পাইপলাইন রুদ্ধ করে তরুণদের স্বপ্ন ধূলিসাৎ করেছে বিসিবি
প্রবল প্রতাপ এক মাফিয়াতন্ত্রের কাছে জিম্মি ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেট। শত-সহস্র তরুণের ক্রিকেট নিয়ে স্বপ্ন দেখার পথ রুদ্ধ করা হয়েছিল গত ১৬ বছর। তার কিছু চিত্র পাওয়া যাবে এই নিবন্ধে। নিবন্ধটি দুই পর্বে ভাগ করা হয়েছে। আজ প্রকাশিত হলো শেষ পর্ব।
![পাইপলাইন রুদ্ধ করে তরুণদের স্বপ্ন ধূলিসাৎ করেছে বিসিবি](/content/images/size/w2000/2025/02/cricket.png)
সাকিব আল হাসানের মতো বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে কীভাবে আওয়ামী শাসনের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন তা সবারই জানা। সেই সাকিব প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিলেন ঢাকা লিগের চরম অনিয়মের বিরুদ্ধে। মুহূর্তের জন্য খেলোয়াড়সত্ত্বা ভর করায় হয়ত সাকিব ২০২১ সালের ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে না পেরে মেজাজ হারিয়ে বসেন। লাথি মেরে স্টাম্প ভাঙেন এবং পরে স্টাম্প উপড়ে ফেলেন। এমন অবিশ্বাস্য ঘটনার জন্য সাকিব বেছে নেন বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় লড়াই – আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ।
ম্যাচটি হচ্ছিল মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়াম; বাংলাদেশের ‘হোম অব ক্রিকেট’-এ। খেলাটি ইউটিউবে লাইভ দেখানো হচ্ছিল। সময়ের ফেরে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনী ও মোহামেডান ক্রিকেট দ্বৈরথ রঙ হারালেও সেদিন সাকিবের সৌজন্যে উত্তেজনা ফিরে আসে ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে। যদিও সেটা নেতিবাচক কারণে। সেদিন মোহামেডানের হয়ে খেলতে নামা সাকিবের বলে আবাহনীর মুশফিকুর রহিমের বিপক্ষে একটি এলবিডব্লুর আবেদনে সাড়া দেননি আম্পায়ার ইমরান পারভেজ। খালি চোখে আউট মনে হলেও আম্পায়ার আউট না দেওয়ায় সাকিব মেজাজ হারিয়ে বসেন, বিতণ্ডায় জড়ান, লাথি দিয়ে ভাঙেন স্টাম্প।
মিরপুর স্টেডিয়ামের প্রেস বক্সে থাকা সাংবাদিকদের ওই ঘটনার ঘোর কাটতে না কাটতেই ঠিক পরের ওভারে সাকিব আবার নিজের হাতে স্টাম্প উপড়ে ফেলেন। সাকিবের সতীর্থ শুভাগত হোমের বোলিংয়ের সময় বৃষ্টি নামলে আম্পায়ার খেলা বন্ধ করার ঘোষণা দেন আর এতে সাকিব আরও একবার মেজাজ হারিয়ে বসেন। ড্রেসিং রুমে ফেরার পথে আবাহনীর কোচ খালেদ মাহমুদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয় সাকিবের।
সাকিবের মতোই বাংলাদেশের ক্রিকেটের আরেক আলোচিত চরিত্র খালেদ মাহমুদ সুজনকে নিয়ে পরে আসছি। সেদিন বিবাদের পরে দুই দলের ক্রিকেটাররা এসে সাকিব আর মাহমুদকে দুই ড্রেসিং রুমে টেনে নেন। সেই ঘটনায় সাকিবকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা ও ৩ ম্যাচের বহিষ্কারাদেশ দিয়েছিলেন ম্যাচ রেফারি মোরশেদুল আলম।
সাকিবের ওই ঘটনার পর প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিলেন মুনিরুজ্জামান টিংকু নামের এক আম্পায়ারও। সেই ঢাকা লিগে সাকিব-মাহমুদউল্লাহর মতো তারকা ক্রিকেটারদের চোখে আম্পায়ারদের প্রতি বিন্দুমাত্র সম্মান দেখতে না পেয়ে এই পেশা থেকেই সরে দাঁড়ান তিনি। বছর তিনেক আগে আম্পায়ারিং ছাড়ার কারণ জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, “সম্মান একটা বড় বিষয়, কাজের পরিবেশটাও গুরুত্বপূর্ণ। এই দুটো কারণেই আমি আম্পায়ারিং ছাড়ছি।”
আম্পায়ারদের পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিং নিয়েও সরব ছিলেন মুনিরুজ্জামান। বলেছিলেন- “প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণির ক্রিকেটে বায়াসড আম্পায়ারিং...এটা তো আপনারা সবাই জানেন। সেটার একটা প্রভাব তো অবশ্যই আছে। সবাই ভাল না, আবার সবাই খারাপও না-- এটা তো ঠিক। দুইটা মিলিয়েই এই জগৎ।”
ধ্বংস করে ফেলা হয় পাইপলাইন
নানা সময়ে ঘটা এসব ঘটনা বাংলাদেশের ক্রিকেটকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। ক্রিকেটে জেঁকে বসা মাফিয়াতন্ত্রের খপ্পরে পড়ে মূলত ধ্বংস হয়েছে দেশের ক্রিকেটে বিপুল সম্ভাবনা। বিশেষ করে ম্যাচ ফিক্সিং, কমিউনিটি থেকে ক্লাবগুলোকে বিচ্ছিন্ন করাসহ নানা ম্যাকানিজমের মধ্য দিয়ে মাফিয়াতন্ত্রের করায়ত্ব হয় ক্রিকেট। নস্যাৎ হয় ক্রিকেটের পেশাদারী চরিত্র।
যে কোনো খেলার মতো ক্রিকেটেরও প্রাণ হচ্ছে কিশোর-তরুণরা। ক্রিকেটের প্রতি তাদের আগ্রহ এবং তাদের বেড়ে উঠার সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি নিরবচ্ছিন্ন রাখার মধ্যেই ক্রিকেট এগিয়ে যায়। কিন্তু আওয়ামী লীগ আমলে একে তো ক্লাবগুলোর থেকে কমিউনিটিকে বিচ্ছিন্ন করা হয়, তদুপরি নিম্নস্তরের লিগগুলোকেও রীতিমত প্রহসনে পরিণত করা হয়। প্রিমিয়ার লিগ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ঢাকার ক্রিকেটের একদম আঁতুড়ঘরে চোখ দিলে অনেককেই আঁতকে উঠতে হয়। প্রতি বছর প্রিমিয়ার লিগের পয়েন্ট তালিকার তলানিতে থাকা দুটি দল রেলিগেটেড হয়। আগের বছরের প্রথম বিভাগ লিগের চ্যাম্পিয়ন ও রানার্স আপ দলের জায়গা হয় প্রিমিয়ার লিগে। প্রমোশন ও রেলিগেশনের এই রীতি আছে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগ লিগেও। কিন্তু তৃতীয় বিভাগ লিগে জায়গা করে নেওয়ার পথটাকে একটু একটু করে কঠিন করে তুলেছিল পাপনের ক্রিকেট বোর্ড।
ঢাকার ক্রিকেটের পিরামিডে ওঠার প্রথম ধাপ তৃতীয় বিভাগ কোয়ালিফায়ার। যেখানে অংশ নিতো বিভিন্ন এলাকার ছোট ছোট ক্লাব। দেখা গেছে এলাকার কয়েকজন উৎসাহী মিলে দল সাজিয়ে খুদে ক্রিকেটারদের খেলার সুযোগ করে দিতেন। তৃতীয় বিভাগ কোয়ালিফায়ার লিগে এন্ট্রি ফি ছিল নাম মাত্র। এই তৃতীয় বিভাগ কোয়ালিফায়ারের সৌজন্যে বহু ক্রিকেটার পেশাদার ক্রিকেটের স্বাদ পেতেন। ৫০-৬০টি দলে সারা দেশ থেকে আসা প্রায় তিন-চার হাজার নতুন ক্রিকেটার প্রতি মৌসুমেই এ লিগে অংশ নিতেন। তাতে দেশের ক্রিকেটের পাইপলাইনে যুক্ত হতো একঝাঁক নতুন ক্রিকেটার।
ঢাকার ক্রিকেট তখন ছিল বহমান নদীর মতো। সেই নদীতে একটু একটু করে বাঁধ দিতে থাকে বিসিবির অদ্ভুত কিছু সিদ্ধান্ত। ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা থেকে জন্ম নেওয়া পাড়ার ক্লাবগুলোর ঢাকা লিগে আসার পথ বন্ধ করতে এন্ট্রি ফি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় বিসিবি। ১০ হাজার, ২০ হাজার টাকার নামমাত্র এন্ট্রি ফি বাড়তে বাড়তে ২০১৫ সালে গিয়ে দাঁড়ায় ৫ লাখে। পাড়ার ছোট্ট ক্লাবের এত টাকা কই! বটবৃক্ষের মতো বিশাল ছায়ার ক্রিকেটকে আগলে রাখার নামে ক্রিকেট বোর্ড হাঁটতে থাকে উল্টো পথে। আগলটা ছোট করতে করতে এমন অবস্থায় নিয়ে আসা হলো, যেখানে টাকাওয়ালারাই তৃতীয় বিভাগ কোয়ালিফায়ার খেলা শুরু করল। টাকা মানেই শক্তি, টাকা মানেই ‘সরকারি দল’।
যে তৃতীয় বিভাগ কোয়ালিফায়ার লিগে একসময় ক্রিকেটারদের মেলা বসতো, সেই লিগেই নেমে আসে শূন্যতা। ক্রিকেটের কল্যাণের কথা ভাবলে এই লিগেই সবচেয়ে বেশি দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথা। শ’য়ে শ’য়ে দলের হাজার হাজার কিশোর-তরুণ প্রথমবারের মতো প্রতিযোগিতামূলক এ লিগে খেলবে, স্বপ্নের সিঁড়িতে পা দেবে। কিন্তু, ২০১৭ সালে তৃতীয় বিভাগ কোয়ালিফায়ার লিগে অংশ নেয় মাত্র দুটি দল। হ্যাঁ, দুটি! দল দুটির নাম পূর্বাচল স্পোর্টিং ক্লাব ও নবাবগঞ্জ ক্রিকেট একাডেমি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে তৃতীয় বিভাগ কোয়ালিফায়ার লিগে এই দুই দল নিয়েই শুরু হয় তৃতীয় বিভাগ কোয়ালিফায়ার লিগ। বৃষ্টির কারণে ম্যাচটি পণ্ড হলে টসের মাধ্যমে তৃতীয় বিভাগ কোয়ালিফায়ার লিগের চ্যাম্পিয়ন দল নির্ধারণ করা হয়। পূর্বাচল টস জেতায় চ্যাম্পিয়ন হিসেবে জায়গা করে নেয় তৃতীয় বিভাগ লিগে, হেরে রানার্সআপ হয়েও নবাবগঞ্জ পেয়ে যায় তৃতীয় বিভাগ লিগের টিকেট। আরো সোজা ভাষায়, কাউন্সিলরশিপ ও ভবিষ্যৎ ক্ষমতা কুক্ষিগত করার সুযোগ।
ক্লাব কর্মকর্তারা অবশ্য তখনই বোর্ডের এই সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করেছিলেন। নিজেদের পছন্দের ক্লাবগুলোকে ঢাকা লিগের পিরামিডে জায়গা করে দিতে ক্রিকেটারদের উঠে আসার বিশাল একটা পথ বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্তটা ছিল নিজের পায়ে কুড়াল মারার মতো। তবে ক্ষমতার মোহে ডুবে থাকা ক্রিকেট বোর্ড তা ভাবেনি। ক্রিকেট বোর্ড ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নেশায় বুঁদ।
সেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে সফলও হয় ক্রিকেট বোর্ড। ২০১৩ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই একটু একটু করে ঢাকার ক্লাবগুলোকে নিজেদের ভোটব্যাংকে পরিণত করার বিশাল প্রজেক্ট হাতে নিয়েছিল পাপনের ক্রিকেট বোর্ড। প্রায় এক দশকের পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিং, ম্যাচ ফিক্সিং, তৃতীয় বিভাগ কোয়ালিফায়ার লিগ নিয়ে কারসাজির মাধ্যমে ঢাকার ৭৬টি ক্লাবকে নিজেদের ছাতার নিচে নিয়ে আসা হয়। কিছু বিরুদ্ধ মতের ক্লাব থাকলেও নিজেদের অস্তিত্বের ভয়ে একটা সময় পর তারাও মুখে কুলুপ এঁটে সব অনাচার মেনে নিতে শুরু করে।
কাঙ্ক্ষিত ‘চক্র’ পূর্ণ হওয়ার পর ২০২২ সালে এসে ক্রিকেট বোর্ডের গঠনতন্ত্র সংশোধন করে ঢাকার সব ক্লাবের জন্য একজন কাউন্সিলর করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। ২০২৪ সালে তা অনুমোদিত হয়। এর আগে প্রিমিয়ার লিগের সুপার লিগে জায়গা করে নেওয়া দলের কাউন্সিলর ছিলেন দুজন। একটা সময় পর সব ক্লাবেই যখন নিজেদের আধিপত্য নিশ্চিত করে বিসিবি, তখন সাবেক বিসিবি সভাপতি সংবাদমাধ্যমে এসে গর্ব করে ঘোষণা দিয়ে বলেন— ‘আপনারা সব সময় প্রিমিয়ার লিগে আম্পায়ারিং নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। সুপার লিগে জায়গা করে নিলে দুজনের কাউন্সিলর হওয়ার সুযোগ থাকে, সে জন্য আম্পায়ারিংয়ের সুবিধা নিয়ে সুপার লিগে যাওয়ার অভিযোগ শুনি সবসময়। এখন থেকে সব ক্লাবের একটি করে কাউন্সিলর করে দেওয়া হবে।’
স্বৈরতন্ত্রের ধ্রূপদী টেমপ্লেট! সমস্ত প্রতিপক্ষ, সমস্ত বিরুদ্ধ মতামতকে দমিয়ে দিয়ে এরপর বিড়াল তপস্বী সাজা। কিন্তু, ক্ষমতা কারও চিরদিনের থাকে না। নিজেকে প্রবল শক্তিধর ভাবা হাসিনাও পালাতে বাধ্য হয়। হাসিনার সাথে সাথে পালায় পাপন আর বিসিবি মাফিয়ারা। তাতে বদল আসে বিসিবির নেতৃত্বেও। ফারুক আহমেদ বোর্ড প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন। সাবেক এই অধিনায়কের অধীনে বেশ কয়েকটি বোর্ড সভায় বিনা নোটিশে অনুপস্থিত থাকায় পরিচালক পদ শূন্য হয় অনেকেরই।
বিসিবির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কোনো পরিচালক বিনা নোটিশে পরপর তিনটি সভায় অনুপস্থিত থাকলে তার পরিচালক পদ শূন্য হয়ে যায়। এই নিয়মে ১১ পরিচালকের সদস্যপদ বাতিল হয়। এর মধ্যে আছেন সর্বশেষ সভাপতি পাপনও। এর বাইরে তিনজন পরিচালক পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছিলেন। এ ছাড়া আলমগীর হোসেন নামের একজন পরিচালক মারা যাওয়ায় সব মিলিয়ে ১৫টি পরিচালক পদ শূন্য হয়ে যায়। বিসিবির সাবেক সভাপতিসহ সদস্যপদ বাতিল হওয়া পরিচালকদের মধ্যে ছিলেন ইসমাইল হায়দার মল্লিক, ওবেদ নিজাম, তানভীর আহমেদ, আ জ ম নাছির উদ্দীন, গাজী গোলাম মোর্ত্তজা, শেখ সোহেল, নজীব আহমেদ, মঞ্জুর কাদের, অ্যাডভোকেট আনোয়ারুল ইসলাম ও শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল। পদত্যাগপত্র গৃহীত হয় খালেদ মাহমুদ, নাঈমুর রহমান ও এনায়েত হোসেনের।
নতুন ক্রিকেট বোর্ড এসে স্বাভাবিকভাবেই নতুন স্বপ্ন দেখিয়েছেন। ক্রিকেট বোর্ডে দুর্নীতির তদন্ত করার আশ্বাস দেওয়ার সঙ্গে ক্লাব ক্রিকেটে পুরোনো আমেজ ফিরিয়ে আনার আশ্বাস দিয়েছেন সভাপতি ফারুক আহমেদ। আম্পায়ারিংয়ের ভাবমূর্তি বদলানোর আশ্বাসও দিয়েছেন। ফারুক আহমেদ এর মধ্যেই তৃতীয় বিভাগ কোয়ালিফায়ার লিগে এন্ট্রি ফি কমিয়ে ছোট ছোট দলগুলোর আবারও ফেরার পথ খুলে দিয়েছেন। ক্লাব ক্রিকেটের দুর্নীতি থামাতে এই মৌসুমের তৃতীয় বিভাগ লিগ থেকেই বিসিবির দুর্নীতি দমন বিভাগকে (আকসু) মাঠে রাখা হচ্ছে। আকসুর কর্মকান্ড আরও জোরদার হবে দ্বিতীয় বিভাগ ও প্রথম বিভাগ লিগে।
তবে দেশের রাজনীতিতে শুধু ব্যাক্তির বদল হলেই হবে না। এক যুগের বেশি সময় ধরে ঘুণে ধরা ক্রিকেট সংস্কৃতি ঠিক করতে হলে বদলাতে হবে বিসিবির গঠনতন্ত্রও। বিসিবি সভাপতি দায়িত্ব নিয়ে প্রথম সংবাদ সম্মেলনেই গঠনতন্ত্র বদলানোর কথা বলেছেন। সে জন্য ক’দিন আগে বিসিবির পরিচালক নাজমূল আবেদীনকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটিও গঠন করা হয়েছে। গঠনতন্ত্র বদলের প্রসঙ্গে নতুন ক্রিকেট বোর্ডের কাছে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন থাকবে একটাই— ক্লাব ক্রিকেটের সঙ্গে ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাচনের যে নোংরা সম্পর্ক, তা বদলাবে তো?
গত আগস্টের পালাবদলের পর আওয়ামী লীগপন্থী ক্রিকেট সংগঠকদের অনেকেই গা ঢাকা দিয়েছেন। তাদের শূন্যস্থান দখল করেছে এতদিন মাঠের বাইরে থাকা বিএনপির সংগঠকেরা। তৃতীয়, দ্বিতীয় ও প্রথম বিভাগের ক্লাবগুলো হাত বদল হচ্ছে, দখলও হচ্ছে। ৫-৬ লাখ টাকায় তৃতীয় বিভাগের দলও বিক্রির খবর শোনা গেছে। পাপনের আমলে দুই-তিনটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের দখলে ১০-১২টি করে ক্লাব ছিল। সে শূন্যস্থান পূরণ করতে হাজির নতুন আরও কিছু প্রতিষ্ঠান। ক্লাবকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ক্রিকেট বোর্ডে জায়গা করে নেওয়ার স্বপ্নও তারা দেখেন। এর মধ্যে এতদিন বঞ্চনার শিকার অনেকেই ক্রিকেট বোর্ডের বিভিন্ন কমিটিতে ঢুকে পড়েছেন। যেমন এক সময়ের নিষিদ্ধ সাব্বির আহমেদ রুবেল এর মধ্যেই ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের কো-অর্ডিনেটরের দায়িত্ব নিয়েছেন। ক্লাবগুলো দখলের মাধ্যমে রাঘব বোয়ালদেরও ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তনের পথ পরিষ্কার হবে।
কিন্তু শুধু ঢাকার একটি ৫০ ওভারের ক্লাবভিত্তিক টুর্নামেন্ট থেকে বোর্ডকর্তা নির্বাচিত হওয়ার অদ্ভুত রীতি ভাঙা না গেলে ভবিষ্যতে আরও একজন পাপনের হাতে পড়বে বাংলাদেশের ক্রিকেট। সংস্কারের বহমান হাওয়ায় ক্লাবনির্ভর ক্রিকেট বোর্ডের প্রথায় আনতে হবে বড় পরিবর্তন। একটি শহরের ৫০ ওভারের টুর্নামেন্টের ওপর দেশের ক্রিকেটের নেতৃত্ব নির্বাচনের চাপ সরানোর পথ খুঁজে বের করতে হবে। ক্রিকেটকে ছড়িয়ে দিতে হবে সারা দেশে, করতে হবে বিকেন্দ্রীকরণ। ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটের ভোটার কমিয়ে বাড়াতে হবে জাতীয় ক্রিকেট লিগের প্রতিটি বিভাগীয় দলের ভোট।
আপনি ক্রিকেট সংগঠক হিসেবে ক্রিকেট বোর্ডে আসতে চান? তাহলে ক্লাবকে শক্তিশালী করুন। ক্লাবকে আবারও কমিউনিটির প্রতীক হিসেবে গড়ে তুলুন। সেখানে বাচ্চারা খেলতে আসবে, তাদের বাবা-মায়েরা খেলতে পাঠাবে। এলাকার লোকজনই ক্লাবের দায়িত্ব নেবে।
বিভাগের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটকে শক্তিশালী করুন, প্রতিটি বিভাগে অবকাঠামো তৈরি করুন, টুর্নামেন্ট আয়োজন করে বিভাগের খেলোয়াড়দের আয়ের ব্যবস্থা করুন। বিভাগের সেই ক্রিকেট উন্নয়ন ছড়িয়ে পড়বে প্রতিটি জেলায়। তাতে সামগ্রিকভাবে সমৃদ্ধ হবে দেশের ক্রিকেট। ক্রিকেট কাঠামোটা হতে হবে এমন– যেখানে প্রতিযোগিতা হবে মুখ্য, দক্ষতা হবে মূল্যায়নের একমাত্র মাপকাঠি।
তবেই হয়তো ক্রিকেট মাঠে দর্শক ফিরে আসবে। সুজন মাহমুদদের মতো ক্রিকেটারদের ক্রিকেটের প্রতি অবিশ্বাস্য বিবমিষার বদলে তৈরি হবে ভালোবাসা।
বাংলা ভাষায় স্পোর্টস ফিকশন লেখকদের সেরা মতি নন্দীর অন্যতম সেরা উপন্যাস ‘স্ট্রাইকার’। সেখানে দেখা যায়, ফুটবল মাঠে অবিচারের শিকার এক তরুণ কারখানার শ্রমিক হিসেবে নিদারুণ দারিদ্রের জীবন কাটান। কিশোর ছেলের ফুটবলার হতে চাওয়াকে ঘৃণা করেন। কিন্তু, সকল অবিচারের সঙ্গে লড়াই করে সেই কিশোর ময়দানের চ্যাম্পিয়ন হয়ে উঠে।
প্রবল রোমান্টিকতায় স্বপ্ন দেখি, একদিন সুজনের ছেলে বড় ক্রিকেটার হবে। ঢাকার মাঠভর্তি দর্শকের সামনে শেষ বলে ছক্কা মেরে দলকে জিতিয়ে হুংকার দেবে। আমরা সবাই তখন প্রবল আবেগে চোখ মুছবো।
নতুন বাংলাদেশে স্বপ্ন তো দেখাই যায়, দেখতে পারাই উচিত।●
নিবন্ধটির প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন এখানে।