উৎসব-অভিযোগে সমাপ্ত চাকসু নির্বাচন
তিন দশকেরও বেশি সময় পর অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকসু নির্বাচনে যেমন ছিল উৎসবের আমেজ, আবার ছিল একাধিক অনিয়মের অভিযোগও।
প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরত্বের চট্টগ্রাম শহর থেকে দুইটি শাটল ট্রেনে আসা শিক্ষার্থীরা যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জড়ো হচ্ছিলেন, তাদের চোখে-মুখে উচ্ছ্বাসের ঝলক ছিল লক্ষণীয়। দীর্ঘ ৩৫ বছর পর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনে ভোট দিতে আসা ভোটারদের কারণে সাধারণ দিনের তুলনায় শাটল ট্রেন স্টেশনে যেন তিল ধারণের জায়গা ছিল না।
এবারের নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ২৭ হাজার ৫১৬ জন, যার মধ্যে ছাত্রী ১১ হাজার ১৫৬, যা মোট ভোটের প্রায় ৪০ শতাংশ। এই নির্বাচনে নারী প্রার্থীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম — মোট প্রার্থীর মাত্র ১১ শতাংশ।
সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে শুরু হয় ভোটগ্রহণ। তবে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ভবনের শামসুন্নাহার হলের কেন্দ্রের সামনে সকাল ৯টা ১৫ মিনিট থেকেই ছাত্রীদের সারিবদ্ধভাবে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। ছবি-সংযুক্ত ভোটার তালিকা থেকে ভোটারদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয়পত্রের ছবির সাথে মিলিয়ে পরিচয় যাচাই করে ব্যালট পেপার দেওয়া হয় এবং স্বাক্ষর নেওয়া হয়। প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং এজেন্টদের উপস্থিতি শুরু থেকে লক্ষ্যণীয় ছিল। প্রিজাইডিং অফিসাররা ভোটারদের পরিচয় নিশ্চিত করে নাম ও ভোটারের সিরিয়াল নাম্বার পোলিং এজেন্টদের জানান। পোলিং এজেন্টরা নিজেদের তালিকার সঙ্গে মিলিয়ে যাচাই করেন। সকল কেন্দ্র ঘুরে একই চিত্র দেখা যায়।
তবে নির্বাচনের শুরু থেকেই অমোচনীয় কালি ব্যবহারে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে।
সকাল সাড়ে দশটার দিকে শিবির ও ছাত্রদল সমর্থিত ভিপি প্রার্থীরা অভিযোগ করেন, ভোটগ্রহণ ধীরগতিতে হচ্ছে এবং অমোচনীয় কালি ব্যবহার করা হয়নি। যাচাই করে দেখা যায়, পার্মানেন্ট মার্কার দিয়েই আঙুলে দাগ দেওয়া হচ্ছে। তবে অধিকাংশ কেন্দ্রে দেখা যায়, একটু ঘষলেই মুছে যাচ্ছে সে কালি। এতে প্রার্থী ও ভোটারদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। সর্বশেষ অনুষ্ঠিত হওয়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনেও অমোচনীয় কালির ব্যবহার না করায় নির্বাচনে বিতর্কের সৃষ্টি হয়।
কাছাকাছি সময়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইটি ভবনে সোহরাওয়ার্দী হলের কেন্দ্রে হঠাৎ হট্টগোল শুরু হয়। প্রার্থীরা অভিযোগ করেন, ২১৪ নং কক্ষে প্রথম কিছু ভোট ভোটারের স্বাক্ষর ছাড়াই ব্যালট বাক্সে ফেলা হয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক জানান, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারা ভুল করে প্রথম ১২ জন ভোটারকে স্বাক্ষর ছাড়া ব্যালট সরবরাহ করেছিলেন, পরে লক্ষ্য করার পর বিষয়টি সংশোধন করা হয়। তিনি ঘটনাটিকে “হিউম্যান এরর” বা মানুষের স্বাভাবিক ত্রুটি বলে দাবি করেন।
নির্বাচনের দিন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য চাকসু ভবনে আলাদা ভোটকেন্দ্রের ব্যবস্থা করা হলেও তারা তাদের মনোনীত সহপাঠীর সহায়তায় ভোট দিয়েছেন, যা তাদের মতে গোপন ভোটাধিকারের লঙ্ঘন। শিক্ষার্থীরা জানান তাদের দাবি সত্ত্বেও ব্রেইল পদ্ধতিতে ভোট দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়নি।
বেলা গড়িয়ে দুপুর একটার দিকে ব্যবসায় অনুষদের প্রীতিলতা হলের কেন্দ্রের সামনে গেলে দেখা যায় ভোটারদের দীর্ঘ সারি। ভোটারদের সাথে কথা বলে জানা যায় অনেককে প্রায় ৪০ মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে ভোট দেয়ার জন্য। এদিকে দেড়টার দিকে প্রীতিলতা হলের জন্য নির্ধারিত ৩৩৫ নম্বর কক্ষে এক শিক্ষার্থী অন্য প্রার্থীর পরিচয়পত্র ব্যবহার করে ভোট দিতে গিয়ে ধরা পড়েন। এ নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। অভিযুক্ত শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করেছেন বলে জানান দায়িত্বরত সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার।
আরও অভিযোগ ওঠে প্রীতিলতা হলে ভোটারদের স্বাক্ষর না নিয়েই ব্যালট সরবরাহ করা হয়েছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে প্রিজাইডিং অফিসাররা জানান, কেন্দ্র থেকে স্বাক্ষর নেওয়ার বিষয়ে নির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। তারা পোলিং এজেন্টদের সঙ্গে সমন্বয় করে কয়েক স্তরে পরিচয় যাচাই করে ভোটগ্রহণ করেছেন।
ভোট প্রদান করছেন শিক্ষার্থীরা। ছবি: জীবন আহমেদ/নেত্র নিউজ
বিকেল সাড়ে তিনটার পর সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ও ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের নারী ভোটকেন্দ্রে আর কোনো সারি দেখা যায়নি। কিন্তু ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের শহীদ ফরহাদ হোসেন হলের কেন্দ্রে তখনও ভোটারদের সারি ছিল। বিকেল চারটায় ভোটগ্রহণের সময় শেষ হলেও আইটি ভবন কেন্দ্রে সারিতে থাকা শিক্ষার্থীদের ভোট গ্রহণ চলমান রাখা হয়।
বিকেল ৩টা ৪০ মিনিটে ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের নিচতলায় ছাত্রদল সমর্থিত ভিপি প্রার্থীসহ দলের কয়েকজন নেতাকর্মী প্রীতিলতা হলে স্বাক্ষর না নেওয়া, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ কেন্দ্রে শিবির সমর্থিত প্যানেলের পক্ষে লিফলেট বিতরণসহ বিভিন্ন অভিযোগ তুলে প্রশাসনের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়ান। এসময় তারা দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষককে ঘিরে ধরে স্লোগান দিতে থাকেন।
ভোট দিতে আসা শিক্ষার্থীরা জানান, চাকসু নেতৃত্ব ক্যাম্পাসে পর্যাপ্ত আবাসন ব্যবস্থা, শাটল ট্রেনের সময়সূচি ঠিক রাখা, স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘাত নিরসন করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, গবেষণাগারের সুবিধা বৃদ্ধি, খাবারের মানোন্নয়ন ও দাম নিয়ন্ত্রণ করা, এবং সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করবেন বলে তারা আশা করছেন।
বিকাল পৌনে পাঁচটার দিকে পোলিং এজেন্টদের উপস্থিতে ভোট গণনা শুরু হয়।
৩৫ বছর পর অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে ছিল উৎসবের আমেজ, কিছুটা অভিযোগের ছায়া আর তরুণ প্রজন্মের এক নতুন প্রত্যাশা — একটি গণতান্ত্রিক, নিরাপদ ও অংশগ্রহণমূলক বিশ্ববিদ্যালয়।●