে তার এই আবেগঘন আবেদন ধোপে টেকে না। ঘটনার দিন, যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সে নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে সুপরিচিত ডানপন্থীদের মুখপাত্ররা দেশের অভ্যন্তরীণ কিছু বলয়ের সহযোগিতায় এই হামলায় উসকানি ও দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছে। আর দুর্বৃত্তরা মুহুর্মুহু আক্রমণে সেইসব নির্দেশনা বাস্তবে রূপ দিতে থাকে।
এগুলো কোনো ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। ইউনূস সরকারের আমলে এই একই অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত শক্তিগুলো নির্বিঘ্নে বিষোদ্গার ছড়িয়ে গেছে এবং ঢাকার ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারের ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ বাড়ি, বিভিন্ন বাসভবন, উপাসনালয়, মাজার, সমাধিসৌধ ও কবরস্থানের বিরুদ্ধে সহিংস দঙ্গলকে উসকে দিয়েছে। তাছাড়া ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক পত্রিকা দুটি এর আগেও এসব শক্তির লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। এমনকি ইউনূসের বাসভবন যমুনার কাছেই আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলনের সময় আল-কায়েদা মতাদর্শী জসীমউদ্দিন রহমানির নেতৃত্বে নামাজ আদায়ের ঘটনাও ঘটেছিল।
তবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সুবিচার করে বলতে হয় যে, প্রতিটি সহিংস ঘটনার পরই প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং ভীষণ পরিশ্রম করে নরম-সরম, নখদন্তহীন কিছু বিবৃতি প্রসব করেছে। ইউনূসের কানে যাদের কথা পৌঁছায়, সেই “উপযুক্ত” লোকেরা কারা – সে বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা থাকলে এই সরকারের প্রশাসনিক অদক্ষতা, অথর্বতা ও অকার্যকারিতার জন্য আর কারা দায়ী, তা বুঝতে কিছুটা সুবিধা হতো। অবশ্য ইউনূসের বহুলপ্রচারিত সংস্কার কর্মসূচির প্রধান উদ্দেশ্যই যদি হয় বিধ্বস্ত একটি দেশের সবচেয়ে দুর্বল দশায় চরম ডানপন্থী উগ্রবাদকে ধাত্রীসেবা দেওয়া, তাহলে অন্তর্বর্তী সরকার নিঃসন্দেহে সাফল্যের এক অনন্য নজির হয়ে থাকবে।
স্বরাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও দেশের প্রথম জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান করদাতাদের টাকায় দিব্যি বেতন নিয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার তদারকি করছেন, নাকি নিজেরাই পেছন থেকে এসবের কলকাঠি নাড়ছেন, সেটা স্পষ্ট নয়। মাত্র গত সপ্তাহেই আগামী নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থী হাদির ওপর ভারতে থাকা আওয়ামী লীগের সদস্যদের উসকানি ও পরিকল্পনায় হওয়া বর্বর হামলার পর অপরাধীরা অনায়াসে ভারতে পালিয়েও গেছে। এই হামলার আগে-পরে ব্যবস্থা নিতে প্রতি পদে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। পরবর্তীতে এই দুই দুলালের চোখের সামনেই বিদেশ থেকে আসা উসকানিতে সংগঠিত হয়ে ইসলামিস্টরা এই হত্যাকাণ্ডকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ পায়। এতকিছুর পরও সরকারের তরফ থেকে আসামিরা পায় কেবল “দৃঢ় ও দ্ব্যর্থহীন নিন্দা।”
রাষ্ট্র জানতো কী ঘটতে যাচ্ছে, কখন ও কোথায় তা ঘটবে এবং কারা তা ঘটাবে। তবু তা ঠেকাতে কোনো পদক্ষেপই তারা নেয়নি। এ অপরাধকে প্রশ্রয় দেওয়ার পরিণতি ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে: ১৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ফের উদীচীর কার্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়। অথর্ব ইউনূস সরকার যদি ন্যূনতম কর্তৃত্ব ও নৈতিক মর্যাদা ধরে রাখতে চায়, তবে তাকে তার এই স্বভাবসুলভ নিষ্ক্রিয়তা ঝেড়ে ফেলে অবিলম্বে চৌধুরী ও রহমানকে বরখাস্ত করতে হবে। তাদের ফাঁপা বুলি কেবল এ দেশের দীর্ঘদিনের ব্যাধি, দুর্বল শাসনব্যবস্থা ও সরকারি জবাবদিহিতার অভাবকেই জিইয়ে রাখছে। এভাবে আসল দায়িত্ব এড়িয়ে, কাজের কাজ না করে শুধু বড় বড় কথা বলার চর্চা জারি রাখলে, এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আদৌ আসন্ন নির্বাচনের মত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় সামলাতে সক্ষম কি না সে ব্যাপারে প্রশ্ন উঠবেই। এই পর্যায়ে এসে, তাদের মুখের “নিন্দা” আদতে এই বিশৃঙ্খল অবস্থাকে জিইয়ে রাখারই অজুহাত।●