চলছে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র গঠনের পুনঃপ্রস্তুতি

২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সরকার সরকারি চাকরিতে ভেরিফিকেশনের নামে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা যাচাইয়ের প্রথা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিলেও, এখনো এই প্রথা বলবৎ থাকার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। তবে কি আরেকটা কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রস্তুতি চলছে ভেতরে ভেতরে?

চলছে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র গঠনের পুনঃপ্রস্তুতি
অলঙ্করণ: সুবিনয় মুস্তফী ইরন/নেত্র নিউজ

গত বছরের ডিসেম্বরের শেষ দিকে, মেহেনাজ স্বর্ণা নামের একজন চাকরিপ্রার্থী তার ফেসবুক ওয়ালে লেখেন, তিনি কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। এমনকি তার পরিবারেরও কেউ কোনো দলের সঙ্গে যুক্ত নন। তিনি ও তার পরিবারের লোকজন রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কার্যকলাপের জন্য অভিযুক্তও নন। এরপরও ৪৩তম বিসিএসের গেজেটভুক্ত হওয়ার পরও তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। সব স্তরের পরীক্ষায় অংশ নিয়ে মেধার ভিত্তিতে তিনি যোগ্য বিবেচিত হয়েছিলেন। কিন্তু প্রথম গেজেট বাতিল করে সরকার আরেকটি গ্যাজেট প্রকাশ করে, যেখানে তিনি বাদ পড়েন। কেন তাকে বাদ দেওয়া হলো তার কোনো কারণ তাকে জানানো হয়নি। একমাত্র কারণ হিসেবে মনে করছেন, তিনি গোপালগঞ্জের বাসিন্দা, শুধু এই কারণেই তাকে রাজনৈতিক বিবেচনায় বাদ দেওয়া হয়েছে।

শিপন দে নামের আরেকজন চাকরিপ্রার্থী ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ঠিক কী কারণে তিনি ৪৩তম বিসিএসের গেজেট থেকে বাদ পড়লেন, তা জানেন না। কারণটা জানলে তিনি ৪৪তম বিসিএসের ভাইবার জন্য প্রস্তুতি নেবেন কি না, সে সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। তার পোস্টের নিচে মোমিত হাসান নামের একটি আইডি থেকে মন্তব্য করা হয়েছে, “উনি হিন্দু, এটুকু পরিচয়ই যথেষ্ট বাদ পড়ার জন্য”।

সম্প্রতি নেত্র নিউজে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ব্যক্তিগত তথ্য যাচাইয়ের (ভেরিফিকেশন) নামে সরকারি চাকরিতে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা যাচাই চলছে। সাধারণ বিমা করপোরেশনের দশম গ্রেডে জুনিয়র অফিসার পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে কয়েকজন প্রার্থীকে বাদ দেওয়া হয় বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন। ভুক্তভোগীদের একজন আশরাফুল ইসলাম জানান, সাধারণ বিমার দশম গ্রেডে জুনিয়র অফিসার হিসেবে একটা পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অর্জন করেন এবং প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হন। কিন্তু ভেরিফিকেশন বা গোয়েন্দা সংস্থার যাচাই প্রক্রিয়ার কারণে তার নিয়োগ আটকে গেছে। এর পর থেকে তিনি নিয়ম করে সাধারণ বিমা অফিসে গিয়ে খোঁজ নিয়েছেন এবং জানতে চেয়েছেন, তার অ্যাপয়েনমেন্ট লেটার ইস্যু হয়েছে কি না, না হলে কেন, ঠিক কোন কারণে লেটার ইস্যু হয়নি? কোনো জবাব পাননি তিনি।

নেত্র নিউজের প্রতিবেদনে একই রকম আরেকজন ভুক্তভোগী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী কাঞ্জিলাল রায় জীবন বলছিলেন, ৪৩তম বিসিএসের চূড়ান্ত গেজেট থেকে বাদ পড়েছেন তিনি। তার অভিযোগ, তিনিসহ ২২৭জন বাদ পড়েছেন। কিন্তু সরকার জানাচ্ছে না, তারা কেন বাদ পড়লেন।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০২৪-এর ১৫ অক্টোবর ৪৩তম বিসিএসের সুপারিশপ্রাপ্তদের যাচাই-বাছাই শেষে গেজেট প্রকাশিত হয়। ওই গেজেট বাতিল করে ৩০ ডিসেম্বর ২২৭ জনকে কোনো ধরনের ব্যাখ্যা ছাড়াই বাদ দেওয়া হয়। প্রার্থীদের লাগাতার আন্দোলনের মুখে শেষ পর্যন্ত ১৬২জনকে নিয়োগ দেওয়া হলেও বাদ পড়েন ৬৫ জন। অন্যদিকে এ সরকারই আওয়ামী লীগ আমলের ২৮তম থেকে ৪২তম বিসিএস পর্যন্ত বাদ পড়া ২৫৯জন প্রার্থীকে নিয়োগ দিয়েছে।

রাজনৈতিক বিবেচেনায় সরকারি চাকরি থেকে বাদ পড়া প্রার্থীদের নিয়োগদানের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে সুশাসন বা ন্যায়বিচারের দৃষ্টান্ত। কিন্তু চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হওয়ার পর একই বিবেচনায় (রাজনৈতিক) প্রার্থীদের বাদ দেওয়ার মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কোন ধরনের দৃষ্টান্ত হাজির করতে যাচ্ছে?

আওয়ামী কর্তৃত্ববাদী সরকার পৃথিবীর আর সব কর্তৃত্ববাদী সরকারের মতোই প্রশাসন সাজিয়েছিল অনুগত লোকজন দিয়ে। সরকারি চাকরিপ্রার্থীদের ভ্যারিফিকেশনের নামে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা যাচাইয়ের মতো অসভ্য ও অসাংবিধানিক প্রথাকে তারা উচ্চতর মাত্রা দিয়েছে। ফলে প্রশাসনের লোকজনের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার বদলে আনুগত্যই হয়ে উঠেছিল প্রধান মানদণ্ড। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রের যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থাকে, ন্যূনতম পেশাদারিত্ব ও সততা থাকে, তার কিছুই অবশিষ্ট থাকেনি।

ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায়, অ্যাডলফ হিটলারও নাৎসি জার্মানিতে প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদগুলো নাজি পার্টির সদস্যদের হাতে তুলে দেন, যার ফলে রাষ্ট্রযন্ত্র গণস্বার্থের বদলে দলের স্বার্থ রক্ষা করে। জোসেফ স্টালিন সোভিয়েত ইউনিয়নে নিজের প্রতি অনুগত কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিয়ে এক বিশাল প্যাট্রিমনিয়াল বুরোক্রেসি গড়ে তুলেছিলেন। মাও সেতুং-এর চীনেও কালচারাল রেভ্যুলুশনের সময় অনুগত পার্টি সদস্যদের মাধ্যমে প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করা হতো। মধ্যপ্রাচ্যে সাদ্দাম হোসেন ও হাফেজ আল-আসাদ নিজেদের জাতিগোষ্ঠী ও দলের প্রতি অনুগত লোকদের প্রশাসন ও সামরিক পদে বসিয়ে শাসন স্থায়ী করেছিলেন।

একাত্তর-পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে প্রশাসনের ওপর দলীয় প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ শুরু হয় মূলত শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়ই। পরবর্তীতে জিয়া ও এরশাদ যুগেও প্রশাসনে আনুগত্যের ভিত্তিতে নিয়োগ ও পদোন্নতির প্রবণতা দেখা যায়, যা পেশাদারিত্বের ক্ষতি করে এবং প্রশাসনকে রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত করে তোলে। পরবর্তীতে রাজনৈতিক দলগুলো সে ধারাকে স্থায়ী রীতিতে পরিণত করে। ক্ষমতার পালাবদলের সাথে সাথে প্রশাসনে বড় ধরনের রদবদলের রেওয়াজ তৈরি হয়। যে দল বা গোষ্ঠী ক্ষমতাসীন হয় তারা তাদের অনুগত লোকজনকে প্রশাসনে যুক্ত করতে মরিয়া হয়ে উঠে এবং ভিন্নমতের রাজনীতির সঙ্গে নিজের তো নয়, পরিবারের কারও দূরতম সম্পর্ক আবিষ্কৃত হলেও চাকরিপ্রার্থীকে অবাঞ্ছিত গণ্য করা হয়।

দার্শনিক জাঁ জ্যাক রুশোর মতে রাষ্ট্রের প্রশাসন সাধারণ ইচ্ছাদ্বারা পরিচালিত হয়, যা সকল নাগরিকের সম্মিলিত ইচ্ছা ও কল্যাণের প্রতিনিধিত্ব করে। এই সাধারণ ইচ্ছা সকল ক্ষমতার উৎস এবং এর উদ্দেশ্য হলো নাগরিকদের স্বাধীনতা ও সমতা নিশ্চিত করা। রুশো মনে করেন, রাষ্ট্রের ভিত্তি হলো একটি সামাজিক চুক্তি, যার মাধ্যমে নাগরিকরা তাদের প্রাকৃতিক স্বাধীনতা সাধারণ ইচ্ছার অধীনে সমর্পণ করে একটি নৈতিক সত্তা হিসেবে কাজ করে, যা রাষ্ট্রকে চালিত করে

ফলে আধুনিক রাষ্ট্রে জনগণের সামষ্টিক ইচ্ছাকে ধারণ করার মধ্য দিয়ে নিরপেক্ষ, যোগ্যতাভিত্তিক এবং নিয়মানুবর্তী প্রশাসন গড়ে ওঠে। অন্যদিকে কর্তৃত্ববাদী শাসনে এটি রূপ নেয় ব্যক্তিগত আনুগত্যের যন্ত্রে। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান দুর্বল হলে শাসকরা প্রশাসনকে ব্যক্তিগত আনুগত্যের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে নিজেদের ক্ষমতা স্থায়ী করে তোলে। ফলত, প্রশাসনে অনুগত লোক নিয়োগের প্রবণতা রাষ্ট্রযন্ত্রের পেশাদারিত্ব ও জবাবদিহিতা নষ্ট করে এবং গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

পৃথিবীর অভিজ্ঞানে আছে, কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা মূলত প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পায় অনুগত ও দলান্ধ আমলাতন্ত্রের মধ্য দিয়ে। শুধু মুজিব-জিয়া-এরশাদ নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি শাসক বা দলই (গণতান্ত্রিক-অগণতান্ত্রিক) বারবার কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে ধেয়ে গেছে। গোটা প্রশাসনকে করায়ত্ব করার মধ্য দিয়ে সর্বত্র স্ব স্ব রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রভাব জারি রাখার চেষ্টা করেছে। ফলে এ দেশে যেমন গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকতা পায়নি, তেমনি প্রশাসনও হয়ে উঠেনি পেশাদার।

রাষ্ট্র যদি একটি সামাজিক চুক্তি হয়ে থাকে, সে চুক্তির অক্ষুণ্ণতা রক্ষা ও বাস্তবায়নের কাজটি নিরবচ্ছিন্নভাবে সম্পন্ন করার দায়িত্ব প্রশাসনের; অর্থাৎ আমলাতন্ত্রের। বিশেষ করে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্র নামের সামাজিক চুক্তির পাহারাদার সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন। সে প্রশাসনকে যখন সঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থ ও এজেন্ডার অধীনস্ত করা হয়, তখন মূলত সামাজিক চুক্তিকে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে জনগণের সার্বভৌম কর্তৃত্বকেই খর্ব করা হয়।

আমলাতন্ত্রের বহুবিধ বিপদ ও সঙ্কট মেনে নিয়েও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এ বিভাগকে পেশাদার, নিরপেক্ষ ও কর্মতৎপর রাখার কাজটি নিরবচ্ছিন্ন রাখতে হয় জনগণের স্বার্থেই। সরকার যারা গঠন করেন তাদের অন্যতম কর্তব্যের মধ্যে পড়ে প্রশাসনকে দলনিরপেক্ষ রাখা। এমন কি প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্তদেরও এ মৌলিক নীতি অনুসরণ করতে হয় যে, তারা কোনো দলের আনুগত্য বা কোনো বিশেষ মতাদর্শদ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবেন না, তারা নিয়ন্ত্রিত হবেন জনগণের আইনদ্বারাই। এবং অবশ্যই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বার্থে রাষ্ট্র, সরকার ও দল— এ তিন পৃথক সত্ত্বাকে পৃথক হিসেবেই বিবেচনায় রাখতে হবে। কিন্তু স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দীকালেরও অধিক সময়ে আমাদের অভিজ্ঞতা ভীতিকর। ক্ষমতালিপ্সা, কর্তৃত্ববাদী মানস এবং লুটেরা চৈতন্যদ্বারা আচ্ছন্ন বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল— যারাই ক্ষমাসীন হয়েছে, তারাই দলকে মনে করেছে সরকার, সরকারকে মনে করেছে রাষ্ট্র, রাষ্ট্রকে মনে করেছে নিজেদের মেনিফেস্টো। সব একাকার করে ফেলা বা গুলিয়ে ফেলার মধ্যেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অবনমন, ভঙ্গুরতা এবং নীতিগত পরাজয় নিহীত আছে। এর মধ্য দিয়ে এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটা কালেক্টিভ লুম্পেনিটির প্রকাশ ঘটে, যা থেকে মুক্তি না ঘটলে এ দেশের গণতন্ত্রেরও প্রকৃত মুক্তি ঘটবে না।

বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জার যে, অর্ধশতাব্দীকালেরও বেশি সময়ে বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীকে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকে রাষ্ট্রনৈতিক মর্যাদা দিতে দেখা যায়নি। দলগুলো তাদের মর্জিমাফিক প্রশাসনের যেমন দলীয়করণ করে গেছে, তেমনি রাষ্ট্রকেও বানিয়েছে নিজস্ব মতাদর্শ, বিশ্বাস, নৈতিকতা ও স্বার্থসিদ্ধির উপকরণ। ফলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আইন, প্রশাসন ও বিচারব্যস্থা এখনো নিজ নাগরিকদের আস্থা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। গোটা রাষ্ট্রটাই থেকে গেছে আধাখেঁচড়া, অপরিপক্ক এবং ভঙ্গুর।

অপরদিকে যে সামাজিক চুক্তির উপর পৃথিবীর আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা দাঁড়িয়ে থাকে এবং একটা গণতান্ত্রিক রূপান্তরের দিকে ধাবিত হয়, তা বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বারংবার বিঘ্নিত হয়েছে। সামাজিক এই চুক্তিভঙ্গে নেতৃত্ব দিয়ে গেছে মূলত রাজনৈতিক দলগুলো। এছাড়া সামরিক বাহিনী ও আমলাতন্ত্রের কারও কারও ক্ষমতালিপ্সাও বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে রাষ্ট্রের ভঙ্গুরতার পেছনে। কিন্তু মোটাদাগে বলতে হবে, এ ব্যর্থতা রাজনৈতিক। ব্যর্থতা রাজনৈতিক দল ও সামাজিক শক্তিগুলোর।

এর ফলশ্রুতি হলো- গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকতা গড়ে না ওঠা, রাষ্ট্রের মৌলিক শর্তগুলো তৈরি না হওয়া এবং সর্বজনবাদী রাষ্ট্র হওয়ার সম্ভাবনা থেকে দূরে সরে যাওয়া।

ধর্ম-বর্ণ, দল-মত নির্বিশেষে রাষ্ট্রের নাগরিকদের যে সেবা ও নিরাপত্তা পাওয়ার কথা ছিল, তা নিয়তই লঙ্ঘিত হয়েছে। সামাজিক চুক্তিভঙ্গের এই প্রক্রিয়ার মধ্যেই একটা রাষ্ট্রের নিপীড়নবাদী হওয়ার সমস্ত শর্ত জড়িয়ে থাকে। এবং সেই নিপীড়নবাদী রাষ্ট্রের ছাঁচের মধ্যেই বারবার জন্ম নেয় স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিস্ট শাসক। সমাজের পরতে পরতে পুষ্টিলাভ করে ফ্যাসিবাদী মানসিকতা।

বাংলাদেশের সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদের ধারা ১-এ বলা হয়েছে, “প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে”। অন্যদিকে, সরকারি চাকরি আইন ২০১৮ অনুসারে, সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ গেজেট, অতিরিক্ত, নভেম্বর ১৪-২০১৮, চতুর্থ অধ্যায়, নিয়োগ, পদোন্নতি, পদায়ন, ইত্যাদি, [৭/১] ধারায় বলা হয়েছে, “এই আইনের আওতাভুক্ত কোনো কর্ম বা কর্মবিভাগে সরাসরি জনবল নিয়োগের ভিত্তি হইবে মেধা ও উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা।”

সংবিধান ও আইনের শর্ত লঙ্ঘন করে প্রশাসনে অনুগত লোক নিয়োগ যেমন ঘোরতর রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা তেমনি সরকারি চাকরিতে ভেরিফিকেশনের নামে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রক্রিয়া রাষ্ট্রবিরোধী তো বটেই একইসঙ্গে কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠার পূর্বপ্রস্তুতিও বলা চলে।

বাংলাদেশের ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান জনমনে বহু আকাঙ্ক্ষার জন্ম দিয়েছে। রাজনৈতিক-সামাজিক মহলে রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি সামনে চলে এসেছে। পুরনো কর্তৃত্ববাদী রীতিকে বিদায় দিয়ে নতুন, বৈষম্যহীন সামাজিক, রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আলাপকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও সংস্কারের বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে বলে জাহির করতে চাইছে। অর্থাৎ, রক্তাক্ত জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সর্বত্র একটা ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা হবে বলে আশা করেছিল সাধারণ মানুষ। কিন্তু এ পর্যন্ত কোথাও পরিবর্তনের বিন্দুমাত্র আভাস দেখা যায়নি।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের নয়া বন্দোবস্তের স্বরূপ কী তার কোনো নমুনাও হাজির করতে পারেনি এতদিনে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের উদ্যোগ হিসেবে ১১টি কমিশন গঠন করা হয়। সেসব কমিশনের নানা সুপারিশ ইতিমধ্যে জমা পড়েছে সরকারের কাছে। সেসব সুপারিশ রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে কীভাবে কাজে লাগাবে তারও কোনো কুলকিনারা হয়নি। উপরন্তু গঠিত ওইসব কমিশন যে কেবলই লোক দেখানো ছিল, তারই নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছে কিছু কিছু কমিশন-প্রধানের বক্তব্যে। সম্প্রতি এক বক্তৃতায় নারী সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভিন হক ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন, সংস্কার কমিশনের কার্যক্রমে নারী প্রতিনিধিত্ব উপেক্ষিত হয়েছে। সংবিধান প্রণয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নারীদের মতামতকে উপেক্ষা করা হয়েছে। তিনি মন্তব্য করেছেন, এ ধরনের তৎপরতা নারীবিবর্জিত ও বৈষম্যমূলক প্রক্রিয়ার প্রতিফলন।

নারী সংস্কার কমিশন যখন তাদের সুপারিশগুলো সরকারের কাছে জমা দিয়েছিল, তখন তার কয়েকটি সুপারিশকে কেন্দ্র করে দেশের কয়েকটি ধর্মাশ্রয়ী গোষ্ঠী উগ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল। বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল দল ও সংগঠন তখন অবমাননাকর ভাষায় আক্রমণ করে কমিশন প্রধান শিরীন পারভিন হককে। সভা-সমাবেশ করে প্রকাশ্যে নারীদের “বেশ্যা” বলে গালাগালও করা হয়। প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী যখন এ ধরনের কর্তৃত্ববাদী, জিঘাংসা ও বিদ্বেষপূর্ণ অবস্থান নেয় তখন সরকারকে দেখা যায় একেবারে নীরব ভূমিকায়।

এরপর থেকে নারী সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো নিয়ে আর কোথাও আলাপ হতে দেখা যায়নি। এমনকি এ নিয়ে সরকারের ভাবনা কি, পরবর্তী উদ্যোগ কী হবে, তার কিছুই জানা যায়নি। সবশেষ জুলাই সনদ ঘোষণার প্রক্রিয়াকে শিরীন পারভিন হক নারী-বিবর্জিত বলে আখ্যা দেন। বলেন, “সনদ ঘোষণার দিন থেকেই আমি বলেছিলাম, আজ আবারও সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্রাঙ্গণে পুরুষ শাসনের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঘটল। একটিও নারী সংগঠনের কণ্ঠ নেই। আমরা এ সনদকে গ্রহণ করতে পারি না, কারণ এতে নারী ও সমাজ সংস্কারের প্রশ্ন উপেক্ষিত।”

নারী সংস্কার কমিশনকে উপেক্ষা করার মধ্য দিয়ে কার্যত অন্তর্বতীকালীন সরকারের “ভাবাদর্শ” প্রকাশ পেয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রে ও সরকারে গণতন্ত্রপন্থী শক্তির চেয়ে দৃশ্যত উগ্র-ধর্মাশ্রয়ী, দঙ্গলবাজ, কর্তৃত্ববাদী শক্তির আধিপত্য প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসা খবর থেকে এ-ও জানা যাচ্ছে, প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে সেইসব প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির অনুগত লোকজনকে নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হয়েছে। কর্তৃত্ববাদী শক্তির আনুগত্য স্বীকার না করলেই তাকে “ফ্যাসিবাদের দোসর” ট্যাগ দেওয়া হচ্ছে।

প্রশাসনে অর্থাৎ সরকারি চাকরিতে লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে ভেরিফিকেশনের নামে রাজনৈতিক বিবেচনা একটা গুরুতর অবিচার। বছরের পর বছর এ অবিচার চলে আসছে সরকারি চাকরিপ্রার্থীদের ওপর। কিন্তু কোনো সরকারই এ অবিচারের রীতি রহিত করছে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মতো আপাত দল-নিরপেক্ষ সরকারও দঙ্গলবাজ, কর্তৃত্ববাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীদ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। ফলে সরকারি চাকরিতে নিয়োগপ্রক্রিয়া তাদের ভাবাদর্শদ্বারা প্রভাবিত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা জন্ম নিয়েছে নাগরিকদের মধ্যে।

নেত্র নিউজের প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, সরকারি চাকরিপ্রার্থীদের রাজনৈতিক পরিচয় যাচাই প্রক্রিয়ায় এখন দেখা হচ্ছে, কোনো প্রার্থীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের দূরবর্তী সম্পর্কও আছে কি না।

চাকরিপ্রার্থী নিজে, পরিবারের নিকটজনের কেউ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত না হলে, দূরবর্তী কোনো আত্মীয়-পরিজন জড়িত কি না তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রতিবেদনে গোয়েন্দারা চাকরিপ্রার্থীদের ব্যাাপারে মন্তব্য লিখছেন— “আওয়ামী লীগ মতাদর্শী”, “আওয়ামী লীগ মনোভাবাপন্ন”, “আওয়ামী লীগ সমর্থক”—ইত্যাদি। এবং সরকারের একজন উপদেষ্টা স্বীকার করেছেন, চাকরি আটকে যাওয়া বা গেজেট থেকে নাম বাদ পড়ার পেছনে গোয়েন্দা প্রতিবেদনই অন্যতম কারণ। এসব তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের জন্য সরকারকে নির্ভর করতে হয় গোয়েন্দা প্রতিবেদনের উপর। এর মধ্য দিয়ে যাচাই করা হয় চাকরিপ্রার্থী কতটা বিশ্বস্ত ও অনুগত হবেন।

যদিও চাকরিতে নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিচয় জানতে চাওয়ার বিধান বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে গত জুলাই মাসে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে আমরা জানতে পারি। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণ করার কথা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগের। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত যে বাস্তবায়নের মুখ দেখছে না, তার নজির দৃশ্যমান হচ্ছে সরকারি চাকরিতে “ভেরিফিকেশন” প্রথা এখনো বলবৎ থাকার মধ্য দিয়ে।

সম্প্রতি গণমাধ্যমের বরাতে জানা গেছে, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রশাসনে রদবদল ও পদায়নে জামায়াতপন্থীদের প্রভাব বাড়ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিএনপি। দলটির একটি সূত্র অভিযোগ করেছে, প্রশাসনে সচিব পর্যায়ে নিয়োগ, রদবদল ও পদায়নের ক্ষেত্রে জামায়াত ঘরানার কর্মকর্তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। বিশেষভাবে প্রশাসনসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে তাদের লোকদের পদায়ন করা হচ্ছে, অথচ বিএনপির কোনো সুপারিশই বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না।

এসব তথ্য জনপ্রশাসনের অবস্থা সম্পর্কে যে ধারণা তৈরি করে, তা কোনোভাবেই সুখকর নয়। উপরন্তু উদ্বেগ ও হতাশা বাড়িয়ে তোলে। প্রশাসনের দলীয়করণে সব পক্ষের যারপরনাই তদ্বির, আমলাতন্ত্রকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির ধান্দা নিজেদেরই গড়ে তোলা রাষ্ট্রের প্রতি অনাস্থাকে দৃশ্যমান করে। এ বাস্তবতায় সরকারি চাকরিতে প্রার্থীদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা যাচাইয়ের রীতি নাগরিকদের সার্বভৌম মর্যাদাকে ভুলুণ্ঠিত তো করছেই, রাষ্ট্রকেও করে তুলছে কর্তৃত্ববাদী এবং ভঙ্গুর।●

রহমান মুফিজ, বাংলা সম্পাদক, নেত্র নিউজ।