শুধু কথায় দুনিয়ার ক্ষত সারবে না
বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন নীতি হলো কিছু নিরীহ, আত্মতুষ্টিকর স্লোগান, যা তহবিল সংগ্রহে সহায়তা করতে পারে। কিন্তু জীবন কিংবা পরিবেশ রক্ষায় কিছুই করে না। দেশের টিকে থাকা নির্ভর করছে এই নীতির পরিবর্তনের ওপর, যা অবশ্যই জলবায়ুর চেয়েও দ্রুত হতে হবে।

বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের রাজনীতি কখনও বৈজ্ঞানিক সত্য এবং সেই সত্যকে অস্বীকার করার মতো বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্কের বিষয় ছিল না। বিশ্বজুড়ে ঘনীভূত এই সংকটের সরাসরি শিকার হওয়ায়, পশ্চিমা বিশ্বায়ন এখানকার ইংরেজিভাষী অভিজাতদের চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করলেও, বাংলাদেশের পক্ষে বাস্তবতা অস্বীকার করার মতো বিলাসিতা করার সুযোগ ছিল না। এর পরিবর্তে, বাংলাদেশে জলবায়ু সংকটকে একটি রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে, যার মাধ্যমে বিভিন্ন গোষ্ঠী ও ব্যক্তি নিজেদের আখের গুছিয়েছে এবং নিজেদের ব্যক্তিগত প্রভাব বাড়িয়ে এক ধরনের অনুসারী তৈরি করেছে।
২০১৭ সালে দাভোসে আল গোরের সামনে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা যখন তার আওয়ামী লীগ সরকারের একটি জলবায়ু তহবিলকে (যা পরে তার বাবার নামে নামকরণ করা হয়) বাংলাদেশের রাজনীতির কেন্দ্রে নিয়ে আসেন, তখন থেকেই এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়। এই তহবিলে প্রতিশ্রুত ও জমা হওয়া কোটি কোটি টাকার হদিস আজও অজানা। তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বাংলাদেশের মানুষ এ থেকে কোনো উপকারই পাননি। দুর্যোগ পরবর্তী ত্রাণ কার্যক্রম ছাড়া (যা প্রায়শই অবকাঠামো উন্নয়নের সাথে যুক্ত এবং দুর্নীতির আখড়া) আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করার জন্য কোনো নীতিগত উদ্যোগ বা বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার— যাদের প্রধান শক্তি হচ্ছে সাহায্য, দাতা এবং অনুদানের মতো পশ্চিমা বুলিতে পারদর্শী সুশীল সমাজের কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি, তারা যখন একটি সাধারণ নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন এই ঘটনাটি ভবিষ্যতের রাজনীতির জন্য একটি সতর্কতামূলক দৃষ্টান্ত হওয়া উচিত। পরিবেশ নিয়ে তাদেরই সবচেয়ে বেশি ভাবার কথা। অথচ, ক্ষমতায় থাকার এক বছরেও তারা বিষয়টিকে দেশের রাজনীতির কেন্দ্রে আনার জন্য কোনো কাঠামো তৈরির কথা ভাবেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবেশ বিশেষজ্ঞের একমাত্র উল্লেখযোগ্য নীতি ছিল প্লাস্টিকের ব্যাগ নিষিদ্ধ করার মতো একটি পুরোনো ও অকার্যকর প্রসঙ্গকে আবার সামনে নিয়ে আসা।
এই সরকারের অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বিদেশী বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বুক ফুলিয়ে ছবি তুললেও, তাদের মধ্যে কেউই পরিবেশবান্ধব কোনো অর্থনৈতিক রূপরেখা নিয়ে ভাবেননি, পরিবেশকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা তো বহু দূরের বিষয়। তাদের ব্যর্থ সংস্কার কর্মসূচির মধ্যে পরিবেশের জন্য কোনো কমিশন গঠন তো দূরের কথা, সরকারের কর্তাব্যক্তিরা শব্দটি উচ্চারণ করারও আগ্রহ দেখাননি, সংবিধানে একে স্থান দেওয়ার কথা তো ভাবাই যায় না। নারী, আদিবাসী এবং ধর্মীয় ও লৈঙ্গিক সংখ্যালঘুদের স্বার্থের বিনিময়ে যখন ইসলামপন্থী ডানপন্থীদের তোষামোদ করা হয়েছে, তখন একজনও সত্যিকারের পরিবেশ বিশেষজ্ঞের দেখা মেলেনি, যা তাদের রাজনৈতিক চিন্তা ও সদিচ্ছার ভয়াবহ ঘাটতিকে প্রকাশ করে।

প্রধান উপদেষ্টা যখন নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, “সরকার সমাধান নয়, সমাধান হলো এই পৃথিবীতে বসবাসকারী মানুষ,” তখন সতর্কতার ঘণ্টা জোরে বেজে ওঠা উচিত। ব্যক্তিগত জীবনে মুহাম্মদ ইউনূস একদিকে শূন্য কার্বন নিঃসরণের কথা প্রচার করেন, অন্যদিকে প্রচুর কার্বন নিঃসরণ করে বিশ্বজুড়ে ঘুরে বেড়ান। এর মধ্যেকার বৈপরীত্য তিনি কখনও খেয়াল করেননি। আর সরকারের প্রধান হিসেবে তিনি সরাসরি সব দায়িত্ব অস্বীকার করে ভুক্তভোগীদের ওপরই দোষ চাপানোর একটি পরিবেশ তৈরি করেছেন। কোনো ভূমিকাতেই তিনি বাংলাদেশের মাটিতে জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় সামান্য কোনো পদক্ষেপও নেননি।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে বেঁচে থাকার দৈনন্দিন বাস্তবতা হলো অপুষ্টি, মহামারী, মানসিক যন্ত্রণা এবং দারিদ্র্যের এক অন্তহীন স্রোত, যেখানে পানীয় জল, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, জীবিকা এবং স্থায়ী আশ্রয়ের কোনো সুযোগ নেই। এর বাস্তবতা হলো, ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত এবং অসুস্থ শরীরে মাইলের পর মাইল হেঁটে কাজ, জল, খাবার বা ওষুধের সন্ধান করা, যেন একদিন শত শত মাইল পাড়ি দিয়ে নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে বড় শহরে একজন অবাঞ্ছিত শরণার্থীতে পরিণত হওয়া যায়। এর কোনোটির জন্যই সাধারণ মানুষ দায়ী নয়, আর তারা একা এর সমাধানও করতে পারবে না। যদি কোনো বাংলাদেশি সরকার এর সমাধান দিতে না পারে, তবে তার উচিত দায়িত্ব অস্বীকার না করে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানো। পশ্চিমাদের তো এখনো জড়িয়ে ধরার মতো কিছু গাছ অবশিষ্ট আছে। ●