নতুন জরিপ: বছর শেষে নির্বাচন চায় অধিকাংশ বাংলাদেশী
একটি জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশিরা সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক রূপান্তরের চেয়ে নিত্যদিনের রুটি-রুজির সমস্যার সমাধান প্রত্যাশা করে।

চলতি বছর ২০২৫ শেষ হওয়ার আগেই জাতীয় নির্বাচন প্রত্যাশা করছেন অধিকাংশ বাংলাদেশী। জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং কর্মসংস্থান সঙ্কোচন তাদের প্রধান উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে। শনিবার প্রকাশিত একটি জরিপে উঠে এসেছে এমন চিত্র।
জরিপে অংশ নিয়ে ৫৮ দশমিক ১ শতাংশ উত্তরদাতা ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে মত দিয়েছেন, যেখানে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ (৩১ দশমিক ৬ শতাংশ) জুন মাসেই নির্বাচন আশা করেছেন। মাত্র ১১ শতাংশ উত্তরদাতা ২০২৬ সালেরও পর নির্বাচন করার পক্ষে মত দিয়েছেন।।
২০২৪ সালের আগস্টে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের সময়সূচী নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) মনে করে ২০২৫ সালের আগস্টের মধ্যে ভোট অনুষ্ঠিত হতে পারে। অন্যদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা যুক্তি দিচ্ছেন, প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করার পর নির্বাচন করতে হবে।
কবে নাগাদ নির্বাচন আশা করছেন?
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে সম্ভাব্য নির্বাচনের সময় নির্ধারণের পরামর্শ দিয়েছেন। তবে নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), যা “ছাত্র-নেতৃত্বাধীন দল” হিসেবে পরিচিত, তার নেতা নাহিদ ইসলাম সন্দেহ প্রকাশ করে রয়টার্সকে বলেছেন, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ২০২৫ সালের নির্বাচনকে কঠিন করে তুলবে।
ইনোভিশন কনসাল্টিং পরিচালিত এই জরিপে ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত ৬৪টি জেলার ১০,৬৯৬ জন ভোটার অংশ নেয়। বাংলাদেশ রিসার্চ অ্যানালাইসিস অ্যান্ড ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক (ব্রেইন) এবং ভয়েস ফর রিফর্ম নামের এক্টিভিস্টদের একটি সংগঠন এই জরিপ কাজের প্রচারণা ও নীতি বিষয়ক কার্যক্রমে সহায়তা প্রদান করেছে।
মাঠে এগিয়ে বিএনপি ও জামায়াত
জরিপে দেখা গেছে, ২৯ শতাংশ ভোটার এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি তাঁরা কাকে ভোট দেবেন। যারা মনস্থির করেছেন তাদের মধ্যে ৬৫ শতাংশ তাদের পছন্দের দলের নাম প্রকাশ করতে সম্মত হন।
জরিপে যাঁরা আগামী নির্বাচনে কোন দলকে ভোট দেবেন সেই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন এবং তা প্রকাশ করেছেন তাঁদের মধ্যে ৪১ দশমিক ৭ শতাংশ বিএনপির প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। পুরনো প্রজন্মের বিশাল একটি অংশের সমর্থন পাচ্ছে দলটি। পাশাপাশি সমর্থন পাচ্ছে তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশেরও। বিশেষ করে মিলেনিয়ালদের (যাদের জন্ম ১৯৮১-১৯৯৬ সালে) ৪০ শতাংশ দলটির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। তা ছাড়া, দেখা যাচ্ছে দেশের অধিকাংশ বিভাগে ভোটারদের শীর্ষ পছন্দে রয়েছে বিএনপি।
জরিপ অনুসারে ৩১ দশমিক ৫৬ শতাংশ সিদ্ধান্ত নেওয়া ভোটাররা সমর্থন জানাচ্ছে জামায়াতে ইসলামীকে। পুরনো প্রজন্মের মধ্যে বিএনপির চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে দলটি। তবে জেনারেশন জেডের অংশগ্রহণকারী (জন্ম ১৯৯৭-২০১২), যাঁরা ছিল উত্তরদাতাদের মধ্যে ৩৬ শতাংশ, তাদের মধ্যে বিএনপি-জামায়াতের প্রতি সমর্থন প্রায় সমান। জেনারেশন জেড জুলাই গণআন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে । তাদের সমর্থনেই নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে নতুন রাজনৈতিক দল। এরপরও বিএনপি এবং জামায়াত উভয় দল এই প্রজন্মের প্রায় ৩৫ শতাংশ থেকে সমর্থন পাচ্ছে।
রংপুর এবং খুলনার কিছু অংশে জামায়াতের শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে, যেখানে অর্ধেকেরও বেশি উত্তরদাতা দলটিকে সমর্থন করেছেন।
২০২৪ সালে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশব্যাপী আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে মাত্র ১৪ শতাংশ ভোটার আওয়ামী লীগকে তাদের পছন্দের জায়গায় রেখেছে। যদিও বরিশালে তুলনামূলকভাবে এ সমর্থন এখনও কিছুটা বেশি। জেনারেশন জেড উত্তরদাতাদের মধ্যে মাত্র ১১ দশমিক ৩ শতাংশ আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে।
যখন জরিপ চলছিলো তখন ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের নেতৃত্বে জাতীয় নাগরিক পার্টি আত্মপ্রকাশের অপেক্ষায় ছিল। জরিপে ভোটের সিদ্ধান্ত নেওয়া উত্তরদাতাদের মধ্যে সিদ্ধান্ত জানাতে প্রস্তুত ভোটারদের ৫ দশমিক ১৪ শতাংশের পছন্দের তালিকায় উঠে এসেছে নতুন এ দলটি। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী এবং ময়মনসিংহে বিশেষভাবে জনপ্রিয় বলে মনে হচ্ছে দলটিকে।
এদিকে, এক সময় বাংলাদেশের রাজনীতিতে কিংমেকার হিসেবে বিবেচিত জাতীয় পার্টি প্রায় রাজনৈতিক পতনের মুখে পড়েছে। দলীয় সমর্থন প্রকাশ করেছেন এমন সমর্থকদের মাত্র ১ শতাংশের বেশি তাদের পক্ষে আছেন। তাদের শক্ত ঘাঁটি রংপুরে তারা সমর্থন পেয়েছে মাত্র ২ দশমিক ৩ শতাংশের।
সামগ্রিকভাবে বিএনপি এবং জামায়াত উভয়ই নারীদের তুলনায় পুরুষ ভোটারদের কাছ থেকে প্রায় সমহারে বেশি সমর্থন পেয়েছে, যেখানে আওয়ামী লীগ এবং ছাত্র-নেতৃত্বাধীন দলের প্রতি পুরুষদের তুলনায় নারীদের সমর্থনের হার বেশি দেখা গেছে।









উদ্বেগের শীর্ষে মুদ্রাস্ফীতি এবং নিরাপত্তা
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি প্রত্যাশার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে বেশিরভাগ উত্তরদাতা ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, ক্রমবর্ধমান অপরাধ এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির মন্থরতার বিষয়ে উদ্বেগ তুলে ধরেন। ২০২৩ সাল থেকেই মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশের আশেপাশে থেকেছে, যা পারিবারিক বাজেটকে চাপের মধ্যে ফেলেছে, অন্যদিকে অপরাধ বৃদ্ধি জননিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা তৈরি করেছে।
দশজনের মধ্যে প্রায় সাতজন উত্তরদাতা আশা করেন, সরকার অবিলম্বে মূল্যবৃদ্ধি মোকাবেলা করবে। তবে অর্ধেকেরও কম উত্তরদাতা মনে করেন, তাদের উদ্বেগগুলো পর্যাপ্ত মাত্রায় সমাধান করা হয়েছে।
একই সময়ে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সংস্কার, বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন এবং সাংবিধানিক সংশোধনী কার্যকর করার ব্যাপারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তরফ থেকে তুলে ধরা যুক্তিগুলো তুলনামূলকভাবে কম বিবেচনায় রেখেছে উত্তরদাতারা।
তবে ১০ শতাংশেরও কম উত্তরদাতা বলেছেন যে, এই বিষয়গুলো বর্তমান সরকারের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত।
মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্র সংস্কারের জন্য এক ডজনেরও বেশি কমিশন গঠন করেছে। এসব প্রচেষ্টার পরও জরিপটি এমন ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, মূল অর্থনৈতিক এবং জননিরাপত্তা চ্যালেঞ্জগুলোর অগ্রগতি ভোটারদের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে।
৪২ শতাংশেরও বেশি উত্তরদাতা বলেছেন, মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে তাদের উদ্বেগ "আংশিকভাবে" পূরণ হয়েছে আর অর্ধেকেরও বেশি উত্তরদাতা মনে করেন, এ সঙ্কট থেকে মুক্তি মেলেনি। একই অংশ মনে করেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে তাদের উদ্বেগ এখনও অমীমাংসিত। ৭০ শতাংশেরও বেশি ভোটার বলেছেন, কর্মসংস্থান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।
৪১ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর থেকে চাঁদাবাজি বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় অর্ধেক অংশ মনে করেন পরিস্থিতি হয় অপরিবর্তিত বা চাঁদাবাজি হ্রাস পেয়েছে।
ভবিষ্যতের দিকে তাকালে জরিপে দেখা যাচ্ছে যে, পরবর্তী সরকার ব্যাপক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে এমন বিষয়গুলোর তালিকায় শীর্ষে রয়েছে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, ব্যাপক অপরাধ, নাজুক কর্মসংস্থান, সরকারি পরিষেবায় দুর্নীতি এবং ব্যবসায়িক পরিবেশের উন্নতি।
৭১ দশমিক ২ শতাংশ বলেছেন, মূল্যবৃদ্ধি রোধ করা ভবিষ্যতের সরকারের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত, অন্যদিকে অর্ধেকেরও বেশি অপরাধ দমনে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষে। গড়ে প্রতি দশজনের মধ্যে চারজন কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে উৎসাহিত করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্থবির হয়ে পড়েছে। প্রায় এক তৃতীয়াংশ ভোটার চান সরকারি পরিষেবায় দুর্নীতি হ্রাসে আরও জোরদার মনোযোগ।
এদিকে, সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে তদন্ত, সরকারি পরিষেবাগুলোতে অ্যাক্সেস সম্প্রসারণ এবং ব্যবসায়িক অবস্থার উন্নতির মতো বিষয়গুলো মাঝারি অগ্রাধিকার হিসাবে স্থান পেয়েছে। ১০ শতাংশেরও কম উত্তরদাতা দ্রুত সাংবিধানিক সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছেন অথবা জুলাই বিপ্লবের সবচেয়ে বিতর্কিত অধ্যায়গুলো পুনর্বিবেচনার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। এর মধ্যে সংঘটিত যে কোনো সহিংসতার ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত।
বাংলাদেশ এখন জাতীয় নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচনের প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এই সময় জরিপের এই ফলাফল এমন একটি জনগোষ্ঠীর চিত্র তুলে ধরে যা সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক রূপান্তরের পরিবর্তে নিত্যদিনের রুটি-রুজির বিষয়গুলোতে জোর আরোপ করে।
অর্থনৈতিক চাপ এবং জনসাধারণের অস্বস্তির পরিবেশে এই প্রশ্ন থাকে যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কি ক্রমবর্ধমান উদ্বেগগুলো মোকাবেলা করতে পারবে নাকি এগুলো মোকাবেলা করার জন্য একটি নতুন প্রশাসন বা সরকার নির্বাচনের দিকে এগুবে।●