বেগম খালেদা জিয়া: বৈপরীত্যে যাপিত এক জীবন
বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুতে নেত্র নিউজের স্মারণিক
ইতিহাসে দ্বিতীয় নারী হিসেবে কোনো মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। এমন একটি দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যেটি নিজেকে চিনিয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের বিপরীতে মধ্য-ডানপন্থী প্রতিষেধক হিসেবে। ২০০১ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় যখন এসেছিলেন, তার অবয়ব ছিল দ্ব্যর্থহীনভাবে আধুনিক। উজ্জ্বল জর্জেট শাড়ির প্রতি তার ঝোঁক ছিল স্পষ্ট। যত্ন করে ফোলানো বুফোঁ স্টাইলে চুল সাজাতেন। মেজাজ-মর্জি সায় দিলে গাঢ় লিপস্টিকও পরতেন। আর ছিল পাতলা ও তীক্ষ্ণ খাঁজকাটা ভ্রু। রক্ষণশীলরা তাকে দেখে কিছুটা ভিরমি নিশ্চয়ই খেতো। অথচ, তার দল বিএনপি ঠিকই আবার রক্ষণশীল ভোটের উপর নির্ভর করতে পারতো। তার সময়েই জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য কট্টর ইসলাম-আশ্রয়ী গোষ্ঠীর সঙ্গে জোট গড়ে তোলে বিএনপি। অর্থাৎ, যেই আলেমরা নারী নেতৃত্বকে অনৈসলামিক বলে মনে করতেন, তাদেরকেও তিনি নিজের নেতৃত্ব মানিয়ে নিতে পেরেছিলেন।
খালেদা জিয়া কি তাহলে গোপনে গোপনে উদারপন্থী ছিলেন, নাকি ছিলেন আজকের বাংলাদেশে আরও বেশি দৃশ্যমান ইসলাম-আশ্রয়ী রাজনীতির একজন আদি-স্থপতি? বাংলাদেশের প্রথম নারী সরকারপ্রধান বেগম খালেদা জিয়াকে ঘিরে রাখা আরো অনেক দোটানার মতই এই প্রশ্নের উত্তরটাও মাঝামাঝি কোথাও।
ক্ষমতায় থাকাকালে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বৃত্তিসহ স্কুল-শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার মাধ্যমে মেয়েদের শিক্ষার উপর জোর দেন তিনি। ১৯৯৩ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি দেশের কন্যাসন্তানদের পক্ষে জোর গলায় কথা বলেন। পাশাপাশি উল্লেখ করেন বাংলাদেশের তুলনামূলকভাবে নমনীয় ও সহনশীল ইসলামী ধারার কথা। তার সরকার বাল্যবিবাহ নিয়ে বিশেষভাবে কঠোর অবস্থান নেয়। তার আমলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা গ্রামে গ্রামে অভিযান চালিয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক বিয়ে বন্ধ করেন। এমন উদ্যম এর আগে বা পরে খুব কমই দেখা গেছে। তার এই তৎপরতা ছিল প্রতিদ্বন্দ্বী শেখ হাসিনার বিপরীত, যিনি কি না প্রগতিশীলতার রাজনীতি করেও মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়সসীমা শিথিল করার পক্ষে যুক্তি দিয়েছিলেন।
নারীদের জন্য সম্ভবত খালেদা জিয়ার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে ঘরোয়া ও বৈবাহিক সহিংসতার বিচার করার পদক্ষেপ নেওয়া। এই ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে স্রেফ অভিযোগের ভিত্তিতেই স্বামীদের বিচার-পূর্ব সতর্কতামূলক আটক রাখার বিধান চালু হয়েছিল। পদক্ষেপটি ছিল একইসঙ্গে বেশ ঢালাও, বিতর্কিত; কিন্তু সমর্থকদের চোখে ইতিবাচক পরিবর্তনের ইশারা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো, ডানপন্থীদের কাছে বিশ্বস্ত এক নেত্রীর পক্ষ থেকে আইনটি আসার ফলে বিতর্ক হয়েছিল কম। আওয়ামী লীগ এটি প্রস্তাব করলে যে মাত্রার তীব্র প্রতিক্রিয়া হতো, তার তুলনায় অনেক কম বিরোধিতার মুখে এটি পাশ হয়। এরকম বহু ক্ষেত্রে, নীরবে এমন সব সংস্কার এগিয়ে নিতে তিনি তার রক্ষণশীল পরিচয়টিকে ব্যবহার করেছেন, যা ধর্মীয় ডানপন্থী শক্তি অন্যথায় তীব্রভাবে প্রতিরোধ করতো।
তার এই প্রবণতা কীভাবে গড়ে উঠেছিল তা খুঁজে বের করা বেশ কঠিন। বাংলাদেশে রাজনৈতিক জীবনী রচনার তেমন ভালো চল নেই। খালেদা নিজে একসময় স্বীকার করেছিলেন যে, তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষা নেই। তার কলেজে পড়ার কোনো প্রমাণও নেই। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তার বিয়ে হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সুদর্শন এক তরুণ কর্মকর্তার সঙ্গে। তার দাম্পত্য জীবনের প্রথম দিকের বছরগুলো কেটেছে এক পোস্টিং থেকে আরেক পোস্টিংয়ে ঘুরতে ঘুরতে।
তবে কি নিজের শিক্ষাজীবন অসম্পূর্ণ রয়ে যাওয়ায় তিনি উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন মেয়েদের শিক্ষার প্রতি উৎসাহী হতে? নিজের অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ার ফলেই কি তিনি বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে অমন দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন? এ ব্যাপারে তিনি কখনো কিছু বলেননি এবং তার ব্যস্ত জনজীবনে এমন অনুসন্ধানের বিশেষ পরিসর কখনোই ছিল না।
১৯৪৬ সালে ফেনীর এক ব্যবসায়ী পরিবারে জন্ম নেওয়া খালেদা বড় হন উপমহাদেশের এক চরম অস্থির সময়ে। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর, যে যুদ্ধে তার স্বামী পাকিস্তানের হয়ে লড়েছিলেন, তার প্রথম সন্তান তারেক রহমানের জন্ম হয়। ১৯৭১ সালে, যখন জিয়াউর রহমান পাকিস্তানি বাহিনী ত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেন, তখন খালেদা সন্তানদের নিয়ে আত্মগোপনে যান। যদিও পরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত তাকে আটক থাকতে হয়।
সেই বছরগুলো তার জীবনে এক ধরনের সংযমী রূপ এনে দেয়। স্বাধীনতার পরেও সেনা-কোয়ার্টারে তার তৎকালীন প্রতিবেশীদের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, চাল-ডালের দাম নিয়ে তিনি কতটা চিন্তিত থাকতেন। ১৯৭৭ সালে জিয়া ক্ষমতা গ্রহণ করে রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরও পরিবারটি বিলাসবহুল জীবনযাপন করেনি। ১৯৮১ সালে জিয়া খুন হলে, তার হাতে প্রতিষ্ঠিত দলটি সাময়িকভাবে টেকনোক্র্যাটদের হাতে চলে যায়। তারপর অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে দলটির নিয়ন্ত্রণ খালেদার হাতে চলে আসে। তাকে সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান করা হয় এবং অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বিএনপির আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন।
তার তৎকালীন মিত্র হাসিনা আপসের পথে হাঁটলেও, খালেদা তা করেননি। জনপ্রিয় এক সেনাপ্রধানের বিধবা স্ত্রীকে ভয় দেখানো ফৌজিদের পক্ষে এত সহজ ছিল না। তার সেই সময়কার অটল অবস্থান তাকে “আপসহীন নেত্রী” খ্যাতি এনে দেয়। সেই খ্যাতির জেরেই তিনি ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়ী হন, যদিও বিপুলসংখ্যক মানুষ ধরে নিয়েছিল যে সেবার আওয়ামী লীগই জিতবে।
তার প্রথম মেয়াদটিকে এখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ধারায় এক বিরল উদারপন্থী ঘোরের মতো মনে হয়: তুলনামূলক স্বাধীন গণমাধ্যম ও বিদ্যায়তন, নতুন নতুন নির্ভীক পত্র-পত্রিকা, সৃজনশীল উদ্দীপনা। কিন্তু বিএনপির আংশিক সামরিক ও আংশিক মুসলিম লীগ শিকড়ের কারণে দলটির মধ্যে সংখ্যালঘুদের প্রতি সন্দেহ এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভাবধারার প্রতি ঝোঁক থেকে গেলো। তাছাড়া সেবার সংসদে খালেদার সংখ্যাগরিষ্ঠতা টেকানো সম্ভব হয়েছিল কেবলমাত্র সংরক্ষিত নারী আসনে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনের বরাতে, যা দলটির প্রতি উদারপন্থীদের দৃষ্টিভঙ্গিকে আরও নাজুক করে তোলে। বিপরীতে আওয়ামী লীগ তখন নিজেকে উপস্থাপন করেছিল বাঙালি সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের ধারক-বাহক হিসেবে: গণমাধ্যম, শিল্প-সংস্কৃতি, বুদ্ধিজীবী শ্রেণি যার প্রধান চালিকাশক্তি।
মতভেদ থাকা সত্ত্বেও অবশ্য তখনো সৌজন্য বজায় ছিল। তারেকের বিয়েতে খালেদার পাশে হাসিনার উপস্থিতিই তার প্রমাণ। এমন একটি দৃশ্য পরবর্তী বছরগুলোতে হয়ে উঠে কল্পনারও অতীত।
খালেদার কথাবার্তা ছিল হাসিনার তুলনায় নমনীয়; তবে হাসিনা নিজেকে তার মতো গুটিয়ে রাখতেন না। খালেদা ব্যক্তিগত আক্রমণ এড়িয়ে চলতেন, কিন্তু হাসিনা তা প্রায়ই ব্যবহার করতেন। তবে খালেদা কখনো অতিথিদের জন্য রান্না করার মতো উষ্ণ ছিলেন না; কিন্তু হাসিনার মধ্যে সেই স্বতস্ফূর্ততা ছিল। তাদের ব্যক্তিত্বের এই স্পষ্ট বৈপরীত্যের কারণে সংঘর্ষও ছিল অবশ্যম্ভাবী।
আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী যখন — বিশেষ করে কুখ্যাত মাগুরা উপনির্বাচনের পরে — নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক করার দাবি তোলে, খালেদা তা ঠেকানোর দিকে যান। এর ফলে বিরোধী পক্ষগুলো সংসদ বর্জন ও রাস্তায় নামার পক্ষে যথেষ্ট অজুহাত খুঁজে পায়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এখন কথায় কথায় রাস্তায় নেমে পড়ার যে বিষাক্ত চল রয়েছে তার পেছনে ওই মুহূর্তটির ভূমিকা কম নয়।
শেষ পর্যন্ত বিরোধীদের দাবি তিনি মেনে নিলেন, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। ১৯৯৬ সালেই তাকে সংবিধান সংশোধন-পূর্বক দ্বিতীয়বারের মতো জাতীয় নির্বাচন দিতে বাধ্য করা হয় এবং সেই নির্বাচনে তিনি হেরে যান।
এরপর বিরোধী দলে থেকে তিনি তার ভারতবিরোধী বক্তব্যে আরো শান দেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করতে শুরু করেন। অথচ একই ধরনের শর্ত তার নিজের সরকারই একসময় আলোচনার মাধ্যমে প্রায় মেনে নিয়েছিল। এসব অবস্থান পরবর্তীতে কঠোরভাবে বিএনপির ভূখণ্ড-জাতীয়তাবাদী মতাদর্শে আরও শক্তপোক্ত অবস্থান নেয়। একে নিয়ে যায় আরো সেনাবাহিনী-ঘেঁষা এবং তীব্রভাবে ভারতবিরোধীতার পথে।
সেই আমলেই তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরা ১৫ আগস্ট তার জন্মদিন উদযাপন করতে শুরু করেন, যেই দিনে শেখ হাসিনার প্রায় পুরো পরিবারকে হত্যা করা হয়েছিল। তারিখ হিসেবে উদ্ভট তো বটেই, তাছাড়াও কম করে বললেও এটি ছিল গর্হিত এবং অপর বিবেচনায়ও নিতান্তই প্রতিহিংসাপরায়ণ। এই চর্চা থামাতেও তিনি অত্যন্ত দেরি করে ফেলেন।
২০০১ সালে আর পরোক্ষভাবে নয়, বরং সরাসরি জামায়াত ও অন্যান্য ইসলাম-আশ্রয়ী গোষ্ঠীর সমর্থনে তিনি ক্ষমতায় ফেরেন। দলটির বেনামী নির্বাচন-পূর্ব পোস্টারগুলোতে হাসিনাকে ভারতীয়দের পছন্দসই এক হিন্দুয়ানি ব্যক্তি হিসেবে চিত্রিত করা হয়। ভারত সফরে হাসিনার গলায় দেয়া হয়েছিল গাঁদা ফুলের মালা, কপালে শুভেচ্ছান্তে দেয়া তিলক। এই ছবি প্রচার করে সাম্প্রদায়িক কালিমালেপনের প্রচেষ্টা ছিল স্পষ্ট। এরপর বিএনপি নির্বাচনে জেতার পর হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ব্যাপক সহিংসতার অভিযোগ ওঠে। ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ঢাকায় নিরাপদ আশ্রয় পেতে শুরু করে, যা প্রতিবেশী উৎপীড়ক-রাষ্ট্রটিকে যারপরনাই বিরক্ত করে। পুরো মেয়াদে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। জিহাদি সন্ত্রাস আরও তীব্র হয়। বিরোধী নেতাদের লক্ষ্য করে হামলা হয়; হাসিনা এক প্রাণঘাতী বোমা হামলা থেকে বেঁচে যান, অন্য অনেকে বাঁচেনি। এর প্রতিক্রিয়ায় খালেদা বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার চাইতে ষড়যন্ত্রের ধুয়োই তুলেছিলেন বেশি।
বৈশ্বিকভাবে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের সময় পশ্চিমা বিশ্বের প্রচণ্ড চাপের মুখে খালেদা কয়েকটি চরমপন্থী সংগঠনকে কঠোরভাবে দমন করেন। ইরাক ও আফগানিস্তানে মার্কিন যুদ্ধ তার পছন্দ ছিল না। ভারতের ক্রমবর্ধমান প্রভাব সম্পর্কে তিনি প্রবল আপত্তি অনুভব করতেন। তার এক সহকর্মী পরে বলেছিলেন, “দেশপ্রেম মানে যদি হয় ভারতের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, তাহলে তিনি ছিলেন এক মহান দেশপ্রেমিক।”শাসনের ক্ষেত্রে তিনি মোটেই তার স্বামীর মত ছিলেন না। জিয়াউর রহমান নিজের পরিবারকে সবসময় সরকার থেকে দূরে রেখে সুনাম পেয়েছিলেন। তার বিপরীতে খালেদা তার বোনকে মন্ত্রী করেছিলেন। সংসদ সদস্য করেছিলেন তার অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা ভাইকে, যিনি এতটাই প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন যে, বলা হতো সামরিক বাহিনীর বহু পদোন্নতির সিদ্ধান্ত তার হাতে ছিল।র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) নামের বিশেষ পুলিশ ইউনিটটিও তৈরি হয় তারই উদ্যোগে। অপরাধ দমন করার উদ্দেশ্য নিয়ে জন্মালেও অচিরেই ইউনিটটি বিচারবহির্ভূত হত্যার কারণে “ডেথ স্কোয়াড” খেতাব পায়। কথা চালু আছে যে, এই বাহিনীর ভীতি-জাগানিয়া কালো পোশাকটি তিনি নিজেই অনুমোদন করেছিলেন— কালো ইউনিফর্ম, সানগ্লাস, স্ট্যান্ডার্ড ক্যাপের বদলে মাথায় প্যাঁচানো রুমাল।
সামরিক বাহিনীর প্রতি তার অগাধ আস্থা ছিল। বিশেষ করে তার ভাইয়ের পছন্দ করা শীর্ষ জেনারেলদের ওপর। সামরিক কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে পরিচালিত র্যাব গঠনের মাধ্যমে বেসামরিক জীবনে সামরিক বাহিনীর প্রভাব আরো দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। হাসিনার আমলে এটি আরও নির্মম হয়ে ওঠে, কখনো কখনো এই নির্মমতার লক্ষ্যবস্তু হয় বিএনপি নিজেই। খালেদা পরে র্যাব বিলুপ্তির দাবি তুলেছিলেন, কিন্তু এটি তৈরির জন্য তিনি কখনো ক্ষমা চাননি।
২০০৭ সালে যখন তার মেয়াদ শেষ, তখন ভোটার তালিকা কারচুপি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা চরমে পৌঁছালে সামরিক বাহিনী হস্তক্ষেপ করে। যেসব জেনারেলদের তিনি বিশ্বাস করেছিলেন, পদোন্নতি দিয়েছিলেন তারাই তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা দুজনকেই গ্রেপ্তার করা হয়। নির্যাতনের শিকার হয়ে পরে লন্ডনে নির্বাসিত হন তার বড় ছেলে তারেক রহমান, যাকে ততদিনে দেশের পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি ও দুর্নীতির প্রতীক হিসেবে চিত্রিত করা সম্পন্ন হয়। তার দল নড়বড়ে অবস্থায় পৌঁছে গেলে সামরিক জেনারেলরা বিএনপির ‘সংস্কারপন্থী’ একটি অংশকে সমর্থন দেয়। অবশেষে যখন সামরিক বাহিনী নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে মাঠ ছাড়তে রাজি হয়, তখন তিনি ছিলেন ক্লান্ত। পরিপূর্ণভাবে শক্তি সঞ্চয় না করে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে অনিচ্ছুক ছিলেন। তারপরও তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং ভয়াবহভাবে পরাজিত হন। যদিও তিনি নিজে যে সব আসনে প্রার্থী ছিলেন, সেগুলোতে জয়ী হন। তার জীবনে তিনি কখনো নিজ নির্বাচনে হারেননি।
পরবর্তী সাড়ে পনের বছর ছিল ভয়াবহ।আওয়ামী লীগ ক্রমশ কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠতে থাকে। একের পর এক মামলা জমতে শুরু করে। এমনকি তাকে তার দীর্ঘদিনের বাসভবন থেকে উচ্ছেদ করা হয়। বিএনপি ও তার মিত্র দলগুলোর কর্মীরা নিখোঁজ কিংবা হত্যার স্বীকার হতে থাকেন। এই জীবনের বড় একটা অংশজুড়ে হাসিনার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা সংজ্ঞায়িত করেছিল খালেদার জীবন। এর ফলে তিনি ইসলামপন্থী মিত্রদের ওপর আরো বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। হাসিনা যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেন, তখন সে আদালত মূলত জামায়াত ও বিএনপির ডানপন্থী অংশের কয়েকজনকে লক্ষ্যবস্তু করে। খালেদা সে-সময় জামাতের পাশে দাঁড়ান এবং ক্রমবর্ধমান রক্ষণশীল স্রোতে গা ভাসান। শাহবাগ চত্বরে যেখানে হাসিনার ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ডের দাবি জানিয়ে এক জনতোষণবাদী গণসমাবেশ হয়েছিল, সেটাকে তিনি আখ্যা দিয়েছিলেন “নাস্তিক চত্বর” বলে। এটি তিনি এমন সময় বলেছিলেন, যখন জিহাদিরা হামলা চালাচ্ছিল নাস্তিক ব্লগারদের ওপর, যাদের মধ্যে কেউ কেউ যুক্ত ছিলেন গণজাগরণ মঞ্চের সাথে। এমন একাধিক হামলায় খুনও হন অনেকে। এমন ভীতিকর পরিস্থিতিতে তার এই বক্তব্য বিরাজমান সহিংসতার আগুনে আরো জ্বালানি জুগিয়েছিল। খালেদার নীরব আশীর্বাদে হেফাজতে ইসলাম অস্বাভাবিকরকমের প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। এর ফল ঘরে তোলে বিএনপি ২০১৩ সালে, যখন দলটি সব বড় সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জয় পায়।
কিন্তু এর পরই বিপদ টের পেয়ে, হাসিনা নিজের বাতিল করা তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহাল করতে কিছুতেই রাজি হন না। খালেদার বিএনপি সহিংসভাবে রাস্তায় নেমে আসে। ২০১৪ সালের নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর ওই সহিংসতা আরও বাড়ে। সেই সময় ফাঁস হওয়া ফোনালাপে প্রকাশ পায়, খালেদা নিজেই একটা ওয়ার রুম থেকে নেতাদের আন্দোলন চালাতে নির্দেশ দিচ্ছিলেন। কিন্তু তার দলের সহিংস কৌশলটি ব্যর্থ হয়। অগ্নিসংযোগে নিহত হন বহু মানুষ। তাদের পুড়ে যাওয়া দেহ জাতীয় চেতনায় দগ্ধ দাগ রেখে যায়।
তার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো মালয়েশিয়ায় নির্বাসিত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের ঠিক আগে তাকেও একটা ছোট দুর্নীতির মামলায় কারাবন্দী করা হয়। কারাগারে তার স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি ঘটে। দীর্ঘস্থায়ী কিডনি ও লিভারের রোগ দেখা দেয়। দীর্ঘদিন হাসপাতালে বদ্ধ জীবন কাটাতে বাধ্য হন। বারবার বিদেশে চিকিৎসার আবেদন করেও ব্যর্থ হন। হাসিনা তাকে ঢাকা ছাড়ার অনুমতি দিতে অস্বীকার করেন। “বয়স তো আশির উপরে, এমনিই তো সময় হয়ে গেছে, এখানে এত কান্নাকাটি করে তো লাভ নাই” — স্বভাবসুলভ নিষ্ঠুরতায় হাসিনা তখন বলেছিলেন। জনমত মুহূর্তেই খালেদার দিকে ঝুঁকে যায়।
কোভিড মহামারীর সময় কার্যত গৃহবন্দী থাকার মত কঠোর শর্তে তাকে বাড়ি ফেরার অনুমতি দেওয়া হয়। তিনি কিছু বললেন না। তার পরিবার ব্যক্তিগতভাবে শেখ রেহানার কাছে সহায়তার জন্য আবেদন করেছিল। হাসিনা পরে ছাড় দিয়েছিলেন কেবল এই ভেবে যে, এতে খালেদাকে দুর্বল দেখাবে। “তাকে দয়া করে বাসায় থাকতে দিয়েছি”— এক সমাবেশে গর্ব করে বলেছিলেন হাসিনা।
২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর হাসিনা দেশ থেকে পালান। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম পদক্ষেপগুলোর একটি ছিল খালেদার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ প্রত্যাহার করা। কিছুদিন পর তাকে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে পাঠানো হয়, যেখানে তিনি তারেকের সঙ্গে পুনর্মিলিত হন।
মুক্ত জীবনে স্বল্প পরিসরের প্রকাশ্য বক্তব্যে তিনি একবারও হাসিনাকে আক্রমণ করেননি। এমনকি তার নামটাও উচ্চারণ করেননি। এই সংযম ছিল বিস্ময়কর। হাসিনা তাকে চোর, চোরের মা বলে গালাগালি করেছিলেন, এতিমদের টাকা চুরির অভিযোগ এনেছিলেন, তাকে অশিক্ষিত বলে অপমান করেছিলেন, তার লিভারের অসুস্থতার কারণ হিসেবে মদ্যপানের দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন, তাকে বাসা থেকে উচ্ছেদের সময় তার ফ্রিজে পর্নোগ্রাফিক ম্যাগাজিন ও হুইস্কির বোতল রেখেছিলেন, যা পরে আওয়ামী লীগ সারাদেশে প্রচার করে। এমনকি, বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে গভীরভাবে অপমানজনক বিভিন্ন বিষয়, যেমন খালেদার চেহারা নিয়ে ব্যঙ্গ, গোপন বিয়ে ও সম্পর্কের ইঙ্গিত করতেও হাসিনার বাধেনি। বিপরীতে খালেদা নিজের পক্ষ থেকে সবসময় হাসিনার স্বামীর সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যক্তিগত সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া কখনো কোনো ব্যক্তিগত আক্রমণ করেননি। চরিত্র ও স্বভাবের এই তীব্র বৈপরীত্য ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট।
সাম্প্রতিক সময়ে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় তিনি আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু জীবনের শেষ কয়েক মাসে তিনি ছিলেন অত্যন্ত দুর্বল; চলাফেরা করতেন হুইলচেয়ারে। সে-সময় তাকে আর তার চিরচেনা শাড়িগুলো পরতে দেখা যায়নি। চুলও সবসময় ঢেকে রাখতেন। এটা বয়স বাড়ার সাথে সাথে বৃদ্ধি পাওয়া ধর্মীয় অনুরাগের প্রতিফলন ছিল, নাকি এমন একটি সমাজে খাপ খাওয়ানোর প্রয়াস ছিল, যেখানে এখন তার প্রথম ক্ষমতার মেয়াদের তুলনায় অনেক বেশি নারী পর্দা পালন করেন — তা বলা কঠিন। বাংলাদেশের গণতন্ত্রমুখী জটিল যাত্রার পরবর্তী অধ্যায়ের ঠিক প্রারম্ভিক মুহূর্তে, ৮০ বছর বয়সে রাজধানীর বসুন্ধরার এভারকেয়ার হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
যে নেত্রীকে একসময় সহজবোধ্য আখ্যার ভেতর আবদ্ধ করার চেষ্টা করা হতো, তার ফেলে যাওয়া লিগ্যাসি আসলে অনেক বেশি বহুমাত্রিক। নারীর অধিকারের পক্ষে জোরালো অবস্থান নেওয়া এক রক্ষণশীল আইকন; সামরিক জেনারেলদের পরাস্ত করা একজন গৃহবধূ, বিধবা রাজনীতিক; আপসহীন এক ব্যক্তিত্ব, যাকে কখনো কখনো খুব চড়া মূল্যে ছাড় দিতে হয়েছিল। শুরু থেকে সায়াহ্ন অব্দি, বৈপরীত্য মাখানো যাপন ছিল এই কিংবদন্তির।●